ফিলিস্তিনি কবি মোসাব আবু তোহার কবিতা

অ+ অ-

 

নিপীড়ন ও দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে কবি

|| ভূমিকা ও অনুবাদ: মনজুরুল হক ||

গাজা সংকটের সূচনার দিনগুলোতে ফিলিস্তিনি কবি মোসাব আবু তোহা স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও দুঃস্বপ্ন তাকে অনুসরণ করা থেকে সরে যায়নি। ফলে নিপীড়ন ও দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে কবিদের পক্ষে যা করা সম্ভব, গাজা থেকে দূরে অবস্থান সেই দায়িত্ব পালন, অর্থাৎ, মাতৃভূমির দুর্দশার প্রতিফলন ঘটানো কাব্য রচনা তিনি অব্যাহত রেখেছেন। তার সেই সমকালীন কাব্য পাঠ করা হচ্ছে যেন সেরকম এক অভিজ্ঞতা—মানুষের মনকে যা বেদনায় আচ্ছন্ন করে তুললেও একই সাথে আশার বাণীও তা শোনায়। এখানে সংযুক্ত তার কবিতা ‘একটি মুহূর্তের জন্য’ কল্পনাতীত দুর্দশা আর নিকটজনকে হারানোর বেদনার হাহাকার পাঠককে শোনালেও বর্ণনার অযোগ্য বর্বরতার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ জানাতে সেটা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করবে। গাজার দুর্দশার কাব্যিক বর্ণনা তুলে ধরা মোসাব আবু তাহা’র সাম্প্রতিক কবিতার সংকলন “কোলাহলের অরণ্য” ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হবে আগামী অক্টোবর মাসে। বইটি বাজার আনছে নামী প্রকাশনা সংস্থা আলফ্রেড ক্‌নফ।
দুঃস্বপ্ন থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে তিনি ছিলেন গাজার এডওয়ার্ড সাঈদ পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৯-২০২০ সালে তিনি ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিটিং পোয়েট এন্ড স্কলার। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতার অনুবাদ। নিচের কবিতাগুলোর মধ্যে প্রথম দুইটি গাজার সাম্প্রতিক মর্মান্তিকতার আলোকে রচিত। অন্যটি সাম্প্রতিক হামলা শুরু হওয়ার আগের রচনা হলেও গাজা ভূখণ্ডকে যে দীর্ঘকাল ধরে বঞ্চনা আর দুর্দশার শিকার হতে হয়েছে, তার বাস্তব প্রতিফলন সেই কবিতায় সহজেই ফুটে উঠেছে। 

ছবি © মোসাব আবু তোহার ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

 


একটি মুহূর্তের জন্য

হাসপাতালের পথে ছুটে যাওয়া অবস্থায় 
বালিকার ক্ষুদ্র দেহ ঝুলে থাকে আমার বাহুতে।
বিদ্যুৎ নেই
আর ভেতরের বারান্দা যেন
সারিবদ্ধভাবে পেতে রাখা শিশুদের পালঙ্কের এক অরণ্য।
যে বালিকাকে আমি বহন করছি
সে যে মৃত
আমার তা জানা আছে।
বিস্ফোরণের চাপ গুড়িয়ে দিয়েছে
ওর দেহের দুর্বল শিরা।
আমি জানি সে মৃত,
তবে সবাই যারা দেখছে আমাদের
ছুটছে তারা আমাদের পেছনে।
জীবন্ত মানুষ যখন পেছনে দৌড়ে,
একটি মুহূর্তের জন্য হলেও
আপনি তখন হয়ে উঠেন জীবিত।

 

পুত্র আমার চাদর ছুড়ে দেয় কন্যার দেহের উপর

রাতে, বাড়িতে আমাদের, আমরা বসে থাকি মেঝের উপর,
একে অন্যের কাছাকাছি এবং
জানালা আর বোমার লাল আলো থেকে
অনেক দূরে। বাড়ি যখন কেঁপে উঠে
আমাদের পিঠ আঘাত করে দেয়ালে।
একে অন্যের মুখের দিকে তাকাই আমরা,
ভীত, তবে তা সত্ত্বেও আমরা যে ভাগ্যবান তা ভেবে সুখী,
জীবন আমাদের এবারের মতন রক্ষা পেয়েছে।
অনিদ্রার ঘুম থেকে জেগে উঠে দেয়ালগুলো।
পতঙ্গ করে ভিড় ছাদে ঝুলতে থাকা আলোকিত একমাত্র বাতির চারদিকে
শীতল রাতে উষ্ণতার প্রত্যাশায়,
শীত, ক্ষেপণাস্ত্র যখন আঘাত হেনে
বাড়ি আর সড়ক আর গাছগুলো করে দেয় উত্তপ্ত
পুড়িয়ে দিয়ে কাছের প্রতিবেশী মহল্লাকে 
কেবল সেই সময় ছাড়া। 
প্রতিবার যখন শুনি আমরা
একটি এফ-১৬ কিংবা এফ-৩২ থেকে পড়ছে বোমা
আমাদের জীবন হয়ে ওঠে আতঙ্কগ্রস্ত। জীবন আমাদের জমে যায়
মাঝামাঝি কোথাও, এরপর কোথায় পালাতে হবে
তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগি আমরা:
গোরস্তানে, হাসপাতালে,
নাকি একটি দুঃস্বপ্নে।
আমাদের জীবন এর কম্পিত হাত রাখে 
হাতঘড়ির উপর, 
আঙুল প্রস্তুত থাকে ব্যাটারি সরিয়ে নিতে 
যদি এবং যখন হয় প্রয়োজন। 
আমার চার বছরের কন্যা ইয়াফফা, ওর গোলাপি পোশাকে শুনে 
একটি বোমার বিস্ফোরণ। গভীর নিঃশ্বাস নেয় সে। 
নিজের পোশাকের মসৃণতা দিয়ে ঢেকে রাখে মুখ। 
ইয়াজ্জান, ওর সাড়ে পাঁচ বছরের বড় ভাই,
আঁকড়ে ধরে ঘুমন্ত দেহের উত্তাপে উষ্ণ হয়ে ওঠা কম্বল।
কম্বল সে বিছিয়ে দেয় বোনের দেহে।
এখন তুমি লুকাতে পার, নিশ্চিত করে সে তাকে। 
আমার নিজের আর স্ত্রী মারামের বেলায়, আমরা প্রার্থনা করি
যেন জাদুর এক কম্বল ঢেকে দেয় সবগুলো বাড়ি
বোমার আঘাত থেকে আর নিয়ে যায় আমাদের নিরাপদ কোনো জায়গায়। 

 

পেছনে ফেলে আসা শৈশব 

আমি যখন চলে আসি, রেখে যাই আমার শৈশব দেরাজে,
আর রান্নাঘরের টেবিলে। নিজের ঘোড়াটিকে আমি রেখে যাই
এর প্লাস্টিকের ব্যাগে।
ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে চলে যাই আমি। 
সেটা ছিল দুপুর নাকি সন্ধ্যা, মনে নেই আমার।

আমাদের ঘোড়া একাকি রাত কাটায়,
রাতের খাবারের জন্য নেই পানি, নেই কোনো শস্যদানা।
সে হয়তো ভেবে থাকবে আমরা গিয়েছি কোথাও রান্না করতে
অবেলায় আসা কোনো অতিথির জন্য অথবা আমার বোনের দশম জন্মদিনে
বানাতে কেক। 

বোনের হাত ধরে আমি হেঁটে যাই, সেই পথ ধরে যার কোনো শেষ নেই। 
আমরা গাই জন্মদিনের গান। 
যুদ্ধবিমান করে প্রতিধ্বনি স্বর্গ জুড়ে। 
ক্লান্ত বাবা-মা হেঁটে চলে পেছনে,
পিতা আমার বুকে ধরে রাখে 
আমাদের বাড়ি আর আস্তাবলের চাবি। 

উদ্ধার স্টেশনে এসে পৌঁছুই আমরা। 
বিমান হামলার সংবাদ হুঙ্কার তুলে রেডিওতে। 
মৃত্যুকে আমি ঘৃণা করেছি, তবে ঘৃণা করেছি জীবনকেও,
আমাদের যখন হেঁটে যেতে হয়েছে এগিয়ে আসা মৃত্যুর দিকে,
আবৃত্তি করে আমাদের সমাপ্তিহীন মহাকাব্য।

কৃতজ্ঞতা: আলফ্রেড ক্‌নফ