পিটার সেমোলিচের পাঁচটি কবিতা 

অ+ অ-

 

|| পিটার সেমোলিচ ||

স্লোভেনিয়ান কবি, লেখক ও সম্পাদক। ১৯৬৭ সালে স্লোভেনিয়ার লুব্জিয়ানায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পড়াশোনা করেছেন লুব্জিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভাষাবিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব বিষয়ে। তিনি ষোলটি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা। সৃষ্টিশীল কাজের জন্য তিনি অনেক পুরষ্কার পেয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে স্লোভেনিয়ার দুটি বিশিষ্ট পুরস্কার, জেনকো’স পোয়েট্রি প্রাইজ এবং প্রিসেরেন ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড (সাহিত্য ও শিল্পের জন্য জাতীয় পুরস্কার)। ১৯৯৮ সালে তিনি ‘১০ বছরের অসামান্য কাব্যিক কাজের’ জন্য ভিলেনিকা ক্রিস্টাল পুরস্কার এবং ২০১৬ সালে ভেলেনজিকা পুরস্কার পান। পিটার সেমোলিচ নাটক ও শিশু সাহিত্যও রচনা করেন। তিনি ইংরেজি, ফরাসি, সার্বিয়ান এবং ক্রোয়েশিয়ান থেকে অনুবাদও করে থাকেন। বর্তমানে তিনি স্লোভেনীয় অনলাইন কবিতা ম্যাগাজিন Poiesis (http://www.poiesis.si/)-এর প্রধান সম্পাদক। প্রতিধ্বনির জন্য পিটার সেমোলিচের কবিতাগুলো অনুবাদ করেছেন কবি ও লেখক মোশতাক আহমদ। 

স্লোভেনিয়ান কবি, লেখক  সম্পাদক পিটার সেমোলিচ

 

|| বাবা ||

কাল শেষ রাতে
তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি, বাবা।  

হরিণের বেশে 
অপার্থিব সবুজ ঘাসের ঢিবিতে
দাঁড়িয়েছিলে তুমি। 

আমি তোমাকে ‘বাবা’ বলে ডাকলাম—
বাবা বলে ডেকে আমি বললাম,

দেখ
পাহাড়ী ঝরনাধারায় ভেসে যাওয়া 
ওই দুটো ভেজা ফুলই 
আমার দুই চোখ। 
এসো
আমার চোখের 
জমানো শিশিরগুলো 
উষ্ণ তোমার হরিণের জিব দিয়ে
মুছে দাও, বাষ্প করে দাও।  

তুমি যেন দাঁড়িয়েছিলে
অন্য এক পৃথিবীতে
ভিন্ন একটা স্বপ্নের ভেতরে, 
ঝাঁকড়া হয়ে ওঠা
ঘাসের ঢিবিটার পাশে। 

তারপর 
তুমি তোমার শক্ত শিং ঝাঁকিয়ে
আমাদের সকল স্বপ্নের বাইরে  
ওই শাদা মেঘের ভেতরে 
হারিয়ে গেলে। 

 

|| গৃহহীন কবির প্রেমপত্র ||

আমি আমাদের ঘর বানাবো শব্দ দিয়ে। 
সেখানে থাকবে বিশেষ্যের ইট 
আর ক্রিয়াপদের কপাট।  

বিশেষণ দিয়ে আমরা মুড়ে দেবো   
জানালার কার্নিশ, 
ফুলের আসর বসাবো সেখানে। 

আমাদের ভালোবাসার এই ছাউনির নিচে
শুদ্ধতম নীরবতায় আমরা অবিরল 
মিথ্যা বলে চলবো 
নিচ্ছিদ্র নীরবতায়। 

আমাদের বাড়িটি এত সুন্দর হবে আর 
এত মিহি কারুকাজ থাকবে যে  
বিপন্ন হবার মতো 
একটা বাড়তি শব্দও থাকবে না। 

আর আমরা যখন কথা বলব,  
আমরা কেবল
চোখের সীমানার জিনিসপত্রের নামই বলবো।  

কারণ যে কোনো ক্রিয়াপদই  
এ বাড়ির ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে,
ভেঙ্গে ফেলতে পারে। 

অতএব, চুপচাপ থাকো, ও আমার প্রেম 
চুপ করে থাকো, এ বাড়ির ছাদে
আসন্ন সকালের জন্য। 

 

|| লিখেই ফেললাম শেষে ||

আপনি যখন বাসের অপেক্ষা করেন, তখন অন্যরা বরাবর 
আগে আগে আসে আপনার, এমন প্রায়ই ঘটে।
সর্বদা শেষ ব্যক্তি আপনি। 
এটাও সত্য যে সবসময় আপনি পরে আসেন না। 
কিন্তু আপনার সন্দেহ ম্লান হয়ে যায় না। 
এবং এটি জানার আগেই
আপনি চন্দ্র সূর্য আর গ্রহবিদ্যা অধ্যয়ন করছেন, 
আপনি বাজি ধরছেন; 
ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোতে
নিজের হাতের রেখার অজস্র চুলের মতো 
সূক্ষ্ম শাখা উপশাখা 
পাঠ করতে চেষ্টা করছেন। 

আমার বিপন্ন লাগে; কিন্তু এটা ঠিক নয় যে
অনেক বছর আমি কবিতা লিখিনি, কিংবা কবিতা যাপন করিনি।
আমি আমার মাথার ভেতরে লিখে গেছি বরাবর, 
তার কিছু গদ্যে, কিছু ছন্দে, 
কিছুবা পয়ারে, ছোট থেকে ছোট, 
আরো পরিমিত, আবছায়া ভরা, কখনও গহীন, কখনও 
কালো জাদুমন্ত্রের কাছাকাছি ভাষায়, বেশিরভাগই তার
ভুলে গেছি কবে—সাথে সাথেই বা দিন কয় পরে, 
তবে কিছু কবিতা পেরেকের মতো 
বসে আছে আমার করোটিতে, 
আমার ভাবনাগুলোকে জোরসে ধরেছে চেপে, পাঠাচ্ছে প্রত্যাদেশ।
বিশেষ কিছু না—
কিভাবে আমি রোজকার মতো 
আমার জুতো পালিশ করবো, হাঁচি দেবো কিংবা চুল আঁচড়াবো,  
করমর্দন করার দস্তুর, কীভাবে পোজ দিয়ে দাঁড়াবো দুই পায়ে।  
বিশেষ কিছুই না। কিন্তু প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে, 
আমি একজন অচেনা মানুষকে দেখলাম আবার, মনে হয় 
একজন আদিম মানুষ, কিংবা আনাড়ি কোনো ওঝা— 
যে কিনা ভুল করে  নিজেই নিজের মন্ত্রপুত। 

একদিন জোগাড় করে ফেলি আমার শেষতম শক্তিশেল
আমার জুতার ডগা দিয়ে
কাগজের মতো শাদা বরফের মধ্যে আমার নামটা লিখি। 
কুসংস্কারের রাক্ষসগুলোকে তাড়িয়ে দাও এবারে। 

 

|| ঘোষণা ||
 
সমুদ্র থেকেই সূর্য ওঠে। যেখান থেকেই দেখ না কেন, 
সূর্য সমুদ্র থেকে উদিত হয়। অতএব
আমি ঘোষণা করছি সমুদ্রই সূর্যের মাতৃভূমি। 

এই ঘোষণায়, পৃথিবী সম্পর্কে এমনকি 
মহাবিশ্বের পুরো কাঠামো নিয়েই 
আমাদের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেলো, তাই না!    
মহাকাশচারীরা আর মহাকাশচারী নন,
তারা এখন সমুদ্রের গভীর ডুবুরি। 

তারার দেশে ডুব দিচ্ছে ডুবুরির দল। সমুদ্রেও তারামণ্ডল,  
আকাশেও তারামণ্ডল—কেবলমাত্র তারায় গিজগিজ। 
রক্তমাংসের ভালোবাসা আর কেতাবের ভালবাসার মধ্যে 

আর কোন ব্যবধান নেই; পৃথিবীর সকল প্রেমিক আজ খুশি। 
আমরা অগভীর জলাশয়ে হেঁটে যেতে যেতে
পায়ে জড়ানো পাথর ভাঙতে ভাঙতে
ব্ল্যাকহোলের ঝিনুকগুলো কুড়িয়ে নিতে এসেছি। 

 

|| লিপিকা||

হোটেলটি কয়েক বছর বন্ধ আছে। 
লবির পিলারগুলোর ভেতর দিয়ে হেঁটে যাবেন,

ঘাসের দরোজাগুলো স্বয়ংক্রিয় মুছে নেবে জুতোর ধুলোবালি। 
ভরদুপুরেও রাত তিনটার মতো খাঁ খাঁ অন্ধকার ছেয়ে আছে, 
এমনকি নির্জন ডেস্কে 

ঘুমিয়ে আছে রিসেপশনিস্ট।
মেঝেতে 
কংক্রিটের স্ল্যাবে—পায়ের ছাপগুলোর নিচে 
আগাছা আর দুঃখের অঙ্কুর গজিয়েছে। কখনো ভাবিনি 
এমন একটা ভবন জুড়ে বিষাদের 

এই বিস্তার।এখনও তেমন বুড়ো তো হইনি— 
নিকোটিন আর একাকীত্বের 
অদ্ভুত রকমের কিছু স্মৃতিময় গন্ধ—ক্রমশ 
আমার শরীরের খালি জায়গাগুলো ভরে দিচ্ছে—দেহের চামড়ায়
স্ফীত হচ্ছে এ কোন ভিন্ন জীবন! 
অতএব, এখন আর নারীকে কল্পনা করার 
বাড়তি কোশেশ নাই চোখের পাতার।  

কিছু পুরুষরা, আর হয়তোবা কিছু শিশু—লিফট থেকে বের হলো,
তাদের হাতে অস্থায়ী নিবাসের চিহ্ন হয়ে ঝুলছে
কতিপয় চাবির ছড়া। 
এদিকে, আমার পিছনে এক টুকরো মেঘ 
ঝাপসা করে দিচ্ছে স্বয়ং সূর্যকে।
অকস্মাৎ আমি আমার নিজের চোখের দিকে তাকালাম। 

*ইতালীয় সীমান্তের কাছে একটি বিশেষ ভূমিরূপের স্লোভেনিয়ান বসতি, যা এক বিশেষ ধরনের ঘোড়ার জন্য পরিচিত। 

Copyright © Peter Semolič 
Bangla copyright © pratidhwanibd.com