চর্ব্য চোষ্য [তৃতীয় পর্ব]
[তৃতীয় পর্ব]
নাশিতা গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে থামল। মতিঝিল ছয় নম্বর সড়কে ভাওয়াল টাওয়ারের সামনে। একটা তেল চকচকে কালো জিপ দাঁড়িয়ে আছে। তার পেছনে আরেকটা জিপ আর দুইটা মাইক্রোবাস। মাঝের জিপে ভাওয়াল চেয়ারম্যান। আতিকুল হাসান তালুকদার। পায়ের ওপর পা তুলে খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছেন।
চালক মি-মি করে বলল, ‘সার, অফিস!’
চেয়ারম্যান খবরের কাগজ রাখলেন। পায়ের ওপর থেকে পা নামালে গাড়ির দরজা খুলে গেল। দুই দল দারোয়ান পথ ফাঁকা করছে। চেয়ারম্যান সোজা গিয়ে লিফটে উঠবেন।
একুশতালা ভবনের বিশতালায় তার ক্যাবিন।
নাশিতা এখনও গাড়িতে বসে আছে। টাওয়ারের সামনে সে কখনও চেয়ারম্যানর মুখোমুখি হতে চায় না।
চেয়ারম্যান লিফটের সামনে যেতেই কাছে এগিয়ে সালাম দিলেন মোহাম্মদ হারুন। টাওয়ার রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী। তারপর আসেন টাওয়ারের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা রাজিবুল ইসলাম। চেয়ারম্যান লিফটে ওঠার সাথে সাথে আসলেন আরো চারজন। বসের মতই সবাই স্যুট-বুট পরা। চেয়ারম্যানের পর তারাও লিফটে উঠলেন।
সবাই গম্ভীর মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন জুতোগুলো দেখছেন। কার জুতো কেমন। আসলে তারা যার যার জগৎ নিয়ে চিন্তা করছেন। সবার জগৎই অনেক বড়। কেউ পান থেকে চুন খসতে দিতে চান না। তবু খসে বটে।
লিফট ওপরে উঠে থামলে নিরিবলি করিডর। দুই পাশে নীলাভ সাদা দেয়াল। মাথার ওপর দেয়ালের রঙ মিলিয়ে সিলিং। পায়ের নিচে কৃত্রিম টাইলসের মেঝেটা যেন রজনীগন্ধার বাগান। সবুজ পাতার ভিড়ে দুই পাশে দুই সারি হলুদাভ ফুল।
করিডরের দুই পাশে বড় বড় রুম। এসব রুমে পরিবারের বিভিন্ন বিভাগের প্রধানরা বসেন। তাছাড়া আছে কিচেন-ডায়নিং। আটতালায় আছে অন্য ফ্লোরের স্টাফদের জন্য আলাদা কিচেন-ডায়নিং। ছবি আঁকা কফি ছাড়া অন্যান্য খাবার সবার জন্য একই বটে।
চেয়ারম্যান রুমের কাছে যেতেই দরজা খুলে দিল স্মার্ট পিয়ন। তার পদবি অফিস সহকারী। সামনে সবাই সেটাই বলে। পেছনে পিয়ন।
ঠিক তিন মিনিট পরে ভেতরে ঢুকল নাশিতা। দাপ্তরিক কাজে থাকলে ঘোড়ার লেজের মত চুল বাঁধে। পরনে ফুলহাতা ফ্লেয়ার ফিট কামিজ বা ফ্রক স্যুট। গলার একটু পরে উঁচু-নিচু ফিট হয়ে ক্রমপ্রসারিত। হাঁটুসমান। ওড়নার মাঝখানটা গলায় বাঁধিয়ে দুই মাথা বুকের ওপর দিয়ে ঝুলিয়ে রাখে। কখনও যাতে একটুও এদিক-ওদিক হতে না পারে সেজন্য সেপটিপিন লাগায় নিয়মিত। লোকজনের সামনে ওড়নায় হাত দেওয়া দেখলে তার রাগ লাগে।
চেয়ারম্যানের সাথে প্রায় দৈনিক সকালে একটু কাজ থাকে নাশিতার। বিভিন্ন বিষয়ে চেয়ারম্যানকে জানাতে হয়। চেয়ারম্যান মাঝে মাঝে দশ-বিশ শব্দের পরামর্শ দেন। এ সময় মিনিট বিশেক একটু টেনশন হয় নাশিতার। বসের মন বলে কথা।
সেখান থেকে বের হতেই সে ফুরফুর করে ওঠে। নিজের রুমে গিয়ে, জুনিয়রদের ডেস্কে গিয়ে খবরদারি করার মজা নেয়। এজন্য অবশ্য এর আগে সে বছর দশেক দিনরাত পথ হেঁটেছে। এখন কয়েকজন টপ বস ছাড়া সবাই তার কাছে ধর্ণা দেয়। ভয়ে থাকে। পারফরমেন্স বিভাগের প্রধান বলে কথা।
নাশিতা বের হলে সিইও ঢুকলেন চেয়ারম্যানের রুমে।
চেয়ারম্যান বললেন, ‘নাশিতা মনে হয় ইদানীং খুব ফাঁকি দিচ্ছে।’
‘তাকে একটা অতিরিক্ত কাজ দেব ভাবছি।’
নাশিতা অল্প সময়ে অনেক কাজ করতে পারে। সবাই জানে।
চেয়ারম্যান বললেন, ‘পোশাক কারখানাগুলো ঢেলে সাজানোর জন্য যে চিন্তাভাবনা আমরা করছি—শ্রমিক অসন্তোষ স্থায়ীভাবে দূর করা—কারখানায় কাজের পরিবেশ উন্নয়ন—এখানে পারবে না?’
‘তা পারবে আশা করা যায়।’
নাশিতা তার রুমের কাছে যেতেই পিয়ন দরজা খুলে দিল। নীলাভ সাদা রুমটা জামরঙ আসবাবপত্রে সাজানো। রুমের মাঝখানে এল আকার টেবিল। টেবিলের ডান পাশে এস আকারের একটামাত্র পা। বাঁ পাশটা ভর করেছে ক্যাবিনেট শেলফের ছাদে একটা ছোট্ট চাকার ওপর। দেখলে মনে হয় ছোঁয়া দিলে পড়ে যাবে। টেবিলের ওপর আছে শুধু একটা দ্রুতগতির কালো ল্যাপটপ যাতে সব ফাইল মুহূর্তের মধ্যে খোলা যায়। কাগজপত্র থাকলে ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি লাগে। কাজ শেষ হলে সব কাগজ ক্যাবিনেট শেলফে রেখে দেয় নাশিতা।
টেবিলের পেছনে মিহি চামড়ায় মোড়া উঁচু পিঠঅলা চেয়ার। জামরঙের ওপর হলুদ আজি টানা। চেয়ারের নিচের অংশে রয়েছে নানা রকম যন্তরপাতি। স্প্রিং বিয়ারিং দণ্ড সিলিন্ডার চাকা ইত্যাদি। যাতে ডানে-বাঁয়ে আগে-পাছে যেদিকে ইচ্ছা হেলা-দোলা যায়। চেয়ারের পেছনে খানিটা ফাঁকা জায়গার পর জানালায় রুমের রঙে মিল করা ফক্স উডের ব্লাইন্ড পর্দা। জানালার মতই শব্দ প্রতিরোধক। প্লাইউডের সিলিংয়ের সাথে নিখুঁতভাবে সেট করা। রিমোট কনট্রোল দিয়ে ওঠানো-নামানো যায়।
আজ নাশিতা নিজের রুমে গিয়ে আরো মজা পায়। বিজনেস প্ল্যান বিভাগে সম্প্রতি জয়েন করা এক ছোকরা এসে বসে আছে। কালো কোটে তাকে নিরীহ পেঙ্গুইনের মত লাগছে। সে নাকি খুব আইডিয়াবাজ। সবচেয়ে কঠিন প্রতিযোগিতার পরীক্ষায় ওপরের দিকে থাকতে পারে। ঢাবি থেকে এমবিএ-টেমবিএ করে এসেছে। তার আগে নাকি আবার বুয়েট-টুয়েটও করেছে। ছোকরার সাথে একটু মজা করা যাক। নতুন জয়েন করা ছোকরাদের সাথে নাশিতা প্রায়ই মজা করে।
‘কী নাম যেন তোমার?’ নাশিতা চেয়ারে বসতে বসতে বলল। যদিও তার নাম তার ভাল করেই মনে আছে।
শিমুল হাসান ঘাবড়ে যায়। অফিসে কেউ তাকে তুমি বলতে পারে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। আর নাশিতা তার নাম ভুলে যেতে পারে তাও তার ধারণায় ছিল না। কালও তার সাথে ফোনে কথা হল। কিন্তু ঘাবড়ালে চলবে না। নিজের মর্যাদা নিজেকেই ঠিকঠাক তুলে ধরতে হবে। সে মৃদু হেসে বলল, ‘আপু আমার নামটা পনের ঘণ্টার মধ্যে ভুলে গেলেন! উইদিন ফিফটিন আওয়ার্স।’
নাশিতা এমন উত্তর আশা করেনি। অফিসের সবাই তার সাথে সবিনয়ে কথা বলে। জুনিয়ররা কাচুমাচু হয়ে থাকে। এক প্রশ্ন দশবার জিগালেও নীরবে উত্তর দেয়।
‘আমি ত জানি যে ভুলে যাবার সাথে মনে রাখার একটা সম্পর্ক আছে,’ নাশিতা ড্রয়ার থেকে ফাইল বের করে ব্যস্ত হচ্ছে।
মানে কী? সে কি বুঝিয়ে দিল শিমুলকে তার মনে রাখার দরকার নেই?
শিমুল চট করে সিদ্ধান্ত নেয়। নাশিতার সাথে বেশি বাতচিত না করা ভাল। আপাতত যদ্দূর সম্ভব চুপ থাকতে হবে। সে একটু কাচুমাচু হয়ে গেল।
নাশিতা মধুর হেসে বলল, ‘সরি, সার! আমি আপনার নামটা দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করে ভুল করেছি। আপনি মাইন্ড করবেন জানলে আর জিজ্ঞেস করতাম না।’
শিমুল নিচু স্বরে নাম বলল। শুধু নামটাই। দ্বিতীয় কোনো শব্দ না। সব জায়গায় বেশি কথা বলতে নেই।
নাশিতাও আর ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না। রিসিভার তুলে ১১১ নম্বরে কল করল। কফি দিতে বলার আগে জিজ্ঞেস করল শিমুল কী খাবে।
‘আপনি যা বলেন।’
নাশিতা শিমুলের ফাইলটা খুলল। ছোকরা এক মাস ধরে কী করেছে একটু দেখা যাক। তাকে রোগাপটকা টেক্সটাইল মিলটা নিয়ে কিছু একটা করতে বলা হয়েছিল। বছর দশেক আগে শুরু করা কম্পানিটা এখনও দাঁড়াতে পারেনি। মাঝে দুই বছর লাভ করলেও আবার তিন বছর ধরে ঝিমাচ্ছে।
শিমুল ৯৬ পৃষ্ঠার পরিকল্পনার সাথে আধা পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপ দিয়েছে। পুরো পরিকল্পনা সাজিয়েছে স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্ত করার বিষয়-আশয় নিয়ে। প্রাথমিক বিনিয়োগের জায়গাটা সে ফাঁকা রেখেছে।
‘বস তাহলে বুঝবেন কী করে?’ নাশিতা মুখ তুলল।
শিমুল কাচুমাচু হয়ে বলল, ‘ঘুস ছাড়া এইখানে কোনো কাজ হয় না। কিন্তু ঘুসের অংক ফাইলে লিখে রাখা যাচ্ছে না। তাই আপাতত মুখে বলতে চাই। তবে আপনাকে বলা যাবে।’
‘গোপন কথা আমাকে বলে ফেলবা?’ নাশিতা চোখ বড় করে নিঃশব্দে হাসল। এই হাসি মোহনীয়। তরুণ শিমুল কিঞ্চিৎ আলুথালু। তার বুকের ভেতর রিমরিম করে উঠল। নাশিতা সম্পর্কে কিছু ধারণা করতে পারছে না।
কফি আর শিঙ্গাড়া নিয়ে আসল পিয়ন। ধবধবে সাদা হাফহাতা জামা মাঞ্জা মারা। চকচকে কালো জুতোয় পিপীলিকার মত হাঁটে। রুমের দক্ষিণ কোণে কাচের টি-টেবিল। অ্যালুমিনিয়াম ট্রে রাখার সময় পিন পড়ার শব্দও যেন না হয়। সব দিকে তার সতর্ক নজর। প্রথমে শিঙ্গাড়ার বাটি নিয়ে নাশিতার টেবিলে সাদা ন্যাপকিনে রাখল। সাদা বাটিতে ঘ্রাণ ছড়ানো শিঙ্গাড়ায় গাইবান্ধার সুস্বাদু মরিচগুঁড়া ছিটানো। তারপর কফির মগ। সাদা মগের গায়ে হালকা গোলাপি চেরি ফুলের নকশা। তরল কফির ওপর গোলাপ-কুঁড়ির ছবি আঁকা। কফির ওপর ড্রইং করার জন্য চেয়ারম্যান চিন থেকে আর্টিস্ট নিয়ে এসেছেন। ল্যাট্টে আর্টিস্ট। তার বেতন মাসে ষাট হাজার টাকা। মেশিনে উচ্চচাপে ব্লেন্ড করা কফির ওপর, ফোমি লেয়ারে, ঘন গরম দুধ দিয়ে সহজে সাধারণ নকশা তোলা যায়। ল্যাট্টে আর্টিস্টের কাজ শৈল্পিক আঁকিবুঁকি। নিত্যনতুন ফুল-লতা-পাতা আর অন্যান্য দৃশ্য ফোটানোর জন্য তার রয়েছে ডজনখানেক ল্যাট্টে আর্ট পেন। আর ভোজ্য রঙ। সবই বিদেশি। এবং ইতালিয়ান লাভাজ্জার ‘এসপ্রেসসো’ ‘ক্রেমা ই গুস্তো’ ইত্যাদি ব্র্যান্ডের কফি। একেক সময় একেক রকম স্বাদে-গন্ধে শীর্ষ কর্মকর্তাদের মন-প্রাণ ফুরফুরে রাখতে চান চেয়ারম্যান।
উদ্দেশ্য পূরণে ল্যাট্টে আর্ট কাজের জিনিস। নিশ্চয়।
নাশিতা ফাইল থেকে চোখ তুলে এক টুকরো শিঙ্গাড়া নিল। তারপর বাটিটা শিমুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে গোলাপি হাসি, ‘প্লিজ, সার!’
শিমুল আবার দুশ্চিন্তায় পড়ে। নাশিতা আসলে কী ভাবছে সে তার কূল-কিনারা পাচ্ছে না। আপাতত নাশিতার মত তারও একটু হাসা দরকার। সে মৃদু হেসে ইংরেজিতে বলল, ‘আমি জানি আমি একটা বাঙ্গি, ম্যাম। ভুলভ্রান্তি হলে মাফ করে দিয়েন, প্লিজ!’
নাশিতা চোখ বড় করে তাকাল। বাঙ্গি মানে যারা বাংলা মাধ্যমে পড়েছে। কথাটা এক সময় ঢাকায় ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। এখনও আছে কিনা নাশিতা জানে না। শিমুলের ভঙ্গিতে সে হাহা করে উঠল। সাথে সাথে দরজার দিকে চোখ এক পলক। রুমের দরজা খোলা রয়েছে। হাসির শব্দ বাইরে যাওয়া সংগত না। সে মুখে হাত চেপে বলল, ‘কোন জেলা যেন তোমাদের? সিভিতে দেখেছিলাম কিন্তু ভুলে গেছি। রিয়েলি।’
‘রাজবাড়ি। পুরনো রাজা এখন আর নেই। কিন্তু রাজবাড়ি বহাল তবিয়তে।’
‘তোমার কাছে সেই রাজবাড়ির ছবি আছে? প্রাচীন স্থাপনা আমার খুব প্রিয়। আমি সময় হলেই বিভিন্ন জায়গায় চলে যাই।’
‘জি, ম্যাম,’ শিমুল ফুরফুর করে উঠল। এতক্ষণে তার মনে হচ্ছে নাশিতা তাকে চাপে রাখবে না। সে খুব উৎসাহিত হয়ে কোটের পকেট থেকে আইফোন বের করল।
ছবি দেখার মাঝখানে পিয়ন এসে বলল নাশিতাকে সিইও সালাম দিয়েছেন।
সিইও একটা নীল ফোল্ডারে কাগজের ফাইলে চোখ বুলাচ্ছিলেন। তার টেবিলের সামনে চাকাঅলা চেয়ারে বসল নাশিতা। সিইও কোনো ভূমিকা ছাড়াই বললেন, ‘চেয়ারম্যান চাচ্ছেন আপনি যদি একটু ফিঙ্গেবাড়ি যান! ওখানে শ্রমিকরা ঘোঁট পাকাচ্ছে যে—।’
‘যে’ বলতে বলতে সিইও বুঝলেন আর কিছু বলার দরকার নেই। অলরেডি ‘যে’ শব্দটা বাড়তি বলা হয়ে গেছে। তিনি ভাওয়াল কনস্ট্রাকশন ফার্মের অডিট প্রতিবেদনে চোখ বুলাতে ব্যস্ত হলেন।
নাশিতা পিঠ টানটান করে বসল। চেয়ারম্যান তাকে কেন ফিঙ্গেবাড়ি পাঠাচ্ছেন। মাস চারেক আগে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ভাওয়াল স্টিলের শ্রমিকরা ধর্মঘট করল। সিইও সেখানে যাবার সময় নাশিতাকে সাথে নিতে বললেন চেয়ারম্যান। নাশিতা খুব অবাক হয়। সেখানে শ্রমিকনেতাদের সাথে মিটিংয়ে সিইও কথা বলেন। নাশিতাও দুচার কথা বলেছিল। চার দিন ধরে চলা ধর্মঘট মিটিংয়ের পর শেষ হয়। নাশিতার কথা কাজে লেগেছিল তা সে ভাবেনি। আজ আবার কেন নাশিতাকে। চেয়ারম্যান কি পুরুষ শ্রমিকনেতাদের সামনে সুন্দরী নাশিতাকে ব্যবহার করছেন।
হলুদাভ ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠল। কিন্তু তার কোনো কারণ খুঁজে পায় না নাশিতা। সে শান্ত হবার চেষ্টা করতে লাগল।
সিইও ফাইল থেকে চোখ না তুলেই বললেন, ‘আপনাকে যেতেই হবে এমন না। এখানে আপনার কোনো দায় নেই।’
‘আমি ভাবছি যে কার সাথে যাচ্ছি। আপনি যাচ্ছেন, সার?’
‘কারুর সাথে না। আপনি যদি যান আর আপনি যদি কাউকে সাথে নেন সে যাবে।’ সিইও এতক্ষণে ফাইল থেকে চোখ তুলে মৃদু হাসলেন।
তার হাসিতে নাশিতা খুশি হতে পারছে না। সে জানে বসের হুকুমের চাইতে অনুরোধ বেশি ফোর্সফুল। স্ট্রেসফুল। এখানে না বলার সুযোগ নেই। অজুহাত দিলে নম্বর কাটা পড়ে। প্রকৃত সমস্যা হলেও কাটা পড়ে। কেন সমস্যা হয়? বস মনে মনে কৈফিয়ত চায়। মনে মনে উত্তর খোঁজে। মনে মনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখে। অমুক সমস্যায় পড়ে। তমুকের ভাগ্য খারাপ। সমস্যা এড়াতে পারে না। সমস্যা মোকাবিলার সামর্থ্য কম।
সিইও বললেন, ‘আপনার সামনে আর কী কী কাজ আছে? মানে আপনার ক্যারিয়ারের পরের ধাপ।’ সিইও আবার হাসলেন। তাকে কালেভদ্রে হাসতে দেখা যায়।
পরের ধাপ হচ্ছে সিইও অথবা চিফ অপারেশন অফিসার অথবা। এ ধরনের পদে কাজ করতে হলে মিটিং-সিটিংয়ের ক্ষমতা থাকা আবশ্যক। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তাদের সাথে হয় এসব মিটিং। নাশিতার বুকের ভেতর দুরুদুরু করে উঠল। ফিঙ্গেবাড়ি যেতে বলা হয়ত তার জন্য এক বিশেষ সুযোগ। বড় ব্যবসা চালাতে হলে বহুবিধ বিষয় পরিষ্কার বুঝতে হয়। নানা রকম সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। সমাধান করতে হয়। কিন্তু শ্রমিকদের সঙ্গে দেনদরবার ত কারখানার ব্যবস্থাপকরাই করে। কারখানার বিভিন্ন বিভাগে একদল ব্যবস্থাপক আছে। তাদের মাথার ওপর আবার একজন মহাব্যবস্থাপক আছে। সিইও হাত দেন কালেভদ্রে। সেখানে চেয়ারম্যানের কেন নাশিতার ওপর নজর পড়ল।
যাহোক।
‘আমি কাকে সাথে নেব, সার?’
‘আপনার ইচ্ছা। ইউ আর দ্য লিডার!’
‘থ্যাংক ইউ, সার!’
‘ওয়েলকাম!’
নাশিতা রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। ফিঙ্গেবাড়ি এখনই যাবে নাকি একটু দেরি করবে। চিন্তা করতে করতে ওয়াশ রুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়াল। কয়েকটা চুল অনেকক্ষণ ধরে গালের ওপর এসে বিরক্ত করছে। চুলগুলো সে শক্ত হাতে অন্য চুলগুলোর ভেতর গুঁজে দিল। এমন করে দিল যেন শায়েস্তা করল। তারপর আর দেরি না করে উঠে পড়ে। আশুলিয়া-ফিঙ্গেবাড়ি এখান থেকে অনেক দূর। প্রায় ত্রিশ কিলো।
কিন্তু চিন্তা বাড়তে লাগল। শ্রমিকদের ঘোঁট মানে তাদের দাবিদাওয়ার বিষয়। তাদের কী দাবিদাওয়া আছে সেসব ত নাশিতা জানে না। সেই দাবিদাওয়া পূরণের জন্য তার হাতে কোনো নির্বাহী ক্ষমতাও নেই! তাহলে সে একা সেখানে গিয়ে কী করবে। সিইওর সাথে শেয়ার করা উচিত ছিল। এখন আবার তার রুমে গিয়ে কথা বলা কি ঠিক হবে। বিষয়টা বন্ধু মাইশার সাথে শেয়ার করা উচিত।
মাইশা বলল, ‘তোমার মুখ ব্যবহারের নির্বাহী ক্ষমতা তোমার হাতেই আছে, সখি!’
‘হা হা হা—!’
‘হি হি হি—!’
মাইশা বহুজাতিক ‘ফেয়ার অ্যান্ড সোনো ক্রিম’ কোম্পানির সিনিয়র হিসাব কর্মকর্তা। সব আয়-ব্যয় তদারক করা তার কাজ। শত খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা আয়-ব্যয় হয়। সব আয় পিরামিডের মত সাজিয়ে তোলার পদ্ধতি রয়েছে। পিরামিডের শীর্ষবিন্দু থেকে তলা পর্যন্ত প্রতিটি পাথর ঠিকঠাক না বসালে নড়বড়ে হয়ে যায়। বসানোর কাজগুলো করে জুনিয়ররা। সেই পাথরগুলো সব নজরে রাখা শক্ত কাজ। ব্যয় খাতও বহু রকম। কেনাকাটা বেতন ট্যাক্স ইত্যাদি। ব্যয় নিয়ে হয় আলাদা পিরামিড। দুই পিরামিড পাশাপাশি ঠিকমত দাঁড় করাতে পারে মাইশা।
নাশিতা একান্ত বিষয়-আশয় শেয়ার করে মাইশার সাথে।
শৈশবের এই বন্ধুরা নাম ধরেই ডাকত। ‘ও’ লেভেলে হয়ে গেল সখি। একদিন রাতে শখ করে বাংলা গল্প পড়তে গিয়ে শব্দটা প্রথম শেখে নাশিতা। পরদিন সে হঠাৎ করেই বলল, ‘মাইশা, আসো আমরা সই পাতাই।’
‘মানে কী?’
‘ডান হাতের পিংকি ফিঙ্গারটা আংটার মত করে বাঁকাও। এভাবে।’
মাইশা হেসে ফেলল।
‘এবার আংটায় আংটা বাঁধাও!’
‘হা হা হা!’
‘এবার আমার মত করে বলো। একবার বললেই আমরা সই হয়ে যাব। আর কিন্তু ভাঙ্গা যাবে না।’
মাইশা ত হাসতে হাসতে খুন।
নাশিতা বলল, ‘আর হাহা করতে হবে না। বলো, মনচুরা চিকুন কালা! কই গিলি কই!’ নাশিতা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলল। মাইশাও বলল। মাঝে অনেকবার হাহা। শেষে নাশিতা বলল, ‘এখন থেকে তুই আমার সই হলি সই!’
‘হা হা হা!’
‘সই বা সখি। তোমার কোনটা পছন্দ?’
‘সখি!’
‘পিংকি প্রমিজ?’
‘পিংকি প্রমিজ!’
বারবার হাহা করতে করতে প্রমিজ করল তারা।
এর আগে ইংরেজি গল্পেও তারা তা পড়েছে বটে। পিংকি প্রমিজ নামে একই রীতি জাপান-আমেরিকা আর আরো অনেক দেশে রয়েছে।
বন্ধুরা কয়েকদিন খুব মজা করল। অনেকেই পিংকি প্রমিজ করলেও আর কেউ সই হল না। নাশিতা মৃদু মৃদু হাসল। মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে থাকল। প্রিয় বন্ধুকে সম্বোধন করার জন্য একটা নতুন, দেশি শব্দ পেয়ে সে যারপরনাই খুশি।
আর তার আইনজীবী বাবা যখন বলে যে, পাড়াগাঁয়ে সই আর দোস্ত ছিল পাতানো আত্মীয়। রক্তসূত্রের মতই পুরোপুরি। আধুনিক হবার জন্য বাঙ্গালরা এসবকে গেঁয়োমি মনে করে ঝেড়ে ফেলেছে। একাত্তরের পর যত বেশি শহরে যাবার সুযোগ পেয়েছে ততই দ্রুততর হয়েছে ঝাড়ুর গতি। তখন নাশিতা খানিকটা আবেগ অনুভব করে। সেই আবেগের জন্যই সে একবার যশোরের গ্রামে গেছিল বাপের পৈতৃক বাড়ি বেড়াতে। তার রেশ তার মনের মধ্যে এখনও আছে।
রুম থেকে বের হবার আগে চালকের সেলফোনে কল করল নাশিতা, ‘খায়ের ভাই, বের হচ্ছি।’ তারপর লিফটে উঠে সিইওকে এসএমএস, ‘ফিঙ্গেবাড়ি যাচ্ছি, সার।’
‘শুভ কামনা!’ সিইও তাৎক্ষণিক উত্তর দিলেন।
নিচে নেমে নাশিতার মুড নষ্ট হয়ে গেল। তার কারটা টাওয়ারের সামনে একগাদা গাড়ির মাঝখানে আটকা পড়েছে। প্রায়ই পড়ে। তখন এখানে দশ-পনের মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আবার গাড়ি রাস্তায় ওঠার সাথে সাথে রওনা হওয়া লাগে। না হলে অন্যদের গাড়ি এসে চিল্লায়। পাছায় গুঁতো মারে।
নাশিতা মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে থাকল। খোলা আকাশে রুপালি রোদ ঝা-ঝা করছে। হরেক রকম মানুষ পাগলা জন্তুর মত ছুটোছুটি করছে। মতিঝিলের মোতি ধরার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে। নাশিতা তাকিয়ে আছে বেগুনি কারের দিকে। তার গা ঘেমে উঠছে। এক হকার এসে মুখের ওপর একগুচ্ছ সোনালি হার উঁচু করে ধরল, ‘এক্কেরে অরজিনাল সুনার মতন, ম্যাডাম। যেইডা নিবেন একশ টেকা!’
অসহ্য!
নাশিতা ভাওয়াল টাওয়ারে গ্রাউন্ড ফ্লোরের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। গ্রাউন্ড আর আন্ডার গ্রাউন্ডে সিনিয়রদের গোটা বিশেক গাড়ি থাকে। তাছাড়া জেনারেটর আছে। নিরাপত্তা কক্ষ আর আরো কী কী আছে। অন্য কর্মকর্তাদের শখানেক গাড়ি রাস্তায়ই থাকে।
বেগুনি কারটা বের হয় নয় মিনিট পরে। ভেতরটা হলুদাভ। নাশিতার মনে শান্তি ফেরায়। এসির শীতল পরশে গা আরাম পায়। আর মেয়ের কথা মনে করতে করতে মন ভাল হয়ে যায়।
আইফোন থেকে মেয়েকে কল করল নাশিতা। মেয়ের সাথে গপ্প করতে করতে স্যামসাং গ্যালাক্সি থেকে বন্ধু মাইশাকে এসএমএস। সে বের হয়েছে। যাচ্ছে গুলশানের ইতালো স্পাইসিতে। মাইশাকেও আধা ঘণ্টার মধ্যে বের হতে বলল। মাইশার অফিস স্পাইসির কাছেই।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন