লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [দ্বিতীয় পর্ব]

অ+ অ-

 

লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [দ্বিতীয় পর্ব]

সদরঘাটের দিকে একটা কাজ ছিল সকালে। সেটা যখন প্রায় শেষের দিকে, তখনই লিনুর ফোন। ‘আমি টিএসসিতে এসে বসে আছি। আপনি আসেন, আপনার সাথে দেখা করব।’ লিনুর সাথে আমার খুব দহরম মহরম সম্পর্ক নয়। ফেসবুকে আলাপ। সম্প্রতি ওর একটা পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম। সে যশোরে থাকে, পোস্টে জানিয়েছিল দুয়েকদিনের মধ্যে ঢাকায় আসছে। সেখানে আমি সৌজন্যবশত লিখেছিলাম এলে দেখা হবে। যেমন আমরা সবসময় বলে থাকি। দূরের যাত্রায় দীর্ঘক্ষণের আলাপের পর বাসের সহযাত্রীকেও নেমে যাবার সময় যেভাবে লোকে বলে—‘দেখা হবে’। যে বলে সেও জানে এটা নিছক কথার কথা, এর কোনো সত্যতাই নেই। তবু লোকে অহরহ এসব কথা বলে। এর আগে অবশ্য ইনবক্সে অনিয়মিতভাবে আমাদের অনেক কথা হয়েছে। যদিও আমরা সমবয়সি, সম্বোধন আপনিতে আটকে আছে। তো, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম অন্য কোনো কাজ আছে কিনা। সে বলল, সব কাজ শেষ। কেবল আমার সাথে দেখা করার জন্য বসে আছে। এরকম কথায় মানুষ নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আমার ভালো লাগল। শিউলির সঙ্গে কয়েকদিন যোগাযোগ নেই। সে নিজে থেকে যোগাযোগ করছে না। কী যেন এক অজানা দ্বন্দ্বে প্রেম-অপ্রেমের দোলাচলে দুলছে। ভাবলাম লিনুর সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। তাছাড়া অফিসও নেই আজ। সাপ্তাহিক ছুটি। ওকে আরেকটু অপেক্ষা করতে বলে আমি রিকশা নিলাম।

রাস্তায় জ্যাম ছিল। পুরান ঢাকার জ্যামগুলো ভীষণ ছ্যাচড়া ধরনের। ছোট ছোট রাস্তা আর হাজার হাজার রিকশা। বেশ খানিকটা দেরি হলো আসতে। লিনু একটা হালকা সবুজ রঙের ড্রেসে টিএসসির দেয়ালের ওপর বসে পা নাচাচ্ছে। ফেসবুকের ছবিতে তাকে যেমন দেখায়, বাস্তবে সে তার চেয়ে বেশি সুন্দর। গড়পড়তা বাঙালি মেয়েদের চেয়ে একটু লম্বা, শ্যামাবর্ণ আর ছিপছিপে আকর্ষণীয় শরীর। ওর চোখ দুটোতে দারুণ মায়া। আমাদের সম্পর্কটা নিছকই বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি ওকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলাম। লিনুও তার উচ্ছ্বাস গোপন করল না। সে খুব বিপ্লবী-ভাবাপন্ন মেয়ে। ফেসবুকে দেখি কদিন পরপরই একেকজনের সাথে ওর গণ্ডগোল লেগে যায়। খুব শর্ট টেম্পার্ড মনে হয় ওকে। তাই ওর সাথে বেশ সাবধানে কথাবার্তা বলছিলাম। কিন্তু লিনু খুব উচ্ছ্ল আজ। কিশোরীদের মতো আচরণ করছে।

‘এতক্ষণ লাগল কেন আপনার? জানেন, আর পাঁচ মিনিট দেরি হলে আমি চলে যেতাম।’

একটা অধিকারবোধ থেকে লিনু বলল। যদিও সেরকম সম্পর্ক আমাদের এখনও তৈরি হয়নি। আমি বললাম, ‘আপনার জন্য ছুটতে ছুটতে এলাম, আর আপনি বলছেন চলে যেতেন! এটা কিন্তু অন্যায়।’ কপট গম্ভীর হওয়ার ভান করলাম।

‘রাখেন আপনার অন্যায়। একা একা অপেক্ষা করা যায়?’

‘কী হয় একা অপেক্ষা করলে?’

‘দুনিয়ার সব পুরুষ তাকিয়ে থাকে একা কোনো মেয়ে দেখলে। চোখ তো না, একেক জোড়া এক্সরে মেশিন।’

‘প্রশংসা নাকি নিন্দা করলেন কে জানে!’

লিনু রেগে যাওয়া কণ্ঠে বলল, ‘মেয়ে হলে বুঝতেন।’

‘সদরঘাট থেকে আসা যে কী ঝামেলা সেটা যদি জানতেন!’

‘এত ঝামেলা যখন বলে দিতেন, আমি এতক্ষণ অপেক্ষা করতাম না। চলে যেতাম। বদমাইশগুলোর মধ্যে বসে থাকতে হতো না।’

‘ইশশ্, পুরুষহীন পৃথিবী আপনি আর কোথায় পাবেন বলেন!’

লিনু এসব ইয়ার্কিতে সাড়া দিল না। সে বলল, ‘চলেন কিছু একটা খাই। ক্ষুধা পেয়েছে।’

অদূরেই একটা ফুচকার গাড়ি ছিল। সেখানে চারটা ছেলে আর দুটো মেয়ে খুব হেসে হেসে ফুচকা খাচ্ছে। আমি সেদিকে হাঁটা দিতেই লিনু বলল, ‘ওখান থেকে না। শহীদ মিনারের কাছে একটা ফুচকাওয়ালা আছে, সে খুব ভালো ফুচকা বানায়, সেদিকে চলেন।’

‘সে কী! আপনি এদিকে নিয়মিত আসেন নাকি?’

‘একটা শর্টফিল্ম বানাচ্ছি গত আড়াই বছর ধরে। মাঝে মধ্যে আসতে হয়।’

‘ওহ, তাই বলেন। তাহলে তো ঢাকায় আপনার অনেক বন্ধু-বান্ধব।’

‘সে তো আছেই। কিন্তু এবার কেন যেন কারো সঙ্গেই দেখা করতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া সবাই সবসময় ফ্রিও থাকে না। এ শহরটা তো খুব স্বার্থপর ধরনের। সবাই যার যার ধান্দা নিয়ে বিজি।’

লিনু কথাবার্তা অনায়াসে যেকোনো শব্দ ব্যবহার করতে পারে, গালিগালাজও। রাবীন্দ্রীক ভদ্রতার ওর ধাতের সাথে যায় না। ফেসবুকে দেখেছি বাপের বয়সী লোকজনের সাথেও তুই তোকারি, গালিগালাজ করতে তার বাধে না। এবং এই নিয়ে তার কোনো অনুতাপ নেই। জিজ্ঞেস করলে বলে, সে যেসব শব্দ ব্যবহার করে সেটাই তার ভাব প্রকাশের জন্য যথার্থ। এর চেয়ে ভদ্র ভাষায় কথা বললে ভাবটা ঠিকঠাক বোঝাতে পারবে না।

ফেসবুকে আমার নানা ধরনের বন্ধু। নায়িকা, রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা, করুণ কেরানি, অবসরপ্রাপ্ত চোর, ধর্মান্ধ, অশিক্ষিত নাস্তিক, কট্টরপন্থি গায়ক, উন্নাসিক কবি, আধাপাগল, প্রগতিশীলতার বেশধারী গোঁড়া, বন্ধুবেশি ক্ষতিকর মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারী মূর্খ, ডিগ্রিহীন মূর্খ, কোণঠাসা সমকামী, নারী সেজে থাকা পুরুষ, ডিগ্রিহীন সত্যিকারের শিক্ষিত, প্রাক্তন মন্ত্রী, খ্যাতিলোভী ঘুষখোর, সহনশীল ধার্মিক, আইনজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তার, গালিবাজ ফেক আইডি, নিপাট ভদ্রলোক, ছিঁচকে বদমাশ, সতর্ক গোয়েন্দা, দুই বঙ্গের ভাতৃত্ব অন্বেষণকারী সহমর্মী, শতভাগ নির্লিপ্ত, বুদ্ধিমান বাউল, নাবালক, বিদগ্ধ রবীন্দ্রগবেষক এবং এর বাইরে আরও নানা ধরনের মানুষ আমার ফেসবুকে আছেন। সুতরাং লিনুও আছে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে। ফেসবুকে তার কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা সময়ে আমার সাথে মতবিরোধ হয়েছে। কিন্তু, সেটি কখনো তিক্ততার পর্যায়ে চলে যায়নি। সে যা বলবে, তার বিপক্ষে কেউ কিছু বললে ক্ষেপে যায়। তার ওই চরিত্রের সঙ্গে আজকের আচরণের কোনো মিল নেই। দুষ্টুমি করছে, হাসছে, গুনগুন করে গান গাইছে। ওর আচরণ দেখে আমি কনফিউজ হয়ে যাচ্ছি, লিনুর কোন রূপটা আসল!

ফুচকা খেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একপাক ঘুরে, রাস্তার পাশের দোকানে মনোহারি জিনিসপত্র দেখে আমরা আজিজ মার্কেটের পাশ দিয়ে চলে এলাম পান্থপথের বসুন্ধরা সিটিতে। তখন দুপুর হয়ে এসেছে। লিনু বলল, ‘চলেন আপনাকে আজ জাপানিজ ফুড খাওয়াই।’

‘জাপানিজ ফুড?’

‘হুম। ভালো লাগবে আপনার।’

আসলে বেশি মশলা খাওয়া আমার বাঙালি জিভে প্রায় মশলাহীন আধাসেদ্ধ জাপানিজ খাবার কোনোকালেই ভালো লাগেনি। কিন্তু সে কথাটা ওকে বলতে ইচ্ছে করল না। তাছাড়া অনেকদিন পর এখানে এত খুশি মন নিয়ে খেতে এসেছে, সেই আনন্দ মাটি করার কোনো মানে হয় না। ও কি সবসময়ই এমন উচ্ছল থাকে? না কি আজই এরকম? প্রথম দেখায় মেয়েরা সাধারণত এমন অনায়াস হয় না। হয়তো সে এমনই। কিন্তু সারাক্ষণ যে হাসে তার ভেতরে অনেক সময় প্রচণ্ড দুঃখ থাকে। বিষয়টাকে আমি সন্দেহের উর্ধ্বে রাখতে পারলাম না।

চপস্টিকে ঠক ঠক শব্দ করে আমার ধ্যান ভাঙাল লিনু। ‘খাবার ভালো লাগছে না?’

আমি বললাম, ‘না না, ভালোই তো।’

দেখলাম লিনু বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছে। আমিও খাওয়া শুরু করলাম। চপস্টিকে খেতে অভ্যস্ত নই বলে কাটাচামচ দিয়েই খাচ্ছিলাম। সে দেখি খাবারের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাও অতি অভ্যস্ত ভঙ্গিতে চপস্টিক দিয়ে পটাপট তুলে খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে দেখা গেল আমাদের হাতে এখনও প্রচুর সময় আছে। আমরা ইচ্ছে করলে আরো অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়াতে পারি। ‘কই যাবেন বলেন?’ লিনু আমাকে জিজ্ঞেস করল। যেন আমি তার শহরে বেড়াতে এসেছি! অবশ্য আমি এই শহরটা খুব যে বেশি চিনি, তাও নয়। লিনুই হয়তো আমার চেয়ে বেশি চেনে। যেসব জায়গায় অফিস বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যেতে হয়েছে, আমার দৌড় সে পর্যন্তই। ঘুরতে বা আউটিং করার জন্য আলাদাভাবে কোথাও যাওয়া হয়নি। আমি বললাম, ‘আপনিই বলেন কোথায় যেতে চান?’

‘বুঝতে পারছি না। এখন তো শরতকাল। কাশবনে যেতে ইচ্ছে করছে।’

‘কিন্তু, সে তো অনেক দূর। কাল যাই?’

‘কাল আপনার অফিস নেই?’

‘আছে, কিন্তু অফিস ছুটির পর অনেকটা সময় হাতে থাকবে।’

‘সত্যি যাবেন কাল? আবার অজুহাত দেখিয়ে সটকে পড়বেন না তো?’

‘আরে না না। যতটা ভাবছেন আমি অতটাও খারাপ নই। আজ বরং আজিজ মার্কেটে যাই আমরা। টুকটাক একটু কেনাকাটাও করার দরকার।’

লিনু আর আমি বসুন্ধরা শপিং মল থেকে একটা রিকশা নিয়ে আজিজ মার্কেটে এলাম। আগের আজিজ মার্কেট আর নেই। আগে যেমন বইয়ের মার্কেট হিসেবে লোকে চিনত এখন নতুন কেউ এলে সেটা ভাবতেই পারবে না। কবি সাহিত্যিকদের আড্ডাও নেই আর। সন্ধ্যার পর দুই একটা জায়গায় উঠতি কবিরা গাঁজা খেত। সিনিয়র কবিরাও সেসব স্নেহসুলভ চোখে দেখত, একদফা চায়ের বিলটাও দিত অনেক সময়। এখন আর সেসব আড্ডা নেই। সম্ভাবনাময় অগোছালো তরুণদের আর দেখা যায় না এখন। কাপড়ের রকমারি দোকানে ভরে গেছে আজিজ মার্কেট। ফ্যাশন সচেতন তরুণ তরুণীরা নানারকম সুগন্ধী মেখে ঝা-চকচকে আজিজ মার্কেটে ঘুরে বেড়ায়। ফলে, ছাপোষা কবি বা কবিভাবাপন্ন লোকেদের আর ঠাঁই নেই। নিচতলায় দু’চারটে বইয়ের দোকান আর দোতলায় ছবি আঁকার সরঞ্জাম পাওয়া যায় এরকম একটা দোকান শুধু টিকে আছে। সেখান থেকে কিছু রং ও কয়েকটা পেপার কিনলাম। লিনুকে একটা ছোট আর্টখাতা গিফট করলাম। সে খুব খুশি হলো। লিনু বলল, ‘সাংবাদিক আবার ছবিও আঁকে নাকি?’

‘গরিবের ঘোড়ারোগ বলতে পারেন।’

‘আমার একটা ছবি এঁকে দেন না।’ আবদারের ভঙ্গিতে বলল লিনু।

‘দেবো। তবে আপনি নিজেকে সেখানে চিনতে পারবেন সেই গ্যারান্টি কিন্তু দিতে পারব না।’

‘হা হা হা। তাহলে বড় বড় করে লিখে দিয়েন এটা লিনুর ছবি।’

ওর হাসিতে আশেপাশের লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। আমি একটু বিব্রত বোধ করলেও এসব নিয়ে ওর কোনো মাথাব্যথা নেই। সে এসব পাত্তা দেয় বলে মনে হলো না। ও যখন হাসছিল, আমি তখন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম সারাক্ষণ। অদ্ভুত সুন্দর সেই হাসি। দারুণ পবিত্র মনে হয়।

পড়ুন  লোকটাকে  যেভাবে খুন করেছিলাম [প্রথম পর্ব]

► আসছে তৃতীয় পর্ব