চর্ব্য চোষ্য [ত্রয়োদশ পর্ব]

অ+ অ-

 

পড়ুন চর্ব্য চোষ্য [দ্বাদশ পর্ব]

চর্ব্য চোষ্য [ত্রয়োদশ পর্ব]

 

আমির সত্যি সত্যি একটা মিটিংয়ের আয়োজন করতে পেরেছে। জনা দশেক ছোটখাটো নেতাকে সে ডেকে এনেছে।

নাশিতা পরিচয় পর্বের পর বলল, আপনারা দুই-চারটা কারখানায় আলাদা করে এই যে আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন, এই দিয়ে কি ভাল কিছু হবে?

নেতারা চুপ। তারা জানে না কী হবে। আবার তারা গুটিয়েও যেতে পারে না। খানিক পরে আমির বলল, যা পারছি তাই করছি। আর কী করব? শ্রমিকদের মুখের দিকে তাকালে চুপ থাকতে পারি না। আপনারা ত কোনো দিন শ্রমিকদের কাছে যান না। তারা মানুষ আছে নাকি পশু হয়ে গেছে তা তাদের কাছে গেলে বুঝতেন।

নাশিতা বলল, না গেলেও কিছুটা ধারণা করতে পারছি। সেজন্যই আমি দৈনিক ফিঙ্গেবাড়ি আসছি। এখন সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য আমাদের কিছু একটা করতে হবে।

কিভাবে?

বড় পরিসরে কাজ করতে হবে। পুরো গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে।

আমির উসখুস করে। সেও তাই চায়। কিন্তু তার মাথায় বুদ্ধি আসে না।

নাশিতা বলল, সব ব্যবসায়ী যত পারে ততই লাভ করতে চায়। সেখানে দুএকজনের ওপর চাপ দিলে তারা আরো শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। দুই-চারটা কারখানাকে বসিয়ে দিলে তারা দুঃখ পাবে। তারা মনে করবে তাদের ভাগ্য খারাপ। তারা বদলাবে না। অন্যরাও বদলাবে না।

আমির চুপ।

নাশিতা বলল, আমাকে মালিকের লোক মনে করবেন না, প্লিজ! আমিও আপনাদের মতই চাকরি করি। শ্রমিকরা যদি ভাল থাকে তাহলে আমার ভাল লাগবে। সবার ভাল লাগবে। এবং তাতে সবাই উপকৃত হবে।

আমির চকিতে তাকাল নাশিতার মুখের দিকে।

নাশিতা বলল, আপনি যদি পুরো সাভার উপজেলায় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন তাহলে আমি আপনাকে ডোনার জোগাড় করে দেব। এ ধরনের আন্দোলনে সহযোগিতা করার লোক আছে। দেশে আছে। বিদেশে আছে।

আমির অবাক হল। নাশিতার এমন কথায় সন্দেহ হয়। আমির ইন্টার ফেল হলেও এতটুকু সন্দেহ করার বুদ্ধি তার আছে।

নাশিতা বলল, ইউরোপ-আমেরিকার শ্রমিকরাও এমন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল এক সময়। বহু বছর ধরে করেছিল। নিউ ইয়র্কের এক পোশাক কারখানায় আগুন লেগে মারা গেছিল একশ ছেচল্লিশ জন।

কথা শেষ না করে আইফোনে নেটে ঢুকল নাশিতা।

আমির হাঁ হয়ে যায়। নিউ ইয়র্কের আগুনে তার সন্দেহ বাড়ে।

নাশিতা বলল, এখন থেকে ঠিক একশ এক বছর আগের ঘটনা ওইটা। দশতালা ভবনের শেষ তিনতালায় ছিল ট্রায়াঙ্গল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরি। যারা মারা গেছিল তাদের মধ্যে একশ তেইশ জনই ছিল কিশোরী-তরুণী। তাদের বেশির ভাগই ইতালি থেকে গেছিল ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে। অনেকের পরিবার হয়ত প্রিয়জনের লাশটিও পায়নি।

আমির সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছে নাশিতার সহযোগিতা নেবে কিনা। কিন্তু দুই মাস আগে শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামকে হত্যার ঘটনায় সে অস্থির হয়ে যায়। সেই থেকে পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত আরো খারাপ হচ্ছে আশুলিয়া অঞ্চলে। কারা আমিনুলকে হত্যা করল। তার প্রতিপক্ষের চেহারা পরিষ্কার দেখতে পায় আমির। তারা হচ্ছে

নাশিতা বলল, আমরা বছর খানেকের মধ্যে ভাওয়ালের একটা কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করার অনুমতি দেব। কালে কালে অন্যান্য কারখানায়। সেই পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চলছে।

নেতারা হাঁ হয়ে যায়। এবার তারা সন্দেহও করতে পারে না বিশ্বাসও করতে পারে না। নাশিতা যেন তাদের ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিল। কিন্তু নাশিতা চায় কী? সৎ শ্রমিকনেতাদের নিয়ে কি নাশিতা কোনো খেলায় নেমেছে?

আমির বলল, কেউ ত দিতে চায় না। ইউনিয়ন করলেই ত চাকরি যায়। আপনারা কেন স্বেচ্ছায় দিতে চাচ্ছেন?

নাশিতা বলল, ইউনিয়ন করতে না দেওয়ায় এবং অনেকের চাকরি যাওয়ায় পরিস্থিতির বেশি অবনতি হচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন হলে একটা ভাল পরিবেশ তৈরি হবে। ভাওয়ালের সব শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এক পরিবারের সদস্যআমরা এমন মনে করতে চাই। ইউনিয়ন হলে সেই পরিবেশ তৈরি হবে।

তাহলে মালিকরা এর বিরোধিতা করে কেন?

তারা বুঝতে পারছে না। এমন আছে না যে, দুই-একজন লোক যা আজ বুঝতে পারছে তা অনেকে বোঝে বহুদিন পরে?

হা। তা আছে ত।

তাছাড়া সেই পরিবেশ তৈরি করতেও অনেক ব্যয় হবে। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। তবে একবার তৈরি হয়ে গেলে তার সুফল সবাই পাবে। উন্নত সব দেশেই ট্রেড ইউনিয়ন আছে।

আমির এতক্ষণে বেশ বিগলিত হয়।

নাশিতা এক ধাপ এগোতে পেরেছে মনে করে ফুরফুরে হয়ে উঠল। ঘড়ির দিকে তাকাল সে। বিকেল সাড়ে চারটা। শিগগির বেরোতে পারলে আজ কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া যাবে। গুলশান-বারিধারায় বিভিন্ন এম্বাসির কালচারাল সেন্টারে বা হোটেলে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কোনো-না-কোনো অনুষ্ঠান থাকে প্রায় দৈনিক।

 আসছে চতুর্দশ পর্ব