লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [অষ্টম পর্ব]
পড়ুন ► লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [সপ্তম পর্ব]
লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [অষ্টম পর্ব]
একা থাকার অনেক সুবিধা। ইচ্ছে করলে লাইট জ্বালিয়ে রেখে ঘুমানো যায়, মশারি না টাঙালেও চলে, এলোমেলো ময়লা বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়া যায়, বিছানায় বসে ভাত খাওয়া যায়, কাপড়-চোপড় খুলে এখানে সেখানে ছুঁড়ে মারা যায়, টিভি চালিয়ে রেখেও ঘুমিয়ে পড়া যায়। কেউ আপনাকে কিছু বলবে না। সকালে বুয়া এসে বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেও বলতে পারে অবশ্য, কিন্তু সেসব ধ্বনিসমষ্টি থেকে কোনো শব্দ আলাদা করতে না পারায় তাতে কান না দিয়ে থাকা যায় অনায়াসে। একা থাকার সব রকমের সুবিধা আমি উপভোগ করি। তবে কখনও কখনও নিয়ম মানতে হয়। কেননা, ক্রমাগত অনিয়মে থাকলে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। আর একা থাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অসুস্থ হলে খুব অসহায় অবস্থায় পড়তে হয়। এই নির্দয় শহরে কাউকে ডেকে পাওয়া যায় না সেসব দিনে। তাই ইদানিং রাত সাড়ে বরোটা, একটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করি।
আজও তেমনই ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ শেষরাতের দিকে দেখি বাসার নিচে একটা পুলিশের গাড়ি আমার খোঁজ করছে। গাড়িটা পুলিশের সেটা সবাই বুঝতে পারছে, কিন্তু কোনো সরকারি গাড়ি না সেটা। রেন্ট-এ-কার থেকে ভাড়া করা। কে বা কারা যেন আমার নামে সিরিয়াস কমপ্লেইন করেছে। পত্রিকায় কলাম লেখার কারণ নানা পক্ষ এমনিতেই আমার ওপর ক্ষেপে থাকে। জঙ্গি আস্তানার মতো চারদিক ঘেরাও করে বাড়ির গেটে সাইরেন বাজাচ্ছে পুলিশ। পুলিশ হ্যান্ড মাইকে আমাকে বেরিয়ে আসতে বলছে, আমি বেরিয়ে না এলে তারা দরজা ভেঙ্গে ব্রাশ ফায়ার করতে বাধ্য হবে। প্রথমে একটা গাড়ি ছিল তারপর এর আরও কয়েকটা গাড়ি চলে এল। সাদা পোশাকে সাদা মাইক্রোবাস থেকে বের হলো ভাবলেশহীন একদল লোক। যেন এরা নির্বিকারভাবে যে কারো গলায় ছুরি চালিয়ে দিতে পারবে। এবং খুন করার সময় তাদের যন্ত্রের মতো মনে হবে। এরা হয়তো আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আর স্বীকার করবে না। জ্বলজ্যান্ত আমি হঠাৎ করে ভোজবাজির মতো অস্তিত্বহীন হয়ে যাব। কেউ কোথাও আমাকে বা আমার লাশকে আর খুঁজে পাবে না। কাগজে কলমে আমি অবশ্য জীবিতই থাকব, কিন্তু সশরীর উপস্থিতি কোথাও কেউ পাবে না। আমার মা-বাবা পুলিশ, ডিবি, র্যাব এবং বিশেষ বাহিনীর কাছে গিয়ে আমাকে খুঁজবে। ওরা যথারীতি বলবে আমাকে তারা চেনে না, কোনোদিন দেখেওনি। ওই নামে কেউ তাদের কাছে বন্দী আছে এমন তথ্য নেই। অন্য কোনো বাহিনীর অফিসে গিয়ে খোঁজ করতে বলবে। তারপর অন্য বাহিনীর অফিসে গেলে তারা আবার আরেক অফিসে খুঁজতে বলবে। কেউ নিজ থেকে স্বীকার না করা অব্দি মফস্বল থেকে আসা আমার পরিবারের লোক এভাবে খুঁজতেই থাকবে। একসময় তাদের টাকাপয়সা আর উৎসাহও হারিয়ে যাবে। সমবেদনাগ্রস্ত মানুষেরাও আর তাদের সঙ্গে থাকবে না। তখন সবাই ক্লান্ত হয়ে খোঁজাখুজি বন্ধ করবে।
গাড়িগুলো এখন সাইরেন বাজিয়ে চলছে। একটানা, বিরতিহীন, ভয়ার্ত সাইরেন। আমার মনে হলো কয়েক হাজার গাড়ি সাইরেন বাজাচ্ছে বিকট স্বরে। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম বিছানায়। সারা শরীর এবং বিছানা ঘামে ভেজা। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। পুলিশের গাড়ির সাইরেন নয়, ফোনটা বাজছে। এত বাজে একটা রিংটোন! কালই চেঞ্জ করতে হবে। টিভি বন্ধ করা হয়নি। জানলাটা খোলা, আলো আসছে। ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে পাঁচটা। সকাল হয়ে গেছে। ফোন করেছে মারুফ। এলাকার বন্ধু। এত সকালে ফোন, কী ব্যাপার? কোনো দুঃসংবাদ ছাড়া এ সময়ে কেউ আমাকে ফোন করে না। আশঙ্কায় কেপে উঠে কলটা রিসিভ করলাম, ‘হ্যালো, কী খবর মারুফ?’
‘ভালো না মামা।’ মারুফ আমার বন্ধু হলেও আমাকে সে মামা বলে ডাকে। আমিও তাকে মামা বলি। আমি বললাম, ‘কী হইছে?’
‘শরিফ মারা গেছে।’
শরিফ আমাদের বন্ধু। স্কুল-কলেজ জীবনে আমাদের যত কুকীর্তি-সুকীর্তি তাতে তার উৎসাহ থাকত সবচেয়ে বেশি। হেডস্যার তাকে একবার তার বড় চুলের জন্য পরীক্ষায় বসতে দেয়নি। ছোটখাট মারামারি, পাড়ায় পাড়ায় গণ্ডগোলে শরিফই থাকত মাথায়। কিন্তু সে খুব বন্ধু অন্তঃপ্রাণ ছেলে ছিল। কোনো কাজে শরিফকে ডেকে কেউ পায়নি, এমন ঘটনা কোনোদিন ঘটেনি। একবার এক ছেলের সাথে আমার সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আমি কাউকে বলিওনি। শরিফ কোথা থেকে যেন ঘটনাটা জানতে পারে। সে গিয়ে আচ্ছামতো পিটিয়ে এসেছিল ছেলেটাকে। আর একবার শরিফ আমার হলে এসেছিল। রাতে ঘুমোতে গিয়ে দেখে তেল চিটচিটে বালিশ, ইটের মতো শক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিছানা-বালিশের কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। কোনোমতে একটা কিছু হলেই হতো। সারাদিন এত ক্লান্ত থাকতাম যে ইটের ওপর ঘুমাতে দিলেও বোধ হয় সমস্যা হতো না। শরিফ এলাকায় ফিরে গিয়ে নতুন দুটো শিমুল তুলোর বালিশ আর ওর বোনের বানানো একটা কাঁথা পাঠিয়েছিল এক ছোট ভাইকে দিয়ে। আমার তখনকার প্রেমিকাও শরিফের মতো কেয়ারিং ছিল না। সেই শরিফ মারা গেছে! কত দিন ওর বাসায় গিয়ে আমি পড়ে থেকেছি। খেয়েছি, ঘুমিয়েছি। সব মনে পড়তে লাগল। আমি বললাম, ‘কীভাবে মারা গেল?’
‘ওকে ক্রসফায়ার দিয়েছে।’
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে এলাকার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে আসছিল আমার। মাসে, দুই মাসে কথা হতো এক আধবার। চাকরিতে জয়েন করার পর সেটা প্রায় শুন্যের কোটায় এসে ঠেকে। শরিফ মাঝে মধ্যে ফোন দিত। অল্প কথা হতো, ওকে এড়িয়ে যেতাম প্রায়ই। ও সেটা বুঝতে পারতো হয়তো, এজন্য একসময় আমাদের আর কথা হতো না। বাড়িতে গেলে দেখা হলেও বড়জোর এক কাপ চা খেয়ে যে যার মতো চলে যেতাম আমরা। ওর সাথে অন্য বন্ধুদেরও ভালো সম্পর্ক ছিল না। বছর ছয়েক আগে থেকে শরিফের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে। সে ড্রাগ এডিক্ট হয়ে পড়ে। বন্ধুদের কাছে নেশা করার জন্য টাকা চাইত। আমি বাড়িতে গেলেও চেয়েছে দুই একবার। দিতে ইচ্ছে করত না, জানতাম দিলে ও নেশা করবে। তবু শেষ পর্যন্ত দিতাম। চাকরি বাকরি, কাজ কর্ম কিছুই করত না শরিফ। বাড়ির অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল হওয়ায় থাকা-খাওয়া নিয়ে তেমন সমস্যা হতো না। কিন্তু নেশা করতে তো নগদ টাকা লাগে, সেটা ছিল না শরিফের। এর ওর কাছ থেকে চাইতো।
মারুফের কাছ থেকে যেটা জানা গেল, নেশা করার জন্য সে যখন এলাকার কারো কাছ থেকে আর টাকাপয়সা ম্যানেজ করতে পারছে না, তখন সে নিজেই টুকটাক মাদকের ব্যবসা শুরু করেছিল। খুচরা ব্যবসায়ী। মূলত নিজের নেশার জিনিস জোগাড় করতেই সে এই পথে নামে। সারাদিন বিক্রি করে যেটা লাভ হয় ওটা দিয়েই সে নিজের নেশাটা চালিয়ে যেত। বন্ধুরা যে যার মতো ব্যস্ত থাকায় কেউ ওকে ওই পথ থেকে সরানোর চেষ্টা করেনি। বরং নিজেরাই দূরে সরে গেছে। মফস্বল শহরে এ ধরনের ছেলেদের সাথে কেউ মিশতে চায় না। ভাবমূর্তি খারাপ হয়ে যায়। সমাজে ভাবমূর্তির কদর সবচেয়ে বেশি।
এলাকায় মাদকের বড় ব্যবসায়ীরা ক্ষমতাবান। তারা সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িত। হয় সরকারি দল, নয়তো বিরোধী দল। দুই দলই আবার কোনো না কোনো সূত্রে আত্মীয়, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন তারা অন্যদের পুলিশি ঝামেলা থেকে বাঁচায়। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ায় খুব ধড়পাকড় চলছিল। চিপায় চাপায় বসে আর মাদক নেওয়ার উপায় ছিল না। সবখানে পুলিশের উৎপাত। বড় ব্যবসায়ীদের সাথে পুলিশ এবং প্রশাসনের বোঝাপড়া খুব ভালো। কিন্তু একটা কিছু তো করতে হবে! মিডিয়ার লোকজনকে দেখানোর জন্য কোনো একজন বলির পাঁঠা দরকার। শরিফ সেই বলির পাঁঠা। এরকম একদম খুচরো একজন সিজনাল ব্যবসায়ীকে ক্রসফায়ার দিয়ে মাদকের ব্যবসা যে বন্ধ করা যাবে না, সেটা সবাই জানে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণেই বড় ব্যবসায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় সবসময়। আমার বন্ধু শরিফ নিজে মরে গিয়ে অন্য ব্যবসায়ীদের অনেকদিনের জন্য স্বস্তি দিয়ে গেল।
একটু পরে অফিসে গিয়ে হয়তো আমাকেই নিউজটা লিখতে হবে। এ ধরনের নিউজের শিরোনামও মুখস্ত হয়ে গেছে পত্রিকা অফিসের সবার। ‘পুলিশের সাথে বন্ধুকযুদ্ধে মাদক ব্যবসায়ী নিহত’। ভেতরের বাক্যগুলোও মুখস্ত। পুলিশ প্রথমে শরিফকে আটক করবে তারপর তাকে নিয়ে অন্য মাদক ব্যবসায়ীদের খুঁজতে বের হবে। খোঁজাখুজির এক পর্যায়ে শরিফের সহযোগিরা পুলিশকে লক্ষ করে গুলি ছুঁড়বে। গোলাগুলির পর দেখা যাবে শরিফ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। সেখান থেকে হয়তো একটা জং ধরা পিস্তল, অথবা দু’একটা ছুরি, অথবা উভয়ই উদ্ধার করা হবে। গোলাগুলির ঘটনায় ইদানিং পুলিশও আহত হয়, তাঁদের আঙুলে ব্যান্ডেজ বাঁধা থাকে।
সকালে প্রায় দিনই এমন নিউজ করি। কোনোদিন কিছু মনে হয় না। সমবেদনাও জাগে না আজকাল। নির্বিকারভাবে রুটিন কাজ করার মতো নিউজগুলো এডিট করি। যারা পড়ে, তাদের মনেও এসব কোনো দাগ ফেলে না সম্ভবত। অনলাইনে কোন নিউজ কতজন পড়ছে সেটা দেখা যায়। প্রথম দিকে এসব নিউজ লোকে পড়ত, এখন লোকেরও আর আগ্রহ নেই। বলতে গেলে প্রায় পড়েই না। ডিসপ্লেতেও থাকে না এসব খবর। কোনার দিকে নিচে পড়ে থাকে। প্রিন্ট পত্রিকায়ও আজকাল এগুলো খুব অবহেলাভরে দায়সারাভাবে দেওয়া হয় নিউজগুলো। মানুষ এমনই বোধ হয়। খুব অভাবিত ঘটনাও বারবার ঘটতে থাকলে লোকে আগ্রহ হারায়। সেটাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
কিন্তু আজ এই নিউজ আমি করতে পারব না। আমার বন্ধুর মৃত্যুর খবর আমি কী করে লিখব। জানি এটা পেশাদার আচরণ নয়। কিন্তু মানুষ তো আর রোবট না। মানবিক ব্যাপারগুলো বেঁচে আছে বলেই আমরা মানুষ। অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না আজ। একটা অন্যায় দিনের পর দিন চলছে কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছে না। কী ভয়াবহ ব্যাপার! আমার মনে হলো এর প্রতিবাদ হওয়া উচিত। কিন্তু আমি কী প্রতিবাদ করতে পারি? নিজে রাস্তায় নেমে স্লোগান দেব? কেউ তো আসবে না! লোকজনের গা সওয়া হয়ে গেছে ক্রসফায়ার। কেউ কিছু মনে করে না। রাস্তায় নামলে মানুষ হাসাহাসি করবে হয়তো। এখন বরং কোনো দিন এরকম নিউজ না থাকলেই হয়তো চিন্তিত হয় মানুষজন। এই পরিস্থিতিতে আমি আমার পত্রিকায় অথবা অন্য কোনো পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে ক্রসফায়ার নিয়ে একটা লেখাই লিখতে পারি বড়জোর। এর বেশি আর কী-ই বা করার আছে আমার। নিজেকে খুব অসহায় লাগে। মূর্তির মতো বসে থাকি বিছানায়। যেন নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়েছি। অক্ষম আক্রোশে সমস্ত শরীর জ্বলতে থাকে আমার।
► আসছে নবম পর্ব
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন