কসাইখানার কবিতা
|| ১ ||
বারান্দার জন্য মায়া হয়।
অদ্ভুত রকম তাকিয়ে থাকা নিষ্প্রভ লাশের জন্য মায়া হয়।
বেদনা লাগে।
খুন হওয়া মানুষের কোনো বেদনা নাই আর!
কেউ জলে, কেউ আঞ্জুমান মফিদুলে, কেউবা হাসাপাতালে, মর্গে
হাঁসফাঁস করতে করতে বেওয়ারিশ পাতালে চলে গেল।
সকরুণ মায়া হয়ে উড়ে গেল অকাল মানবজনম।
বারান্দার জন্য মায়া হয়
বারান্দায় দাঁড়িয়ে লোকটি আকাশ দেখতে ভালবাসত।
আমাদের ভাই মাঠে গেছে ফিরে নাই আর।
আমাদের বোন ঘাটে গেছে ফিরে নাই আর।
আমাদের আত্মজ হাটে গেছে ফিরে নাই আর।
কসাইয়ের সপ্রতিভ চাপাতির নিচে তারা শুয়ে আছে
তারা ঝুলে আছে কসাইখানায় মাংসের ঢলে।
আকাশ খুন করে আততায়ী ঘুরে বেড়াচ্ছে
আইনি আকাশের তলে।
বারান্দাও খুন হয়ে যায়।
আকাশের বারান্দার জন্য মায়া হয়।
|| ২ ||
ঘুম থেকে উঠতেই নাকে-মুখে ছিটকে পড়ল
গত রাতে খুন হওয়া একটি তাজা লাশ।
তার চোখ তখনো কী বেঁচেছিল, কেবল আকুতি ছিল!
মরবার আগে তার ঠোঁট কী নড়েছিল!
অব্যক্ত অনেক কথা বলতে যেয়ে
কথারা স্পষ্ট হতে হতে
লাশের সুরতহালের মতো অস্পষ্ট হয়ে গেল!
গত রাতে ঘুমানোর আগে একটি লাশ বিছানায় ছিটকে পড়ল।
তার হাত ছিল, পা ছিল, বলবার সাহস ছিল, বুকে বল ছিল।
কিছু নাই আর, জগতের সমস্ত ভার নিরাপদে
তোমাদের ঘাড়ে রেখে সে খুন হয়ে গেল।
খুন হওয়া লাশেরা বড় মিস্টিক, তারা রহস্যঘেরা
অস্পষ্ট কবিতার মতো
অন্তরের দগ্ধ কান্নার মতো
বানানো কাহিনির ফাঁদের মতো
রহস্য তৈরি করে প্রতিদিন মানুষেরা অদ্ভুত লাশ হয়ে যায়।
আর তোমাদের চতুর চোখের স্বপ্নে এসে জানায় সমস্ত আকুতি,
তোমরা চোখ ফিরিয়ে নিয়ে
বিস্তীর্ণ প্রান্তরের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে ওঠো
অসহায় মাঠে বসে পড়ো মাথায় হাত রেখে।
তোমোদের ঘাড়ে অদৃশ্য চাপাতি এসে কোপ বসিয়ে দেয়
গুলি ভেদ করে চলে যায় তোমাদের লাল কলিজা।
তাজা খুনে ঝলমল করে ওঠে কসাইখানা।
তোমরা লাশ হয়ে যাও।
কসাইখানায় ঝুলতে থাকে মৃত ও জীবিতের মাংস।
|| ৩ ||
বাংলাবাজারে প্রতিদিন মাংস বিক্রি হয়।
ভাড়াটে খুনি দরদামের মতো মাংস নিয়ে দরদাম হয়।
কসাই গালে হাত দিয়ে বসে থাকে অদূরে, হাসে।
দামের বাহানা দেখে তার খুন করতে ইচ্ছা করে।
মাংসের কারবারে মাথামুণ্ডু, কলিজা, সিনা ও মগজের দাম একই রকম।
প্রথমে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে গলা কেটে মুণ্ডুটা আলগা করে।
তারপর হৃৎপিণ্ড খিঁচিয়ে বের করে।
মগজটা আলগা করে হাত-পায়ের রগ কেটে মাংস ছিলে ফেলে সহজে।
তারপর মাংসের বাগানে নিয়ে টাঙিয়ে রাখে।
প্রতিদিন বাংলাবাজারে মাংস বিক্রি হয়।
কসাইখানায় মানুষেরা দরদাম করে মাংস কিনে।
প্রতিদিন মানুষের সুস্বাদু মাংস খায়।
|| ৪ ||
মানুষ মাংসাসী প্রাণী।
কাকের মাংস কাক খায় না।
মানুষের মাংস মানুষ খায়।
মাংসের লোভে সমুদ্র পাড়ি যায়।
বনে শিকার করে।
মানুষ জবাই করে জলে ভাসিয়ে দেয়।
লাশেরা জল হয়ে যায়।
মাছেরা জলের রক্ত খেয়ে বাঁচে।
মানুষেরা মানুষের রক্ত খায়!
রক্ত, পুঁজ, হাড়-হাড্ডি সব খায় তারা।
কুকুরের সাথে প্রতিযোগিতায় নামে।
এমনকি খাকি বাহিনি, রাষ্ট্র ও সংবিধান
প্রতিদিন মাংসের প্রেমে পড়ে হাসে ও হাসান
দোকানে দোকানে তারা মানুষের মাংস খান!
সকাল বাজারে নিত্য কেনাবেচা হয়, কী প্রবল টান!
নাদান হয়ে ফুটে আছে অসংখ্য মাংসের বাগান!
|| ৫ ||
বর্ষার খল জলে ভেসে যায় অগণিত লাশ
হলদে কদমের ফুল শরীরে থাকে জড়ায়ে
বুকে চাপা ব্যথা নাই কারো, নাই দীর্ঘশ্বাস
কসাইখানায় খুনের সংক্রমণ পড়ছে ছড়ায়ে।
উড়ায়ে দিচ্ছে যারা, হেসে খেলে খাচ্ছে তারা
আততায়ী মুচকি হাসে, দেখে অন্ধক্ষমতার পাহারা!
লাশের শরীরে মশা মাছি উড়ে
সাপে-ব্যাঙে খায়
মানুষ কাঁদে না ভয়ে
কাঁদে স্বজন আর লাশেদের মা’য়।
লাশ ভেসে যায়
জলে
জলের চঞ্চলে
নাই কোনো দাগ
তোমার অঞ্চলে শুধু ব্যথা
মরণের ভাগ!
তোমারও রয়েছে হিস্যা খানিক এতসব খুনে
মাথা খায় আজ ধড়িবাজ মাথার উকুনে!
|| ৬ ||
হরেক জনের হরেক কাণ্ড চলছে দাপাদাপি
সবাই জানে বলছে না কেউ ভয়ে কাঁপাকাঁপি।
লুটের মালের আড়ত কোথায় চলছে কানাঘুঁষা
কার ঘাড়ে কয় গর্দান আছে সবাই যেন পোষা!
বিড়াল কিংবা কুকুর জানে বলতে কথা মানা
চোখ আছে কী, দেখতে কী পাও, তুমিও তো কানা!
কানার দেশে বধির সবাই শুনছো কী কেউ কিছু
চাপাতির ভয়, কিংবা গুলি, যম নিয়েছে পিছু!
বলতে বারণ দেখতে বারণ শুনতে কিনা মানা
সোনার দেশের প্রজারা সব চোখ থাকিতেও কানা!
কোন প্রাণীটা খায় তো বলো নিজের দেহ বেয়ে
রাষ্ট্র নামে দৈত্যটা যে আসছে নেচে ধেয়ে।
মাগো আমার সোনায় ছাওয়া বাংলাদেশটা কই
খুনের গন্ধে ঘুম আসে না, গুমের ভয়ে রই!
|| ৭ ||
এই নগরে কেন যে মরতে আসো তোমরা!
সকাল নাই বিকাল নাই হুড়মুড় করে ঢুকছে
তেলাপোকার মতো, কেঁচোর মতো, পোকামাকড়ের মতো
মানুষের মতো অসম্ভব স্পর্শকাতরতা।
লালসা, হিংসা, বাসনা, খ্যাতি, চকচক করা লোভ
প্রেম ও পরিহাস, রোদন ও বেদনাবোধ
নিঃসঙ্গ স্বপ্নবাজ পাখিদের অশেষ উড়াল
হারিয়ে যাবার আগেও বুঝতে পারে না
কবেই হেরে বসে আছে এই নগর ও উচ্চাশা।
সবুজঘন শস্যফল, মমতাকোল, রহস্যসিন্ধু ছেড়ে
মৃতনগরে লাশের সারি কেন যে লম্বা কর তোমরা!
জগতের এই বিশেষ অনুভূতির ভার বুঝতে পারে না
অতিউচ্চ দেয়ালে হাঁটতে থাকা টিকটিকির খসে পড়া লেজ।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন