গল্পের সেই শব্দটা

অ+ অ-

 

প্রতিদিনই হরেকরকম গল্প শুনি। বাসে শুনি, বাজারে শুনি, ফুটপাথে শুনি, ঘরে শুনি। আর কোথায় শুনি? মনে পড়েছে। আরও একটা জায়গা আছে গল্প শোনার। গণমাধ্যেম গল্প শুনি। নিজে যেহেতু গণমাধ্যমে কাজ করি তাই গণমাধ্যমে শোনা গল্পগুলো খুব মন দিয়ে শুনি না। কেন শুনি না আপনারা আন্দাজ করতেই পারেন।

আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয় লাগে বাসের গল্প, বাজারের গল্প, ফুটপাথের গল্প। এইসব স্থানের গল্পকাররা নিজের গল্পেরই চরিত্র। তারা বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলেন না। অন্যের অভিজ্ঞতা শুনে বা কল্পনা থেকে গল্প বলেন না। এটা আমার ধারণা। আপনার ধারণা আমি জানি না।

কামারখানার শ্রমিক যদি গল্প বলে তাহলে সেই গল্প হবে আগুনে পোড়া। খুব ধারালো। একদম জমাট। আবার এই গরমে গতর খাটা মানুষের গল্প পাবেন ঘামে ভেজা।
আজ সকালে অফিস যাবার পথে ছোট্ট একটা গল্প শুনেছি। গল্পের চরিত্র আবার আমি। মানে আমারই পেশা নিয়ে গল্প বলা হচ্ছিল। তাই কানটা একটু বেশই বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। এরকম গল্প যে আজই প্রথম শুনলাম তা কিন্তু নয়। আমাদের পেশা নিয়ে বা আমাদের চরিত্র নিয়ে আজকাল গল্প হয় সবচে বেশি। এই ধারার গল্প শুনতে শুনতে কানের পোকা মরে যাবার দশা।

তারপরও আজকের গল্প আমি কেন এত মন দিয়ে শুনলাম! আসলে গল্পটি আমাকে খুব টানেনি। গল্পের মধ্যে একটা শব্দ আমাকে দগ্ধ করেছে। আমাকে পুড়িয়ে কয়লা করে দিয়েছে। আবার এই কয়লা দিয়ে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলবে সেই আশা করবেন না যেন। হৃদয় পোড়া কয়লার কোন বাজারেই দাম নেই, আর এর মান এতটাই খারাপ যে এই কয়লা দিয়ে টাট্টিখানার হাগুও ঢেকে রাখতে চাইবে না কেউ।

থাক পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আলাপ করার দরকার নেই। আমি বরং আজ সকালে বাসে শোনা গল্পে ফিরে যাই। না গল্পের সেই শব্দে ফিরে যাই। শব্দটি এতটাই চমকপ্রদ আর নতুন যে আমি প্রথমে মুগ্ধ হয়েছিলাম। শব্দটি বাংলা। বাংলা ভাষার হাজার কোটি শব্দের মধ্যে কটিই বা জানি আমরা। না জানলেও লজ্জায় অর্থ বোঝার জন্য অভিধান খুলে বসি না আমরা। ভাবখানা এমন করি যে জানি কোন শব্দের কী মানে। যেমন-ধুচুনি। এই শব্দটির অর্থ কী আমি আজ অব্দি জানতাম না। আগে যে ব্যবহার করেছি তেমনও নয়। তবে শব্দটি বাংলা ভাষার একটি ডটডটের পুত বলে যে গালি আছে সেই ডটডটের পরিবর্তে ধুচুনি ব্যবহার করা যায়। ধুচুনির মানে হচ্ছে বাঁশের তৈরি একটি ঝুড়ি। চাল ধুতে যা ব্যবহার করা হয়।

যাকগে বাসে শোনা গল্পের সেই শব্দের কথা বলতে গিয়ে কত শব্দের যে আমি অপব্যবহার করছি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই যে ব্যবহার ও অপব্যবহার শব্দ দুটিকে টেনে আনলাম, এর একটা কারণ আছে। বাসের সেই দুই গপ্পোবাজ ওই শব্দটির চমৎকার ব্যবহার করেছেন আমি বলতে পারছি না। আবার অপব্যবহার করেছেন তাও বলা যাবে না। অপব্যবহার শব্দের অর্থ আমরা জানি। আমি না হয়ে আপনারা কেউ ওই গল্পের সেই শব্দটি শুনলে বলতেন চমৎকার ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু আমি অথবা আমার পেশা যেহেতু গল্পের বিষয়ে পরিণত হয়েছে তাই আমার কাছে চমৎকার মনে হয়নি। আসলে শব্দটির নিদারুণ ব্যবহার হয়েছে বলতে পারলেই আমি খুশি হবো।

আমাকে বাজারে মজমা জমিয়ে মলম বিক্রেতা ভাবছেন তো? মলম দেখানোর আগে হাজার কথা বলছি তাই না? আমার আসলে আজ এমন একটা মলম দরকার যা হৃদয়ের সব জ্বালা-পোড়া নিমেষেই বরফের মত শীতল করে দেবে। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি গল্পটি শুনে বা গল্পের সেই শব্দটি শুনে কতটা আহত হয়েছি। বাস থেকে নেমেও দুইবার ওই লোক দুটোর দিকে তাকিয়েছি। প্রথমবার চমৎকার একটি শব্দ শোনানোর কৃতজ্ঞতায় আর দ্বিতীয়বার ধিক্কার জানাতে। না জনাব, ওই দুই ভদ্রলোকের প্রতি আমার কোন ক্ষোভ নেই। আমি ধিক্কার দিতে চাই নিজেকে। নিজের পেশাকে।

অফিসে ঢুকে বরাবরই ক্যান্টিনে গিয়ে এককাপ চা খাই। খুব আয়েশ করে। তারপর নিজের ডেস্কে ফিরে কম্পিউটার অন করে ফেসবুক বা কিছু পত্রিকায় চোখ রাখি। আজ চা খেতে গিয়ে মনে হয়েছে ক্যান্টিনের ছেলেটার কানের নিচে পাঁচ আঙুলের দাগ হয় এমন কড়া করে সতেরটা থাপ্পড় মারি। চায়ের প্রথম চুমুকের সঙ্গেই যেন বাসে শোনা গল্পের সেই শব্দটা তেলাপোকা মারা বিষের মত পেটের মধ্যে চলে গেলো। জিহ্বা থেকে পাকস্থলি পর্যন্ত জ্বালাপোড়া করছে। দ্বিতীয় চুমুক না দিয়েই বেসিনে গিয়ে বমি করার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। শেষ কবে বমি করেছি মনে নেই। বমি করা অনেকেরই অভ্যাস। বিশেষত নারীদের। তারা চাইলেই বমি করতে পারেন। আর পারে শিশুরা। আমার মত চালশে বমি করবে কিভাবে? তবে বমিটা হলে খুব ভালো লাগতো।

কয়েকবার ওয়াক ওয়াক করে কিছু থুতু বের হয়েছে। কিন্তু থুতুর সঙ্গে বাসে শোনা গল্পের সেই শব্দটি বের হলো না। হবে কিভাবে? আগেই তো বলেছি শব্দটি তেলাপোকা মারার ওষুধের মতে পাকস্থলিতে গিয়ে বসে আছে। সহকর্মি জাহেদ সেলিম আমার দশা দেখে কিছু না বুঝলেও এগিয়ে এলেন। শরীর খারাপ লাগছে না, মেজাজ খিচড়ে আছে, কিছু থুতুসহ আমার জবাবে লোকটা দাচোকাবো হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে খ্যাক খ্যাক করে বললেনমেজাজ খিচড়ে গেলে কেউ বমি করে জানতাম না। কোথায় মাথা মগজ আর কোথায় পাকস্থলি।

আমি জাহেদ সেলিমের জবাবে বাসে শোনা গল্পের সেই শব্দের কথা বলবো ভাবছিলাম। কিন্তু লোকটা বেসিন থেকে ক্যান্টেনের রান্নাঘরে গেলেন। দুই হাতে দুই কাপ চা এনে টেবিলে বসলেন। বাড়তি চা যে আমারই জন্য তা জানি। রোজই আমরা একসঙ্গে চা খাই। আজ আমার মেজাজ অস্বাভাবিক তাই জাহেদ সেলিমের জন্য অপেক্ষা না করেই ক্যান্টিনে গিয়েছিলাম।

ভাই মেজাজটাকে তিরিক্ষি করে অফিসে এলেন? ঘটনা কী। বাড়ি থেকে ভাবি কল করেছিল? পাসপোর্টের বিষয়ে কথা হয়েছে মনে হয়? জাহেদ সেলিম শুধু সহকর্মি নন। আমার পারিবারিক বন্ধুও অনেক বছর ধরে। তাই আমার যত খুঁটিনাটি সবই তিনি জানেন। ফলে এমন প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি মেজাজ বিগড়ানোর কারণ জানতে চাইবেন খুব স্বাভাবিক।

আমি চায়ে চুমুক দিচ্ছি না দেখে জাহেদ সেলিম আবারও আলাপ জুড়ে দিলেন। শোনেন আপনি পাসপোর্ট করা নিয়ে যে বাহানা শুরু করেছেন ভাবির জায়গায় আমি হলে আরও বাজে ব্যবহার করতাম। চারটি পাসপোর্টে আপনার খরচ আর কত হবে। চাকরি করেন, পাশাপাশি লেখালেখি করেন মাস শেষে কিছু তো বাড়তি টাকা থাকে আপনার। আমার দশা তো জানেন।

আমি মুখ না খুললে জাহেদ সেলিম আলাপ এগিয়ে নিতে এমন সব বিষয় তুলবে যা মেজাজ আরও বিগড়ে দেবে। লোকটার সঙ্গে আমার স্ত্রীর এই এক জায়গায় খুব মিল। কথার পর কথা আর যুক্তির পর যুক্তি। একেবারে সাল তারিখ ওয়াক্ত সব তার মুখস্ত। তবে তাদের দুজনের অমিলও আছে একটা। আমার স্ত্রী বলতে শুরু করলে আমাকে কথা বলার সুযোগই দেয় না। কিন্তু জাহেদ সেলিম কথা বলেন খুব ধীরে। মানে চাইলেই তার একটা শব্দ শুনে দ্বিতীয় শব্দের আগেই আমি ঢুকে পড়তে পারি। এতটাই শান্ত আর গোছালো।

জাহেদ সেলিম আজ অফিসে না এলে আমি কল করেই বাসে শোনা সেই গল্পের শব্দটা নিয়ে আলাপ করতাম। খুব ঘনিষ্ট কেউ না হলে ওই শব্দটা নিয়ে কথা বলা মুশকিল। আমাদেরই পেশার বেশিরভাগ মানুষ শব্দটা শুনেই বলবেপাবলিক তো পাবলিক, সাংবাদিকদের মর্যাদা কিভাবে দেবে। ওরা যদি জানতো আমরা কোন পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করছি তাহলে দুইবেলা টিভি-পত্রিকায় সালাম করতো।

অথচ বাসে শোন গল্পের সেই শব্দের মধ্যেই যে আমাদের পেশারই ভিন্ন চিত্র চরিত্র ফুটে উঠেছে তা নিয়ে তারা একবারও ভাববে না। চিকিৎসকদের কসাই বলেন অনেকে। এটা নিয়ে চিকিৎসক সমাজের ক্ষোভের অন্ত নাই। কোন কাজ পারে না বলে হাইস্কুলে-কলেজে শিক্ষকতা করে অনেকই, শিক্ষকতা পেশা নিয়েও কথা হয় এমন। বিসিএসে টেকে নাই আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায় একথাও আমি অনেকের মুখে শুনেছি। যার নাই কোন গতি। কোন পেশাই আসলে প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়।

কিন্তু মহাশয় আজ বাসে শোনা গল্পের গল্পের সেই শব্দটি আমার মনের মধ্যে কিসের প্রতিরূপ এঁকে দিয়েছে তা বলতে পারছি না। প্রতিটি শব্দেরই একটা চিত্র থাকে। চিত্র না থাকলে কল্পচিত্র বা চিত্রকল্প থাকে। কিন্তু বাসে শোনা গল্পের সেই শব্দটির কোন ছবি আঁকতে পারছে না আমার মন। কল্পনাপ্রবণ একজন মানুষ হিসেবে আমি ভয়ানক অস্বস্তিতে আছি। জাহেদ সেলিমকে কিভাবে বোঝাবো আমার এই দুর্দশার কথা।

জাহেদ সেলিমই আমাকে উদ্ধার করলেন। শোনেন আজ একটা গল্প শুনলাম অফিসে আসার পথে। দুই লোক বাসে গল্প করছিল। গণমাধ্যম শব্দকে ওই লোকেরা কী বলেছে জানেন?
আমি অবাক জাহেদ সেলিমও ওই গল্প শুনেছে। মিরপুর থেকে বনানী আসার বাসে? আমি শুনলাম নতুনবাজার থেকে বনানী আসার বাসে! কী আশ্চর্য। সব বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে, প্লেনে সবাই এই একই গল্প করছে আর গণমাধ্যম কর্মিদের *দিমাধ্যম কর্মি বলছে?

জাহেদ সেলিম বললেনঠিকই আছে আমাদের কজন নেতা আর কিছু প্রতিষ্ঠান যা শুরু করেছে তাতে শব্দটা জুতসই। কী বলেন ভাই?

পেটের মধ্যে তেলাপোকা মারার বিষের মত বাসে শোনা গল্পের সেই শব্দটা যেন দুর্বল হয়ে গেছে এতক্ষণে। তাই রাগ-ক্ষোভ কিছুটা কমলেও একেবারে বিলীন যায়নি আমার। জাহেদ সেলিমের চা শেষ। আমরা নিউজরুমে চলে আসি। কিন্তু জাহেদ সেলিমকে বলা হলো না আমিও গল্পটা শুনেছি। বিশেষ সেই শব্দটা সারাজীবন আমাকে পোড়াবে। *দিমাধ্যম কর্মি। আমি *দিমাধ্যম কর্মি!