নির্ভয় কিংবা আমার স্বর্গে যাওয়ার সিঁড়ি!

অ+ অ-

 

আমাদের ঘরের সামনে উঠান, তারপর জংলা বাগান, সামনে ধানের ক্ষেত। আর একটু বামদিকে ঘুরলে দুটো নারকেল গাছের পাশে কয়েক প্রজাতির প্রাচীন বাঁশঝাড়। বেশ কয়েকটা ঝাড়। সবমিলে ছোটখাটো বাগান। ঝাড়গুলো পরস্পরের কাছ থেকে বৃত্তাকারে সরে সরে থাকায় মাঝখানে একটা ফাঁকা মতোন জায়গা। ছায়াঘন এবং স্যাঁতস্যাঁতে। অন্য কোনো উদ্ভিদ এমনকি ঘাসও নেই। জায়গাটা আমার খুব আপন এই কারণেদুপুরে ভাত খেয়ে বিকালে খেলার আগ পর্যন্ত সেখানে সবকিছু থেকে নিজেকে আড়াল করা যেত চমৎকারভাবে। আমি তা করতামও প্রায় প্রতিদিন।

সব থেকে ভালো লাগত শীতের পর যখন ঝরে ঝরে পুরো বাগানজুড়ে বাঁশপাতার স্তর জমে যেত। এমনই কোনো এক পাতাঝরা সময়ে আমার নিভৃতযাপনে সঙ্গী হয়েছিলো দূর থেকে আসা এক বন্ধু। ঘুরতে ঘুরতেই কি খেয়ালে যেন সে গম্ভীরমুখে বলল, এই এখানে কয়েকটা বিশেষ বাঁশ আছে, যেগুলোর কঞ্চিতে পা দিয়ে দিয়ে স্বর্গে যাওয়া যায়। ব্যাস এটুকুই! সে আর কিছু বলেনি। আমিও তার কথায় বালকের বিস্ময় ঘোরে ঝাড়গুলো দেখতে দেখতে কিছু জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গিয়েছিলাম। এই ঘোর আমার বহুদিন কাটেনি, সম্ভবত এখনো না।

সে চলে যাওয়ার পর আমি প্রায় প্রতিদিন সেই বিশেষ বাঁশ খুঁজতাম একা একা। অনেকগুলোতে চড়েছিও। কিন্তু মায়াবতী সেই উদ্ভিদের সন্ধান আর মেলেনি। তবে এরপর থেকে এক অদ্ভুত ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। ঝাড় থেকে বাঁশ কাটতে গেলেই আমি আতংকিত বোধ করতাম। এইবুঝি সেই বাঁশ কাটা পড়ল। আমার এই মানসিক অবস্থা কাউকে বলাও যাচ্ছিল না। খুব ভালো করেই জানতাম সবাই হাসবে। তা ছাড়া এমনিতেই আমার ছেলেমানুষি কল্পনা আর অদ্ভুতুরে কথাবার্তায় সবাই মজা করত। তাই কাটার পর সবাই চলে গেলে গোড়ায় থেকে যাওয়া অংশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম একা একা। এই অবসেশন থেকে আমি আজও মুক্তি পাইনি। বাড়িতে গেলে আমি সেখানে যাই। কবে থেকে কেনইবা আমি কাঠের টুকরো কেটে মুখ আর মুরতি বানাই, তা বলতে গিয়ে সম্ভবত ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে গেলো। আবার হয়তো না!

২০০৫ সালের শেষের দিকে আমি নানা কারণে বিক্ষিপ্ত এবং একই সঙ্গে বুঝদার এক কিশোর। গ্রামের বাড়ি ছেড়েছি আরো আগে, ১৯৯৯ সালে। মাঝেমধ্যে যাই। গ্রামের বন্ধুদের স্থলে শহরে বন্ধু জুটে গেছে বেশ কয়েকজন। তবে তখনকার ওই মফস্বলে যার সাথে আমার এক অনবদ্য হৃদ্যভাব গড়ে উঠেছিল সে আমার থেকে অন্তত চার-পাঁচ বছরের বড়। এই হৃদ্যতা পূর্ণ রূপ পায় ২০০৩ সালের পর আমি কলেজে ভর্তি হলে। সমবয়সী কাছের বন্ধু থাকলেও আমার চিন্তা আর আজগুবি কল্পনার চর্চা সব থেকে বেশি হতো দাদার সাথে। আমরা পড়াশোনা করতাম কম, বেশি করতাম বাঁশি সংগ্রহ। নাটকের সংগঠনও করতাম। গান লিখতাম, দাদা সুর দিত। ছবি আঁকতাম, কবিতা লিখতাম, দাদা বলত বেশ হয়েছে। কিন্তু জানতাম এবং বেশ বুঝতাম, যা হয়েছে তা তেমন কিছু না। কিন্তু আমাদের সময় কাটত চমৎকার। তাই কিছু না হলেও এগুলোই যাপন করতাম প্রতিদিন। এসবেরই ফাঁকে একদিন আমার জন্য ঘটে যায় বিশেষ কিছু।

মনে আছে, ছবি আঁকার জন্য পেন্সিল কাটছি এন্টিকাটার দিয়ে। হঠাৎই অনুভব হলো আমার খুব ভালো লাগছে। কাটারের ধারালো ব্লেড পেন্সিলের কাঠ তুলে নিচ্ছে নির্দিষ্ট শেইপে। একের পর এক টুকরো খসে পড়ছে। আমার ভালো লাগছে। আগেও তো কেটেছি অনেক, এমন তো হয়নি! আমি থামছি না। কখন যেন পুরো পেন্সিল কেটে ফেললাম, সেটার কথা এক মুহূর্তের জন্যও আমার মাথায় অন্য কিছু আসেনি। তন্ময় হয়েছিলাম পুরো সময়। এরপর যেন নেশা হয়ে গেল। আমি পেন্সিল কাটতে লাগলাম।

একদিন হঠাৎই আবিস্কার করলাম পেন্সিলের কাঠে আমি একটি মুখ তৈরি করে ফেলেছি। পরেরটি চেষ্টা করলাম সচেতনভাবে। এটা আরো ভালো হলো। একটা প্যাটার্ন দাঁড়িয়ে গেল। দেখলাম এরপর আমি পেন্সিলের কাঠে এন্টিকাটার দিয়ে অনায়াসেই মুখ তৈরি করতে পারছি। লাকরির দোকান থেকে পাতলা টুকরো কাঠ নিয়ে এলাম। একই প্যাটার্নে ছোট ছোট কয়েকটি মুখ বানালাম। লকেটের মতো হলো একটা। কয়েকজন দেখল, বলল বাহ! খুব ভালো হয়েছে।

আমি বুঝতে পারছিলাম কাটাকুটির এই কাজটা আসলেই আমার ভালো লাগে। সব থেকে দারুণ ব্যাপার হলো, আমি নিমগ্ন হয়ে যেতে পারি। অন্য আর কিছুতেই এমন হয়নি তখন পর্যন্ত। এতোটা টানেনি। বুঝলাম, আমাকে আরো বড় কিছুর ওপর চেষ্টা করতে হবে। এর মধ্যে কিভাবে কিভাবে যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলাম সংস্কৃত বিভাগে। ভালো। ভর্তি হয়ে ক্লাস করছি কিন্তু টানছে না তেমন। এর বছরখানিক পর অবশ্য সংস্কৃত পাঠ নিয়ে আমার পুরো চিন্তা পাল্টে যায়। সে অন্য প্রসঙ্গ।

আগে থেকেই আমার ছবি আঁকার ঝোক ছিল আর পেন্সিল আর টুকরো কাঠ কেটে নতুন আস্বাদন পেয়েছি। ফলে চারুকলায় ঢু মারতাম প্রায়ই। চারুকলায় ভর্তি পরীক্ষা পরে নিতো। তাই ভাবলাম চেষ্টা করব। কিন্তু আমি তো ওইভাবে কখনো ছবি আঁকা শিখিনি। ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন একবার বরিশাল চারুকলায় ভর্তি হয়েছিলাম কিন্তু ভালো না লাগায় মাস তিনেকের বেশি যাইনি। তারপরও পরীক্ষা দিলাম আর অকৃতকার্য হলাম। তবে সুযোগ হলে আমি যে ভাস্কর্য নিয়ে পড়তাম তা নিশ্চিত।

এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রীষ্মের ছুটি দিল। গ্রামের বাড়িতে গেলাম। বন্ধুবান্ধব তেমন নেই। যারা ছিলো তারা বাড়িতে থাকে না। একা একা ঘুরছি বনে-বাদারে। ঘুরতে ঘুরতে যথারীতি হাজির হলাম বাঁশ বাগানে। দেখছি। পুরনো অভ্যাসবশত চোখ আটকে গেল কেটে নেয়া বাঁশের অবশিষ্ট গোড়ার দিকে। দারুণ। পেন্সিলের থেকে বড় কোনো মাধ্যমের ওপর মুখের অবয়ব দেয়ার যে পরিকল্পনা আমার ছিলো, সেই মাধ্যম আমার চোখের সামনে দেখতে পেলাম। ঘরে গিয়ে দা নিয়ে এসে কাটলাম কাঁচা দেখে একটা গোড়া।

ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম যে এ জিনিস এন্টিকাটার দিয়ে আদৌ কাটা সম্ভব কিনা! তারপরও চেষ্টা করলাম। মজার ব্যাপার আমি পেরেছিলাম। জিনিসটা একেবারে খারাপও হয়নি। নতুন উদ্যোমে কেটে আনলাম আরো কয়েকটা। পরপর তিনটা তৈরি হলো। তিনটা তিন রকম। দেখলাম, আরে! এতো বাবা-মা আর দুষ্ট ছেলের একটা পরিবার হয়ে গেছে। এরপর আরো একটা বা দুইটা তৈরি হলো কয়েকবারের ছুটিতে। কয়েকটা চুলের কাটাও বানিয়েছিলাম, যেগুলো হারিয়ে গেছে।

ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর বাড়িতে গিয়ে দেখলাম বহু গাছ ভেঙে গেছে। এরমধ্যে ছোটমতো একটা মেহগনি গাছের গোড়া আমি কেটে নিয়ে এলাম। এই প্রথম বাশের থেকে ভিন্ন তুলনামূলক বড় মাধ্যমে একটা কিছু তৈরি হলো। এরপর বহু বছর আমি আর কিছু বানাইনি। তখন আমি সংস্কৃতের মনযোগী ছাত্র। রেজাল্ট ভালো হচ্ছে প্রতি সেমিস্টারে। বিশেষ করে এমন একজন গুরুর সন্ধান পেলাম যিনি সবার কাছে মান্য এবং সংস্কৃত নিয়ে আমার বোঝাপড়ার প্রকাশ্য প্রশংসাকারী। আমার নারায়ণ স্যার। পড়াশোনার মধ্যে এই ডুবে যাওয়ায় আমি অন্য আর কিছুতে মনোযোগ দিতে পারিনি। তবে সত্যি হলো আমি প্রায়শই ভাবতাম, একদিন দারুণ কিছু বানাতে হবে কাঠ দিয়ে। কারণ কাঠ কেটে কেটে যে মগ্নতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল, যে শান্তি দিয়েছিল তা অনন্য। এরপর আরো বহু বছর কেটে গেছে।

দৃশ্যমান জগতের সফলতা-ব্যর্থতা দুটোই দেখে ফেলেছি। সন্তানের জনক হয়েছি। কিন্তু নতুন করে কাঠ দিয়ে আর কিছু তৈরি করা হচ্ছিল না। অবশেষে এই বছর মানে ২০২৩ সালে এসে কাঠ কাটার মনের মতো কিছু ছুরি হাতে এলো আমার বোনের কল্যাণে। ব্যাস, আমার আর কি চাই! সন্তান পালন ছাড়া আর কোনো কিছু করছি না। চাকরি ছেড়ে দিয়েছি তিন বছর আগে। পেশাগত ব্যস্ততা নেই। সমিল থেকে কাঠ কিনে আনলাম। ইন্টারনেট ঘেটে দেখলাম উড কারভিংয়ের জন্য অন্যতম পপুলার কাঠ হলো বাসউড [basswood]। এই কাঠ কাটার জন্য বেশ নরম।

সব মিলিয়ে নতুন নতুন চরিত্র তৈরি করতে লাগলাম। ছেলে এনিমেশন দেখে ট্যাবে-মোবাইলে। ভাবলাম ওর দেখা এসব চরিত্র তৈরি করা যায় কিনা। তৈরি হলো ফড়িংবাবু আর খুকু। আমার উদ্দেশ্য ছিল ও যা স্ক্রিনে দেখছে, সেটা কোনোভাবে বাস্তবে ওর হাতে তুলে দেয়া যায় কিনা। ভালো লেগেছিলো ফড়িংবাবু হাতে পেয়ে আমার ছেলের খুশি দেখে। এখানে একটা বিষয় বলে রাখা ভালো যে, আগে আমি যখন কাঠ বা বাঁশ কাটতাম তখন বিশেষ কিছু তৈরির আমার কোন পরিকল্পনা থাকত না। এখনো যে থাকে তা না। কাটতে কাটতে যখন দেখতাম কাটার আর কিছু নেই তখন বুঝতাম জিনিসটা এবার হয়েছে। তবে এখন মাথায় কিছু একটা চরিত্র আগে থেকে ঠিক করেও তৈরি করতে পারছি।

নিজেকে প্রশ্ন করে দেখেছি যে কেন আমি এগুলো বানাচ্ছি। এর সব থেকে সহজ উত্তর, আমার ভালো লাগে। কাঠ কাটার সময় আমার সমস্ত ভয়, আতংক, উদ্বেগ, বিষণ্নতা এমনকি ভালো থাকার কামনাও উধাও হয়ে যায়। আর অন্যভাবে দেখলে আমি ভীষণ স্মৃতিকাতর মানুষ। আমি হয়ত কোনো না কোনোভাবে আমার স্মৃতির মানুষগুলোকে আবার ছুঁয়ে দেখতে চাই। স্বপ্নের মুখগুলোকে বাস্তবে দেখতে চাই। ওই যে বাঁশের কথা বলেছিলাম, যেগুলো বেয়ে বেয়ে স্বর্গে যাওয়া যায়, আমার কেন যেন মনে হয় সেগুলোকে কেটে ফেলা হয়েছে। আর সেগুলোকে রক্ষা করতে না পারলেও, কেটে নেয়ার পর থেকে যাওয়া গোড়াটুকু আমি ধরে রাখতে পেরেছি। সেগুলো এখন কয়েকটা চরিত্র হয়ে আমার কাছে থেকে গেছে।