আমরা কি পারবো এই আত্মত্যাগের মূল্য দিতে?

অ+ অ-

 

২০১৭ সালে আমি যখন ভর্তি পরীক্ষার কোচিং করতাম, সেসময় কোচিং-এর এক শিক্ষক বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে যদি ফেসবুক থাকতো তাহলে দেশ কখনো স্বাধীন হতো না। ২০১৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলন পাই। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে রক্তে আগুন লেগেছে মতো অবস্থা, স্বাভাবিকভাবেই সেই আন্দোলনে আমার ভূমিকা বেশ সরব ছিল। যতদূর মনে পড়ে, আন্দোলন চলাকালে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয় এবং কোন এক সন্ধ্যাবেলা ঘুম ভেঙ্গে জানতে পারি, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার নয় পুরোপুরি বাতিলই করে দিয়েছেন। অনভিজ্ঞ মস্তিষ্ক হলেও সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম, এগুলো অভিমানের কথা। আন্দোলন সফল হলো কী হলো না বোঝার আগেই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি।

তারপর এলো নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। সেখানেও সরব উপস্থিতি ছিল আমার। কিন্তু এবারও আন্দোলন কয়েকদিনের মাথায় থামিয়ে দেওয়া হয়, আন্দোলন বিফলে গেল কি-না তা বুঝে উঠবার আগেই। এই দুটো ঘটনায় আমার মনে বেশ ভালোভাবে গেঁথে গেল, ফেসবুক চালানো জেনারেশন দিয়ে হয়ত আন্দোলন হয় না।

তাই এ বছরের জুলাইয়ে যখন বাংলা ব্লকেড দিয়ে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন জোরদার রূপ নেয়, ভেবেছিলাম এটিও ব্যর্থ হবে। অফিসে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে ফেসবুকে চোখ বুলাতাম, আজ কোথায় ব্লকেড হচ্ছে তা জানতে। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন যৌক্তিক তো বটেই কিন্তু এদেশে কবে কোন আন্দোলন সফল হয়েছে, সেই নৈরাশ্য থেকে একপ্রকার উদাসীনভাবেই জুনিয়রদের আন্দোলনের ছবিতে চোখ বুলাতাম।

আমার বাসা ছিল আজিমপুরে, গুলশান থেকে আজিমপুরের বাস শাহবাগ দিয়েই যেত। তাই নিজে আন্দোলন করতে না পারলেও আন্দোলনরত মানুষগুলোকে এক নজর দেখার খুব সাধ হতো! যেন সেখানে আমার অতীতের হারানো সময়গুলো দেখতে পাবো। কিন্তু বাস যখন শাহবাগ পৌঁছাতো, তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। আন্দোলনের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকতো না।

প্রথম বর্ষের টগবগে রক্তের আগুন নিভে ব্যাঙের রক্তের মত ঠান্ডা হয়ে গেছে। আন্দোলন দেখলেই কেবল একটি গানই মনে বাজতো, কী আর এমন হবে, কে পেয়েছে কবে, স্বপ্নগুলো স্বপ্ন হয়েই রয়।

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজাকার ডাকাকে কেন্দ্র করে যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাতের বেলা মিছিল নিয়ে বের হয়, সেদিন ভেবেছিলাম, আবারও বুঝি শেষের হাওয়া বইতে শুরু করলো। আবারও ক্ষমতাসীনদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিপেটা করা, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া এবং হল ভ্যাকেন্টের মাধ্যমে একটি যৌক্তিক আন্দোলনের অযৌক্তিক পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে কি!  

পরদিন অফিস যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশের টহল। বুঝলাম, আইজ একটা বিরাট ফাডাফাডি হইবো। আমার আশংকা সত্য প্রমাণ করে শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো ছাত্রলীগ। রাতের বেলা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নেমে আসে বিপদের কালো ছায়া। ফেসবুক স্ক্রল করছি আর লাইভ দেখছি, ভিসির বাসায় বন্দি অবস্থায় কী ভয়ংকর রাত পার করছে আমার সহপাঠী, জুনিয়ররা। আবু সাইদের মর্মান্তিক মৃত্যু, আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়া এবং প্রশাসনের নিশ্চুপ ভূমিকা সবই ক্ষেপিয়ে তুলছিলো শিক্ষার্থীদেরকে, আমাদেরকে। বিশেষ করে, আবু সাইদের মৃত্যু সব সচেতন নাগরিকের চেতনা দণ্ডকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। তবে এখনো এমন অনেক মানুষ আছেন যারা একটি গণতান্ত্রিক দেশে অধিকার চাওয়ার আন্দোলনে কোন শিক্ষার্থীর বুক পেতে দাঁড়ানোকে পুলিশের গুলি চালানোর প্রণোদনা হিসেবে ধরে নিয়ে তা জাস্টিফাইও করেছেন, তা বিভিন্ন টকশোতে আমরা দেখেছি।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হল ছাড়া করবার পর তাদের সহচর হিসেবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামলো, নামলো স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। পুলিশের গুলিতে পথে মারা পড়লো কতশত তাজা প্রাণ। চোখের পলকে পুরো বাংলাদেশ হয়ে গেল রণক্ষেত্র। ঢাকার প্রতিটি জায়গায় গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড আর টিয়ারশেলের আওয়াজ। আর তারপরের কাহিনি তো আরও ভয়াবহ। সারাদেশে একযোগে চলে গেল ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। অবশ্য এর আগেই মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ইন্টারনেট ব্ল্যাকাউটের সময়টায় মিডিয়ার সামনে চাতক পাখির মত বসে থেকেছি, কী হচ্ছে জানতে। প্রথম দুইদিন কয়েকটি চ্যানেলে সংঘর্ষের খবর দেখালেও পরবর্তীকালে সব চ্যানেলেই বইতে থাকে শান্তির সুবাতাস। দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতির বাম্পার ফলন দেখাতে দেখাতে বোধ করি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সবই যখন স্বাভাবিক তাহলে কারফিউ থামছে না কেন? টানা পাঁচদিন ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখার পর আবারও সীমিত পরিসরে চালু করা হলো ব্রডব্যান্ড। প্রথমদিন অফিসে গিয়ে ভিপিএন চালু করে ফেসবুকে ঢুকলাম। একে একে মৃত্যুর খবর আসতে লাগলো ফেসবুকে, ইন্টারনেটে। মনে হচ্ছিলো, ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে আছি।

এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবি সরকার পূরণ করে নেয় তবে কত প্রাণের বিনিময়ে তা বেমালুম ভুলে যেতে চাইলো দেশের কিছু শান্তিপ্রিয় জনতা। কারণ একটা আধা-বিকশিত জাতি কতদিন আর এই আন্দোলনের ধকল সইতে পারে? বিগত বছরগুলোতে আন্দোলন করে কারো কোন দাবি-দাওয়াই পূরণ হয়নি কিংবা পূরণ করার আশ্বাস পর্যন্তই বিষয়টি ঠেকেছে। তাই অনেকেই ভেতরে ভেতরে চাইছেন, এভাবে কি কিছু আদায় হবে, শুধু শুধু আরও কতগুলো প্রাণের অপচয় হওয়া ছাড়া? তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি নেতিবাচক বলবো না কারণ বিগত ১৫ বছর যে প্রচণ্ড হতাশায় নিমজ্জিত জাতিতে আমরা পরিণত হয়েছি, সবকিছুর উর্ধ্বে যেকোনো মূল্যে আমরা শান্তিকেই বেছে নেব তা যতই সাময়িক হোক না কেন।

পুলিশ যত মানুষ মারে, তত বাড়ে শিক্ষার্থীদের সাহস, তারা হয়ে উঠে অকুতোভয়। অন্যায় প্রতিহত করার এক প্রচণ্ড জেদ চেপে বসে শিক্ষার্থীদের ওপর। ছয় সমন্বয়ক সেই সাহসে আরও ভরসা জুগিয়েছেন, জুগিয়েছেন বিশ্বাস।

ক্রমশ কোটা আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। জানের ক্ষতি হলো, মালের ক্ষতি হলো। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মত অনেকেরই চোখ ভিজে আসলো, মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে।

হাসিনার পতন চেয়ে দলে দলে মানুষ একাত্ম হয় শিক্ষার্থীদের ডাকে। কোন রাজনৈতিক দলের অংশ না হয়েও একদল শিক্ষার্থীর ডাকে সাধারণ মানুষের জীবন বাজি রেখে বেরিয়ে পড়াই বলে দেয়, এই দেশের অধিকার বঞ্চিত মানুষেরা এতদিন একটি ডাকের অপেক্ষাতেই ছিল। ঢাকার পথে পথে শেখ হাসিনার এত উন্নয়নের চিহ্ন লেগে আছে, তবুও কেউ নিবৃত্ত হচ্ছে না। মাথার ওপর মেট্রোরেল হাতছানি দেয় কিন্তু এতদিনে মানুষ বুঝে গেছে, রক্তের দাম মেট্রোরেলের চেয়েও অনেক অনেক বেশি। বোঝেনি শুধু সরকার।

এত গ্রেফতার, এত গুলি, এত খুন, এত উসকানি। রাতের বেলা বাসায় বাসায় চলতো পুলিশের রেইড, তথাকথিত স্বাধীন দেশে গোপনীয়তার কোন ধার না ধেরে চেক করা হতো ফোন। লাল না কালো, কোন প্রোফাইল পিকচার ফেসবুকে দেওয়া হবে সে ব্যাপারেও চলতো সরকারের কড়া নজরদারি। দেশের প্রতিটা মানুষ জানতো, এ যাত্রায় হেরে ফিরলে কেউ আর বাঁচতে পারবে না। কেউ মরে গিয়ে বেঁচে যাবে, কারো স্থান হবে জীবিতদের কবরস্থান আয়নাঘরে।

যেদিন শিক্ষার্থীরা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলো, মনে শংকা ছিল, এত বড় কর্মসূচি খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল কি-না! সারাদেশে শতাধিক মৃত্যুর পরও মনে হলো, এই আন্দোলন তবু থামবে না। সরকারের ক্ষমতাসীন বাহিনীকে মাঠে নামানোর পরেও ৭ মিনিটে খালি করা গেল না ঢাকা শহরকে। মানুষ মরলো, পুলিশ করলো, ছাত্র মরলো, ছাত্রলীগ মরলো। বহাল তবিয়তে বেঁচে রইলেন কেবল একজনই। তাদের বড় বড় কথার খই ফোটা বন্ধ হয়েও হচ্ছিল না।

অবশেষে আসলো সেই কাঙ্ক্ষিত দিন, যেদিন জোরদার কারফিউয়ের ডাক দেওয়ার সাথে সাথেই ঘোষণা করা হলো লং মার্চের। রাতে চোখে একফোঁটা ঘুম নেই, শুধু দুঃস্বপ্ন। যদি আজকের এই কর্মসূচি সফল না হয় তবে কি সব শেষ? এতগুলো প্রাণ কি তবে পথেই হারিয়ে যাবে?

সকালবেলা আবার বন্ধ হলো ইন্টারনেট। বুঝলাম, আমার ভাইবোনদের বুকের ওপর গুলি চলছে হরদম; আজ ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হবে রক্তে। সেখানে বেঁচে থাকবে যারা এখনো বিশ্বাস করে হীরকের রাজা ভগবান আর বুকভরা কষ্ট নিয়ে দিনযাপন করবে আমার মত স্বার্থপর ভীতু মানুষেরা।

দুপুর দুইটায় খবর দেখতে ছুটলাম সেনাপ্রধান কী ভাষণ দেয় তা জানতে। কিন্তু সেদিন টিভি খুলে যা দেখলাম আমার সারাজীবনে এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য কোনদিন দেখিনি।

রাস্তা ভর্তি আনন্দিত জনতার ঢল, অন্য সুরে গান গাইছে মিডিয়া, নিউজ প্রেজেন্টারদের চোখে-মুখে হাসির ছটা। যেন অনেক যুগ পর হাসতে পেরেছে তারা। সেদিনের অনুভূতি ভাষায় বর্ণনা করার মত না। শিক্ষার্থীদের ডাকে পায়ে হেঁটেই লাখ লাখ মানুষ ছুটে এসেছে লং মার্চে এক হীরক রাজার পতন ঘটাবে বলে। চোখের পলকে শ্রীলঙ্কার মতো গণভবনও ভরে গেল মানুষে। কিন্তু কোথায় গেলেন তিনি যার জন্য এতদূর আসা?

বুকভর্তি মেট্রোরেলের কান্না আর লাগেজ ভর্তি পদ্মাসেতুর দুঃখ সাথে নিয়ে একজন উড়ে গেলেন দূরে চুপিচুপি। তবে সেই দূরত্ব ঠিক কতখানি তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু যে ইতিহাস রচনা করে গেল এদেশের ছাত্র সমাজ, যে রক্তচোষা সিস্টেম থেকে এদেশের জনগণকে মুক্ত করতে প্রাণ দিলো শতশত তরুণ, তাদের এই ঋণ কি শোধ হওয়ার? আমরা কি পারবো তাদের এ আত্মত্যাগের মূল্য দিতে? এটিও সময় বলে দেবে।

শুধু আমরা যারা এখনো বেঁচে আছি, সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কাজ করতে পারি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা, যে স্বপ্ন দেখেছিলেন চব্বিশের আবু সাইদ, মুগ্ধ, ফাইয়াজসহ অসংখ্য শহীদেরা।