রাত্রি আর কুয়াশা

অ+ অ-

 

|| ১৭ ||

দুপুরে কোথায় যে কী ঘটে যায় তার কিছুই টের পাই না আমি। শুধু কলাতিয়া পাড় হয়ে যে মেয়েটা ছাই বেচতে এসেছিল পর্যবসিত হাওয়ার টানে তাকে মনে পড়ে। মনে হয় তার সাথে কলাতলি চলে যাই। ত্রিমোহিনী ঘাটের কাছে কাউকে জিজ্ঞাসা করি আমার ওষুধের নাম তারা জানে কিনা! 

দুপুরের ছায়ার কাছেই আমার যত ঋণ জমে আছে। ছেলেবেলায়, আঙিনায় মেয়েদের ফিসফিস করা গল্পগুলো আজো মনে পড়ে। তুমি সেই সকালে কাপড় পাল্টে চলে গেছ নিরুদ্দেশ অজানার দিকে। আমার বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নিরুত্তর বইগুলো। আমি একটাও খুলে দেখিনিজীবন কীভাবে নিমফুলের মতো মাটিতে পড়ে শাদা হয়ে আছে আমি কিছুই জানি না। 

কলাতিয়া পার হয়ে যে গ্রাম ধূসর এবং সবুজ এই অবিশ্রান্ত দুপুরে আমি সেইসব ভাবতে ভাবতে বস্তু-পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে উঠি। জীবনকে আমার বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে থাকা থালাবাসনের মতো মনে হয়।

 

|| ১৮ ||

দুপুরে কোথাও কিছু থাকে না কেবল মউতের ফরশা হাত আমার ঘরের মধ্যে ধূসর হয়ে ওঠে। বসিলা পার হয়ে যে মফসসল হাওয়ায় কেঁপে ওঠে আমি সেইখানে যেতে চাই। কয়েকটা আধোভাঙা বাড়ির উঠানে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে নক্ষত্রের অবনীল আলোয়। আমার কী হয়েছে কেউ-ই জানে না শুধু ওষুধ আর পেসক্রিপশন উড়ে বেড়াচ্ছে আমার বিছানায়। জানালার বাইরে তাকালে কোনো ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসে চুম্বনের শব্দ আবার কোথাও কেবল মশলার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশে। 

এমন দুপুরে আমার কেবল মনে হয়, গোরস্থানে যাই। ঝরে পড়া পাতাগুলো সাফ করে নিজের এপিটাফ লিখে আসি চিত্রার্পিত ফলকে। গোরস্থানে কত কত নাম আমি মুখস্থ করি অথচ এদের কাউকেই আমার ওষুধের নামের মতো চিনি না আমি। এখানে যে ছায়া তার নিচে বসে বসে মনে হয় জীবন কোনো কেটলির মতো খালি পুড়ে যাচ্ছে বিত্রস্ত কয়লায়। কতগুলো ফুল ফুটে আছে, আমি তাদের নাম জানি না। শুধু জানি তুমি চলে গেছে সকালের পাংশু আলোর মধ্যে নরম ছায়ায়। 

বসিলা পার হয়ে যে গ্রামে বৃষ্টি হচ্ছে প্রতিদিন, আমি সেইখানে আমার জীবন বাঁধাই করতে দিয়ে আসি, পুরানা তারিখঅলা ক্যালেন্ডার দিয়ে স্রেফ সেলাই করে রাখার মতন। 

 

|| ১৯ ||

দুপুরে গোরস্থানে বসে বসে মানুষের আসা-যাওয়া দেখি। কখনো নতুন মুর্দার সাথে দুপুরও কেমন বিহ্বল হয়ে পড়ে। এখানে অনেক গাছ। পাতা ও মঞ্জরি ঝরে পড়ে বিবর্ণ কবরের উপর। তাজমহল রোড থেকে জেনেভাক্যাম্পের দিকে যে রাস্তাগুলো চলে গেছে তাদের গন্তব্য আমি চিনি। শুধু তুমি চলে গেলেই টের পাই ভালোবাসা কত একা। এখানে বড় বড় বাড়ির হাজার জানালা-কপাট। এতদূর থেকেও আমি চুম্বনের ঘ্রাণ পাই কোনো রতিবান্ধব তরুণীর। কবরের ফলকে যা লেখা থাকে জীবীতরা কখনোই তার অর্থ উদ্ধার করতে পারে না। এসব বাক্য কেবল মৃতদের জন্যই। 

আমার ঘরের মধ্যে এই দুপুরেও মশারির চারকোণা বাঁধা থাকে। হাওয়া আসে জানার গ্রিল দিয়ে। আমি এমন করে তোমাকে চাই যেন মশারি উঠালেই তোমার মুখ দেখা যায় এই তেইশের দুপুরে। মউতকে আজ আর দূরের বিড়াল ছানার কান্না মনে হয় না। মনে হয় এই তো বসিলা ব্রিজ পার হয়ে সে এসে পড়বে আমার ওষুধের নাম মুখস্থ করতে করতে। 

 

|| ২০ ||

শৈশবে আমি ভাবতাম মউত তো অনেক দূর! তা কেবল বৃদ্ধ আর ক্ষয়িষ্ণু যুবকদেরকেই তাড়া দিতে থাকে যেমন চাবুকে তাড়া দেয় একজন সহিস তাজি ঘোড়াকে। কিন্তু আজ দেখি মউত এত কাছে যেন মনে হয় রাজিয়া সুলতানা আর নূরজাহান রোডের মধ্যবর্তী দূরত্ব। আমি শৈশবে সেইসব বৃদ্ধদের কথা ভাবতাম যারা দুপুরের বারান্দায় বসে বসে সবুর করত মউতের আর শুভ্র পেয়ারার ফুল ঝরে পড়ত তাদের চারপাশে। 

আমার এই ঘর, বিছানা, সাজানো কাপড়ের বাকশো সবকিছুই কেবল তোমার সবুর করে। তুমি চলে যাও সকাল হলেই। তোমাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনের যে সময়টুকু ঘড়িতে লেগে থাকে আমি সেটুকুর জন্যই সবুর করি সারারাত। দুপুরে এখন মাঝেমধ্যেই সমুদ্রের হাওয়া বয়। আকাশে থমথমে কালো মেঘ করে আসে। কলাতিয়া থেকে যে লোকটা সবজি বেচতে আসে আমাদের গলিতে আমি তার শিশুটার কথা জিজ্ঞাসা করি। তার মুখে কেমন সোনার আশরাফির হাসি লেগে থাকে। 

মাঝে মধ্যে জীবনকে আমার মৃগেল মাছের নামের মতো সুন্দর মনে হয়।