হাসান হাফিজুর রহমানের ভাবাদর্শ
গড়পড়তা বাঙালি কবিদের নিছক শব্দ চর্চার সাথে হাসান হাফিজুর রহমানের [জন্ম ১৪ জুন ১৯৩২- মৃত্যু ১ এপ্রিল ১৯৮৩] লেখক সত্তাকে ঠিক মেলানো যায় না। পৃথকত্ব বোঝার জন্য সৃষ্টিকর্মে পাশাপাশি তাঁর কর্মকাণ্ডের দিকেও ফিরে তাকাতে হয়। তিনি যে প্রজন্মের সন্তান, সেই সময়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ [১৯৪৭] পাকিস্তানবাদ প্রতিষ্ঠার খুব জোরজবরদস্তি চলছিল। শাসকগোষ্ঠী এর জন্য ধর্মকে সামনে এনে মুসলমানি তমদ্দুনের অজুহাত তুলে বাঙালিদের ওপর উর্দুভাষা চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালায়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এই দুরভিসন্ধি অল্প সময়ের মধ্যে বুঝতে পেরেছিলেন এদেশের তরুণ-সমাজ। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর অভিঘাতের প্রধান কারণ ‘পাকিস্তানবাদী’ ভাবাদর্শের চাষ শুধু নয়, শোষণ-শাসনকে স্থায়ী করা। হাসান হাফিজুর রহমান এই ভাবাদর্শের বিপরীতে ভিন্ন বক্তব্য নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের উপনিবেশবাদী পরিকাঠামোর বৈরী বাস্তবতায় হাসান হাফিজুর রহমান স্পর্ধা ও সাহসের ভিত্তি ছিল উদার মানবতাবাদী চেতনা। বায়ান্নোর রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা মধ্যবিত্তশ্রেণি পাকিস্তানি ভাবাদর্শ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। হাসান হাফিজুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই সড়ক ধরে কবি ও কর্মীর দ্বৈত ভূমিকা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁর সাহিত্য-সাধনা, সাংবাদিকতা, সম্পাদনা, অধ্যাপনা, সাংগঠনিক তৎপরতার মূলে রয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্পৃহা। হাসান, ব্যক্তি কিন্তু ইতিহাসের সঙ্গে অনিবার্যভাবে লিপ্ত, যুক্ত হয়েছিলেন দুরন্ত সাহস নিয়ে। একাধারে পরিকল্পনাকারী, সংগঠক ও যোদ্ধার ভূমিকায় লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিভাগোত্তর তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠী নতুন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলো, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠলো, এই নির্মাণ ছিল অভূতপূর্ব।
আসলে বাঙালি মুসলমান, সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ রাজনৈতিক বাসনার জালে আটকা পড়েছিল। ধর্ম ও রাজনীতি সম্পর্কে কোনো আত্মমীমাংসায় উপনীত হতে পারছিল না। জাতীয় চেতনার এই পরিকাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে হাসান হাফিজুর রহমান পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তার দুঃসাহসিক পরিচয় পাওয়া যায় ঐতিহাসিক গল্প সংকলন ‘দাঙ্গার পাঁচটি গল্প’ [১৯৫০] প্রকাশের মধ্যে। মুমূর্ষু মানবিক চেতনাকে জাগ্রত করতে এই সংকলন সম্পাদনার কাজটি তাঁকে মূল সড়কে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র আঠারো বছর। হাসান হাফিজুর রহমানের ছিল বিস্ময়কর সাংগঠনিক শক্তি এবং সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব। এ দুটি দুর্লভ বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সৃজনশীল প্রতিভা যুক্ত হওয়ার কারণে বয়স তার কাছে কোনো বাধা হয়ে ওঠেনি। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ [১৯৫৩] সংকলনে তিনি তা আবার প্রমাণ করলেন। বৈরী বাস্তবতার ভেতরেই হাসান গোপনে গোপনে লেখা সংগ্রহ করেন। মোহাম্মদ সুলতানের ভাষ্য থেকে জানা যায়, ‘সেই সময়ে “একুশে ফেব্রুয়ারী” বের করতে সেই মুহূর্তে ৫০০ টাকার প্রয়োজন আমার আর হাসানের হাতে ৫০ টাকাও নেই। সমাধান করে দিল হাসান। বাড়িতে গিয়ে জমি বেচে সে টাকা নিয়ে আসবে। যা ইচ্ছা, হাসান তাই করল।’ সরকার সেই সংকলন বাজেয়াপ্ত করলো, তার নামে জারি করে হুলিয়া। সাম্প্রদায়িক ভাবধারা থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার নির্মাণে এমন আত্মত্যাগের দ্বিতীয় উদাহরণ আজো সৃষ্টি হয়নি।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের পরিপেক্ষিতে জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক নির্মাণের যথার্থ নায়ক হাসান হাফিজুর রহমান। তাঁর কাব্য চর্চা, অন্যান্য লেখালেখি, রাজনীতি, সবকিছুর মূলে ছিল দেশ, দেশের মানুষের প্রতি বিশাল দায়িত্ববোধ। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র’ [১৫ খণ্ড] তার সর্ব শেষ কাজ সেটাও জাতীয়তাবাদী দায়িত্বেরই অংশ। রাষ্ট্র সবসময় তার প্রচারযন্ত্র, স্টেইট অ্যাপারেটাস দিয়ে নানা রকম সম্মতি উৎপাদন করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রও তার ব্যতিক্রম ছিল না, কিন্তু সেই গুপ্ত কিংবা প্রকাশ্য ভাবাদর্শের ভেতরে থেকে বিপরীত মতাদর্শ চর্চা, অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানকে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির দিকে পথ দেখিয়ে, আত্মবিকাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এই মহৎ কাজটি হাসান হাফিজ কোন তাড়না থেকে করেছিলেন? বহুরকম রাজনৈতিক প্রলোভন এড়িয়ে, ব্যক্তিগত স্বার্থ-কন্টকিত পথ পেরিয়ে, কতটা শিল্প-স্নাত, নিঃস্বার্থ হলে ব্যক্তি তা পার? দেশপ্রেম আর খাঁটি জাতীয়তাবাদী চেতনাই ছিল তার মূলমন্ত্র। আধা-সামন্তবাদী মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আধুনিকতাবদী মানসে পরিবর্তন করা, এ ক্ষেত্রে টি. এস. এলিয়েট, বোদলেয়ার বাহিত পশ্চিমা আধুনিকতার সাথে ভারতীয় বুদ্ধদেব বসু অনুসৃত আধুনিকতার অবিকল অনুসরণ হাসান হাফিজ করেননি। তিনি চেয়েছিলেন সাহিত্য হয়ে উঠুক স্বদেশীয় সামষ্টিক ও সামাজিক সংস্কৃতির ভাবধারা। আধুনিকতার মধ্যে কোনটা ‘আমাদের’ কোনটা ‘পশ্চিমের’ তা তাত্ত্বিকভাবে বোঝা নয়, আত্মপরিচয়ের রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে বুঝতে চেয়েছেন। ‘আধুনিক কবি ও কবিতা’ [১৯৬৫] গ্রন্থটি তার প্রমাণ।
কারণ, পঞ্চাশ-ষাটের দশকে সংস্কৃতিই রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে, রাজনীতি সংস্কৃতির ওপর কর্তৃত্ব করেনি। সংস্কৃতির আবহে ছিল অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিক মূল্যবোধ, প্রতিবাদী চেতনা, স্বদেশ, স্বাধিকার চেতনা। হাসান হাফিজ এগুলোর সাথে দারুণভাবে অ্যাক্টিভ বা যুক্ত ছিলেন। তার চিন্তন-বুদ্ধিজীবিতার মধ্যে নিখাদ বাঙালিত্ব, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার স্বপ্নময় আকাঙ্ক্ষা প্রবল ছিল। হাসান হাফিজুর রহমানের জীবন ও কাজকে দুটি ভাগে দেখা যায়—১৯৫০ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়কাল ছিল জাতীয়তাবাদের নির্মাণ, স্বপ্নময় আকাঙ্ক্ষা, বাঙালির সংজ্ঞার্থ বদলের সংগ্রাম ও লড়াই। এবাবত হাসান তারুণ্য ও যৌবনকে খরচ করেছেন নির্দ্বিধায়। সাহিত্যের সাথে রাজনীতি মতাদর্শগত বোঝাপড়া করতে চেষ্টা করেছিলেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিমুখ প্রান্তর’ থেকে ‘শোকার্ত তরবারি’, ‘আমার ভেতরে বাঘ’ কিংবা ‘ভবিতব্যের বাণিজ্য তরী’ পর্যন্ত তার প্রতিবাদী ভূমিকা এতটুকু ম্লান হয়নি। বুর্জোয়া বাস্তবতা সাথে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার সূক্ষ্ম পার্থক্য বুঝে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ছিল তার প্রধান কাজ। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৩ সাল—এ সময় থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার মধ্যে দেখা দিয়েছিল ভাষা সংস্কৃতি মর্যাদা নিয়ে হতাশা। দেশ ও জাতির মধ্যে প্রতিরোধ সংগ্রামের নন্দনতত্ত্বিক প্রণোদনার ঘাটতি দেখেছেন। খুঁজে পাননি কোনো উত্তরসূরী। হাসান হাফিজুর রহমান বেঁচে থাকবেন কাজের মধ্যে, তাঁকে মূল্যায়ন করতে হবে তার কালের সাপেক্ষে। জাতীয়তাবাদের উর্বর জমিনে। যেমন তিনি একটি কবিতায় লিখেছেন—
হে আমার দেশ, বন্যার মতো
অভিজ্ঞতার পলিমাটি গড়িয়ে এনে
একটি চেতনাকে উর্বর করেছি।
সাধারণ মানুষের বিজয়ে তাঁর আস্থা ছিল অটুট। তাঁর অবস্থান সংগ্রামের পুরোভাগে। বাংলাদেশের কবিতার সমাজনিষ্ঠ প্রগতিশীল ধারায় জনপ্রিয় ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। এই ধারা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছেন শামসুর রাহমান। শিখাগোষ্ঠী বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়কে কুসংস্কার থেকে বের করে আধুনিক করতে চেয়েছিলেন, হাসান হাফিজ সেই ধারা থেকে আরেকটু অগ্রসর করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত করেছেন। এখানেই কবি ও কর্মী হিসেবে তাঁর সাফল্য।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন