মাহমুদ দারবিশের কবিতা
মাহমুদ দারবিশ
মাহমুদ দারবিশ ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি এবং সাহিত্যিক। জন্ম ১৯৪১ সালের ১৩ মার্চ ফিলিস্তিনের এক ছোট্টগ্রাম আল-বোরোতে। মৃত্যু ২০০৮ সালের ৮ অগাস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন, টেক্সাসে। শৈশবে জন্মভূমি থেকে উন্মূল উদ্বাস্তু দারবিশ চিরকাল তার হৃদয়ে ফিলিস্তিনকে ধারণ এবং লালন করেছেন, আজীবন লড়েছেন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য। তার কবিতা ও প্রবন্ধ মিলিয়ে গ্রন্থের সংখ্যা ৫০-এর অধিক। দ্য লোটাস প্রাইজ, লেনিন পিস প্রাইজ, দ্য নাইট অব দ্য অর্ডার অব আর্টস এন্ড লেটারস-সহ তিনি বিভিন্ন পুরষ্কার এবং সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
মাহমুদ দারবিশ © ছবি: ইউনিউজের সৌজন্যে
ভেঙে গেছে সাইপ্রাস
‘সাইপ্রাস গাছের কষ্ট, সাইপ্রাস গাছ নয়,
সাইপ্রাসের ছায়া নেই, সে নিজেই গাছের ছায়া’
— বাসাম হাজ্জার
সাইপ্রাস ভেঙে গেছে মিনারের মত
শুয়ে পড়েছে রাস্তায়
অন্ধকার শীর্ণ সবুজ তার নিজেরই ছায়ায়,
যেমন সবসময়।
আহত হয়নি কেউ।
দ্রুত গতির যানবাহনেরা মাড়িয়ে গেছে
তার শাখা-প্রশাখা
উইন্ডশীল্ডে ধুলো উড়িয়ে...
সাইপ্রাস ভেঙে গেছে,
কিন্তু
প্রতিবেশী কবুতরটা বদলায়নি
তার চিরাচারিত নীড়।
অভিবাসী পাখি দুটি উড়ে গেছে প্রান্ত জুড়ে,
করেছে কিছু প্রতীক বিনিময়।
প্রতিবেশীকে প্রশ্ন করেছে এক নারী:
বলো, তুমি কি ঝড় দেখেছ?
সে বলেছে: না, এমন কি বুলডোজারও না...
সাইপ্রাস ভেঙে গেছে,
ধ্বংসাবশেষের পথযাত্রীরা বলেছে:
হয়তো অবহেলায় ক্লান্ত হয়েছিল,
দিনে দিনে বয়স বেড়েছে, জিরাফের মতো দীর্ঘ,
ধুলো ঝাড়া ঝাড়ুর মতো সামান্য,
দুই প্রেমীকে দিতে পারেনি আশ্রয়।
বালক বলেছে:
আমি তাকে নিখুঁতভাবে এঁকেছি,
তাকে আঁকা সহজ ছিল।
বালিকা বলেছে:
সাইপ্রাস ভেঙে গেছে,
তাই আজ আকাশ অসম্পূর্ণ।
যুবক বলেছে:
সাইপ্রাস ভেঙে গেছে,
তাইতো আজ আকাশ সম্পূর্ণ।
আর আমি নিজেকে বলেছি:
রহস্য নয়, বাস্তবতাও নয়,
সাইপ্রাস ভেঙে গেছে
এবং এটাই উপসংহার:
ভেঙে গেছে সাইপ্রাস!
কবিতা থেকে ঘোড়া পড়ে গেছে
ঘোড়া পড়ে গেছে কবিতা থেকে
গ্যালিলিয়ান মহিলারা ভিজে গেছে
প্রজাপতি আর শিশিরের সাথে,
চন্দ্রমল্লিকার বুকে নাচতে নাচতে
অনুপস্থিত দুজন: তুমি আর আমি
তুমি আর আমি দুজন অনুপস্থিত
একজোড়া সাদা ঘুঘু
হোলম ওকের ডালে,
কথা বলে
প্রেম নেই, তবু আমি
পুরাতন প্রেমের কবিতা ভালবাসি
অসুস্থ চাঁদকে যে
ধোঁয়া থেকে বাঁচায়
আমি আক্রমণ করি, পশ্চাদপদ হই,
কোয়াট্রেন বেহালার মতো
নিজের সময় থেকে দূরে চলে গিয়ে
আবার ফিরে আসি ভূত্বকের কাছাকাছি...
ভালোবাসাকে উদযাপন করতে
আধুনিক ভাষায় আর কোন
অবশিষ্ট প্রান্ত নেই,
যাই হবে ভবিষ্যৎ... তাই হবে অতীত
ঘোড়া রক্তাক্ত
আমার কবিতায়
আমি রক্তাক্ত
ঘোড়ার রক্তে...
পরিত্যক্ত থিয়েটারে আমার একটি আসন আছে
পরিত্যক্ত থিয়েটারে
আমার একটি আসন আছে—বৈরুতে।
ভুলে যেতে পারি, মনেও রাখতে পারি
শেষ দৃশ্যের প্রতি বেশি আশা রাখিনি...
অন্য কোনো কারণ নেই
তা ছাড়া নাটকটি দক্ষতার সাথে লেখা হয়নি...
বিশৃঙ্খল
যুদ্ধ দিনের হতাশাগ্রস্তদের মতো,
দর্শকদের আবেগের আত্মজীবনী।
অভিনেতারা তাদের স্ক্রিপ্ট ছিঁড়ে ফেলছিল
আর আমাদের মধ্যে সন্ধান করছিল লেখক,
আমরা সাক্ষী হয়ে আমাদের আসনে বসা—
প্রতিবেশী শিল্পীকে বললাম: অস্ত্র এঁকো না,
আর লেখক না হলে একটু অপেক্ষা কর!
— না
তারপর সে আমাকে প্রশ্ন করে: আর তুমি?
তুমি কি লেখক?
— না
আমরা ভয় পেয়ে বসে থাকলাম।
আমি বললাম: ভাগ্যের বিধান থেকে পালাতে
নিরপেক্ষ বীর হও
সে বলল: দ্বিতীয় দৃশ্যটিতে
কোনো বীর সম্মানিত হয় না
আমি বাকিটুকুর জন্য অপেক্ষা করব।
হয়ত একটি নাটক সংশোধন করব।
হয়ত মেরামত করব
লোহা আমার ভাইদের যা করেছে
আমি বললাম: তাহলে তুমিই?
সে উত্তর দিল: তুমি এবং আমি
দুজন মুখোশধারী লেখক এবং
দুজন মুখোশধারী সাক্ষী
আমি বলি: এটা কি আমার ভাবনার বিষয়?
আমি একজন দর্শক মাত্র
সে বলল: ফাটলের দরজায় দর্শক নেই...
এখানে কেউ নিরপেক্ষ নয়।
তোমাকেই শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করতে হবে
তোমার ভূমিকা
অত:পর আমি বলি:
আমি শুরুটা দেখিনি,
শুরুতে কী ছিল?
যদি অন্য কেউ হতাম
এই পথে যদি অন্য কেউ হতাম,
ফিরে তাকাতাম না,
কোনো পথিক যা বলে কোনো পথিককে
সেভাবে বলতাম:
আগন্তুক! জাগ্রত করো গিটার আরো!
আমাদের আগামীকাল বিলম্বিত করো
যেন আমাদের যাত্রা দীর্ঘ হয়,
আমাদের পথ প্রশস্ত হয়,
যেন আমরা উদ্ধার পেতে পারি, একসাথে,
আমাদের গল্প থেকে:
তুমি নিজেই অধিক ব্যপক...
আর আমিও অধিক এই আমার চেয়ে,
তোমারই সামনে!
যদি অন্য কেউ হতাম,
তবে পথ হতাম,
তুমি আমি কেউ ফিরতাম না আর।
জাগ্রত করো গিটার,
যেন অনুভব করতে পারি সেই অজানা গন্তব্যকে
যা পথিককে অভিকর্ষে প্রলুব্ধ করে।
আমি কেবল পদক্ষেপ,
তুমি আমার দিকসূচক, সুরঙ্গপথ দুটোই।
যদি অন্য কেউ হতাম এই পথে,
তবে স্যুটকেসে লুকিয়ে রাখতাম আমার আবেগ,
কবিতা হতো জলের,
স্ফটিকস্বচ্ছ, সাদা,
বিমূর্ত, এবং হালকা...
স্মৃতির চেয়ে শক্তিশালী,
শিশিরবিন্দুর চেয়ে দুর্বল,
বলতাম:
আমার পরিচয় এই বিস্তৃতি!
যদি অন্য কেউ হতাম এই পথে,
গিটারকে বলতাম:
আমাকে তারের নতুন একটি ধুন শেখাও!
কারণ ঘর এখনও অনেক দূর,
আর এই পথ আরো সুন্দর—
আমার নতুন গান যেন তার কথা বলে।
পথ যতই দীর্ঘ হয়, নবায়িত হয় তার অর্থ পুনর্বার,
আর আমি হয়ে যাই দুই
এই পথে:
আমি... এবং অন্য কেউ!
তার অনুপস্থিতিতে আমি নির্মাণ করেছি তার অবয়ব
তার অনুপস্থিতিতে আমি নির্মাণ করেছি তার অবয়ব:
পার্থিবতার বাইরে, স্বর্গীয়তার গোপনে।
আমি ওজন করছি বিস্তৃতি
জাহিলি-গাঁথার সাথে...
তার অনুপস্থিতি আমার পথপ্রদর্শক,
পথপ্রদর্শক তার অনুপস্থিতি।
প্রতিটি অন্ত্যমিলের জন্য একটি করে তাঁবু।
এবং বাতাসে প্রবাহিত প্রতিটি অস্তিত্বের জন্য একটি করে কবিতা।
তার অনুপস্থিতি আমাকে শিখিয়েছে তার পাঠ:
তা না হলে কেউ
মরীচিকার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় না...
তারপর শূন্যতায়,
প্রাচীন হরফে লেখা কারো চিঠি ছিন্ন করে
আমি অনুপস্থিতির দিকে ঝুকে পড়েছি।
পরিদর্শনের পর তাহলে আমি কে?
একটি পাখি? প্রতীকের মধ্যে ভ্রাম্যমান পথচারী?
স্মৃতি বিক্রেতা?
আমি যেন কোন সুপ্রাচীন-সংগ্রহ,
ইয়াবাউসের ওৎ পাতা ভূত, নিজেকে বলছি:
চলো সাত পাহাড়ে যাই।
পাথরের উপর বসিয়ে দেই আমার মুখোশ,
পা চালাই নিদ্রাহীন পায়ে, স্বপ্নের নেতৃত্বে।
ঝাঁপ দেই এক চাঁদ থেকে আরেক চাঁদে।
সেখানে ইতিহাস থেকে অস্তিত্বকে মুক্ত করতে
আছে সীমাহীন অচেতনতা,
সেখানে অচেতনতা থেকে আরোহণকে মুক্ত করতে
আছে বিপুল ইতিহাস।
আমাকে আমাদের সেই প্রথম
বছরগুলোতে নিয়ে চলো—আমার প্রথম প্রেয়সী বলে।
জানালা খুলে চড়ুইগুলোকে
তোমার স্বপ্নে প্রবেশ করতে দাও—আমি বলি...
তারপর জেগে উঠি আমি,
এবং শহরে কোন শহর ছিল না
‘এখানে’ ছাড়া ‘সেখানে’ নেই।
‘সেখানে’ ছাড়া ‘এখানে’ নেই।
যদি মরীচিকা না থাকত
আমি সাত পাহাড়ে যেতাম না...
যদি না শুধু মরীচিকা থাকত!
অনুবাদ ও ভূমিকা ► লায়লা ফারজানা
যখন সবাই যুদ্ধে : কবে দেখা হবে আবার? : যুদ্ধের শেষে। : যুদ্ধ কবে শেষ হবে? : আমাদের দেখা হলে! — মাহমুদ দারবিশ
Laila Farzana
অক্টোবর ২৪, ২০২৩ ১৭:২৭