জেগে থাকা আত্মার গান ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-

 

জ্বরাগ্রস্ত ধুলার পৃথিবী

জীবন মৃত্যুর ধুলাখেলা
পৃথিবীতে এসেছিলাম সে
চিহ্নটুকু বিধাতা নিয়েছে কেড়ে।

যেটুকু সময় রয়েছি ভোরের আলো
অন্ধকারে চোখের অশ্রুর বিনিময়ে,
এইটুকু জানি আপন আলোয়
তারে আলোকিত করে যেন
ধরার ধূলিতে ধুয়েমুছে যেতে পারি।

বলে যেতে পারি মানব জনম যেন
শূন্য নয় পূর্ণ, বরাভয়হীন এক
অবারিত আকাশ রক্তিম সূর্য তুমি।

তোমার নামটা মানুষের মাঝে
আলো জ্বালিয়ে রাখুক এইটুকু চাই।

হে জন্ম হে মৃত্যু
যা কিছু দিয়েছো যেন—
সেটুকু নিয়েই আলো হাওয়ার এক
পৃথিবীতে বিলীন হয়েও জেনো রেখো
ছিলাম, থাকবো, অফুরন্ত—
তুই আর আমি শুকতারা হয়ে নীল
নভোমন্ডলে সে, এক অপার পৃথিবী।

জ্বরা তাকে ছোঁয় না লোভের ঘৃণা
দুনিয়ায় আমাদের প্রাণ যেন এক,
অক্ষয় অজর, অমর সজীব পূর্ণ
দূর্বার উন্মুক্ত, বৃষ্টিতোয়া মাটিগন্ধ
ভরা ভেজা বাতাসের উঠি-উঠি
আলো রঙধনু রঙে আঁকা,
আশ্চর্য বিভায় ঝংকৃত সুরের গান।

ঝরে পড়বে হাজার বছরে
অজর অমর আত্মা তুমি।
রক্ত তোকে নিয়ে নিতে পারে
মাটি আলো হাওয়া প্রকৃতি,

আমাদের ধারণ করবে, এই
মহাবিশ্বে, কত না যন্ত্রণা নিয়ে
আমরা ছিলাম, থাকবো হয়তো প্রাণ
থেকে প্রাণের ভেতর আলোকিত গান
হয়ে ঝরে পড়া দুই ছোট্ট ধুমকেতু।

 

জেগে থাকা আত্মার গান

নিদ্রাবিহীন কালো রাত শেষে
ভোরের আলোয় জেগে ওঠা
শহরের বিষণ্ণ বাতাসে
তখনো রয়েছে তাপ
যেন অন্ধ করে দেবে কালাকাল।

আজ যে পথে তোমার যাত্রা
সেখানে কোন পিলগ্রিমেজ রয়েছে,
দেখেছো কি হাজার বছর
পথ পথ পাথুরে নদীর
তীরে অদ্ভুত আঁধার!

একা পরিব্রাজক যে
যিশুর ক্রসের পাশে
নবীর নামের শেষে দরুদের দোয়া।
বুদ্ধের অহিংস বাণী
গীতার কর্মাই ধর্মা
জরাথ্রুস্থে পাখির ঠোঁটের
হাড়টুকু পড়ে থাকা কংকাল কংকাল।

নিঃস্তব্ধ মিনারে হয়তো সেখানে আছে
ধবল জোৎস্নার রাত—
আর্তনাদে দীর্ণ এক আত্মা।

তার গাঢ় কান্নার ধ্বনিতে
জেগে ওঠে মহাকাল, দিব্যকান্তি,
অপরূপ বিভা আলোকিত
নভোমণ্ডলে সে জেগে থাকে।

নীচে এই কালো রাতের গহবরে
আমি এক অভিশপ্ত আত্মা,
খুঁজে ফিরি পথের ধুলোয়।

পথ থেকে পথে ছেড়া ঘুড়ি
লাল বল জুতোজামা
আমারই হাঁড়গোড়ে রক্তমাংস
মানুষের জিঘাংসার চিহ্ন ফুটে থাকি
পথের ধুলোয় গড়াগড়ি যাই।

আধখানা আঙুল আমার বলে
এই দেখো মানুষ মানুষ
আমাকে খুবলে খায়,
চোখ বন্ধ হাত থেকে ঘড়ি
চশমার আড়ালে চোখের
মণি খুবলে নিয়েছে,

আমি তখনো দেখেই চলেছি চলেছি
মানুষের লোভ জিঘাংসার কালো হাত
লাশঘরে ঠান্ডা শীতল যে আমি
অপেক্ষার প্রহর শেষের এক
গাঢ় ঘুম কবরের নিঃস্তব্ধতা!

কোথাও তক্ষক অথবা পেঁচা
এক আধবার ডেকে উঠলেও
ঘুম ঘুম ঘুম প্রবল জমাট রক্তে…

 

রক্তাক্ত পাখির ডাক

দেখো পাখি ডাকে বারবার বসন্তের
শীত শেষে হলুদ মর্মর ঝরাপাতা
সে তো আমি, পড়ে থাকি
তাকিয়ে পথের দিকে,
ঠিক যেদিক যেখানে গিয়েছিলি!

আমি কেন ঝরে যাইনি বাবাই
আমাকেই কেন মৃত্যু তুমি
দেখোনি কেন এই তরুণ কবিকে
তার স্বপ্নগুলো নিঃশেষ করলে!

রক্ত রক্ত রক্তাক্ত আমার
শরীর আমার শিশুর সোনালি চুল
দীর্ঘ চোখ দীর্ঘ সুপুরুষ,
কোথা থেকে যেন এসেছিল!

আর চলেই বা কেন যে যেতে হলো,
বলি শোন, মানিক আমার
তুই বুঝিসনি আমি বুঝি,
মানুষের হিংসার আগুনে,
তোর বলিদান হলো
যেতে হলো তোকে অসময়ে!

বলেছিলি, তোমাকে কে দেখবে বলতো!
আমি শুকনো মুখের দৃষ্টি
একটু হেসেই বলেছি তুমিই আছো
আর কে আছে আমার!

এই তোকে নিয়েই সাতটা জন্ম
নয়টা জন্মের পার
তবুও যে ভবের পৃথিবীতে
আমাকে রেখেছো জ্যান্তমরা!

এক প্রাণ নিয়ে তুই কি আবার
আর একটাবার আসবি,
বাবাই আমার আয় কোলে
আয় নেই তোকে জঠরে আবার!

আমি সাত জন্ম নয় জন্ম পার
হবো তোকে নিয়ে পাড়ি দেবো
সাত সাতটা সমুদ্র অসংখ্য নক্ষত্র!

রূপকথার যে দেশ সেখানে যাবার
কি এতো তাড়া সে কি আমি বুঝি?

ওখানে একটা নীল পাহাড় সবুজ ঝোরা
তোর কি জাফলং মনে আছে!
পাথর পাথুরে নদীর জলের নীচে
টলে টলে মুখের ছায়া পড়েছিল
তোর, আমি কম তাকাতাম।

তোর নানু বলতো নিজের
আত্মা তোর ও, এভাবে দেখো না।
কপালের কোনে কালো
টিপ এঁকে দিয়ে বলতাম
চাঁদের কপালে চাঁদ!

কোথা থেকে লকলকে
মানুষখেকোর দল এলো,
এলো রাক্ষস খোক্ষস
আয়োজন করলো অজান্তে
আমার, নকশা বানালো রঙিন গল্প।
আর তোকে রক্তের ভেতর
ভাসিয়ে ডুবিয়ে এক
আকাশের নীচে রেখে গেছে,
আমি বিহ্বল, নিস্তব্ধ!

মানুষের লোভের দুনিয়া তোকে
নিয়ে গেছে আমার পৃথিবী
থেকে, ঘুমিয়ে আছিস
আমার ভেতরে, যা তুই করিস বরাবর
সবাইকে যেতে হবে, তোকে
তোর স্বপ্ন তোর আশা যারা
ছিনিয়ে দিয়েছে মৃত্যু,
তারাও একই রকম মৃত্যুর স্বাদ পাবে,
একদিন আগে নয়তো দুদিন পরে!

ভয় পাসনে মা তোর সাথে আছি,
ওই যে তারার মেলা আমিও সেখানে আছি,
অশ্রুনদী পার হয়ে আমি আছি
ঠিক তোর পাশে শুকতারা! 

নূহের প্লাবনে যেমন ভেসেছে লোকালয়
তেমনি ভাসবে লোভি জনপদ।
আমার অশ্রুর বিনিময়ে,
তোকে দিলাম সাতটি গ্রহ,
আর এই নে মায়ের চোখদুটো।

যে চোখ তোকেই দেখে অন্ধ
আমি ভালো ভালোই কাটছে
নীরব মাটির উপর নিঃশব্দ নীল
ফুল ঠিক তোর মাথার পাশেই আমি।

আমরা আবার করবো পৃথিবী প্রদক্ষিণ,
গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘুরে ঘুরে
ক্লান্ত আমরা টিলার ওপারে,
বসবো কিছুটা জিরিয়ে বলবি, মাগো
পা ব্যথা চলোতো, ভীষণ গরম, আমি
স্বর্গ থেকে বাতাসের ঝাপটা বুলিয়ে দেই
শান্ত তুই, শান্ত আমি ঘুম ঘুম।

 

তোমার হাড়ের মিনার

যখন উন্মাদ সময়ের কাছে তুমি
নতজানু, হাঁটুগেড়ে খাও
খুদকুটো, ধান, বীজ, সব
যেন খুটে খুটে খাঁও তোমার শরীর।

শরীরের ভেতর জেগেছে
জন্মান্ধের ক্রোধ, দাহ—
আমি তার হাতের মুঠোয়
একফালি নরম মাখন যেন
মৌতাত ফুলের উৎসব শেষের বেলা।
সেখানে জন্মায় হলুদ পাতার গান
কিংবা ধরো বিমর্ষ আকাঙ্ক্ষা!

কল্পতরু নামে যে গাছটি
ফুলেফেঁপে ভরেছিল সেটি
চুপচাপ জলের তলায় ঘুম।

নিদ্রাহীন কালোরাত শেষে
ভোরের আলোয় জেগে ওঠা
শহরের বিষণ্ণ বাতাসে
তখনো রয়েছে তাপ
যেন অন্ধ করে দেবে কালাকাল!

আজ যে পথে তোমার যাত্রা
সেখানে কোন পিলগ্রিমেজ রয়েছে—
হাজার হাজার পথের ক্লান্তির শেষে
তুমি এক পরিব্রাজক যে
যিশুর ক্রসের পাশে
নবীর নামের শেষে দরুদের দোয়া।
বুদ্ধের অহিংস বাণী।
জরাথুস্ত্রে আমি পাখির ঠোঁটের কোণে
বিদ্ধ রক্তমাংস, হাড়টুকু পড়ে আছে
উঁচু উঁচু নিঃস্তব্ধ মিনারে।

হয়তো সেখানে আছে কোন
ধবল জোৎস্নার রাত,
তার গাঢ় কান্নাধ্বনি
মর্মর বাতাসে হিল্লোলিত
আকাশের দিকে কারো চোখদুটো
তখনো রয়েছে জেগে।