মোহাম্মেদ এল-কুর্দের কবিতা
প্রসঙ্গ কথা
মোহাম্মেদ এল-কুর্দ ফিলিস্তিনের এক তরুণ কবি, সাংবাদিক ও সংগঠক। মোহাম্মেদ মূলত #শেখজারাহবাচাঁও আন্দোলনের একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা। প্রথম ফিলিস্তিনি কবি হিসাবে তিনি দ্য নেশন পত্রিকার জন্য কাজ করেছেন। ইংরেজি ভাষায় রচিত তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রিফকা’ [২০২১] ইংল্যান্ডের ফরওয়ার্ড পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় অর্ন্তভূক্ত হয়। রিফকা গ্রন্থের কবিতায় মূলত জেরুজালেমের জবরদখল, ফিলিস্তিনকে উপনিবেশিকরণের উপর বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী চেতনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন এই একবিংশ শতাব্দীতেও চলমান। জাতিগত নিধন ও জাতিবিদ্বেষ এই উত্তর-আধুনিককালেও শক্তভাবে চর্চিত—বিশেষত আক্রমণ, যুদ্ধ, ধ্বংস ও বাস্তুচ্যুতি কি করে বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়াবলি দিয়ে নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি তৈরি করে। সমকালীন রাষ্ট্রশক্তির একরৈখিক নীতি কি করে মানব বিপর্যয়ের নিয়ামক হিসাবে কাজ করে, তা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তার রচিত সকল কবিতাই আত্মজীবনীমূলক ও কাহিনীভিত্তিক। কবিতায় ব্যক্তি আর মাতৃভূমির ভিন্ন ও সম্মিলিত স্মৃতি আর যাতনার ছবি খুবই নিপুণভাবে চিত্রিত করেছেন তিনি।
মোহাম্মেদ এল-কুর্দ © ছবি: দ্য পিপলস্ ফোরামের সৌজন্যে
কোন পয়গম্বর আটক ছিলো না
২০১৪ সালের ১৬ জুলাই, গাজা শহরের সমুদ্র তীরে, নয় থেকে চৌদ্দ বছর বয়সী চারজন ছেলে ফুটবল খেলার সময়, ইসরাইলি নৌ-সেনাদের অগ্নিগোলা নিক্ষেপে নিহত হয়।
গাজায় কবর দেয়ার কোন জায়গা নেই, তাই বলে কি—
মৃত্যুর জন্য এই সমুদ্র পাড়ে এনেছো?
এর জন্যই কি—
ভাঙ্গা পাথর টুকরোর মতো আমাদের জড়ো করেছো ঘরে-দুয়ারে?
ঠিক যেমন আমাদের ভাইবোনদের, আমাদের ভবিষ্যত, আমাদের ঈশ্বরদের
আলাদা আলাদা করে রেখেছো।
এটা কি শুধু এই জন্যই যে—
আমাদের শ্মশানের জন্য শ্মশান দরকার
আমাদের সমাধি স্তম্ভের একটা আশ্রয় দরকার?
এটা কি শুধু এই জন্যই যে—
আমাদের পিতাদের আরো দুঃখভরা জীবন দরকার?
আমাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ পাখির মতো হাওয়ায় ভাসছিল,
আমাদের আনন্দগুলো ঢেউয়ের মতো সমুদ্রতীরে ভেঙ্গে পড়ছিল।
তখন আমাদের পায়ে পায়ে ছিল ফুটবল।
এখন তাদের পায়ে পায়ে আমরা ফুটবল।
কোথাও পালাবার তাড়া নেই। কোন পয়গম্বর আটক নেই।
ঢেউগুলো সব বিনি সুতায় বাঁধা, অবিভাজ্য, প্রস্থাণের পথ—অকল্পনীয়,
সময় স্বল্প, তাই সময়ের আগেই একটু কেঁদে প্রাণ জুড়িয়ে নেই।
আমরা মেঘেদের দিকে তাকাই, আমরা মেঘেদের মাঝে ডুবি।
আমরা এখানে, দুটো র্সূয দেখি।
একপাশে পৃথিবীর সারথি, অন্যপাশে সাদা ফসফরাস।
আমরা এখানে, দুটো সত্য জানি:
এক নির্ঘাত মৃত্যু, আর মৃত্যুর আগে কিছু শেষ নিঃশ্বাস।
ওই সব শিশুদের তুমি কি বলবে?
যাদের কাছে লোহিত সাগর কখনো বিভক্ত হয় না।
নাকবার দিনে জন্মেছি
তোমাদের নিষ্ঠুরতা আমার জীবনকে নতুন করে লিখেছে
তোমাদের ক্রুর ভরা কৌতুক আমার নাড়িতে শেকড় গেড়েছে,
আমার জিহ্বা হয়ে উঠেছে ধারালো ফলক,
আমার মুখগহ্বর ফুলে উঠেছে
বজ্রধ্বনিতে।
তোমাদের নির্দয়তা শিখিয়েছে কি করে বুক ঠেলে
সামনে এগিয়ে যেতে হয়,
আরো কাছ থেকে দেখতে হয়,
আরো মন দিয়ে শুনতে হয়।
নাকবার সুর্বণজয়ন্তীতে আমি জন্মেছিলাম
এমন এক মায়ের গর্ভে, যে কেটে কেটে জমাচ্ছিল
জলপাই, ডুমুর ও কোরানের কিছু আয়াত।
আমার নাম যেন সাদাঘরের এক ঘুমন্ত অগ্নিপিণ্ড,
বিমানবন্দরে হেঁটে যাওয়া এক চলন্ত অবিশ্বাস,
এক গন্তব্যহীন রাজনীতি।
নাকবার সুর্বণজয়ন্তীতে আমি জন্মেছিলাম
হাসপাতালের বাইরে:
বিক্ষোভ, পোড়া রাবার,
কাফিয়া বাঁধা মুখগুলো, নগ্ন দেহগুলো,
ট্যাংকের দিকে নিক্ষিপ্ত পাথরগুলো,
ট্যাংকের গায়ে আঁকা আমেরিকার পতাকাগুলো
মাটির ঘ্রাণে কাঁদুনে গ্যাসের ঝাঁঝ,
আকাশের প্রাণে রাবার বুলেটের সাজ,
কিছু মানুষ গুলিবিদ্ধ, আর কিছু প্রাণহীন—
মৃতদের সংখ্যাই শুধু খবরের শিরোনাম।
আমি
ও আমার বোন
জন্মেছিলাম।
জন্ম মৃত্যুর চেয়ে দীর্ঘতর
ফিলিস্তানে মৃত্যু আসে হঠাৎ করে,
মুর্হূতের মধ্যে আসে,
অবিরাম আসে,
দুটি শ্বাসের মাঝামাঝি সময়ে চলে আসে।
আমি কবিতার মাঝেই জন্মেছি
ঠিক সুর্বণজয়ন্তীতে।
হাসপাতালের বাইরের স্বাধীনতা সঙ্গীত
সুর ও ছন্দে মাকে যেন বলছিল—
আরো জোরে দম ছাড়ো।
নোট: আরবিতে নাকবা শব্দটির অর্থ বিপর্যয়। বর্তমানে নাকবা মূলত ১৯৪৮ ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন এবং জাতি নিধন ও গণহত্যার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে শতকরা ৭৮ ভাগ ভূমির অবৈধ দখলকে নির্দেশ করে। ফিলিস্তিনবাসী প্রতিবছর ১৫ মে নাকবা দিবস হিসাবে পালন করে। ইহুদি জাতীয়তাবাদ [জায়নবাদ] প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ হয়। মতান্তরে, ইসরাইলের দখলদারি-উপনিবেশবাদী প্রকল্প আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের হত্যা, দখল ও বিতরণের মাধ্যমে নাকবা বজায় রেখেছে।
কাব্যহীনতার দিন
আত্মহননে কোন কাব্যময়তা নেই
যেমন নেই সিগারেটের ধোঁয়ায়,
তারপরও
শত শত কবি বন্দুকের ভয়ে পঙ্ক্তি রচনা থামিয়ে দেয়
খাঁজকাটা পাথরে বাধা পেয়ে পঙ্ক্তিমালা ছিঁড়ে ফেলে।
কবিরা খাঁজকাটা পাথরের ধারে ঘাড় পেতে দেয়।
কেউ কেউ পাহাড়ের ফাটলে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে।
অনেকেই মৃত্যুর মাঝে ছন্দ খুঁজে পায় আর গেয়ে ওঠে
ঘুম পাড়ানির গান—যেন এক আনন্দ নিবাস।
শোকের সাগরে ডুবসাঁতার
কানে কানে চুপকথা, লেখার টেবিলে ছড়িয়ে আছে
কবিদের শেষকথা।
এখানে আর কোন সৌন্দর্য নেই।
অনুবাদ ও ভূমিকা ► পলাশ মাহমুদ
Osadharon
TareiQue TarIq
অক্টোবর ২৫, ২০২৩ ২৩:৫২