কেউ দেখে না যে ক্রন্দন ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-

 

উচ্চতা কোনো সীমানা নয় 

ভাবছ, জীবন এক লাল ঘোড়া 
টগবগিয়ে ছুটবে সে তার গন্তব্যে 
ছেড়ে দিলে আকাশের ঠিকানায় 
মোহগ্রস্ত খুঁজবে মর্ত্যের বৃক্ষ থেকে শূন্যে 
অথচ গভীর শূন্যে আকাশ থাকে না 
আকাশের ঝুল থেকে মেঘ হয় 
মেঘের সঙ্গম থেকে জল 
সাঁতার না জানার আগেই 
কূলে উঠতে চাওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত?  
এদেশের নদীগুলো শিক্ষক হয়নি 
সাঁতার শেখাটা সূচীবদ্ধ হয়নি কোথাও 
আয়নার পশ্চাতে পারদ ঘষে দিলে 
কিছুই যায় না দেখা, 
গৌতম, তোমার লাল চাদরের কারণে পাহাড় 
দেখা না গেলে সহজে আমি উচ্চতা বুঝি না।

 

বেলাবিস্কুট 

খামির ও মাওয়া 
সরাসরি তন্দুরে যাও লাল হতে
জন্ম নাও দ্রুত তন্দুর শৃঙ্গারে, 
এতটা অল্পায়ু নিয়ে এসেছ জীবনে  
আস্বাদের নামে শরীরে কামড় দেয়া 
ফুর ফুর করে ভেঙে জিহ্বায় একেবারে...  

অন্তঃপুরে চলে যাওয়া তোমার পরিণতি—
মনুষ্য কামড়—ছটফট বিদীর্ণ বাগান  
কাউকে নালিশ দাওনি কখনো  
এমনই ধৈর্য্য নিয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে যাও 
শুনেছি আমিও পর্তুগিজ মোঘলরা 
তোমাকে ব্যাকুল চুমু দিত ঠোঁটে 
অথচ দহন কেউ-ই বোঝেনি; এমনকি বর্গিরাও 
সেদিন বালির পাহাড়ে তোমার গড়াগড়ি  
যাওয়া দেখেছি, হে অসহায় বেলা বিস্কুট 
ধুঁকে ধুঁকে তোমার ভবিষ্যৎ এখনও টিকে আছে। 
খাদে পতিত মানুষ 
কী বিবর্ণ তোমার কান্দন! 

 

একটা অচেনা লোমহর্ষক বাঘ

একটা অচেনা লোমহর্ষক ডোরাকাটা বাঘ 

কোথা থেকে এলো ঘাটের কিনারে 
আমাকে সে নিয়ে যাবে গভীর জঙ্গলে 
পাহাড় গভীর অরণ্য ও নদী পেরিয়ে সে—
রেখে গেল আমারকে পুরাতন ঠিকানায়; 
এটিই রহস্য! 

বাঘ—আমাকে একটা আঁচড় দেয়নি, 
খাবলে খায়নি আমার দেহের মাংস। শোনা হলো, 
প্রাণিবধ ভালো লাগে না তার। রক্ত পানে আগের সে
তৃপ্তি নেই। বাঘের শরীর নীলবর্ণ রক্তনুন 
রক্তবমিতে ভাসছে বনবাদাড়ের বৃক্ষ 
অনাগত সময় খারাপ, খুব 
বুভুক্ষু মানুষ, যেকোনো দিন-ই বন্যপ্রাণী খাওয়া শুরু করবে নির্ঘাৎ 
পুরো পৃথিবী গভীর অ্যামাজনে রূপান্তর হবে  
মানুষের হিংস্রতম প্রথা রবিভোর ছুঁড়ে দেবে দূরে 
শ্রাবণের অবিরল ধারা যখন গাইছি ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ।

 

কেউ দেখে না যে ক্রন্দন

ভীষণ আরাম করে কবিতা লিখবো 
একবাটি ধনেপাতা সম্মুখে তাকিয়ে 
করুণ আমার দিকে 
এক অমলেট ডিমে ধনেপাতারও জীবনাবসান 
এনিয়ে উদ্বেগ 
পেঁয়াজ পাতার অবিশ্রান্ত কান্না কুঁচি কুঁচি হবে 
নুদুস শরীর 
ভয়াবহ এ-ই কান্না আমার চোখেও জলধারা 
গড়িয়ে চলছে চোখের উনুনে। 
ভেঙে যাওয়া ডিমের সমস্ত শরীরে তেল 
আধিক্য—খাওয়া রুচিসম্মত হয়নি 
আমরা বুঝিনি কখনোই উনুনে ডিমের কান্না,
তেলের ফুটানি 
কথাখানি সারিবদ্ধ পিঁপড়েও জানে 
আরামমতো কবিতা লেখা পাঠ—উপযোগী হয়, 
যদি শরীর বেতসলতা শুয়ে-বসে বুকটানে  
না জানুক কথাটা কেউ—সন্ধ্যার আবেগ জানে।

 

যদি মর্ম সরে যায় 

তুমি অধর্ম করেছ জানি সারাবেলা 
যদি মর্ম সরে যায় কী জানি কি হয় 
চুরিতে করি না পাপ ওগো বোন-মেঘ 
মনে সুসংহত চাঁদ তবু কেন পরাজয়।   
আমাকে যেখানে তাকদীর নেবে নিক 
যদি হতে থাকি আমি শুধু ক্রীড়নক 
এত প্রহরায় রাখা যত রাত আয়ু বনে 
প্রতিদিন বাড়ে চুল, বাড়ে গুপ্ত নখ।  

নিঃসঙ্গ চেরাগ জ্বলে যদি আসে আলো  
অজ্ঞতা প্রকাশ্যে নগ্ন হ'য়ে ওঠে রথে 
জীবনের শেষ সূর্য আজ অস্তমিত দেহে 
বাড়ন্ত বেদনা নড়ে নাকের ঝিমুনো নথে। 

বাসমতী চাল ঝেড়ে কাঁচা রোদ ঝিল হলে 
আসঙ্গ রূপতী ভাসে মরা কোন যমুনার জলে! 

 

যখন দুঃখ প্রস্তুত হতে থাকে

দুঃখের একটি মেয়ে 
অনেক দূরের 
নন্দনকানন কাটা পাহাড়ের গায়ে 
যখনই ছেঁড়া মেঘের জিহবা ঘামে 
যখন ধরার চেষ্টা করি 
আমার বাবার মানা যেন কখনোই কোন দুঃখ
হাত দিয়ে না ছুঁই।  
বাবা অসুখের সময় দু’হাতে চেপে 
ঝরঝর করে কাঁদতেন 
আমার মা কাছে বসে দেখতেন,  
আমি দূর থেকে গ্রীষ্মকালে কালোমেঘ 
দেখতাম—যেন শরবিদ্ধ মানুষ বুকছিদ্র 
জলের ফোয়ারা চোখের সাঁতার 
একেকটা লবণের গোলা।  
বাবা না বুঝে মতন অল্প জল 
মুখে নিয়ে লবণের স্বাদ পাই। 
একদিন সকাল বেলায় বাবা মেসওয়াক করছেন 
এদিক-ওদিক ধীর পায়ে হাঁটছেন, 
আমি ক্ষীণস্বরে বলি, 
বাবা, তোমার দুঃখের লবণাক্ত জল ক্ষার এবং ধার   
জিহবার তল পর্যন্ত পৌঁছালে 
তুমি—বাবাকে চিনতে সহজ উত্তম 
বাবাকে দুঃখের সাথে মেলাতে ভীষণ কষ্ট— 
একদিন মা কাঁদলে সরল বুঝতে পারি 
দুঃখ—আমার অশিক্ষিত মা 
বাবা ভারী বোঝা টানতে টানতে ক্লান্ত।