মুক্তিযুদ্ধের জন-ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য বই

অ+ অ-

 

সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ যখন চলে, তখন আসলে কী ঘটেছিল? কারা কারা সম্মুখ সমরে অংশ নেন। তাদের কী ভূমিকা ছিল, বামপন্থীরা কী করেছিল? এমন বহু চলমান প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে বইটি পড়া জরুরি।

 

বার্থ অব বাংলাদেশ: দ্য পলিটিক্স অব হিস্টোরি অ্যান্ড দ্য হিস্টোরি অব পলিটিক্স
নূরুল কবীর
প্রকাশক: সংহতি প্রকাশন
প্রকাশকাল: ২০২২ সাল
প্রচ্ছদ:
 নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
মূল্য: ২০০০ টাকা

বাংলা ভাষার মহান বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে মহাসিন্ধুর কল্লোল বলে অভিহিত করেছিলেন। এই মহাসিন্ধুর কল্লোল বিষয়টা এক কথায় বুঝিয়ে বলা খুব মুশকিল। সহজ অর্থে বলতে গেলে সমুদ্রে যেমন অনেক ঢেউ, অনেক শব্দআমাদের মুক্তিযুদ্ধও ছিল তেমনি অনেক বড়। অনেক ঘটনা, অনেক মানুষ, তাদের মত ও পথ সবকিছুকে এক সঙ্গে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ যখন শেষ হয়ে গেল তার ঠিক অব্যবহিত পরে সমুদ্রের ঢেউ এবং শব্দের সংখ্যা কমতে শুরু করে। আর পঞ্চাশ বছর পর একটি বা দুটি ঢেউ, একটি বা দুটি কণ্ঠস্বরই যেন টিকে আছে বা আমরা শুনতে পারছি। আমাদের সরকারগুলো যেসব বক্তব্য হাজির করে জনগণের সামনে তাকে বিশ্বাস না করে উপায় থাকে না। আমাদের হাতের কাছে কোনো বই নেই যা দেখে এবং পড়ে আমরা বুঝতে পারতাম আসলে কী ঘটেছিল। ফলে এখানে যে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে একটা পিপলস ভয়েজ তৈরি হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। পঞ্চাশ বছরেও হয়নি।  

এর কারণ কী?

কারণটার সন্ধান পাই আমাদের সময়ের অকপট বুদ্ধিজীবী, গবেষক ও সম্পাদক নূরুল কবীরের বার্থ অব বাংলাদেশ: দ্য পলিটিক্স অব হিস্টরি অ্যান্ড দ্য হিস্টরি অব পলিটিক্স বইয়ে। বইটা কিনেছিলাম কয়েক মাস আগে। কেনার পর নূরুল কবীরের অটোগ্রাফও নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু পড়া হচ্ছিল না। বারবার প্রচ্ছদ উল্টে, সূচি দেখে, কোন অধ্যায়ে কী লেখা আছে দেখে আবার রেখে দিচ্ছিলাম।

পড়া শুরু করছিলাম না বইয়ের আকার দেখে। প্রায় এগার শ’ পৃষ্ঠার বই। ভাবছিলাম যে শুধু শুধু পড়তে শুরু করব আর শেষ করা হবে না। ইদানিং এমনই হচ্ছে, অনেক বই শুরু করি তবে শেষ করতে পারি না। পরে আবার শুরু থেকে পড়তে হয়।

নূরুল কবীরের এ বইও দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তবে দ্রুতই পড়তে শুরু করি বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে। এখানে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে তাদের যে বক্তব্য হাজির করে তা বেশ কৌতুহল উদ্দীপক। সে কৌতূহল মেটাতে বইটি পড়া শুরু করি।

পড়তে শুরু করার পর মনে হলোবইটা যেন আমাকে তার ভেতর টেনে নিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের মহাসমুদ্রে আমি যেন এক অভিযাত্রী হয়ে পড়েছি। একটানে তড় তড় করে পড়ে ফেললাম। আর পড়ার পর থেকে বইটা সারাক্ষণ আমার ভেতর অনুরণন তুলছে।

এর মধ্যে যেমন ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন কথা উঠল। আমি সেসব আলোচনায় অংশ নিতে পারলাম নূরুল কবীরের বইটার কারণে। যদিও ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমাদের আরেক মহীরূহ বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমরের তিন খণ্ডের পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন বইটা পড়া ছিল। তবে নূরুল  কবীরের বইয়ের সুবিধা হলো অন্যান্য আরো রেফারেন্স বা তথ্য তিনি সন্নিবেশিত করেছেন। তার বইটা পড়ে আমার মনে হয়েছে কনফ্রন্ট উইদ দ্য প্রেজেন্ট বর্তমানে যেসব তথ্য-বক্তব্য আমাদের সামনে হাজির করা হয়, সেগুলোকে প্রশ্ন করা এবং তার উত্তর খোঁজার এক সাহস বা অনুপ্রেরণা যা-ই বলি না কেন এ বই থেকে পাচ্ছি। এতে নিজের ভেতর একটা ফুলফিল ভাব আসে।

এই বইয়ের সুবিধা হলো ইতিহাসের সব পক্ষ, সব মতকে পাওয়া যায়। শাসক শ্রেণির বয়ান এবং সেই সময়ে যারা প্রত্যক্ষ করেছেন ঘটনাবলি তাদের বিবরণ মিলিয়ে পড়তে পারবেন পাঠক। জোর করে কোনো একটা ঘটনাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রয়াস এ বইয়ের নাই। বরং লেখকের উদ্দেশ্য উল্টো। তিনি ইতিহাসের নামে একটা তক্তা হাজির করতে চান না যাকে নতুন করে গড়া যাবে না।

আমাদের এখানে ক্ষমতাসীনরা ইতিহাস নামে যে নিরেট তক্তা হাতে ধরিয়ে দেন, জাতিকে তা নিয়েই যেন চলতে হবে জনমভর! নূরুল কবীর সেই ক্ষমতাসীন বয়ানকেই প্রশ্ন করেন বা দুর্বল করে দেন। এ কাজ অবশ্যই কঠিন। অনেক খেটে, বহু পরিশ্রম করে যত বেশি সম্ভব পারপস্পরিক তথ্যগুলো একসঙ্গে করার যে হিম্মত লেখক দেখিয়েছেন তা বইটি হাতে নিলে এর ভর অনুভব কলেই মনে হবে।

শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে যত আলোচিত ঘটনা ঘটেছে সেগুলোকে নানাজনের দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে আনা হয়েছে। তবে এগুলো শুধু জানার জন্যই জানা হয়ে থাকে নাই আমার কাছে। সেই হালকা উদ্দেশ্য নূরুল কবীরের ছিলও না। এ জন্য শুরুতে ইতিহাসকে দেখার একটা দৃষ্টিভঙ্গি তিনি প্রস্তাব করেন।

ইতিহাসকে অতীতের ঘটনা হিসেবে জানতে বা বুঝতে আমরা অভ্যস্ত। আমাদের জন্য নূরুল কবীরের পরামর্শ হলো ইতিহাস বর্তমানের ঘটনা। অবশ্য এ তত্ত্ব বা দর্শন তার নিজের একার নয়। বিশ্বের অনেক দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, তাত্ত্বিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বিষয়টাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। নিজেও বলেছেন অনেক কথা। এসব কথার মর্মার্থ হলো, ইতিহাস বিনির্মাণের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ক্ষমতার প্রশ্ন। ক্ষমতা কাদের হাতে, তাতে নিহিত কোন ইতিহাস জনগণের সামনে হাজির করা হবে, সে বিষয়টি। শুধু হাজির নয়, ক্ষমতার কথা হলো তাদের ইতিহাসই শেষ কথা এবং একেই বিশ্বাস করতে হবে। ক্ষমতা যে জনগণের ওপর তার প্রভাব বিস্তার করবে, সেই ছড়ির নাম হলো ইতিহাস। বাংলাদেশে বসে আমরা যা খুব ভালোভাবে টের পাই।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের ইতিহাসেই এক অবস্মিরণীয় ঘটনা। একে কারো হাতের খেলার পুতুল করে ফেলা থেকে অন্তত বার্থ অব বাংলাদেশ: দ্য পলিটিক্স অব হিস্টরি অ্যান্ড দ্য হিস্টরি অব পলিটিক্স বইটি আমাদের রেহাই দেবে। ইতিহাস অনুরাগী, রাজনীতি সচেতন কোনো ব্যক্তি বা বুদ্ধিজীবী এবং তরুণদের জন্য অবশ্য পাঠ্য একটি বই।

এমন পরিস্থিতিতে বর্তমানে শাসক শ্রেণির যে হেজেমনির ভেতর নাগরিকদের থাকতে হয়, সেখানে একটা দরজা নূরুল কবীরের এ বই। এই দরজা দিয়ে নূরুল কবীরের ইতিহাস ব্যাখ্যার ভুবনে প্রবেশ করলে শাসক শ্রেণির চলমান বিভিন্ন তথ্যকে উলটে-পালটে দেখা যায়। আর এই দেখা শুধু জানার জন্য না তা আগেই বলেছি। এই দেখার মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্বকেও টের করা সম্ভব। যা এখনকার এবং আগামীর রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা তৈরির সম্ভাবনা জাগায়।

যদি তেমন রাজনৈতিক পরিবর্তন নাও ঘটে অন্তত শাসক শ্রেণির বা সরকারি তথ্যের নিষ্ঠাবান ভোক্তা হয়ে পড়া থেকে মুক্তি দেবে এ বই। মুক্তিযুদ্ধকে জানা-বোঝার অনেক চোখ খুলে দেবে। পাঠকের জন্য এ লেখক মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাখ্যা করার উন্মুক্ত এক ক্ষেত্র সাজিয়েছেন।

বইটিতে অধ্যায় রয়েছে মোট দশটি। মুক্তিযুদ্ধকে শুধু বাংলাদেশের শাসক শ্রেণি নয়, বরং ভারত-পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বা তাদের বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে দেখেন, তারও তালাশ করা হয়েছে। এসব ঘটনার সবগুলো যে নতুন তা নয়। বা এটাও নতুন বলে মনে হয়নি যে, মুক্তিযুদ্ধকে দেখার জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি। তবে নূরুল কবীরের বইটার গুরুত্ব প্রথমত সময়। যে খবরদারির শাসন এখন চলছে, একদেশদর্শিতাকে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, সে সময়ে এমন একটি বই লিখতে পারার সাহস সবার থাকে না।

দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধকে বুঝাপড়া ছাড়া, বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সামগ্রিক মুক্তি অসম্ভব। এ বিষয়টি নূরুল কবীর বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি কিছু প্রশ্নকে ডিল করেছেন। যেমন মুক্তিযুদ্ধ নামের যে বিপ্লব আমরা কীভাবে দেখব তাকে? মুক্তিযুদ্ধ কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, নাকি সেক্যুলার বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ, একক ব্যক্তির নৈপুণ্য প্রদশর্নের যুদ্ধকী আসলে? নাকি জনমানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যুদ্ধ হয়েছিল এ দেশে, সেই মুক্তির অর্থ কী?

এগুলো নিয়ে আমাদের দেশের সুধি সমাজ, বুদ্ধিজীবী বা রাজনীতিবিদরা অনেক কথা বলেছেন। নূরুল কবীর নতুন যা যুক্ত করছেন তা হলো প্রায় সমস্ত আলোচিত ঘটনাকে নেড়েচেড়ে দেখিয়েছেন যেএখনকার যারা কথা বলছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের কোনটা কতটা সত্য।

দার্শনিকভাবে তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, এই সত্য আগে থেকে হাজির থাকা কোনো বিষয় না। বরং এই সত্য তৈরির কার্য-কারণ রয়েছে। আর এতে যুক্ত রয়েছে মানুষের দুঃখ, কষ্ট, বঞ্চনা, অপমানিত হওয়ার ইতিহাস। অর্থাৎ অজস্র মানুষ যার যার অবস্থান থেকে এ সত্যকে নাজেল করেছেন। সেখানে নেতৃস্থানীয় যারা ছিলেন, তারাও পয়গম্বর ছিলেন না। তাদেরও নানা উদ্দেশ্য, অপারঙ্গমতা ছিল, রাজনীতি ছিল। তারাও বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে চলমান সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরম্পরার অংশ। তাদের রাজনৈতিক ভুলসহই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ঘটে গেছে। আর যেহেতু সাফল্য এসেছে ফলে ব্যর্থতাকে যদি ধামাচাপা দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পন্থা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবে। তখন স্তুতি করাই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পর্যবসিত হবে। সেই রাজনীতিকে নস্যাৎ করে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক মানচিত্র আঁকতে চেয়েছেন নূরুল কবীর।   

যেমন ২৫ মার্চ পকিস্তানি হানাদার বাহিনির নির্মম গণহত্যার আগে কী ঘটেছিল? বঙ্গবন্ধু আসলে কী করেছিলেন। বা তার পরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে কী করেছিলেন। তিনি যে রিভোল্ট করেছিলেন তার আগে কি আর কেউ করেছিল বিদ্রোহ পাকিস্তান সামরিক বাহিনিতে?

সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ যখন চলে, তখন আসলে কী ঘটেছিল? কারা কারা সম্মুখ সমরে অংশ নেন। তাদের কী ভূমিকা ছিল, বামপন্থীরা কী করেছিল? এমন বহু চলমান প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে বইটি পড়া জরুরি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানের রাজনৈতিক বাস্তবতা কী ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তানের জনতা এক হয়ে যায় শাসকদের বিরুদ্ধে। ইতিহাসের এসব ঘটনা জানাকে জরুরি করে তোলেন নূরুল কবীর। তার বইটি বলাবাহুল্য মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা। 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের ইতিহাসেই এক অবস্মিরণীয় ঘটনা। একে কারো হাতের খেলার পুতুল করে ফেলা থেকে অন্তত বার্থ অব বাংলাদেশ: দ্য পলিটিক্স অব হিস্টরি অ্যান্ড দ্য হিস্টরি অব পলিটিক্স বইটি আমাদের রেহাই দেবে। ইতিহাস অনুরাগী, রাজনীতি সচেতন কোনো ব্যক্তি বা বুদ্ধিজীবী এবং তরুণদের জন্য অবশ্য পাঠ্য একটি বই।

একই সঙ্গে নূরুল কবীরের প্রতি আরো শ্রদ্ধ বেড়ে যায়, তিনি তার পরের প্রজন্মকে ঋণী করে গেলেন। এখনো তিনি যে তারুণ্য, শক্তি ও ক্ষমতা নিজের ভেতর ধারণ করেন, তা আমাদের প্রজন্মে অনুপস্থিত। কী কষ্টকর এক কাজ এত বড় একটি বই লেখা! বইটি ইংরেজিতে লেখা হলেও পড়তে সহজ ও চিত্তাকর্ষক। শুধু এ সময়ের জন্য নয়, যে কোনো সময়ের ক্ষমতাসীনদের বলাবলিকে প্রশ্ন করতে পারার একটি কণ্ঠ হয়ে থাকবে বইটি। কয়েক দশক আগের ঘটনাবলি নিয়ে লেখা হলেও, বইটির প্রাসঙ্গিকতা থেকে যাবে অন্তত আরো বহু বছর।