কাজলরেখা
চোখ মেলে তাকালে বিষম অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার, সকাল হয়নি। ঘরটার ভেতর ভ্যাপসা গরম, হয়তো শেষরাতে কারেন্ট চলে গিয়েছে। ফ্যানটা বন্ধ হওয়ায় কি ঘুম ভাঙলো? কই, সে তেমন ঘামেনি।
ঘোরটার ভেতর চাইলো ভাবতে। ঘুম ছিলো না, অচেতনের মিশ্রিত তন্দ্রা ভাবনাটুকু এলোমেলো করে কিছু যেন থোকা থোকা ফুটিয়ে হারিয়ে গেলো মুহূর্তে। কপালের চুল বাম চোখের কোণায় ঢুকে পড়েছে, অস্বস্তি খুব, হাত দিয়ে সরাতে গিয়ে অনুভব করলো শরীরের ক্ষীণ অনুভূতি; এক অর্থহীন বিস্ময় মুহূর্তের ভেতর এলো আর নিত্য অভ্যস্ততায় তাকে নিয়ে এলো মনন ও চেতনার লক্ষ্যে। স্নায়ুগুলো ছিলো শিথিল। মাথাটায় ঝিমঝিম অনেক। চোখ বুজে আসছিলো ক্লান্তির শূন্যতায়! ডান চোখের ওপরের পাপড়িটা পরপর নড়লো। সংস্কারে এসবের অর্থ আছে—অনর্থক।
মাথাটা ঘোরাতেই সে বুঝলো, যেন দেখলো একপলকে, শাড়ির ভেতর ঝড়োকাকের মতোন তার দেহটা। রাতে ড্রিঙ্ক করেছিলো সামান্য। মাথাটা ভারি হবার কথা না। শ্বাস নিতে গিয়ে ব্যথাটা ধরা পড়লো—ব্যথা, অসহনীয় ব্যথা—ছড়িয়ে দিচ্ছে। স্বাভাবিকতায় চেপে রাখা এই প্রয়াসই দুঃখ, ভাবেনি। চোখের পাপড়িটা আবার নড়লো। কোনো শুভ অর্থ কি হয়? হাসলো—ফিক করে, আর ভাবলো, সে মানেই শুভ। তন্দ্রার ঘোরটা নেই। ধীরে ধীরে পুষ্ট হচ্ছিলো সকাল।
পাশ ফিরে শুয়ে হাঁটু দুটো ভাঁজ করে দু’পা এগিয়ে নিলো, বাম পাশের বৃদ্ধাঙুলি নুয়ে পড়া। ঘাড় ছুঁয়ে বুকের বেণিটা নেমে চাপ রাখছে প্রবণতায়। মুহূর্তটা এমন, টানা সাতদিন যদি ঘুমাতে পারতো, অক্লান্ত-নিথর, তন্দ্রায় মৃদুশ্বাসের অপরিমেয় ঘুমের স্নিগ্ধস্বরে সপ্তাহ পার করে কোনো ক্যাফেতে গিয়ে উদাস অপেক্ষায় থাকা। আরো কিছু ভাবতে চেয়েছিলো। পাশের ঘরে মা উঠে পড়েছে বুঝে এলোমেলো হওয়াটাকে রাখতে চাইলো না। ভেজানো দরজা ঠেলে মা এগিয়ে এসে, যেন গোনা গোনা শব্দে আর মৃদুস্বরে—কাজল, কাজল ওঠ মা—বলে ডেকে ওঠেন, মৃদু শ্বাসহীন আর্দ্র করুণায়। নিজের ওপর তপ্তবিরক্তি উগ্রতায় রূপ নিয়ে কাজল চাচ্ছিলো উঠে দাঁড়াতে; অন্তত মা’র সুইচ টিপে আলো জ্বালানোর প্রক্রিয়াটা এতো নিত্য এতো অভ্যস্ত দেখা, সেটা বিড়ম্বনা। সকালে চোখ মেলে অন্ধকার ঘরটাই ভালো লাগছিলো। অন্ধকারের খুব ক্ষুদ্র এক আলো অজান্তে সে দেখেছিলো... অথচ মা জানে ইলেক্ট্রিসিটি নেই তবু সুইচ বোর্ডের দিকে মা’র হাতটা এগিয়েছে! স্তব্ধতার শীতলতা আনে অপরাধবোধ অথবা হীনমন্যতা, না-কি অবসাদকে মানার মতো নিস্তব্ধ প্রেক্ষিত। খোলা জানালা থেকে আলো এনে মা কাজলের দিকে তাকালে মনে হলো, মা কি তার জন্মদাগটা এখনো খোঁজে; না পেয়ে বহুদিন বলতো, দু-একজনের চামড়ার তলে থাকে, দেখা যায় মরণের সময়। তারটা কই? সে কি জন্মেছে?
বাইরে রোদ ও মেঘলা আকাশ। যুগপৎ স্থির। ঘরে হাওয়া ঢুকে গুমোট ভাবটা কাটিয়ে দিলো। রাস্তায় গাড়ির শব্দ তার অবসাদগুলোকে সক্রিয় করে এক ধরনের নেতিবাচক গতিশীলতা দিলে এক অস্থির দ্রুততায় বিছানা ছেড়ে কাজল কয়েকটি ওষুধ হাতের তালুতে এনে রাখে। বাসি পেটে যে ওষুধগুলো খাওয়ার নিয়ম। সকালে রূপ দেখছিলো জানালায়। সকাল বলে কিছু আছে—কখনো দ্যাখে? প্রখরতায় সকালের তাপগুলো তৈরি হয় রাতে। স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা উন্মোচিত হয়ে মুখোশের সৌকর্য বাড়ায় একটি শব্দে; বিরল অভ্যস্ততায় আর অনুষঙ্গে অবলীলায় তাকে সন্ত্রস্ত রাখে—সে রাত; নিভৃতে লুকোচুরি খেলার মতো নীরবতা। অলক্ষে নেমে যায় ঘামের বিন্দুতে ভেজা ঠাণ্ডা সরীসৃপ, ফণা দোলায় শীতল সতর্কতায় আর মূর্ছনায় অকপটে মাথা নাড়ে, চোখের মণি ঘোরায়, বাস্তবতায় হিস্ হিস্ করে! এই সত্যকে সে মেনে নিয়েছে, গ্লানিকে গলাচাপা দিয়ে এগিয়েছে শুরুতেই, শুধু তার শূন্যতাটুকুই!
বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়ালো কাজল। সামনে ঝুঁকে আসা চুলের পাশাপাশি দেখলো ঘন পাপড়িগুলো। প্রশস্ত গভীর চোখে প্রেমিকার স্নেহস্ফুরণ। মৃদু হেসে একটি বিষয় লুকোতে চাইলো-বা। মনোরমা হাসি আর ঝুঁকে আসা চুল ছুঁয়ে চোখের গোপন অশ্লীলতাটুকু বিব্রত করলো। একটা বৈসাদৃশ্য কণ্ঠনালিতে দলা পাকিয়ে দিয়ে আটকে ফেলতে চাইলে কাজল সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে না, অন্তত শ্লীল-অশ্লীল—বিবেক-বিবেচনা যে ভয়ের জটিল রূপ, বিষয়গুলোকে ভেবেছে এভাবে। আপন স্বজ্ঞায় এক স্বীকৃতি গতিশীল করে শিরা-উপশিরায়। কোমরের ব্যথাটা তখনো! সোজা হয়ে মাথা উঁচু করলে বেড়ে ওঠে যন্ত্রণা! চুলগুলো আলগোছে সরিয়ে, দাঁতে টুথব্রাশ ঘষে, চোখে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘাড়ে ভেজা হাতটা রেখে দিলো, চপলতার বিপরীতে তার সবকিছু হোক! মনে হলো, তার দেহের আকার চতুর্ভুজি কোনাকুনি না-কি ঢেউ খেলানো? ঊনত্রিশ বছরের নিস্বনে রূপ-রস-গন্ধে থাকে, গেরস্থি অবয়ব বিলুপ্ত আর ত্বকের ঔজ্জ্বল্যে হালকা সেই রঙ এখনো পেলব। চামড়ার তল থেকে এক অদ্ভুত গন্ধ তার নাকে এলো—মাংসের! চোখ-মুখ-হাত-স্তন পুষ্টঋদ্ধ দেহের তুলনায় কাজলের পা’দুটো সামান্য ছোটো। জিব-নখ আর ঠোঁট উষ্ণ-তৃষ্ণার্ত—যেন নবান্নে—পালং শাক যাকে নারী বানিয়েছে। রাতে ডিসপ্রোনিয়ার বিষগুলো গ্রহণীয় করে তুলতে তুলতে জন্মদাগের কথা মনে হয়। আদৌ ও জন্মেছে! জন্ম হলে যেসব অর্জন ধর্তব্য তালিকায়, লজ্জিত না হবার মতো কারিকুলাম ভিটা, উচ্চতর একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন, ইনস্টিটিউশনের নাম, বাবার পেশা, স্থায়ী ঠিকানা, ফিঁয়াসের স্টেটাস—নিত্য টাইপ করা পাতার গোল ভাঁজকে সরু গার্ডার দিয়ে টাইট করে রাখা। তার আদৌ কি কোনো অস্তিত্ব আছে?
রাতে যে যুবকটি কাজলের পিছু নিয়েছিলো ওকে এখন খারাপ লাগছে না তার। গাড়ির পেছনের নেমেছিলো দরজা থেকে। দুজন সঙ্গে। সাহস আছে—হেঁটে আসার ভেতর বোঝা যায়। কাজল ভয় পেলো। যুবকটা সিগারেট জ্বালালো দেশলাই দিয়ে—তারপর হাত বাড়িয়ে... ব্যাগটা দিন—। কাজল হাতব্যাগটা দুহাতে বুকে চেপে রাখলো। রাস্তাটা বেশি নীরব, দূরে দু-একটি রিকশা। যুবকটার পোশাকের তুলনায় চুলের নিপুণ পারিপাট্য দেখে বোধহয় কাজল বললো, বেশি টাকা এই ব্যাগে নেই। তখন এই বাক্যটির ভেতর একটা ব্যাপ্তি তার নিজের কানেই লাগলো। গাড়ির দিকে যেন পিছিয়ে গেলো যুবকরা। পরক্ষণে এগিয়ে এসে অদ্ভুত দৃষ্টিতে কাজলের দিকে তাকালো: থ্যাঙ্কস—বলে গাড়িতে ওঠার আগ্রহটা তাদের খুব ধীরে। পুরনো টয়োটার ঘটঘটে আওয়াজ চাপ পড়ছিলো কাজলের ওপর। এগিয়ে আসা যুবকটি ডান হাতে সিগারেট ধরিয়ে বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটি একটু বেশি নাড়িয়ে বললো, বাই। তারপরই কাজল যেটা বললো, পরে অবাক হয়েছিলো নিজেই: প্লিজ গাড়িটা পাল্টিয়ে ফেলবেন; শব্দটা অসহ্য, ইঞ্জিনটা ঠিক করতে হলে নিশ্চয় কিছু টাকা লাগবে—। একটা ট্যাক্সি ক্যাব সামনে এগিয়ে এলো বাম রাস্তা ঘুরে। কাজল গাড়িতে উঠতে উঠতে ভাবলো, বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। এখন টানাপড়েনটা তার অদ্ভুত! ওরা এখন ফলো করবে, করতে থাকবে, পথে হয়তো থামাতে পারে আবার, জানে না, এই ড্রাইভার লোকটা কেমন সাহসী না ওদেরই লোক? সন্তর্পণে লুকিং মিররে তাকালে গাড়িটা পেছনে দেখা গেলো না। কোনো শব্দও পেলো না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কে যেন ইলাস্টিকের মতো নেশাটাকে টানছে। ইঞ্জিনটা কি পাল্টাতে গেলো? চুলের পারিপাট্য দেখে মনে হয়েছিলো, রিজিন্বল, জেদি হবার কথা না। যা হোক—তার বমি লাগছে। ফিরলো দ্রুত রাস্তা-ঘাট ফাঁকা থাকায়, ঘরে ঢুকে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো মনে নেই।
কাজল বাথরুম থেকে বের হলে মা বললেন, নাস্তাটা করে নে।
না, ভালো লাগছে না। (ভালো লাগছেও না)।
রাতে বেশি কিছু খেয়েছিলে?
হ্যাঁ—(কাজল মা’র দিকে তাকিয়ে নির্বিকার মিথ্যা বললো)।
কার বাসায়? দাওয়াত ছিলো কোথাও?
অফিসের—।
অফিসের কে? কাজল বিরক্ত হতে পারে ভেবে মা অন্তরঙ্গ হলেন যেন, স্বগত স্বরেই বললেন, অফিসের হলে যেতেই হয়।
খুব ভারি লাগলো কাজলের। মা একটা হাই তুলে তপ্ত শ্বাস ফেললেন। এমন শ্বাস যে করুণ শুষ্কতায় রুক্ষতা আনে সকালের রোদ, কাজলের সাম্প্রতিক কিস্তিতে কেনা ক্ষুদ্র ফ্ল্যাটের দরোজার পাশে রাখা টবের গাছের সবুজ পাতাগুলো মৃদু কালচে হয়। যেন তার হাত-পা নোংরা কাদায় আটকে গেছে—ভেতরের হাড়-মাংস অব্দি। অপার নিঃসঙ্গতায় রূপান্তরিত হবার অবিরত যন্ত্রণায় সে সীমাহীন জর্জর।
জানালা থেকে আসা মেঘলা রোদের ছাপ। কাজলের শীত লাগলো বোধহয়। জাপান থেকে ফিরেছে সীমা কয়েকদিন আগে, মা’র সঙ্গে দেখা করে গিয়েছে, চার মাস বাইরে, কাজল দেখা করেনি বলে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলেও মা এখন সতর্ক থাকেন। মায়ের কথা বোঝার অবকাশ কাজলের থাকে না। সে অনুভব করে, বারবার অনুভব করে, এই মেঘলা রোদে শীত লাগাটা সে বাড়িয়ে দেবে। হঠাৎই যেন গৃহকাতরতা পেয়ে বসে, এই আবহাওয়া কাজলের পছন্দ—মৃদু আলোর গুচ্ছ তাপহীন সক্রিয়তায় রাখে, অর্থপূর্ণতায় হাওয়া-রোদ আর প্রশ্নাতীত মুক্তির স্বাদ নিয়ে পাখির ডানায় প্রতিফলিত হতে থাকে আকাশের রঙ, গাছের পল্লবিত সবুজ, সড়কের নিস্তব্ধতা, যা স্বয়ংক্রিয়তায় কাজলের মননে নিরবচ্ছিন্নভাবে একাত্ম।
বিস্তৃত সবুজে অসীম দৃষ্টি নিয়ে চারপাশ ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিংগুলো। নীরব। নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেঙে এগোতে হয়; দূরবর্তী শান্ত অন্তর্জগতে মনোরমা। মূল ফটকটির বাইরে চা-বিস্কুটের দোকান। কড়া লিকারের চা আর গোল্ড লীফ। ভিড়ভাট্টা বেশি নেই, যা আছে পরিচিতরা। বেচাকেনা কম। এরকমই।
রুম্মান বললো, লাইফ হলো ফার্টিলাইজার, সাগরকলাগুলো উড়ে যাচ্ছে রোজ! সেলে রুম্মান সে একই কথা বলে চলছিলো বান্ধবীকে। সামনে বসা ওর অনুগত কেউ মন দিয়ে শুনছিলো। মিস হয়ে যাচ্ছে, ধরা যাচ্ছে না। অনুগত রুম্মানের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইলো। পারলো না। দোকানদার মলয় বললো, কথাটার অর্থ এট্টু বুঝায়ে বলেন। সাগরকলার সাথে কী যেন মিলাইলেন?
ধুর ব্যাটা, রুম্মান কদমছাঁট মাথায় নিজের বাম হাত রেখে বললো, ফার্টিলাইজার, ফার্টিলাইজার মানে সমৃদ্ধি, উর্বর, আর সাগরকলা বলে রুম্মান মলয়কে আঙুলের ইঙ্গিতে দেখিয়ে বললো, তোর ওই কলা কি সাগরকলা? সাগরকলার রঙ, গন্ধ আর সৌন্দর্য হলো ফার্টিলাইজার। চলে যাচ্ছে সামনে দিয়ে, ধরা যায় না। মলয় বোধহয় সামান্য বুঝে মাথা নাড়িয়েছিলো। তার ঝোলানো কলাগুলোয় ওই ফার্টিলাইজার না কি কতটুকু আছে সে বোধহয় চাচ্ছিলো তা দেখতে। অনুগত অবশেষে মুখ খুলেছিলো, সাগরকলা ধরতেই হবে এমন কী? সময়তো আছে।— স্লো অ্যান্ড স্টিডি উইনস্...
নাহ্, আমি একটা ডেভিল পটেনশিয়াল। কোনো ব্লেসিং নেই। রুম্মান ধরানো সিগারেটটা নিয়ে চোখ ঘুরিয়ে বলেছিলো, গড শুড ব্লেস মি। অনুগত সাহস নিয়েই বলেছিলো—র্যাডিকালদের এমনই হয়— অসহিষ্ণুতা লেগে থাকে। বল্ র্যাডিকাল কে?— রুম্মান আরো অসহিষ্ণু হয়ে বললো নিজেই—বুর্জোয়া বা প্রলেতারিয়েত কারোর পক্ষে না। তবুও ইমপর্টেন্সটা এখানে—কেবল নিজের বিরুদ্ধে, অবিরত নিজের বিরুদ্ধে। র্যাডিকাল খুব কমই লুম্পেন হয়। অনুগতের ভাবনায় খোরাক যুগিয়ে উদাস হয়েছিলো রুম্মান। সে চায়ের কাপ থেকে মুখ তুললো না। হাতে ধরানো সিগারেট। অনুগতর চেহারাটা বুড়িয়ে যাওয়া মনে হলো। কথাগুলো বলে এখন যেন খেলো লাগছে তার। মলয়ের চোখেমুখে ক্রিয়া নেই। উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রুম্মান। হাত দিয়ে বিদায় জানিয়ে ভেসপা স্টার্ট দিলো। সে আত্মকেন্দ্রিক, না অনুসন্ধান করা লোকগুলো এরকমই হয়? রুম্মান ভাবলো, তার জীবন বাতাসে উল্টে যাওয়া পর্যটন করপোরেশনের ক্যালেন্ডারের মতো। দিন-মাস-বছর—সামনেরগুলো পেছনে থাকে, এতো উল্টো, জীবনের প্রতিবিম্ব তার টোটালি উল্টো। শেয়ার বাজারের পড়তি অবস্থা মনে হওয়ায় ভেসপা ডাইনে ঘোরালো রুম্মান। বি.ও অ্যাকাউন্টে তার টাকা কমে এসেছে। মানি মার্কেটের প্রক্রিয়াটা এখন ব্যাংকিং ক্যাপিটালের সূত্রে মেলানো যায় না। আইপিও’র শেয়ারের লটারি খুব একটা তার পক্ষে যায়নি। সেকেন্ডারি শেয়ার এতোটাই অনিশ্চিত মনে হচ্ছে, যেন ওয়ার্ল্ডের ফাইন্যান্স-ক্যাপিটাল নিজেই ঘেরাটোপে। যমুনা তেল কোম্পানি আইপিও থেকে না দিয়ে ডাইরেক্ট পারচেজ করিয়ে ধরা খাইয়ে দিলো। রুম্মান ভাবলো, সেই মুহূর্তে, কতোটুকু বৈষয়িক সে, বা স্বামীসুলভ; অন্তত সীমাকে ধরে রাখার মতো। সে কি প্লেবয়— না। নৈতিকতার প্রাথমিক স্তরগুলো তার রক্তের ভেতর আদৌ আছে কি না তা নিয়ে সংশয়! তার কান্না, ব্যথা, আত্মপীড়ন নিজের কাছেই স্পন্দিত না। সামাজিক সামান্য সতর্কতা ছাড়া গ্লানিবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। চৌকষ শিক্ষিত বুদ্ধিমান হলেও নিজের ইউটিলিটি নিয়ে প্রশ্ন আছে। উপযোগিতা কি প্রেক্ষিত নির্ভর? রুম্মানের ভেসপাটা ঘুরছে, তার মনে হলো, ডান হাতটা হেডলাইটের সুইচে। হেডলাইট জ্বলছে কি না। সুইচটা নাড়িয়ে দেখলো। তারপর রুম্মান বাঁয়ের একটা সরু গলিতে ঢুকে বন্ধ করলো গতি। সামনে একটি বিল্ডিং। পথের দুপাশ পুরনো, শ্রীহীন মানুষের নিবাস, ছেঁড়া আর তালি লাগানো পোশাক পরে বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে—ক্ষুধার্ত, অনিশ্চিত চেহারা! একটি মেয়ে প্রেমিকের হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছে ভারি বুক দুলিয়ে। চারপাশে এতো বৈষম্য—রিহ্যাব মেলায় কোটি টাকায় ফ্ল্যাট বিক্রি হলো। লাখ টাকা দামের পালঙ্ক শিল্পমেলা থেকে একদিনে সাতজন কিনেছে। হাজার বছরে বাঙালির হাতে এতো টাকা আসেনি। রুম্মান ভাবতে ভাবতে তিন তলায় উঠছে, ঘড়ির ডায়ালে কাঁটা দেখলো। মনে হলো, ঘড়িতে সেকেন্ডের কাঁটার গতি যে রীতিতে যায়, মিনিটের কাঁটা তা না—আগে-পিছে ঘটে। কোথা থেকে কোথায়! তার চিন্তাগুলো এলোমেলো। তিন তলার রুম দেখলো লকড। এখন কি লাঞ্চ আওয়ার? স্ট্রেঞ্জ!
গত রাত থেকে ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত সীমা ঘুমায়নি। জাপানে ট্রেনিঙের সময়েও এরকম। গালের দু’পাশে হঠাৎ জ্বলছে। ঘরে হাঁটতে হাঁটতে জীবনের কি পরিবর্তন আসছে ভাবে, দুঃখ আর নিরাশায় টানা একরৈখিক ক্লান্তিকর দিনগুলোর পরিসমাপ্তির সম্ভাবনা কবে? ঘরে আলো আসে নীল আর ধূসর হয়ে; আসবাবের কোনো কোনো পাশ ঔজ্জ্বল্যে আর নিষ্প্রভতায় বৈভিন্ন্যের প্রতিবিম্ব। তার অনামিকায় উদয়সূর্যের আলো আর পাথরটার ঘাসসবুজ রঙে প্রদীপ্ত সকাল। উজ্জ্বল আর টলটলে পান্নার আলোয় সতেজ প্রতিশ্রুতি। স্ব আয়নায় উত্তাপ সঞ্চয় করছিলো। ঠিক সেই উত্তাপ, পৃথিবী থেকে অনেক দূরে মেঘমুক্ত স্বচ্ছ অনাবিল নীল আকাশের মধ্যেখানে যেমন সূর্য জ্বলে। সকাল-মুহূর্তে সীমা ঠিক করেছিলো অসাধারণ এই পাথরটিকে ছাড়বে না। তার আঙুলে, কনিষ্ঠার পাশে অনামিকায়—অনিবার্য ব্যক্তিক ওয়াদায়। বিশ্বাসে না বিজ্ঞানে না বিমূর্ত এক সত্তায়।
ধূ-ধূ এ রাজধানীর নানা পাশ জুড়ে সোডিয়াম আলোর নিষ্প্রভ ছায়ায় মানুষের ছোটাছুটি শুধু অনন্ত, আর সাপের হাঁ থেকে নিঃশ্বাস ফেলে সতীর্থদের অকৃতজ্ঞতায় দুঃখ হতাশা আর ক্ষোভের ভেতর চমকে ওঠা এই জনগোষ্ঠী। দীর্ঘ দাসত্বের যে জড়তা সেটাকে সীমা আর স্বাভাবিক ভাবতে পারে না।
—রাত তো বেশ হলো, তাই না?
—হ্যাঁ, রুম্মান বললো।
—হাতের টাইটান ঘড়িটা কবে কিনলে?
—কিনিনি আমি, একজন দিয়েছে।
—কে? (একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন)। শাড়ির আঁচল ঘাড় থেকে নামিয়ে নিলো সীমা।
—একটা মেয়ে।
—কে-সে?
—প্রমীলা।
—কী করে?
—একটা রিসোর্টের এক্সিকিউটিভ—থামলো রুম্মান, সীমার দিকে তাকালো।
একটা ক্লারিফিকেশন খুব দরকার। সব সত্য সুন্দর করে বলা যায়? বলাটা হয় কখনো? তারপর বললো, শি ইজ সিলেকটিভ... এইটুকু বলে বাধা পেলো। সীমার প্রতিক্রিয়াটা দেখলো না। সীমা বালিশ থেকে মাথাটা তুলে চোখটা ঘোরালো দেয়ালে। ঠোঁটের নিচে ঘামলো। আবহটা খয়েরি পটভ‚মিকায় গালের ভেতর নুনের দানায় ওঠা পিক! ধূ-ধূ জ্বলন্ত আগুন বালিতে অনুক্ত উত্তেজনার এই রাত নিষ্ঠুরভাবে একজন মানুষের দুর্বলতা প্রকাশ করে তৈরি করলো একটা নীল শিখা। সীমা দাঁড়ালো ব্যালকনিতে। এক ক্ষীণ কাতরধ্বনি কী যেন ফাটিয়ে দিচ্ছে। টানা দুঃখভরা সেই কাতরতা প্রকাশহীন অধুনায় ভেতরে চাপ দিচ্ছে স্যাঁতস্যাঁতে গজানো শুঁড়ের ভেতর থেকে আসা গন্ধে। রাস্তায় ইলেক্ট্রিক তারে একটা প্রাণী—পাখি না প্যাঁচা? ডাকছে! সীমার মনে হলো ওটা যেন ডাকছে বিকৃত স্বরে। শুকপাখির কথায় বিয়ের টোপটা গিলতে গিয়ে তার প্রাপ্তি এই রক্তক্ষরণ। সীমা ড্রইংরুমে বসে কিছুক্ষণ কাঁদলো। কিছু ভাবলো যেন-বা।
ওয়ারড্রবের ব্যক্তিগত ড্রয়ারটা চাবি দিয়ে খুলে কয়েকটা ডায়েরি আর কাগজপত্র বের করলো।
১০ নভেম্বর ১৯৯৯
আজকের দিনে আমার সতের ঘণ্টা সময় আছে। এই সময়টা আমি আমাকে দেবো। কাজ—যা আমার সাফল্যের অংশ। আমাকে মুক্তি দেবে।
১১ নভেম্বর ১৯৯৯
কয়েকদিন আগ পর্যন্ত আমার নির্ভরশীলতা ছিলো সতের ঘণ্টার সবটুকু সময়। তুচ্ছ চিন্তা, অলসতা এবং বন্ধুদের সঙ্গে আমার সময় কাটতো। সবটুকু নির্ভরশীলতা ছিলো বন্ধুদের ওপর। আজ থেকে আমাকে গঠনমূলক হতে হবে।
২০ নভেম্বর ১৯৯৯
সেদিন রাতের পরে আর চলা সম্ভব না। সম্পর্ক রাখা সম্ভব হবে না। আমি রাখবো না। খোদা হাফেজ। সমস্ত সম্পর্ক শেষ। মনিরা, নিলা আপু এদের জায়গা থেকে আমাকে সরে আসতে হবে। এখন শুধু বাইরের সম্পর্কের জন্যে সম্পর্ক থাকবে। শুধু সম্মানের কথা ভেবে চলা।
২৮ নভেম্বর ১৯৯৯
আমি ভালো আছি। প্রতিদিন দশ থেকে পনের ঘণ্টা পড়ছি। ভীষণ তৃপ্ত লাগছে। সবকিছু অর্থপূর্ণ লাগছে। প্রতিদিন খুব সেজে বের হই। নিজেকে শূন্য মনে হচ্ছে না বরং অর্থপূর্ণ লাগছে। পড়ছি, গান করছি, আনন্দ করছি।
৬ ডিসেম্বর ১৯৯৯
মনে পড়ে কবিতা শুনে হাত ধরে ফেরা। মনে পড়ে কলেজ ফাঁকি দিয়ে, ক্লাস না করে, রাস্তা পরিবর্তন করে রমনায় হাত ধরে বসা, ঘাস ছোঁয়া, গায়ে হাওয়ার ভালোবাসা জড়ানো, মনে পড়ে রিহার্সেলে না গিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা, আবোল-তাবোল বকা।
২১ ডিসেম্বর ১৯৯৯
কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে, এতো বড়ো পরাজয় মেনে নিতে। ভেতরটা ভেঙে টুকরো টুকরো হচ্ছে। ভুল হলো কেন? এতোদিন কী বুঝলাম!
২২ ডিসেম্বর ১৯৯৯
বুভুক্ষু আমি। অপরিণত আমি। অলস আমি। অক্ষম আমি। সময় নষ্ট করি। আমি কাজ করি না। আমার দিয়ে কিচ্ছু হবে না।
সীমা ডায়েরিটা বন্ধ করে একটা কাগজ হাতে তুললো।
সীমা,
কাল মধ্যরাতে যখন ঝড়োহাওয়ায় বৃষ্টি
বারান্দার গরাদে আমার শক্ত হাত, ভিজে যাচ্ছি
আকাশে অদৃশ্যপ্রায় তারাগুলো খুঁজে ফিরছি
কালো আকাশ—জমাট মেঘ—তোর জলজ চোখ মনে পড়ছিলো ভীষণ।
তোর আছে অসম্ভব সুন্দর এক তটিনী
আর আমার আছে সেই তটিনীর জল
চল আমরা ভেসে যাই সেই নদীর স্রোতে
চলে যাই সেই সীমানায়,
যেখান থেকে নীলগিরি পর্বতমালা দেখা যায়
পাওয়া যায় মল্লিকা ফুল।
সীমা পড়া শেষ করলো। কাঁদতে চাইলো, পারলো না। ভাবলো, কোনোদিন আর চাইবে না।
পরদিন রুম্মান জেগে উঠলো বেলা করে। রক্তের ভেতর বিষাদ আর শুষ্কতা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে দেখলো কোলাহল। গোপনে লজ্জা কাজ করছিলো ভেতরে। হারিয়ে যাবে সে। লজ্জা-ভয় আর ক্রন্দন থেকে অব্যাহতি। ভেসপা নিয়ে বহু ঘুরে এলো নিজের অজ্ঞাতেই সেই পরিচিত জায়গাটায়। কেন সে এখানে? কারণ রুম্মান মদ খাবে। গতরাতে মুক্তির ক্ষীণতম আশায় রাতভর চেয়েছিলো এই সকালটা। রাতে সে কারাগারে জেগেছিলো অন্ধকূপে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসাটাই মূল। যেন জীবনের কাছে প্রাপ্তি, জগতের কাছে প্রাপ্তি এই প্রান্তর। এই তো হওয়ার কথা। একটা বার অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। চারপাশে কৌতূহলের উদ্রেক। ঘন কয়েকটি গাছ, পাতার গাঢ় আচ্ছাদন আর সেই মৃদু ছিদ্রগুলোর ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো দুর্বিনীত। হাওয়ায় রোদ আর ধুলো একাকার। জ্বলন্ত পরিপার্শ্বে শ্বাস নিতে কষ্ট হলো রুম্মানের। সেই মুহূর্তে জিজ্ঞাসা এলো—দিনে, এখন কেন মদ খাবে? রুম্মান ভেবে মনে মনে বললো, তার ইচ্ছে।
স্যার,
রুম্মান তাকালো। কী অর্ডার দেবে। দিনে শাদা রাতে লাল। শাদাটা চলুক।
ভোদকা। লেবুর সঙ্গে লবণ দিয়ো; শোনো শসা দিয়ো আর পেঁপে দিয়ো, আর বাদাম দিয়ো ঝাল দিয়ে মাখিয়ে, আর একটা সেভেন আপ দিয়ো। টিস্যু দিয়ো কয়েকটা। সিগারেট আনতে হবে।
কী সিগারেট?
বেনসন।
লাইট না হার্ড?
লাইট।
কয়টা?
দশটা—রুম্মান টাকা বের করলো।
দশ টাকার প্লাস্টিক নোটটা পাল্টে দেন।
কেন?
কেউ নিতে চায় না।
ইদানিং কখন কী চলে আর চলে না রুম্মান বুঝতে পারে না। না চললে তাকে অন্যজন দিলো কেন? সেই ঠকবে শুধু, নিয়তিটা এমন, জিততে চাইলে প্রশ্ন উঠবে। রুম্মান সফিস্টিকেশন ভাঙলো। পরপর চার পেগ ঢাললো গলায়, স্থিরতায়। ওয়েটারের বিস্ময় লক্ষ করলো না। পেটের ভেতর একটু জ্বললো। চিরতার রস খেতে খেতে পেটটাকে সে নষ্ট করেছে—অন্যকিছু নিতেই পারে না। কিছুক্ষণের ভেতর রুম্মান দেখলো, গোলাপি পর্দায় দুলতে চাচ্ছে তার আরক্ত ছায়া। লক্ষণীয় পরিবেশ পাক খেতে খেতে ধেয়ে এসে ভেঙে দিচ্ছে ভারসাম্য। হৃদস্পন্দনে লাট্টুর পেরেক ঘুরছিলো মাথায়। আচ্ছন্নতা চোখে আর পায়ের পাতার ওপর ভার দিচ্ছে অদৃশ্য ওজনে। রুম্মান উপভোগ করতে লাগলো। অজ্ঞাতে গুনগুন করে গান গেয়ে উঠলো। আর সঙ্গে মেনে নিলো জীবনে মানুষের একটাই বিলাস—মদ। বিস্মৃত হয়ে কোনো এক অসহায়ত্বকে চাইলো অপমান করতে। পা’দুটোয় কম্পন। শিরায় আর নখমূলে শিরশির আবেশে প্রণত। পান করো রুম্মান; খেতে খেতে ভুলতে হবে, নিজেকে ভুলতে হবে। বিলাসের কোনো বিধান নেই, স্নায়ুর ধারগুলো লুপ্ত হোক; ক্ষুদ্র জগত-জীবনে আওতাভুক্ত বলে না থাকে। বিলুপ্তি অনেক সরল, কী আছে—হারবে? জিতে গিয়ে মানুষ যেখানে যায়, জয় সেখানে অর্ধেক। রুম্মান ওয়াস রুমে ঢুকলো সিগারেট ধরিয়ে। জিপারে দুই আঙুলের টান, চোখ পড়লো সামনের দেয়ালের হোয়াইট ওয়াসের উপর। দুটি লাইন। কলম দিয়ে কেউ লিখে গেছে। লাইন দুটি পড়তে লাগলো, অনেকক্ষণ তাকিয়ে আশ্চর্য হলো রুম্মান; সে সাহিত্যের ছাত্র, পঙক্তি দুটি আগে কোথাও পড়েনি। রুম্মান ডুব দিলো তার স্মৃতির কোষগুলোতে। খুঁজতে চাইলো; লেখকের নাম স্মরণ করতে না পারায় চাপ তৈরি হচ্ছিলো তার ওপর। লেখাটা তাকে আটকে রেখেছে। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলো দেয়ালের দিকে। স্থবির সে: পৃথিবী যে প্রিয়া রাত্রি তার ঘোমটার কৌতুক/নিজেকে জ্বালিয়ে চেনা যায় উত্তীর্ণ সেই মুখ! এর অনেক পরে পকেট থেকে নিজের ডট পেনটা বের করলো; লেখাটার নিচে ‘ড্যাশ’-এর দাগ দিলো তারপর দাগটার শেষে লিখলো: রুম্মান। দ্রুত বেরিয়ে গেলো। টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্কতায় টানলো চেয়ারটা। গ্লাসের ভেতর থেকে স্পিরিটের গন্ধ হাওয়ায় উড়ছিলো। মদে সোডা মেশালো। বরফের টুকরো ফেলে গ্লাসে কাটা লেবুর রস নিলো। পরপরই বোকার মতো তাকিয়ে থাকলো গ্লাসটার দিকে। হঠাৎ তাকে ক্ষুদ্র মনে হলো। দেয়ালে নিজের নামটা কেন লিখলো? তার মনে হলো সে কিছুটা অন্তসারশূন্য। নিজের একটা লোভ ধরা পড়েছে চোখে। নাম বসিয়ে দিয়ে চুরি করতে চেয়েছে। অন্যের থেকে চুরি করে মানুষ এভাবে মালিক হয়। রুম্মান গালে লবণ দিলো; অপরাধের কিছু কাতরতা আঁকড়ে ধরেছিলো তাকে। মাথাটা ডানে বাঁয়ে নাড়িয়ে এক স্থবিরতায় ভাবলো, উনিশ শতক-পরবর্তী রেনেসাঁ, সেই রেনেসাঁর আজ ধারাবাহিক এক ব্যক্তিগত মেধাবী সত্তার নাম রুম্মান। ভাবতে ভাবতে সে আরও দুই পেগের অর্ডার দিলো—আর মনে হলো ওয়াস রুমে গিয়ে ব্যাংকের চেকে কাটাকাটি হলে দ্বিতীয় বার সই করে যেমন, সে তেমনভাবে আবার দেয়ালে নিজের নাম কেটে আবার স্বাক্ষর দিয়ে লিখে দিক, না, রুম্মান লেখেনি। বাধা পেলো। মাতলামো না তো? ভাবলো: চোরা মন সতর্ক—মাতাল হতে পারে? ঠিক করলো রুম্মান: পথ একটাই—সিক্রেট। গুপ্ত! গুপ্ত হয়ে থাকা। রাখা। আকস্মিক রুম্মানের মনে হলো সিক্রেট থেকেই কি সেক্রেটারিয়েট শব্দটা এসেছে? রাষ্ট্রের জালিয়াতি নিখুঁতভাবে যেখানে লুকানো হয়। একজন প্রশিক্ষিত সচিব যা করেন।
প্রিয় বন্ধুগণ, পঞ্চাশ-ষাট বছর পর গতকাল আকাশে চাঁদের দুই কোণায় দুটি তারা দেখা গেছে। ব্যালকনিতে দাঁড়ানো ছাড়া সন্ধ্যার পর আকাশে দিকে তাকানো হয় না। রেইন-বো ছাড়া মুন-বোও আছে। কাল রাত থেকে তার একটা কথা বার বার মনে হয়েছে, জীবন বোধহয় সেই কুকুরটার মতো। যে একটা হাড় পেয়ে চিবোতে লাগলো। হাড়টা শুষ্ক ছিলো খুবই, খটখটে, কুকুরটার মাঢ়িতে হাড়ের খোঁচা লেগে রক্ত বেরুচ্ছিলো। কুকুরটা ভাবতে লাগলো, অনুভব করলো এটা হাড় থেকে আসা রক্ত-মাংস। হাড়েরই রক্ত। সে চেটেপুটে খেতে লাগলো। নিজের রক্ত নিজে খাওয়া আর গ্র্যাটিচিউট দেয়া অন্যকে—ম্যানকাইন্ড এই জায়গায়!
চুলের ভেতর চিরুনি নিয়ে সীমা বেডরুম থেকে ব্যালকনিতে। ফুলের মৃদু গন্ধ। এদিক-ওদিক চাইতেই চোখে পড়লো ঘন অন্ধকার। কিছুক্ষণ আগে ঘড়িতে দেখেছিলো সাড়ে এগারোটা। অস্থিরতা কাজ করছিলো সীমার। বিবরগুলো দেখতে পাচ্ছিলো। ফাটলগুলো মানচিত্রের মতো আঁকাবাঁকা। ইচ্ছে হলো সিগারেট খেতে। রুম্মানের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট এনে ধরাতে পারে। সিগারেটের গন্ধটা ভালো লাগে। কিন্তু সে খাবে না। তুচ্ছ বিষয়, তবুও না। রুম্মান এটাকে নীরবতা দিয়ে হয়তো উৎসাহিত করবে। আরও এগোতেও সাহায্য করবে। রুম্মান ফ্রিডম দেবে কেন? অধিকার রুম্মানকে কে দিলো? নিজে ভাঙতে পারে না, ভাঙাটা বোঝে। চিরুনির টানে চুলগুলো সমান করলো সীমা। ঠিক তখনই কোথায় যেন একটা পাখি ডেকে উঠলো— পাখি না প্যাঁচা?
বাম হাতে কানের রিংটা থেকে চুল ছাড়ালো। অসহনীয় প্রবাহ চলছিলো তার আঙুলের ভেতর। সিগারেট খেতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। স্ট্রাইপের সবুজ তাঁতের শাড়ি পরা সীমার বাধলো। জিনস পরে থাকলে গতিটা পেতো। শুধুই কি তাই?—ভাবছিলো জাপানে সে এতো পাখি দেখেছে, ভয়হীন দ্বিধাহীন অবিকল পুরুষের মতো। তার ঘাড়ে কোথা থেকে একদিন একটা পাখি এসে বসেছিলো। আশ্চর্য হলো সীমা, রহস্য এসেছিলো মনের ভেতর। ব্যালকনির রেলিঙের ওপর চিরুনিটা রেখে সামনের কিছু চুল হাত দিয়ে সরিয়ে দিলো বাঁয়ে। আকাশে অনেক তারা, কলস থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসা রুপোর টাকা দলবদ্ধ মাছের বৃত্তে। বিকেলে টিভি প্রোগ্রাম দেখতে দেখতে সে মিলিয়েছিলো তার আকাঙ্ক্ষার এক রক্তবীজে। কার্পেটের ওপর দু’বেণি বাঁধা আট-দশটা কিশোরী-বালিকা দু’হাঁটু ভেঙে ভাঁজ করে বসে। মাথা ডাইনে-বাঁয়ে দোলাচ্ছে। ভালো লাগলো সীমার।—মুক্তোমালার ছাতি মাথায় বর্ষা এলোরে... মেয়েরা কোরাস ধরলো; তাল-লয়ের সমতায়;—সারা গায়ে গোলাপ পানি ছিটিয়ে দিলোরে...
সিগারেটের ইচ্ছেটা যাচ্ছে না সীমার। কাজলের মতো স্মার্ট না। দোদুল্যমানতা তার রক্তে কিছু জায়গা নিয়ে আছে। ঝুঁকি নেয়ায় বাধাটা কি বয়েস না লালিত আকাঙ্ক্ষার ঊনতা? চোখটা ছলছল করে উঠলো সীমার। ফোঁটাগুলো পড়ার আগেই দু’চোখের নিচে আঙুলগুলো। পরপরই বেডরুমে ঢুকলো। রুম্মান মুখ হা করে শ্বাস নিচ্ছে জোরে জোরে। মাঝে মাঝে গোঁ-গোঁ করছে; সেন্স অব র্যাশনালিটি। পাতলা শাদা চাদরটা সীমা ওর গলা পর্যন্ত টেনে দিয়ে তারপর ফ্যানটা বাড়িয়ে দিলো। এরপর লাইট নিভিয়ে ড্রইংরুমে চলে এলো। বিকেলের স্মৃতিটা নিয়ে এতোদিনের আকাঙ্ক্ষা শীতলতায়। জানে, সে অ্যাভারেজের ওপরে। একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে, অন্তত একটা। ঘরে তাদের দু’জনের যে ক্ষেত্রপট—তৃতীয় কারও আগমন সীমা মনে করে, অসহনীয় অভিশাপ ছাড়া কিছু না। সীমা হতে দেবে না।
‘জুয়া খেলিলো সাধু হারাইলো সম্বল
ধনরত্ন হাতি-ঘোড়া সব হইলো তল।
সদাগর ডাকিয়া কয় ‘পরাণের ঝি’
এই না মন্দিরের মধ্যে দেখেছো তুমি কি
কাইন্দা কাজল রেখা বাপের আগেরে কয়
এক আছে মীরদ কুমার সে যে শুইয়া রয়।’
আব্বা হাইড্রো খেলাটা পছন্দ করতেন।
ফ্লাশের নাইন কার্ডও আব্বার হাতে স্যুট করতো—সীমার কথাটার পাশে কাজল যোগ করলো।
জোকার বড়ো ফ্যাক্টর হয়, সীমা ভাবছিলো, হাইড্রোতে দুই জোকারে এক কাচ্চু, একেকটা কাচ্চুর মূল্য আবার পঁচিশ থেকে দুইশো টাকা। কাচ্চুর প্রিয়তা এখন মধ্যবিত্তদের কাছে।
কাজল বললো, দুর্বল মনের লোকের জন্যে ফ্লাশে তিন তাসের চেয়ে নয় তাসের খেলাটা ভালো। আব্বা প্রায়ই বলতেন, হাতে ট্রায়ো অথবা রানিং ফ্লাশ, এ সময় অপনেন্টের চাপ নেয়া কঠিন। পাঁয়ের আঙুল কাঁপছে, হয়তো হাতটাও, মাথাটা অস্বাভাবিকভাবে নড়ছে। কার্ডসেন্স আর ইনটুইশান শার্প হতে হয়। সীমা বললো, আব্বা কিন্তু ফিফটি ফিফটিতে, জুয়াই বোধহয় শেষমেষ এটাই। কাজল বললো, আব্বা কিন্তু ব্যালান্সড। মাসে দশ দিন খেলতেন না। সংসারের ক্ষতি হয়নি। সীমা বললো, তা ঠিক। তবে হাইড্রোর একশো চার জোড়ার হিসেব সহজ না। আব্বা মেধাবী ছিলেন।
গাড়ির ইঞ্জিন আরেফিন ওয়ার্কশপে পাল্টাতে গিয়েছিলো দুইদিন: তারা জানিয়েছিলো ইঞ্জিনটা অনেক অক্ষত, মোটর আর শক অ্যাবজর্বার পাল্টালে শব্দের প্রকটতা পাবে সহিষ্ণুতা। ঠিক করে দিলেও আরেফিনের মনে হয়েছিলো, আরেকটা গাড়ি দরকার পড়বে। ব্যক্তিগত ব্যাপারটা আরো ব্যক্তিক হয়ে ওঠে। ওইরাতে কাজলের কাছে হাতব্যাগ চাওয়াও ছিলো এক সরস কৌতুক; তার মাথায় চাড়া দিয়ে উঠেছিলো তা। নানাভাবে এরকমই হয়; ভারতে রমা, কোরিয়ায় সুজানা, এনাবেল-জেনিফা, উত্তরায় লুবনা, সোনিয়া, নীরা—নারী-পুরুষ সম্পর্কিত অনুভবের স্পন্দিত উদ্ভাসে তৈরি হচ্ছে অষ্টম বলয়টি? চল্লিশের কোঠায় ছোঁয়া আরেফিন তার বিদ্যমান একাধিক সংসার জীবনে কখনো আইনগত সম্পর্কের উপরিকাঠামোগুলোকেও লক্ষ করেনি, পিতা বা স্বামীর মর্যাদা ন্যূনতম বহন না করে এসেছে; অত্যুগ্র প্রেমিকসত্তা বারবার তাকে ঠেলে দেয় সবুজে, লক্ষ্য—একাধিক সত্তার ঐক্য। অনেকে বলেছিলো, নির্মল জীবনের কথা—যে জীবন বিভক্তির না, অনুক্ত উত্তেজনায় সামষ্টিক, বিস্তৃত অনুভবের চেয়ে প্রতিশ্রুতির সত্যতা পরম, প্রেমের চেয়ে মমতার মূল্য বেশি, অনাগ্রহের দায় মেনে মানুষ যেখানে মহৎ হয়। যারা বলেছিলো, আরেফিন জানতো তাদের। তারা জানতো না আরেফিন চেনে।—অবদমনের বর্জ্য চিবিয়ে কষটুকু নিয়ে জাবরকাটা—কৌণিক বিন্দু ছাড়া জীবনে কোথাও সমকোণ নেই; ঐক্যের প্রতিটি টুকরোকণায় বহুভাবে খণ্ডিত; মায়ার নামে আছে করুণা আর ওয়াদার দায়, মমতার নামে যাপনে ধারালো চাকু।
কাজল এগুলো নিয়ে ভাবতে চায় না। একটা স্টিল কর্পোরেশনের কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্টের পুরো কাজটার দায় তার। ত্রিকোণ বা লম্বা লোহার রডের অ্যাঙ্গেল, চ্যানেল, দুইসুতো, চারসুতো মাপের টন হিশেব, পে-অর্ডার, চেক আদান-প্রদানে ঝানু ক্রেতাদের হ্যান্ডেল করে। ক্লান্তি এতো কম, ভারি কাজগুলো ঠাণ্ডা মাথায় নেয়, অবলীলায় হবার মতোই কাজের ধরন। পি.আর.ও থেকে ফ্রন্ট ডেস্ক অফিসার (এফ.ডি.ও)—দুই সেকসনে তার দক্ষতা। প্রফিট বোনাস। কোম্পানি বিশ কোটি টাকার শেয়ার ছেড়েছে। শেয়ার অফিসারের বিহেভ কতোটুকু পারফেক্ট, তা নিয়ে কাজলের সংশয়?
ক্যান্টিনে লাঞ্চ করতে যাবার সময় কাজলের মনে হয়েছিলো, ‘কর্মদোষে কাজলরেখা জন্ম অভাগিনী, ভাবলো—ধর্মদোষ নিয়ে বললে কেমন হয়? পরে কথাটা শুনেছিলো সেলসের এক্সিকিউটিভ আলেয়া: আমরা আর মেয়ে নেই, সেলসের স্টিল, কর্পোরেশনের অ্যাঙ্গেল। কাজল শ্লীলতা সরিয়ে দিলো, সুতোর মাপটায় নরম করে দেবে। আলেয়া খুব হেসেছিলো, মাপ জানলে হবে না, অ্যাঙ্গেলটা সেট করে ভিতে বসাতে হবে।
ভরদুপুরে গাড়ি নিয়ে কাজলের অফিসে এলো আরেফিন। কাজলের মিনি স্যুটকেসটা হাত থেকে নিয়ে পেছনের ডিক্কি খুলে রেখে আরেফিন বসলো স্টিয়ারিং-এ। গাড়ির দরজা বন্ধ হলে স্টার্ট দেয়াটা আনমনে দেখে আরেফিনের চুলের পারিপাট্য বাম হাতের আঙুলগুলো দিয়ে নাড়িয়ে মনমতো কপালের ওপর এলোমেলো করে দিয়ে ভাবলো, অন্তত দুপুরের তাপটা কমে গেলে ভালো লাগতো বোধহয়। চলতে চলতে কাজল দেখছিলো, গরমে দূরের দৃশ্য রোদের পর্দায় ঢাকা। জায়গাটা নাকি ঠাণ্ডা। পরে তারা দেখেছিলো সামনে পাহাড়ের গায়ের ওপর ঘাস ছড়ানো ছিটানো। কালো পিচের রাস্তার পুবদিকে এগিয়ে মাঝামাঝি বেইলিব্রিজ, নিচে বার্মিজ নদী—অদূরবর্তী সমুদ্রে ঘুর দিয়ে। রাস্তা থেকে এবড়ো-থেবড়ো ধূসর রুক্ষ পাথুরে পথ; বেড়া বাঁশের খুঁটি আর টিনের গোছানো দশ/বারোটা ঘর, নৃ-গোষ্ঠীর। বেইলিব্রিজের বাম দিক থেকে এগিয়ে যাওয়ার পথে দেখা গেলো মাটি ফুঁড়ে ওঠা পরিণত একটা গাছে আধাআধি ক্ষেত্র থেকে বিনম্র স্তন, গ্রীবা-চোখ-নাক-কান-মাথা মিলিয়ে নগ্ন নারীমূর্তির এক প্রোজ্জ্বল ভাস্কর্য। দূরে, পেছনে আর বড় একটি ঘর, ভেতরের মাটি থেকে ওঠা একটা গাছের গুঁড়ি ঘরের মেঝে জুড়ে, ডালপালাগুলো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে নিযুত উদ্বাহু। কয়েক গজ দক্ষিণে ঝাউয়ের বিন্যস্ত সবুজ। পাশে কাঠের দোতলা ঘর, মজবুত, জানালায় লোহার শিকের বদলে দেয়া লম্বাটে সবুজ রঙের সরু সরু বোতল—আলোয় দূরের বিম্বিত প্লাবন। বাঁশের চঙের সিঁড়ি দিয়ে উঠে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছেন আনমনা একজন শিল্পী। পশ্চিমে পাহাড়ের মাথার কাছে ভাঙা মন্দিরের স্তম্ভগুলো কয়েক ধাপ ছড়িয়ে। সমতল থেকে খাড়া হয়ে উপরে গিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে কয়েকটা চওড়া সিঁড়ি। কাজল মুগ্ধ, দাঁড়িয়ে। ধূসর পাথরের পাহাড়ি পথ আর ঘন সবুজ বেষ্টিত নদী ও সাগরের সম্মিলনে মন্থরে এগিয়ে আসছে ঝাউয়ের মৃদু হাওয়া। টিলার ধাপগুলো উজ্জ্বল, কালচে সবুজপাতা আর মাটির লালচে রুক্ষতায় সাজানো।
কাজলের দুটো হাত দুইদিকে টানে, একপাশে সমুদ্রের ঘন উত্তাল ঢেউ, ওপাশে সবুজ পাতার ঝাড় আর ধূসর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ওঠা ভগ্নস্তম্ভ। দূর থেকে আসা কয়েকজন পরিদর্শকের গলা। নৃ-গোষ্ঠিরা দূরে-দূরে থাকে ফ্যালফ্যালে চোখে, শহুরে মানুষের কাছে ক্রীতদাসের মতো বিনয়কে ধরে। আরেফিনের নীল পোশাকের ছোটো ছোটো ভাঁজগুলোয় ইস্ত্রির ছাপ। মৃদু কোঁকড়ানো চুলগুলো এসে পড়েছে ঘাড়ে। পায়ে শুঁড়তোলা হলদে স্যান্ডেল। কাজল কখনো নদী দেখেনি। সমৃদ্ধ সাগরের ব্যাপকতার ভেতর চাচ্ছিলো কিছু। পাশে ঝাউয়ের ঘন সুউচ্চ বনের পাশে জুম-যব আর সবজির বিস্তৃতি। অনুর্বর ভূমিতে কতো প্রতিকূল আবহাওয়া—আরেফিন দেখে সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত অনন্তস্বচ্ছ প্রাণদায়ী বাতাসের অবিরত দোল; সবুজ সমুদ্র আর পাহাড়ের বৈচিত্র্যে বালিয়াড়ি মাঠ আর উপত্যকায় আদিম ভাস্কর্যের সম্পন্নতা।
সমুদ্রের তীরটা আর কতদূর হবে ভাবছিলো কাজল, যেখানে গিয়ে দেখবে ফেনার ঘনত্ব। টিলার রাস্তাগুলোর পেছনে বালির আস্তরণ ভেদ করে জমেছে কালের ক্ষয়ে যাওয়া পাথর। চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছিলো আরেফিন। তীরে যাওয়ার আগে গাছের মূর্তিটার মুখের ওপর ভালোবেসে আঙুল রেখেছিলো কাজল, তার সত্তার চেয়ে বেশি কিছু। সূর্যাস্তের শেষরেখা মৃদু অন্ধকার ভেদ করে রঙ ফেলেছে পাতায়।
ঢেউয়ের অনুচ্চ উচ্চারণ আর অস্ফুট ধ্বনির অনুরণন ছড়িয়ে পড়ছে তীরে।
আকাশে তারা জ্বলছিলো। গেস্টহাউসের খাবারের সময় হয়নি। মেহগনি গাছের মসৃণ কাঠের সজ্জিত একতলার বড়ো ঘরটায় পর্যটকরা সমবেত। ভেসে আসছে মেয়েদের সুরেলা কণ্ঠের গান। তীরের কাছে ছাড়া-ছাড়া লোকজন। অনেক রাতে দলবেঁধে আসবে পুরুষ আর মেয়েরা। উগ্র মদের গন্ধ পাওয়া যাবে। কানে একটি শামুক নিয়ে দূরে গিয়ে শুনছিলো কাজল: সমুদ্রের শোঁ-শোঁ শব্দেরই টানা আগ্রাসী সুর। প্রেমও কি এরকম? যাকে জন্ম দেয়, সারাজীবন তাকে বইতে হয়। বালিতে পা রেখে কাজল দেখছিলো, টিলার ওপর লাল আলোর অস্পষ্ট প্রতিবিম্ব।
তার বেণিবাঁধা কালো চুল বাতাসে দুলছে। ইচ্ছে হয়েছিলো পুঁতির একটা চওড়া বালা হাতে পরবে। রেখার বন্ধনী নন্দনে ফুটছিলো পোশাকের নিচ থেকে। টারকুইজ-গ্রিনের ড্রেস ভারী মানিয়েছে—সেটা জানে। সন্ধ্যায় জামার ভেতর থেকে কাজল বের করেছিলো একটি খাম, মসৃণ আর নীল, আঠার দাগ বের করে মধ্যবিন্দু থেকে জোড় খুলেছিলো সযত্নে, এদিক-ওদিক নাড়ালে দুই হাতের আঙুলগুলো আকার দিলো কাগজটিকে, তারপর নিপুণ কয়েকটি ভাঁজে হাত থেকে বেরিয়ে এসেছিলো নীল কাগজের নৌকা। আরেফিন খেয়াল করেছিলো পরে।
তারা তখন তীরের ও তাদের খুব কাছাকাছি। মনে হলো আরেফিনের, সমুদ্র যে ঢেউগুলো এই মুহূর্তে দু’পায়ের গোড়ায় ছুড়ে দিলো, সমান নির্ভার। আকাশটা মুক্তোর মতো শাদা। নৌকার নিচে যতোটুকু পানি থাকে ততোখানি নৌকার ভেতরে দিলে অতিরিক্ত যদি হয় তখনই নৌকা ভাসে, না-হলে কি ডুবে যায়? ভেসে যাওয়ার জন্যই কি হাওয়া-পানি আর ঢেউ? মানুষ ভাসে কি শুধু ডুবে যাওয়ার ভয়ে, নাকি কেবল সাড়া দেয় উদ্ভুত অন্য নীল কাগজের বাঙ-এ। পৃথিবীর প্রথম নৌকা নূহ-র, খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে, আদমের জন্মের এক হাজার ছাপ্পান্ন বছর পরে। পাথর ভাসিয়েছে মানুষ, কত কোমল, না-ভাসলে হয়?
‘কর্মদোষে কাজলরেখা হইছিলো বনবাসী
কঙ্কন দিয়া কিনিলো ধাই নাম কঙ্কনদাসী
এক সত্য করে কুমার চিনিতে পারে
পরাণে বাঁচাইছো কন্যা বিয়ে করবার তরে।
দুই সত্য করে কুমার দাসীরে ছুঁইয়া
পরাণ বাঁচাইছো তুমি পরাণো প্রিয়া।
তিন সত্য করে কুমার ধর্মসাক্ষী করি
আজি হইতে হইলা তুমি আমার ঘরের নারী।’
কাজলের নৌকাটা তীরের ঢেউ-এ। সময়টা ভাটার হলে টেনে পেছনে নিতো। সেটা সম্ভব না। নৌকাটা যেন শর্তহীন, সতর্কবিহীন বেশ স্পন্দিত! খামের ফরগেট মি নট লেখাটা নৌকার গায়ে। তীরের পানিতে ঠেলে দিলো নৌকাটা। দেবার মতো আমার কিছুই নেই, তাই এটা ওকে দিলাম, কিন্তু সময়টাকে মনে রাখবো; পানিতে হাত রাখলো কাজল। আরেফিন পানিতে নেমে গিয়ে নৌকাটাকে ঠেলে দিলো। সত্যি আমি এটাই চাচ্ছিলাম, কাজল বললো, তোমাকে এই জন্যে বড়ো একটা কিছু দিতে ইচ্ছা করছে। এই কাজের জন্যে কোনো মজুরি আমি চাই না। মন চাইলো করতে। তীরের আলোয় নীল নৌকাটাকে শাদা ফেনার ওপর বিন্দুর মতো লাগছিলো। ভাটার পানি এপাশে-ওপাশে কাৎ করিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টায় তখন ক্ষিপ্র; অন্ধকারের পুব থেকে আসা একটা ঢেউ সন্তর্পণে নৌকাটাকে ডুবিয়ে দিয়ে পরমুহূর্তে আবার ভাসালো। আরেফিন তখন হাতটা ধরেছিলো, কাজল বলছিলো, আমার বিশ্বাস এমনদিন আসবে সমুদ্রের সামনে মানুষ আর স্তব্ধ হবে না, ভয় পাবে না। অন্যকে ধারণ করবে। হবে ঢেউয়ের আলোকমুকুট। আরেফিন অন্যমনস্ক হয়েছিলো। তার হাঁটার ভঙ্গিতে ফুটছিলো নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন পুরুষের সম্ভ্রম। কাজল সমুদ্রের অসীম বিস্তৃতির দিকে বারবার চেয়েছিলো—এই বিস্তৃতি তার জন্যে কতোটুকু—তার জীবন ওইখানে অজ্ঞাত-অপরিচিত পরিণতিধারায়। আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি, মনে হচ্ছে যেন পানিতে ডুবে ক্রমে ক্রমে তলিয়ে আবার ভেসে উঠছি, অতল থেকে যেন শ্বাস নিচ্ছি। দেড়গুণ বড়ো এমন একজনের সাথে আমার মন ও যৌবন নিয়ে স্বপ্ন দেখছি। আস্থা ও বিশ্বাস-নিরপেক্ষ এমন একজনের সঙ্গে। আরেফিন একসময় বলেছিলো, ভালো সঙ্গী ছাড়া মানুষের কখনো মুক্তি হয় না; বারবার ঝুঁকি নেয়াটা সেজন্যে।—বলে লক্ষ করছিলো তীরে ক্ষীণ হয়ে আসা ঢেউয়ে ফেনার পানি শুকনো বালিমাটির জায়গায় ভিজিয়ে কোমল করে দিয়েছে। কাজলের পেডিকিয়োর করা সুদৃশ্য ছবির মতো দুটি পা সেই মাটিতে ছাপ রাখছে। মুখের দিকে চোখ পড়ে গেলো। সৌন্দর্য, ডাল থেকে বৃন্ত হয়ে আসা একক ফুলের তাজা রঙ! অসম্ভব সৌন্দর্য অনেকক্ষণ দেখা যায় না, আরো যদি সরলতা থাকে। আরেফিন হাসলো, বিদেশে তাকে বলতো—স্নেকচার্মার—ধুর!
সাগরের দিকে তাকিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরেছিলো আরেফিন; অনেক সময়। পরে তাদের দুজনেরই মনে হয়েছিলো দেহের নিচ থেকে উঠছে ক্ষীণ ক্ষুধার মতো কিছু। সেই সময় আরেফিন চেয়েছিলো গেস্ট হাউজে ফিরতে, আর কাজল যেতে চাইলো পেছনের দূরবর্তী মন্দিরটায়।
সেই ধূসর মন্দিরটার কোণে কোণে চৌকষ স্তম্ভ; বিষণ্ণ দর্পে চারপাশে সবকিছু ছাপিয়ে। দুইপাশে কোমর পর্যন্ত উঁচু ঘাসে ভরা সমতল। সমতলের ওপর গজিয়ে উঠেছে নানাজাতীয় গাছগুলো। জাহাজের সার্চলাইটের রশ্মি উঁচু হয়ে দূর থেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলো দিচ্ছে। বড়ো বড়ো গাঁটওয়ালা ডালগুলোয় জালিপাতা আর শাদা ফুল। মন্দিরের ভেতরটায় উঁকি দিলো আরেফিন, পরিচ্ছন্ন না হলেও অসহ না, আচ্ছন্ন-মগ্নতা। আবেগে কাজল আরেফিনের গা ঘেঁষে। ভেতরে ঘাস-গজানো দেয়ালগুলোর আবছা সবুজ পর্দা ঘোর বাড়ায়। স্তব্ধ সবুজে খরখরে আওয়াজতোলা মৃদু বাতাসে অন্তহীন নির্বাকে যেন হারিয়েছে তারা। মন্দিরে ঢুকে ঘাসগুলোর আড়ালে বসতে চাইলো দূর থেকে আসা দরজা ভেদ করা আলোর ছায়ায়। সিগারেট ধরিয়েছিলো আরেফিন, আরেফিন কি পোড়খাওয়া কেউ? অনেক বর্ণাঢ্য ঘটনা জীবনে থাকার অর্থ এই না, চতুর বা খুব পক্ক, বরং উল্টো। এই পাশে না এলেও এলাকাটা পরিচিত। সমতল থেকে একশো পঞ্চাশ ফুট ওপরে, পঞ্চাশ একর নিয়ে সেগুন একাশিয়া আর ঝাউ, নিচে শ’দুয়েক আবাসকুটির। সজারু আর বানরের ছুটোছুটি। পাহাড়ি কলাগাছ টিলার গায়ে মেলানো। টিয়াডু আর বেলম্বের ব্যাপকতা কাশফুলের সঙ্গে। আরেফিনের বাহুর ওপর কাজলের মাথা। সাপের কথা মনে হয়নি। অবশ্য সে কখনো রানী বা দাসী হবে না, মুক্ত প্রেম নিয়ে বেঁচে থাকাটুকু। আরেফিন মীরদ কুমার কি না জানে না, তবে কাজল হয়তো কারো সুঁচ তুলতে চাইবে না; ফুটে থাকা আপন সুঁচগুলো তুলবে। আরেফিনের হাতটা কিছুক্ষণ আগেও ধরেছিলো: প্রেম ভীষণ কোমল। আলোয় ঘরের অন্ধকার কালোকে নীল করে। অন্ধকারের অনুভূত সৌন্দর্য স্পর্শে বহুদূর নেয়। এতো নয় সে ছেলেমানুষ। শরীর ও মনকে বহু ধাঁচে সাজিয়েছে; ক্ষণকালীন দেখা হওয়া, নিয়মিত টেলিফোনে কথা, ছোটো ছোটো রোমান্স, সেমিসেক্স বা দু-একবার যৌনতা আর প্রেম তো এক না। প্রেম দাঁড়ায় দুরূহ বাস্তবতা আর প্রতিবন্ধকতার মুখে, শরীর ও মন পরিপার্শ্বের প্রভাবমুক্ত প্রলয়ের সৃষ্টিতে।
তার ভাবনা প্রেম ও যৌবন। আরেফিন তাকিয়ে আছে কাজল তা লক্ষ করলো। মন ভালোবাসলে শরীরও চায় সত্তা। তখন ঘাসের কোমল খোঁচায় সে ঘামছিলো।—ইস্ গরম! পরে তলার সরু ফিতে দুটো ঘাড়ের ওপর থেকে সরালো, লেসের নিচে চিকন পাইপিং করে ঢোকানো সরু স্টিলওয়্যারের বৃত্ত—যেটা কামড়ে রেখেছিলো, খুলতেই হাতভরা পাহাড়ি তরমুজের মতো লাল হয়ে ফুটলো অনাবৃত। তাপটা বাড়িয়েছে আরেফিন। কোমল আর সরস ঘাসের সিক্ততা যখন উদ্বেল, লম্বা উঁচু ঘাসগুলো বারবার দলিত হয়ে ফিরে উঠছিলো আবার। দরোজার সামনে থেকে একটা সজারু গায়ে কাঁটা মেলে সরে গেলো। মূর্ত সবুজ ঝড়ে তারা আবিষ্কার করতে চেয়েছিলো পরস্পরকে। দুজনই অন্যকে দেখার ইচ্ছা ছিলো। তাদের কল্পনার মতো কাউকে দেখতে পেলো না। তলপেটে কোমল কম্পন। আরেফিনের গলা ও বুক ছিলো রক্তজমাট, পিঠে নখের তীক্ষ্ণতা, হাতে তরলের ঘনত্ব আর আঙুলে লেগেছিলো ব্রাউন রঙের কিছু একটা।
অনেক পরে দুইজনের ঘোর কেটেছিলো। ওয়াদা না করিয়েও যেন কেউ তাদের জানিয়ে দিয়েছে।
প্রথম দিকে তার ভয় হতো। চারিপাশটাকে, নিজেকে। ভয় আর ক্রোধ। সামাজিক যুক্তির জীবন সাগরের কথা বলে, সীমা বোঝে, নদীভাঙা বাওড়ে গিয়ে শেষ হয়। এই জগত কতো নির্মম সীমার চেয়ে কে বোঝে। ধিক্কার দিতেও ঘৃণা! বাবার মৃত্যু তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। এক শুভ্র সকালে চোখ খুলতেই আকস্মিক ছোড়া এক নির্মম পাথরের আঘাতে থেঁতলে গেলো জাগতিক মনন। কী করে কী করবে পারছিলো না ভাবতে। বাবার বুকের ব্যথায় মুখ থেকে ফেনা উঠতে লাগলো। কাজলের তখন অনার্স পরীক্ষা। মা সেইমুহূর্তে ওপরতলায় বাড়িঅলার বাসায়। উদভ্রান্ত সে তক্ষুনি গাড়ি জোগাড় করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। মা কাঁদতে কাঁদতে আসছিলেন পেছনে, স্কুটারে। ছয় ঘণ্টা পরে চোয়াল ঝুলে গেলে মাথার ওপর দিয়ে মুখে গজ লাগানো হলো। পা দুটো শক্ত হয়ে গেলে নিজে হাতে বেঁধেছিলো। ভাড়া করা অ্যাম্বুলেন্স করে বাড়িতে নিয়ে এলে মা তখন অজ্ঞান! সেইমুহূর্তে ফোন করে জানানো, চিরবিদায় স্টোরে যোগাযোগ, মাইকের দোকান খোঁজা, জানাজার ব্যবস্থা, কবরের মাটি খোঁড়ানো—কোনটা আগে-পরে, তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিলো তার। স্বজনদের কাছে কতোটুকুই-বা সাহায্য পেয়েছিলো? চাইলেও কি পাওয়া যেতো এই নাগরিক সমাজে? মামাতো বোনের শাশুড়ি কল্যাণপুর নিবাসী একজন বৃদ্ধা পনেরো হাজার টাকা দিলে রক্ষা পেয়েছিলো সীমা। আর কাজল? ‘আমার আব্বা’ অসমাপ্ত বাক্যটায় আটকে গিয়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিলো সীমাকে জড়িয়ে। স্বাধীনভাবে সীমা তৈরি হতে চেয়েছিলো, পারেনি, তার আগেই বিয়ে। দুপুরে সীমা মাস্টার্স অব ফিলোসফি রিসার্চের কাগজগুলো দেখছিলো বারবার। পাতায় পাতায় ঝরা শ্রম, সম্পন্নের শেষ বিন্দুটার জন্যে, কতোটা কম পারা যায়, এমন শর্তহীন বৃত্তি নিয়ে সে এগোবে। সীমা এটাকে কথিত শিক্ষা মনে করে, হয়তো চারপাশ দেখেই ধারণাটা হয়েছে। দেহকে পণ্য করার মতোই প্রভুদের কাছে ভোগবাদের জন্যেই বিক্রি; সে কি কখনো গুণী নারী-মানুষ হবে, হয়তো জ্ঞানী পসারিণী হওয়ায় তার নিয়তি। সীমা ভাবলো, ভবিষ্যতে মানুষের তাৎক্ষণিক শ্রদ্ধাবোধে কি কুঁকড়ে যাবে না? নিজের পায়ে দাঁড়ানো এই? বিনয়ের নামে ওপরে নিরাসক্ত ভান আর অতলের সুপ্ত তৃপ্তির তাপ। কিছুটা তৃপ্তির জায়গা তার আছে। গবেষণার বিষয়বস্তু জৌলুসের না। গাইড একজন দেশপ্রেমিক। তাকে বলে অনেক সত্য উদ্ঘাটন করেছে। নদী ও মানুষের আন্তঃসম্পর্ক, সেই আদিকাল, নিরবচ্ছিন্ন নদীর বহমানতা সুস্থ জীবনে, নদীর অবদান মানুষের এই কৃষিসভ্যতার মাটিতে আত্মত্যাগী জননীর পা। সেই নদী নিয়ে প্লাবনের দোহাই দিয়ে নগরসভ্যতায় অগ্রগতির প্রতিবন্ধক করে বিদেশি ফর্মুলায় নদী শাসনের নামে যে বর্বরতা, লেখাতে সে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছে। সম্পন্ন করবে পূর্ণতায়। সে ততো রাজনীতিমনস্ক না। বরং গভীরে মেনে না নেবার মতো অনেক কিছুকে মেনে নেয়। ভেঙে বেরুতে গেলে ভয় হয়—বেশি হচ্ছে কি? পারবে তো? যদি ভাঙতে গিয়ে না পারে মচকে যাওয়া মন তৈরি হতে পারে। তখন? নিজের ওপর ক্ষুদ্র বিশ্বাসটুকু নষ্ট হয়— সীমা ভাবলো, ডিগ্রিটা তাকে নিতে হচ্ছে। তার দ্রোহ নেই, ভাঙনের প্রবণতা নিজের ভেতর দেখেনি, কঠোর মনোবলের পরিবর্তে দোদুল্যমানতা—তবু সীমা বিশ্বাস করে শিক্ষাকে সে কোনো প্রকল্পে নেবে না।
ওভেনে দুইশো সেন্ট্রিগ্রেডে কেক বানাচ্ছিলো। ডিম, ময়দা, চিনি, দুধ, বেকন পাউডার, বাটারওয়েল সে মিশিয়েছে, ডিমের হলুদ আর শাদা অংশ দুটির বিভক্তিটাও খাপ খাওয়ানো। চিন্তা হচ্ছিলো এসেন্স নিয়ে। ফ্লেভারটা মনমতো আসবে তো? এগুলো সীমার বহুদিনের অভ্যস্ততা, আজ সে আনমনা ছিলো, তার মনের অবস্থা কেক বানানোর মতো না; কিন্তু রুম্মানের জন্মদিন বলে এটা বানাচ্ছে। বাবার মৃত্যুর পর মানসিকভাবে এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি সে হয়নি। দুইদিন যেভাবে সে ভাঙাচোরার ভেতরে সেই বিবরণ তার জানা নেই; অসম্ভব অস্বস্তি আর জ্বালা নিয়ে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আজকাল এগুলো কোনো কলঙ্কই না, কিন্তু প্রশ্ন—কাজল এটাকে আনবে প্রকাশ্যে। সীমার কাছে রীতিমতো উন্মাদনা। সমাজে তাদের যা শ্রেণিঅবস্থান, অর্থনৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো প্রভাবই নেই। এই দেশে ঘটনাটাকে কদর্যভাবে দেখা হবে। সীমা নিজেও কি খুব একটা মানতে পারছে? ফাঁকে ঘড়ি দেখলো সীমা। তিরিশ মিনিটের সাত মিনিট হয়েছে। ভয় হচ্ছে মাকে নিয়ে, নিশ্চিত মারা যাবেন। কাজলের ওপর সীমার ক্ষোভটা মাথাটার ভেতর জ্বালা ছড়িয়ে দিয়ে বিস্তার লাভ ঘটাতে চাচ্ছে বন্যতায়। স্বল্প পরিচয়ের একজন মানুষকে আচ্ছাদনহীনভাবে শরীর উৎসর্গ করা কতোটুকু নৈতিক? একটা চূড়ান্ত অনুভূতির শেষ বিন্দুতে গিয়েও কারো কারো সতর্কতা থাকে, সেটা যখন হারিয়ে যায়, সীমা ভাবলো, নো ওয়ে টু ব্যাক। ক্রোধ হু হু করে উঠলো জ্বলে; মানুষ কখন লজ্জিত হয় না, রক্তের প্রবাহ যখন শিরায় শিরায় তাজা আগুন! সীমার তবুও হীন মনে হচ্ছে—চিরন্তন নৈতিকতার মুখোমুখি পুরনো অন্যায়। অন্তত এখানে নিজেকে রক্ষা করার মতো দাঁত, চোখ, নখের ধার আর দেহের সবলতা নিয়ে লড়তে আসার মতো কতোটুকু সক্ষম? হেরে গেলে ধিকৃত! ভয় পেয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো ফ্যাকাশে মুখে। আরো আঠারো মিনিট আছে। ফ্লেভারটা এখনো নাকে আসেনি। অনেকক্ষণ সীমা তাকিয়ে ওভেনটার দিকে। হ্যাঁ, কলঙ্কেরই ঘটনা।—পরপরই সীমার মনে হলো কাজল কি অপমানবোধলুপ্ত পৌরাণিক প্রেমিকা যে একই সঙ্গে ভুল আর সত্য নিয়ে দাঁড়াবে? বোনটাকে তার অসাধারণ মনে হয়নি, আজ গ্রহণঅযোগ্য অর্থে সাধারণও মনে হলো না। বিস্মিত হবার মতো ওর একটা গুণ, মানুষ চিনতো। সীমা কি বহুপাশ থেকে দেখছে? নাকি ভয় লজ্জা আর বিস্ময় তাকে হতবাক করে ভাবায়। কাজল যা ভাবছে: যুগের সস্নেহ প্রেরণা নাকি নিছক ভ্রান্তি। বিরক্ত হলো সীমা; তার দ্বন্দ্বগুলো দ্রুত সিদ্ধান্ত চায়। কতো মানুষ এই বিশ্বময়। প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা পৃথিবী, তার গ্রহ আছে, অন্যেরও গ্রহ আছে, একেকটা গ্রহ অন্য গ্রহের দিকে তাকিয়ে ঘুরছে, চলছে কখনো-বা নিকটে কিংবা দূরবর্তী মানসলোকে। একটা করুণ হাসি তার ঠোঁটে উঠে এলো। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র এক দেশ, সেখানে রাজধানী নামক উন্মূল এক নগর, সেই নগরের এক নারী—কাজল, তার শিক্ষা, সৌন্দর্য, দর্শন, সভ্যতা—তার আবার প্রাতিস্বিকতা—দায় তাকেই নিতে হবে। মনে হলো, অবাধ্য অন্যায়ের যোগফল জিতলে সত্যের দিকেও মুখ রাখে।
টেবিলে ওভেনে কেক। চেয়ারটা টেনে মানসিক ক্লেশে সীমা বসলো, বাঁ হাতটা কনুইয়ের ওপর রেখে ঘাড়টা কাত করে পানি ঢাললো গ্লাসে। চেকের গোলাপি শাড়িটা ঘাড় থেকে নেমে পড়তেই ঠিক করে ঘড়ি দেখলো সীমা।
এখন সুইচটা অফ করা যায়। কতোটা উৎকর্ষ পেলো, লক্ষ করলো না।
অনেকদিন পরেই কাজলকে দেখলো সীমা। তখন পাঁচটা হবে বেলা। বাইরে থেকে সে জন্যেই ঘরে ঢুকেছে এমন আলো, কঠোরতা কম। কাজলের চোখ চকচকে। ঘরে ঢুকেই গদিঅলা সোফার চেয়ারে শরীর ডুবিয়েছে। কোমল আলোয় ঘরটা হেমন্তের হলুদ। কোথা থেকে নিয়ে আসা বাদামি রঙের দেয়ালের ওপর কাজলের লাল সিল্কের দূরান্বয়ী প্রতিবিম্ব। সীমা এগিয়ে এসে হাত ধরলো ওর। কয়েকটা এলোমেলো চুল গুচ্ছ ভেঙে ঘাড় থেকে নেমে এসেছে কাজলের মুখের ওপর। একটা লৌকিক কোলাহল সীমার ভেতর। কাজল টেবিলের ওপর খাতায় লেখা দীর্ঘদিনের তৈরি তালিকাগুলো মনোযোগে সীমার দিকে এগিয়ে দিলো।
বেবিক্রিপ (দেড় হাত লম্বা), ডাইপি, অনেকগুলো। ডাইপার টেবিল (দুই হাত)। চেক করে নিতে হবে, টেবিলের ভেতরের পার্টে বাথপট ঠিক আছে কি না? বেজমেন্ট রাউন্ডে ঘুমাবে, দেড় হাত লম্বা, দুই মাসের জন্যে। ডাইপারের পাশে র্যাক। কাপড়ের সাইজ (অবশ্য বাচ্চাটার ওজনের ওপর নির্ভর করে) ৪০০/০৩/ এর পনেরো দিন পরে ০৬/০৯/১২ এক বছরের শার্ট আর ট্রাউজার। লোশন হেড টু টো জনসন কোম্পানির ভালো। ঘুমের জন্য হাত মোজা, পা মোজা সব মিলিয়ে একটা পোশাক। এটা কয়েকটা। ফিডার/ ফর্মুলা/ ভিপ/ ওয়েট টিস্যু (টয়লেটিং) বেবি ট্রলি বা প্রাম। এছাড়া রাইস সিরিয়াল উইট সিরিয়াল খুব দেখেশুনে কাজল এগুলো কিনবে। অভিজ্ঞ একজন দরকার।
তালিকা দেখে সীমা বললো, শুরুতে অনেক টাকা লাগছে।
কাজল অদ্ভুত কণ্ঠে বললো, আমি আট মাসে বেবি শাওয়ার করবো। শুধু তোর গিফটগুলো নেবো।
বেবি শাওয়ারের দিন বাচ্চার বাবাকে যদি দেখতে চায়—বলতে বলতে ভেঙে পড়লো সীমা—আমরা তো অ্যাডভান্সড লাইফে না।
ধুর এটা কে বলেছে? কাজল হাসলো। আসলে আসলো, না হলে তুই হলেই হবে।—কথাগুলো বলে তালিকাগুলোর দিকে দৃষ্টি দিচ্ছিলো কাজল। আরও কিছু বাদ পড়লো কিনা বুঝতে পারছে না। সে চিন্তা করছে এমনভাবে, যেন দুই কাঁধে কোমলভাবে চাপ দিচ্ছে দুধারের স্থিত ডানা। সীমা কাজলকে দেখছিলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। শুধু কাজল না, অনেক কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে।— এই সত্তা তারও, তারই রক্ত, অথচ দূরত্বে ব্যবধান অনন্ত। পাঁচ মাসের এক আলোকরশ্মি শুধু কাজলের দেহের ভেতরেই কেবল না, আকস্মিক সারা ঘরের জানালা-দরোজার ফ্রেমগুলো গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে ঘুচি-গলি থেকে রাজপথে, শাদা আবেগের ছায়ায় স্বগতোক্তিতে, কাজলের ললাটে টিপ হয়ে ফুটছে প্যাস্টেলের কচি রঙ। সুতরাং ছবির মতো অবলীলার সে আগমন, আবছা আর ধূসর জলের ঘোলা পাকে পূত হয়ে বেড়ে ওঠে কোনো মণিপদ্মে; প্রত্যক্ষ মৃত্যুর সঙ্গে সহবাসের মৃত্যুঞ্জয়ে!
তখন ক্ষুদ্র একটা কাঁটা আরেফিনের গলায় ফুটছে। ঢোক গিলতে পারছে না। টেলিফোনে কথা বলতে অস্বস্তি। যেহেতু সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছে না, ফলে তার স্বর হয়েছিলো নিচু আর নিজে সে চমকে উঠেছিলো আর ভাবতে ভাবতে সে পায়চারী করছিলো এঘর ওঘর। যন্ত্রণার ডুবোপাহাড়ে বারবার তার চলমান গতিটা বিঘ্নিত হতে পারে আতঙ্কে নিজেকে তার থেকে বিযুক্ত করার চেষ্টায় ছিলো। কিছু প্রতিক্রিয়া তার সমগ্র অস্তিত্বে কেন্দ্রীভূত বিন্দু হয়ে মুহূর্তেই বৃত্তে ফেলে। ব্যক্তিগত অনুভূতির বিলাস কিংবা বেদনা কোনোটাকে আরেফিন পারছিলো না সনাক্ত করতে। ধনী না হলেও তার এক্সপোর্টের ব্যবসা এশিয়া জুড়ে। শুরুর অবিরত পরিশ্রমে সে ভাবার অবকাশ পায়নি দেশ আর বিদেশের কোনো লক্ষযোগ্য ব্যবধান। প্রতিক্রিয়াটা হচ্ছিলো নিজেকে নিয়ে। মূল্যবোধ নিয়ে। কেন সে এগুলো ভাবছে, অন্তত গত কয়েকদিন ধরে, তার ভেতরে এক ব্যাপক একাকিত্ব তৈরি হচ্ছে কিনা জানে না। সে ধীশক্তিসম্পন্ন। কখনো অস্থিরতা তার স্বভাবে নেই। খুব ফিটফাট গোছানো মানুষ হিসেবে তাকে মনে হয়। ভেতরটা কেউ জানুক-বুঝুক চায় না। আরেফিন বন্ধুবৎসল আর হইচই স্বভাবের একজন, কিন্তু ক’জন জানে কোনো বিষয় নিয়ে ইচ্ছে করলে আরেফিন একনাগাড়ে এগারো ঘণ্টা ভাবতে পারে, নিরবচ্ছিন্ন ছাদের ওপর বসে বা কোনো লেকের ধারে হাঁটতে হাঁটতে। পাঁচশো পাতার একটা বই আরেফিন মনোযোগ দিয়ে তিন দিনে শুধু শেষ করে না, মাথায় গেঁথে আত্মস্থ করে আলোচনা করে। বিপর্যয় মনের ওপর পড়লেও নিয়ন্ত্রণহীন হয়নি। নিজের চঞ্চলতা দেখে আজ অবাক!— অস্থিরতা? ভয় নিশ্চয়ই, কোনো মনের ভেতর। প্রশ্নটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করলে আশ্চর্য হলো উত্তরটা ধারালো, অভিজ্ঞতা জানালো, চাইলে একটি জায়গায় ক্ষমা পাবে—সঙ্গে উষ্ণ আশ্রয় যা তাকে কেউ দেয়নি। নেবে না—প্রেম বিক্ষত হবে। ক্ষমা কখনো বড়ো শাস্তি বরং হারাবে, সরে যেতে হবে তাকে। যাকে নিয়ে ভাবছে সে-ও হয়তো এমনই। প্রেমিকার সঙ্গে দুঃখ-কষ্ট-বেদনা ভাগ করায় সে ভাগ্যহীন। নিয়তি শুকনো গোলাপের কাঁটার মতো শীর্ণ। চোখ ছলছল করে উঠলো আরেফিনের, জলে, তারপর ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো—বি-দা-য়! গুডবাই কাজল!
কাজলের হাত থেকে তালিকাগুলো নিয়ে চোখ বোলালো সীমা। তারপর ভেবে বললো, আলট্রাসনোগ্রাফিতে কি?
মৃদু হাসলো কাজল, ভালো—ছেলে।
নিয়মিত চেক-আপ করাস আর মাকে বরং আমার কাছে আনি—সীমা চিন্তিত; পরপরই হালকা হলো সীমা—থেমে থেমে বললো, কী নাম রাখবি ওর?
দিব্য—কাজল হাসলো মুখ নাড়িয়ে।
তাই—কী পড়াবি?—সীমার চোখে সরস কৌতুক।
ঘরের ভেতর শীতের ঠাণ্ডা ও বসন্তের শিহরণ। দুটো মিলিয়ে জলবায়ুর একটা মৌলিক পরিবর্তন, ছেলেখেলার মতো, ঢুকলো এলোমেলো হয়ে। কাজল ঘাড় উঁচু করে তার কমনীয় দীঘল শরীর দুলিয়ে তীব্র ক্লান্তি-আনা বাসনার আবেগে হঠাৎ সীমাকে বললো—এই, ‘থিয়োলজি’ শব্দের ঠিক অর্থটা কী? সীমা কাজলের শরীরের রেখায় সঞ্চালনের ভেতর সূক্ষ্ণ পরিবর্তন লক্ষ করছিলো, কাজলের দেহটা নড়ছিলো যেন পাহাড়ি তালে আর চোখের তারায় ছিলো দুরন্ত হাওয়ার লয়। মুখে রহস্যময় সপ্রাণতা।—এই সময় তাকে চমকে দিলো কাজলের প্রশ্নটা।—কয়েকদিন আগে ঘরে ‘ভারত-সাধক’ খণ্ডগুলোর একটা পড়ছিলো সীমা, যমুনাচার্য, বিবেকানন্দ আরো বিভিন্ন সাধকের জীবন ও দর্শন। অভেদানন্দের অধ্যায়ে এসে একটা লাইনের বিশ্লেষণে সে মুগ্ধ হয়েছিলো। অভেদানন্দ বলছেন, যিশু স্বয়ং আসবেন বলে যে ধারণাটা আছে তা রূপক। তার দর্শন ও জীবনপ্রণালী সত্য হয়ে আবার ফিরে আসবে। যিশুর আসা মানে এটাই।
অনেক পরে কাজল চলে গেলো। সীমা ব্যালকনিতে একা।
যাওয়ার মুহূর্তে সে কাজলকে জিজ্ঞেস করেছিলো, ওকে নিয়ে কি একা থাকবি?
হ্যাঁ, দৃঢ়তায় কাজল বলেছিলো। তিনজন একসঙ্গে থাকলে সুন্দর হবে না। এই সামাজিক বলয়ে বন্দি হতে চাই না। ঠাণ্ডাস্বরে বলেছিলো, সীমা, একটা মানুষের জন্ম হোক আমি চাই। পূর্ণাঙ্গ মানুষ। দূর থেকে দেখায় ভালো। এই কাছাকাছি থাকা, সবকিছু দেখে ফেলে বুঝে যাওয়ায় মনটাকে দুর্বিষহ করে। প্রতিনিধিত্ব করার মতো কোনো মানুষ বানাতে চাইলে একসঙ্গে থাকা আজ বড়ো প্রতিবন্ধক। দিব্যর কষ্টটা নিশ্চয় কোনো বড়ো জায়গায় ছাপ ফেলবে। দেখিস ও মহৎ হবে।
সীমা ব্যালকনি থেকে বাইরে তাকালো, সামনে মানুষের জনপদ, দোকান-পাট, যানবাহনের শব্দ। ইলেক্ট্রিক তারগুলো ঝুলে। ওপরের তারটায় একটা প্রাণ—পাখি না প্যাঁচা?
সীমার ভেতর স্থিরতা আসছে; মনে মনে বললো, এতো ভাবারই-বা কী আছে। মানুষেরই তো জন্ম!
* * *
সেলিম মোরশেদের ‘কাজলরেখা’ গল্পের পাঠ/ সাগর নীল খান ----------------------------- “…স্বাভাবিকতায় চেপে রাখা এই প্রয়াসই দু:খ” নিজের সাথে নিজের আলাপ, এই গল্পের এক বিশেষ দিক। তবে একজন চরিত্র না, কোনা না কোনোভাবে পরস্পর সম্পর্কিত চারজন কথা বলে চলছে নিজের সাথে। আত্মকাহিনীও না, ‘সব সত্য সুন্দর করে বলা যায়? বলাটা হয় কখনো?’, নিজের উন্মোচন আসলে। নতুন ধরনের সামাজিক বন্ধন আর ব্যক্তির একান্ত দিক, এটাই হলো এই সময়, ‘কাজলরেখা’ তাই। এরা যেন নিজের একটা বিকল্প-সত্তা তৈরি করে নিয়েছে। নিজের অবলম্বন সে নিজেই। আত্ম-সচেতন এক একজন মানুষ। সমাজের আবহমানতার সাথে নিজের টানাপোড়েন শুধু না, উত্তরণও এখানে বিষয়। ব্যক্তি চিরাচরিত ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে অনেককিছুতে। আবার একরকমের ‘সেন্স অব র্যাশনালিটি’ নিয়েও কাটিয়ে যাচ্ছে। জানাবোঝা হয়ে যাওয়া ব্যক্তির দ্বন্দ্বপূর্ণ এক মনস্তত্ত্ব চোখে পড়ে। সম্পর্ক-সম্ভাবনার নানা চিহ্ন, যদিও অধিকারবাদের বহুকথিত বিষয়আশয়ের আলোচনা না। অধিকারবাদ তো সিস্টেমের সংস্কার। আচ্ছন্ন হয়ে থাকা সংবেদনশীল মনোলগে ব্যক্তি-এককের আত্মউপলব্ধি বৈপ্লবিক প্রস্থানের ইঙ্গিত দেয়। বিপ্লব আর সংস্কার আলাদা। রাজনীতি অর্থনীতির প্রচ্ছন্ন এক ডিসকোর্সও পাওয়া যায় এখানে। অনেকক্ষেত্রে পরিস্থিতির কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড পাওয়া যায় না এই গল্পে। ঘটনাক্রমে একজনের সাথে পরিচয় এবং তার সাথে ঘুরতে চলে চলে যাওয়া, ব্যস এইটুকুই। আরো দেখা যায়, খুব ছোট একটা প্যারার ব্যবধানে অন্য বিষয় শুরু হয়ে যায়, যেন আকস্মিক। এক চরিত্র থেকে আরেক চরিত্রের মনোলগে যেতে ঘটে যায় ন্যারেশনের সূক্ষ্ম বিপর্যয়। সাধারণত ন্যারেটিভ ধারার লেখায় ব্যাকগ্রাউন্ড উপস্থাপিত হয়, সেটা আসলে এই গল্পের প্রাধান্য-বিষয় না মনে হয়েছে। কেননা পরিণত সময় ও চরিত্র, ব্যাখ্যার প্রয়োজন নাই। আর সাহিত্য তো শুধু ব্যাকগ্রাউন্ডের স্টোরি টেলিং না, সেন্স। গল্পটা ফেনায়িত না হয়ে সেন্সকে ধরতে চেয়েছে। ------------------------------------------ # সাগর নীল খান
ইশরাত তানিয়া
এপ্রিল ০৮, ২০২৪ ০৩:৪৮