আগুন ও তৃণভোজী
পাল
আমাকে কিছু বলেনি ঝড় দিকশূন্যতার ভোরে জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে বেড়িয়ে পড়েছি
আমার পেছনে উপকূল বাঁকা হয়ে যায়,
সব আকৃতির মাঝে পাখিদের ঢেউ এসে পড়ে
তাদের পদচিহ্ন না রেখে ভাসিয়ে রেখেছে আমার উর্ধ্বারোহণ।
স্বপ্নের উপর দিয়ে এই জলযান তার লক্ষ্য টাঙিয়ে রেখেছে
পালগুলো আমার বয়স—রক্ত-শেকড় দিয়ে গড়া,
বুড়ো হতে থাকা হাড় দিয়ে বানানো হুইল আমি তরুণ স্বপ্নের কাঁটার পরিধি মেনে ঘুরিয়ে চলেছি
একত্রিশটা ঝড় ছুয়ে গেছে
খুবলে তুলে নিয়েছে লবণ বেঁধা মাংসের অবতল
আজ তবু সুর উঠেছে গতিতে
আমি চালিয়ে নিয়ে চলেছি সমুদ্রের ঝড়ের গহীনে
সেখানে সবকিছুই জীবন থেকে দূরবর্তী
সেইসব দেশ ছেড়ে শেষরাত্রিতে আমার হৃদয়, যারা ভেসে উঠেছিল বছর সকল জুড়ে
নীল নদী সত্য তুলে ধরে আমার দৃশ্যকে।
লিখে রাখছি একজনকে, যার দেশ তাড়িয়ে দেয়নি
আমাকে স্পর্শ করেছে সমুদ্র।
|| ২ ||
এ কোনো সমুদ্র নয় এখানে কাঠগুলোই আমাদের পা
বেহেশত থেকে নির্বাসনের যন্ত্রণা আকাশকে বিলীন করে দিয়েছে
নিম্নে বেড়ে ওঠা গাছের শাখা-চূড়ায় মাছেদের যৌনতা, ফুল আর চূর্ণ পাথর
আমাকে হাঁটতে বাধ্য করে স্থলভাগের ’পর নতুন ব্যবধানের উদ্ভবে।
|| ৩ ||
এক ধূসর দেহের স্বপ্নে ক্ষয়ে পড়া অনতিমুখর দাঁড়, তারপিনকালো নৌকো
তক্তায় দোঁআশ জল ধাক্কা মারে, এত তীব্র!
তারার বাদামি পথে এ রাত্রিতে হাওয়ার প্রবাহে কাঠের বেহলা
ফসফরাসের দুধারী ছুরির সাথে যুঝে।
ভাস্কর্যের জীবিত পাথরে রক্তের বেহালা লবণে ডুবে যায়
সুর শুদ্ধ করে রক্তবিহীন মাংসের, এ প্রহরে গানের সে রাগ ধ্বনিবদ্ধ
যাকে আমি যেচেছিলাম প্রহার, রটনা-সম্ভোগ-ক্ষুধা, লবণ-কোরক
সব যেচে মিশ্রিত এখানে।
নির্জলা মিথ্যার শুদ্ধকৃতি আমার জীবনে আলস্যের সব ধার মিটিয়ে দেয়
দিনের আলোতেও প্রখর অমিতাচারী স্তম্ভচূড়া স্তব্ধতার বায়ুশিকারী শকুন
এখান থেকেই আমার বৈধব্য আহার করে
আমার কাঁধে বসেছে দুধার বেহালা।
|| ৪ ||
এই ঘরে সব উল্টো হয়ে আছে, নারীরা জান্তব সব মূর্তি
সচল, কালো নদীর মতো চুলগুলো নেমে এসেছে খোঁয়ারি থেকে
সেখানে জলের ফোঁটা নক্ষত্রে উজ্জ্বল।
কুকুরদের অভুক্ত পেটে ওই আলো এসে পড়ে
হাড়ের খয়েরি গুড়ো ঝুর ঝুর একদম ভেতর অবধি মনুষ্য ইতিহাসের ভেঙে পড়া শৃঙ্খলার সুতো।
আত্মার গহীনে থাকা বিস্মরণগুলো, তারা স্মরণ করেছে আমাদের
আলো, সব আয়নাকে যেন টেনে নেয়।
অভুক্ত কুকুরদের দেখা যায় না কোথাও
এখনও রক্তের পাথারে অথই নথিহীনতার হিংস্রতা বল্লম উঁচিয়েছিল
মাঝে মাঝেই যখন অশ্রুকে বন্ধুত্ব বলে ভ্রম হয়
কুকুরদের কে সে বন্ধু! রাত্রিতে আলোর উন্মাদনা ঝরে
ক্ষুধা ভুলে যায় আত্মা
চরাচরের চিড়িয়াখানা নস্যি তাদের যুথবদ্ধতার রক্ত-স্রোতে।
সবকিছুতে বিচ্ছিন্ন থাকে তারা আর পায়ে ঝুলে থাকা কালো মহাকাশজুড়ে
দেয়াল না ডিঙিয়ে ভেতরে যাওয়ার সুরঙ্গ সমগ্র দিন খুড়েছে।
পাহারাদারেরা, যারা দায়িত্বে ছিল রাত্রিভূকদের তাড়ানোর
পাহারাদার শুধু, হরিণদের মাংসশূন্য ছড়ানো অবয়ব দ্যাখে।
মাংসে থাকা জলপাই আর আমলকি তীব্র লবণাক্ত লাল বাতাসের খাদ্য
চিড়িয়াখানায় চুলের কালো নদীগুলো আসে
এই ঘরে রক্তমেঘজমা লব্ধ খোঁয়ারিতে।
|| ৫ ||
জংধরা ছুরির অবয়বের কথা আমরা শুনেছি, সাবানের মাঝে ডোবানো তার লাল দাগ
বাদামী শরীরে ফেনা, নীল আর নম্র পিচ্ছিল আয়তনে তার অস্থি-হাড়, স্বপ্ন লোহায় গড়া।
সাবানই তখন ছুরি, জল দিয়ে তাকে প্রবাহিত করা হয়
যে ঢেকে দিয়েছে ঐন্দ্রজালিক হিংস্রতাকে।
বাতাস তার সঙ্গী ছিল, নিজেও, তার উপাদান ক্ষয় করে ফেলে স্বপ্নের খুনগুলো
নিজ অভ্যন্তরে পৃথিবীর সীমাহীন ব্যাখ্যা, হাতির অর্ধেক শুড়, স্বপ্ন আর সমস্ত শরীরের মাপ।
তখন পুরো জঙ্গল বিজোড় হয়ে যায়
আচ্ছাদন হারিয়ে শরীর অনুভব করে মাত্রাজ্ঞান, বসুধা বিভক্ত পৃথিবী নাম
আমাকে না দেখে ছুরি দরোজা পেরিয়ে যায়
বাতাস লাল দাগ বহন করে আনে, নীল সাবান থেকে জাগে আচ্ছাদন
আমাদের মাঝে আড়াল নির্মাণ করে ব্যাখ্যা, সূত্র, জ্ঞান।
|| ৬ ||
তখন সমগ্র শূন্যতার কাঠ খুলে নেওয়া হয়
আকাশের প্রান্তে মেঘফোটা সরোবর, ওখানে আমার বাড়ি!
যারা বৃষ্টিতে কখনও লয় প্রাপ্ত হয়
এমন বাতাস নির্বাসিতদের হৃদয় মুচড়ে উঠা মরুভূমি থেকে আসে!
বিশ্বহীন তখন নতুন দেশ!
একটা নিঃসঙ্গ ঘোড়া তারস্বরে ডাকে
বর্শাবিদ্ধ ভূমি আমাদের হৃদয়ে অর্থ বদল করে।
আগুন ও তৃণভোজী
গুহার মধ্যে শুয়ে আছি। আগুন জ্বলছে।
শিকার করে আনা তৃণভোজীদের পোড়ানো মাংসের ভেতর
যৌনতা আর ঘাস তাদের রেশ রেখে গেছে।
ইতিহাস এখানে ভিন্নভাবে বিবর্তিত
শীতরাত্রির এই নরকে পশুরা দুইভাবে বিভক্ত করে নিয়েছে তাদের।
শূন্যতা ওহ শূন্যতা, আগুনের পশু আমাকে দখল করে রেখেছে
আমাকে ঘিরে উলুধ্বনি করছে প্রেতেরা
নিম্নাভিমুখী দেবতা, অবিনশ্বর দেবী—
সিঁদুর জমা আদিবাসী নারীর ভগ্ন দোকান।
এই গুহায় আমার দৃশ্যে ভাসে সেসব, সিঁদুর-রক্তজল নদীতে
ভেসে যাচ্ছে চিরপ্রবাহমান যৌনতা
ঘুমহীন বেড়াল বসে থাকে আমার পাশে। কুয়াশার ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে
তার পশমে জেগে থাকে আমার স্বপ্ন।
আগুন। নারীটির শীতল স্তন হয়ে জমে আছে রাত।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন