মা ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-

 

কোয়র্জ পাথরের সাথে

বাতাসের কাছে জানতে চাইছিলাম আমার কেমন লাগছে! রাত বাড়তেই যে বৃষ্টিটা খুব কাছাকাছি নেমে আসে তার জন্য একটা তৃষ্ণায় ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়ি। রাতের হাতে হাত রাখতেই নিজেকে আবিষ্কার করি, আমি একাই একা নই, এই রাতটাও অজস্র তারা লয়ে বহুকাল আগে একা একা কাটিয়ে দিচ্ছে তার ডাইনিংয়ের চেয়ারগুলোর সাথে।

একা খেতে বসলেই মনে হয় চেয়ারগুলো নড়ছে পায়ের কাছাকাছি এসে। এরপর এঁটো থালার সাথে ইচ্ছে করে যে শব্দগুলো নেচে উঠছে তার মুদ্রা আমার ফ্ল্যাটে  দীর্ঘ নদীর মতো এপাশ থেকে শুরু করে ওপাশে থেমে যায় একটা অচেনা মানুষের সুর যেন।

কিছু সময় মনে হয়, আমিতো এমন বর্ষায় ডুবে যেতে চাইতাম বহুদিন, যেন এক ডুবেই সহজে পাওয়া যায় জলের জীবন। সাপের খোলসের গায়ে লেগে থাকা যে অর্বাচীন জীবন, আমার কিছুসময় সে মোহ জাগে। ছুটে আসা ঢেউয়ের কোলাজগুলো একটা একটা করে ভাঙে নৈঋতের সিঁড়ির কাঠামো। ভাওয়াল রাজার বাড়ির সিঁড়ি থেকে নেমে আসার পর একটা উপাখ্যান যেমন চোখ থেকে শুরু হয় তেমনই ভাসতে থাকি আমি ভিটেমাটি লয়ে।

আমার কেমন লাগছে জানি না, কেবল মনে হয় পৃথিবীর শূন্য কেন্দ্র ভর হচ্ছে আমার ভিতরে ইনফেকশন হয়ে। আমি জানছি কিছু দূরত্বের পরিধি ক্রমশ বিষণ্ণতা দীর্ঘশ্বাস হয়ে নিজস্ব জলের কাছে বসে থাকবো ধ্যানস্থ বকের মতো। প্রতিটি সূর্যাস্তের কাছে গিয়ে দেখে আসবো বহুমাত্রিক পৃথিবীর লালিত ভবিষ্যত। সূর্যোদয়ের উপাখ্যান আমায় টানছে না আর, একা একা মনে হচ্ছে কফি খাচ্ছি প্যারিসের কোনো টেবিলে যেমন বসে থাকতেন ভাস্কর নভেরা।

ঠিক সন্ধ্যার সে প্রহরটায় পাশের ছাদে একটা দাঁড় কাক ময়ূর হয়ে যেন ডেকে যায়, পাশ কাটিয়ে উঠতে থাকে ব্যস্ততা। অতঃপর রাতের অন্ধ দোকানি জানিয়ে দেয় আমারে নিঃশব্দ আততায়ী প্রেম।

কী একটা অজানা উৎপাত চলে, শরীর ঘেমে উঠে আসে আমার, দৌড়ে চলে যাই মা'র ঘরে, দুঃস্বপ্ন কিংবা ছায়ার দৈর্ঘ্য হবে হয়তো। মা মাথায় হাত বাড়িয়ে টেনে নেয়। পৃথিবীর সমস্ত ওম জুড়ে সাদা একটা কথা বলতে ইচ্ছে হয়, গর্ভে প্রবেশ করতে চায় মন জন্মের তাগাদায়।

আমার কেমন লাগছে জানি না, কেবল হিসেব কষে কয়েকটা প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে আমার, যেন আমাদের দিনগুলোর করুণঘন বর্ণনা কেউ লিখে শেষ করে দেয়। আমার তার কথা মনে হয়, যারে একবার দেখেই মনে হয়েছিল এর জন্য মরে যাওয়া যায়! হয়তো অনার্য রোদের ঘরে ফিরে আসার সুখবর পেয়ে যাবো আমরা, কেবল দীর্ঘ একাকীত্বই রচনা করবে অসীম একার শষ্যক্ষেত্র।

 

মরারোদ

প্রতিদিন মরা রোদ গিলেছি আমি। রোদচশমা তৈরি করে জেনেছি ওসব আলোর মতো করে বহুপক্ষীয়। আমি চোখ হিসেবে জেনেছি নিজের আলোকে, আলো জেনেছি মাটির  চোখে তাকিয়ে। প্রতিটি সূর্যাস্তই একটি অভিযোজন।

নিজে নিজে এত কথা বলি অথচ গুছিয়ে শেষ কথাটি বলতে পারছিলাম না। আমি হয়তো আমার আলোকে বেকায়দায় মেরে ফেলছি অনেকগুলো তারে  সম্পৃক্ত আলোর সাথে।

ঊন-আলো জ্বেলে বসে আছি আমরা যেন কলিজার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে বর্নিল কফিন। আমি চেয়ে থাকি বিশিষ্ট ব-দ্বীপের দিকে। তারে খুঁজে নিতে না-পারা আমার চোখেরা অবিরাম অগ্রযাত্রায় সন্তুরিত হয়, মাছেদের কানকো রঙের শাড়ি জড়িয়ে আমিও উড়ুক্কু মেঘ হয়ে গেছি। মাছ উড়ে গেলেই হয়তো আসবে নিরাপদ বসন্ত।

আমি তাকিয়ে দেখি আমার জলাঙ্গী হাত। ভিজে যাওয়া পায়েরা নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যায় নদীটার মতো তার কাছে; পায়েরা জানে না জোড়া চোখ জলে ভেসে গেছে বহুকাল আগে।

আমি হয়তো তারই নামান্তর, মরে যাবো বৃথার বেদনায়। জলের ঢলে নেমে পড়বো লোহিত বর্ষার অঝোর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খুব সহজ হবে অভিযাত্রা। উদ্বায়ী ধর্মের নামে পরিচিত মুখ আমার কাছে এসে আবার পতিত হবে ভীষণ মোটাদাগে।

ভাবছিলাম অন্তত একবার হলেও আমাদের আভিজাত্য নামুক, এই মনকারা ইচ্ছে যা খুশি করার মতো। তবে আমি হত্যা কারে করবো—নিজেকে সরিয়ে তারে!

 

মা

মা আর আমি এখানে, আছি আর প্রতিদিন বৃষ্টি নামছে। আর তেমন নতুন খবরে নেই আমরা।একই জীবন যাপন থেকে চলছে আমাদের ছোট অক্ষর। নতুন খবরে নেই কোনো পত্রিকার পাতায়। সাদাসিধা জীবনে নিউজপেপার রঙের একটি ঘর, ছককাটা দাবার মতো; আমরা আছি কোলাহল থেকে দূরে, কেউ নেই বলে আমরা আর আফসোস জমিয়ে রাখি না, কেননা কেউ কোনোদিন ভালোবাসেনি আমাদের আশৈশব। মা শিখিয়ে দিচ্ছেন ভালোবাসাহীন জীবনের তালপাতার গল্প।

এসব মাড়িয়ে আমি দূরের মহীরুহ, কেবল বিচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য সিমেট্রি। একটা নির্জন মাঠে বসে আছি ঘাসের বুকে, চিরকালের জন্য, হয়তো মৃতদের মতোই পিঠ ঠেকিয়ে মাটির হৃদয়ে।

চাইলেই ঘুমানোর গল্প আমার কাছে জমা নেই, মা জানেন, আমাদের কেউ কোনোদিন ভালোবাসেনি। আমি যা জানতাম তা হারায়েছে। আমরা নিজেদের কথাগুলো গোপন রাখতে শিখেছি।

মা কিংবা মেয়েআমাদের যে জীবন তার অন্য কোনো নাম নেই আমি অবশ্য জেনে গেছি এতক্ষণে আমাদের দিনগুলোর করুণ ঘন বর্ণনা বেঁচে থাকার নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে দেওয়া কষ্টেরা জানে না সন্তরণ করতে হয় জীবনকে আশ্রয় করে৷

 

কাটাকাটি

তখন আমরা পারুল ফুল চিনতাম, জবার পাতা ভিজিয়ে তৈরি করতাম তেলের বিপরীত, লাল ঝুমকো আনতে ডিঙিয়ে গেছি কাকের আগের ভোর। কলাবতী পেঁচিয়ে বসে থাকতো হলুদ ডোরা সাপ। ঝড়ের শেষে আমগুলো ঘরে রেখে আমরা বেরিয়ে যেতাম ভাঙা পাখির বাসার খোঁজে, সেটাই আমাদের মানবতা বলতে পারেন। ডিমগুলো ঠিকঠাক রেখে বাসাটা সাজিয়ে দিতাম আগের মতো, কেবল কাকের বাসা সাজানো অসম্ভব, মানুষের মতো নাবুঝে কা কা করতে থাকতো। আমরা একবার এক কাঠঠোকরা পাখিকে বাঁচিয়ে ছিলাম, বাঁচাতে পারিনি এক জোড়া চড়ুই। সে কী কান্না আমাদের! অনেক দৌড়ে হলুদ বাটা এটা সেটা দিয়েও পারিনি। তবে মৃত চড়ুই জোড়া আমরা জোড়া আমের তলায় সমাধি দিয়েছিলাম, এক সপ্তাহ ফুলও দিতাম। এত বড় হয়েও জোড়া আমের তলায় গেলে আমার এখনও মনে হয় চড়ুইদের কথা।

আমার অভিজাত বিলাসি অহংকারী মন না থাকলে আমি চড়ুই পুষতাম। ডাক্তারি পড়লে নিজের ডেথ সার্টিফিকেট লিখে রাখতাম। প্রতিদিন তারিখ বদলে নিতাম লালকালিতে। কাটাকুটি খেলায় সব চলে...