নদীর লিরিক ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-

 

নদীর লিরিক ২৫

মানুষ ছুটছে আজ নদীহীন দিগন্তের দিকে 
সেখানে মানুষ নেই; পুঁজির অনুপ্রবেশ এক
পাগলা ঘোড়ার মত দাপিয়ে বেড়ায় বাঁধাহীন
উদ্ধত বালির আগ্রাসনে কত স্বপ্নের সমাধি। 
তরল মুহূর্তে কেউ লিখে নাম বালির শরীরে 
আমি লিখি নিজ নাম সংগোপনে হৃদয়ে নদীর 
তোমার শরীর জুড়ে প্ররোচক নদীর লাবণ্য 
স্রোতের সেতার বাজে হঠাৎ শীতনিদ্রার পর।

যত দূর নদী যায় তত দূর মানুষের আশা
সেই নদী বয়ে চলে ধমনীতে নিরবে আমার 
স্বীকার করে না কারা প্রাণের অস্তিত্ব অই নদী?
বাঁচার অনন্ত উৎস অমন অদৃশ্য অম্লযান;
মানুষেরা মরে গেলে নদী জেগে থাকে বেদনায়
নদীর মরণ হলে সে মানুষ কবে মনে রাখে!

 


নদীর লিরিক ২৬

কোথায় খুঁজিনি বলো রাতজাগা পাখির দুচোখে?
এখানে কোথাও নেই ছায়াও মিশেছে আঁধারে 
নদীকে কেবল দেখি মানচিত্রে বঙ্কিম রেখায়
তবে কী নদীরা চিরদিন দুখের শিল্পশরীর!
অনেকে ভুলেছে অই নদীর নামই গণতন্ত্র 
তীরছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস তার,শোষিতের ধ্বনি কলা
তবু হতাশার পঙ্কে নয় রাখি উজানে বিশ্বাস 
যে তুমি চেতনা-পদ্ম ফুটে আছো হৃদয়ে আমার। 

দেখেছি তোমাকে কবে মনকাড়া নাচের মুদ্রায় 
যে নাচে বেদনা উড়ে যায় শিমুল তুলোর মত
জলের কল্লোলে যারা শিখেছি দ্রোহের স্বরলিপি
সঁপেছি নদীকে প্রাণ আরও দেব রক্তের অঞ্জলী;
আমার স্বদেশ তবু ফিরে পাক প্রশান্ত প্রহর
নেচে ওঠো বালি ফুঁড়ে আদিগন্ত স্রোতের হরিণী।

 


নদীর লিরিক ২৭

প্রেতের হুঙ্কারে দেশ! কাঁপে মাটি, সহসা সঙ্গীন
তোমার মুখশ্রী যেন আঁধারের অবাধ প্রণয়
তোমাকে তাঁতের মত জড়িয়ে রেখেছি নিশিদিন 
তবে কি আচ্ছাদনের মায়া? বলো তার বেশি নয়? 
আত্মার পরিশোধনে যদি পাই তোমার করুণা 
বিগত জন্মের পাপ ধুয়ে নেব এজন্মে সলিলা
ভাটির বাউল আমি তুমি ‘স্বচ্ছ সলিলা বরুণা’
সত্যি যদি নদী হও মূর্ত করো তোমার সে লীলা। 

কারা আচ্ছন্নের মত সয়ে যায় প্রেতের তাণ্ডব? 
বিদূষক ঘিরে আছে মহামহিমের চারপাশ
দাবি তুলবে না কেউ বনবাসে পালাবে পাণ্ডব! 
নদীর মুখাগ্নি দেখে কেবল করবে হাঁসফাঁস। 
তোমাকে নদীতে খুঁজি বুকে নিয়ে বিষাদ-সেতার
স্রোতের কল্লোলে এসো, ফিরে জলবতী অহঙ্কার।

 


ক্রান্তিকালের পঙক্তি 

ভাসছি আমি চোখের জলে গাইছে কে যে গান
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান।

জলের তোড়ে মন ভাঙে কি স্বপ্নেরা খান খান! 
হাসতে কবে ভুলেই গেছি নদে এলো বান।

আধপেটাতে পাড়ার লোকের দিন হল গুজরান
‘চলছে সুদিন’ শুনেই গেলাম নদে এলো বান।

রুক্ষ হাতের শক্ত চেটোয় ধরা কাস্তে খান
ফসল কোথায় ক্ষেত লুকালো নদে এলো বান।

মাস-মাইনে আর জোটে না শূন্যে মা তাকান
চাকরি খুইয়ে ফিরলো ছেলে নদে এলো বান।

আর বাজে কই খুশির সানাই হলুদ মেখে স্নান 
আইবুড়ি সব খুকুমণি নদে এলো বান।

চাঁদ ঢেকে দেয় শোকের মতন কালো মেঘের থান
ফায়দা লোটে কারা অমন? নদে এলো বান।

ঘুম আসে না চোখে চোখে খাড়াই থাকে কান
তবু তারা দিব্যি আছে নদে এলো বান।

দুঃখ ফোটে থোকায় থোকায় বুকের মধ্যিখান
হর্ষ-স্মৃতির জাবর কাটি নদে এলো বান।

ভাতের চালে ফুটো চালে চালের-ই উত্থান 
কাঁপছে এদেশ পুতুল নাচে নদে এলো বান।

চোখ জুড়ে ঠিক ঘৃণার বারুদ বুক করি টান টান 
যতই পড়ুক বিষ্টি এবার যতই আসুক বান! 

 

 

শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে 

আবার দেখা হোক নদীর মোহনায় 
যেখানে উচ্ছল স্রোতের পদাবলী 

সহসা খুলে ফেলি সমূহ শৃঙ্খল 
যদিও ধেয়ে আসে বেদনাঘনপলি।

সমাজ, লোকভয় চেনা সে লালচোখ 
পতিত বিশ্বাসে হিংস্র হানাদার 

পরাতে চায় তারা নিষেধ শতবেড়ী
স্বপ্ন কেড়ে নেয় আঘাতে বারবার।
 

 


নদীর মত কেউ

এভাবে ডেকে যাই নদীকে প্রতিদিন
কোথাও নদী নেই বালির প্রহরায়
দারুণ দাবদাহে পৃথিবী সঙ্গীন
এখানে হাঁসফাঁস গাছেরা কী মলিন ;
যদিও ফোটে গাছে ফুলেরা ঘ্রাণহীন
উধাও মেঘদল পাখিরা অসহায়,
মরাল গ্রীবা তার; সে তুমি উড্ডীন
দেখেছ ভয়ানক মানুষ তড়পায়।

জেনেছি কতদিন, মাটির কত আগে
হয়েছে এ হৃদয় ভীষণ মরুময়
খোলস ফেলে রেখে অনেকে আগে-ভাগে
পালিয়ে অবেলায় দারুণ অনুরাগে!
আনে কী পরাজয়, গলিত চাঁদ জাগে;
নদীর মত কেউ স্নিগ্ধ অতিশয়
রাঙাক দেহমন রাঙাবে এই ফাগে
তুমি তো নদী নও যে আনে বরাভয়।

নদীর বুকে ছিল হাওয়ার জয়গান
জলের সৌরভে ভরেছে এ হৃদয়
খুঁজেছি সেই আমি নদীর সন্তান
তোমার বুক জুড়ে অমন সুঘ্রাণ;
হবে না সেই নদী হৃদয়ে বহমান?
মাছের ব্যালে নাচে নাচুক জলাশয়
চোখের মত জোড়া চপল সাম্পান
ডাকুক ইশারায় ভয়কে করে জয়।

নদীর মহামারী যদিও ধেয়ে আসে
ভাসাব দেহমন জলের যৌবনে
আমাকে ডেকে নাও সজল আশ্বাসে
স্রোতের দীপাবলি কেন যে নিভে আসে!
আঁধার গাঢ় হয় এখানে চারপাশে
ক্রমশ ক্ষয়ে যাও জরার ঘর্ষণে
সবুজে বাঁচি চলো দুজনে উচ্ছ্বাসে
প্রেম কি নত হয় জরার সে শাসনে!