চক্র ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-

 

 

চক্র

দিন যায়, রাত হয়
—দিন আসে।
প্রতিটা ভোর শত শতাব্দির স্বপ্নের ভার বইতে বইতে
অনন্ত ইতিহাসের ইশারা হয়ে মুহূর্ত মিশে যায়
অগণন মুহূর্তে।
শ্রেণী ও বর্ণের ভেদ মুছে
বহুসংস্কৃতির সম্মেলনময় ভূ-বিশ্বে
আত্মপরিচয়ের ক্লান্তি ও বিষাদ জমে জমে
আজও দুনিয়াতে অন্য কোন অতীত দিনের মতোই
যুদ্ধ-মুহূর্তের জন্ম হয়।
একজোড়া ঠোঁট আর একজোড়া ঠোঁটে পৌঁছাতে
এক পৃথিবীর সমান অনুরাগের পথ এক মুহূর্তেই পেরিয়ে যায়
একটা চুমোর মুহূর্ত থেকে অফুরান আয়ুশ্বাস আয়ত্ব হলে
তার উপর ভর করে
জন্মের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে
প্রেমিক-প্রেমিকারা যখন ভেজা ভেজা মরা পাতায় আচ্ছাদিত
বনের মধ্যেও যথেষ্ট আদিম হতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে
সভ্যতার দিকে তাকায়, দেখতে পায়—
দেহের ভিতর নিহত নদীর রেখার পরতে পরতে
পনিসূত্রগুলো অপঠিত থেকে যাচ্ছে
আরও দেখতে পাওয়া যায়—
বৃক্ষের আদিম ও অনন্ত প্রকাশের কাছে
সবচেয়ে সফল জীবনকেও বঞ্চিত দীর্ঘশ্বাস মনে হয়।
হে জগৎ,
ওহে, মুগ্ধ প্রেমের মাতাল অস্থিরতা
প্রচীন জীবন আজও কেবল কালের নিয়মে ধরা ইতিহাস চক্র কাটিয়ে
অনন্তকালকে বাঁচাতে
—নতুন মুহূর্তের
   জন্ম দিতে দিতে
পুরানা জীবন দুনিয়াতে আজও কেবল নতুন হতে থাকে।

 


লোহা

লোহা—ইতিহাসের চিহ্ন বেয়ে এবার
          মিশে যাও মেরুদণ্ডে।
প্রিয়—প্রেমের ফাঁকিতে
         চুলের ঘ্রাণে জন্ম নিচ্ছে শীতগন্ধ
         লজ্জিত পুষ্পসকল
কানন ছেড়ে কামার খানা বেছে নিয়েছে
আঁচলের তলে খেলা করতে থাকে—
শতাব্দির চেয়ে প্রচীন লোহাপোড়া বাতাস।
তরলে জন্ম জীবন—ক্রমে আরও তরল হতে হতে
                          অধিক ফলনের আশায়
আন্ধার তাড়ানো ঝিঝিপোকাও মরে যায় বালাই নাশকের ছিটায়
নিঝুম নিগূঢ় সত্তার সাড়া না পেয়ে
ধীরে ধীরে অসুখ আর সুখের পার্থক্য মুছে যাচ্ছে।
লোহা—ইতিহাসের কাল নির্ধারণী এক ধাতু সত্তা তুমি
          আকাশ থেকে পাতালে, জন্মাবেগ থেকে
পাতালে তোমার ভূমিকার বহু কিচ্ছা অকথিত
এবার মিশে যায়ও আমাদের মেরুদণ্ডে।
জন্মকে উদ্‌যাপন করতে না পারলেও
মৃত্যুকে স্বাগতম জানাতে জানাতে
জীবনের কয়লা ও দরদী ছাইয়ের মধ্যেই
আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হবে
—নয়া ইতিহাসের জন্মের আগ পর্যন্ত
লোহা—ইতিহাসের চিহ্ন বেয়ে বেয়ে আমাদের মেরুদণ্ডে মিশে যাও
           যে কোন মূল্যে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

 


কমেডি

সারারাত কুয়াশা ঝরে আর সকালে উঠে—
আমাদের সমস্ত মনযোগ থাকে মামলার দিকে।
শক্ত বুকের ছাতিতে ধপাস করে
তোমার নরম বুক আছড়ে পড়ার পরে
ভেবেছিলাম নরম চাপে আমাদের সৌভাগ্য বুঝি ফুছে ফুলে উঠছে।
অথচ আজ রাজভাগ্য পাহাড়া দিতে দিতে আইন অজুহাতে
দুয়ারে দুয়ারে পুলিশ পৌঁছে গেল, আর
নতুন দিনের স্বপ্নের অস্থির আহবানে
কুয়াশার ফোয়ারর নিচে ঘুমাতে পারি না
অন্ধকার ধান ক্ষেতে আলোর চেয়ে অধিক সম্ভাবনায় অন্ধকারে
উষের ভেজা ভেজা বিষণ্নতায় জেগে থাকি সারারাত, দেখি
—রাতভরে কুয়াশাপাত।
ক্ষমতার ভেতর পেকে ওঠা ভয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে
আমাদের সব ঘরের ঠিকানা জেনে যায় পুলিশ
আমরা যারা জানি দুনিয়ার সব ঘর অলীক ঠিকানামাত্র—
আমাদের স্বপ্নের ঠিকানা তারা জানতে পারে না কিছুতেই।
—শিশুর ঠোঁট থেকে পিতাকে,
—মায়ের আদরের মূহূর্ত থেকে সন্তানকে,
—প্রেমিকার শীতবিনাশী আলিঙ্গন থেকে প্রেমিককে
  ছাড়িয়ে নিতে আজরাইলও থমকে যায়।
 তবুও পুলিশ আসে, যমের দ্বিধা মুছে
 ক্ষমতার হুকুমে পুলিশ দ্বিধাহীন, সদা অতি তড়িৎ
 ধেয়ে আসে—আইনের বর্মতে দেহ ঢেকে
—পুলিশ আসে আমাদের নিয়ে যায় খোলা জেল থেকে বদ্ধ জেলে
—এই বিক্ষোভের কালে।
ক্ষমতার অসহায়ত্বের নিয়মে আমরা এও জানি—
পুলিশ আর মৃত্যু যতক্ষণ সমার্থক না হবে,
ততক্ষণ দুনিয়ার সবাইকে পুলিশের পুলিশির মধ্যে আনা যাবে না।
হে রাজভাগ্য প্রহরী—তোমাকে দেখে যখন আর কারো ভয় জাগবে না
তখনও এই তুমি,
—প্রচণ্ড প্রতাপশালী
—খুবই তড়িৎ
ছুটতে থাকবে দিকহীন দিকে দিকে...
সারারাত কুয়াশা ঝরে আর আমরা মজে থাকি মামলাতে
রাজনীতি, রাষ্ট্র, ক্ষমতা, জাতিসংঘ—
কোথাও কুয়াশার মতন কোমল কোলাহলহীন
সম্ভাবনা দেখি না
—তবুও খুব তৎপর থাকে পুলিশ।
যদিও এইসব অভিনয় দেখে আমরা হাসবো
কিন্তু পুলিশ অভিনয় দক্ষতার জন্য কোন বেতনও পাবে না
—এই ট্র্যাজেডির নাম পুলিশ কমেডি।

 

 

ফ্যাসিবাদের কালে লেখা কবিতা

রাষ্ট্র বলেছিল দোজখ সরায়ে এনে দিবে হ্যাভেন
এখন দেখি হাতে হাতে একে ফরটি সেভেন।

কথাছিল বেহিসেবি দুপুরে বৃষ্টির আসলে
পানির সাথে মিশবে আরও পানি
এখন চড়া মূল্যে গুজব বিক্রি হয়
কৃষ্ণের সাথে লীলার সম্পর্ক নিয়ে সবাই করে কানাকানি।।

মিছিলের হাত ভিক্ষায় হলে শামিল
কোনভাবেই রোধ করা যায় না আত্মক্ষয়
জীবনের সব হিসেবে হয়ে যায় গরমিল।।

পুষ্ককাল ঢেকে যায়, বহুপুরানা বাসি ছাই সামনে চলে আসে
জীবনকে পাহারা দেয় মৃত্যু, বাচাল অজ্ঞানের সূত্রে লোহাকেও ভাসায়
টিভিতে সুখের হুল্লোর ওঠে, আর সুভদ্র সুরতে সন্ত্রাস হাসে,
বন্দুকের নল ঠিক করে সময়-অসময়, মাঘের পর মাঘ মানুষ থাকে—আশায়।।