ফিলিস্তিনের কবিতা: রুদ্ধশ্বাস ও নিহত আত্মার জীবন্ত আর্তনাদ

ফিলিস্তিনি কবিতার সৌন্দর্য নিহিত রয়েছে এর গল্প বলার মধ্যে, যেভাবে এর শব্দগুলোকে একত্রিত করে জীবন, ঐতিহ্য, প্রেম ও সংস্কৃতির গল্প বলা যায় তাতে। ফিলিস্তিনি আরব জাতির আনন্দ এবং দুঃখ উভয়ই প্রকাশ করতে পারে এর কবিতা, জানাতে পারে ন্যায়বিচার ও মুক্তির আহ্বান—অস্তিত্বের বিপন্ন অভিজ্ঞতাই তাদের তা শিখিয়ে দিয়েছে। ফিলিস্তিনিরা জানে, তাদের জন্য, বিশেষ করে গাজাবাসীর জন্য কবিতার জন্ম হয় বোমার বৃষ্টিতে, শোকে, বিচ্ছিন্নতা ও বিশ্বাসঘাতকতায়, পাশাপাশি জীবন ও আশার উদযাপনে।
‘বিচারক-যে অন্ধ দেবী/ আমরা কালোরাই তা ভালো জানি:/ ব্যান্ডেজে লুকানো তার পচাগলা ক্ষত দুটি/ হয়তো বা চোখ ছিল কোনোদিন।’ মার্কিন কবি ল্যাংস্টন হিউজের কবিতা। খুবই সত্যি, এর বাণীটুকু। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর কালোদের পাশাপাশি তা ভালো জানে আরব জাতির ফিলিস্তিনিরাও। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, গোটা ইউরোপ, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের সাধারণ মানুষ তা বুঝলেও, এসব ভূ-খণ্ডের রাষ্ট্রনেতারা কিছুতেই বুঝতে চান না কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকেন। এর করুণ পরিণতি, আজকের ফিলিস্তিন—বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার। যেখানে অসম যুদ্ধে বারবার হামলে পড়ে ইসরায়েল। যেখানে ইসরায়েলি বোমাগুলো একের পর এক রক্তাক্ত নিহত শিশুর জন্ম দিয়ে চলে। যেখানে শিশুদের কান্নার নিচে স্বাধীন দেশের দাবি তলিয়ে যায়। তবে তলিয়ে না গেলেও পশ্চিমা গণমাধ্যম শিশুদের কান্না দিয়ে তা বেশ নিখুঁতভাবেই ঢেকে ফেলে! এই কান্না ছাপিয়ে ফিলিস্তিনীদের চিৎকার বিশ্বের কাছে কোন দাবি জানায়, তা আর শ্রুতিযোগ্য হয়ে ওঠে না। কিংবা তাদের চোখগুলো, ঠোঁটগুলো শিশুদের আর্তনাদের প্রতিধ্বনি হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় অবশিষ্ট থাকে না।
মিডিয়ার কল্যাণে তাই আহত-নিহত শিশু, আর বাবা-মা-ভাই-বোনের আর্তনাদ ছাড়া কিছুই যেন আর শুনতে পায় না বিশ্ববাসী। শিশুদের রক্তেচোবা লাল জুতো জোড়া ছাড়া আর কিছুই যেন দেখতে পায় না তারা। দেখতে পায় শুধু, ওই কংক্রিটের স্তুপ হয়ে থাকা এক বিধ্বস্ত দেশ। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তির সিংহভাগই ছুড়ে ফেলে পশ্চিমের রাজনৈতিক সমাজ। বিশ্বজুড়ে তাদের মিডিয়া প্রপাগান্ডায় মনে হয়, বয়স্ক মানুষের মৃত্যু আর আমাদের স্পর্শ করে না বুঝি! এমন একটা ভ্রান্তিজাল দিয়ে বন্দি করে ফেলা হয় ‘মুক্ত বিবেক’! আমরা ভুলে যাই, ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রই ইসরায়েলকে এখানে রোপন করেছে। পৃথিবীর একমাত্র ‘বিশুদ্ধ ধর্মদেশ’ তৈরি করেছে তারা। আর আজকের ইসরায়েলিরা হয়ে ওঠেছে তখনকার ইউরোপীয় জার্মান-খ্রিস্টান। আর ফিলিস্তিনিদের বানিয়ে ছেড়েছে তাদেরই নির্যাতিত অতীতের প্রতিধ্বনি! ফিলিস্তিনিদের আর্তনাদের শব্দ ছাড়া যেনো ইসরায়েলি সরকারের এখন আর ঘুমই হয় না!
গণমাধ্যমে উপস্থাপনা কৌশলে সহজ হয় হামাস সৃষ্ট গাজা সীমান্তে সুড়ঙ্গের বিপুলক্ষমতার কথা শোনানো ও দেখানো। সহজ হয়, হামাসের প্রবল প্রতাপশালী হয়ে ওঠার গল্প ছড়ানো। দীর্ঘদিন ধরে এ ভূ-খণ্ডের সীমান্ত অবরোধ করে গেছে ইসরায়েল ও মিসর। সমুদ্র অবরোধ করে রেখেছে ইসরায়েলি নৌবাহিনি। তবু হামাসের শক্তিশালী হয়ে ওঠার গল্প শোনানো হয় এই বলে যে, ইসরায়েল ‘জঙ্গি’ হামাসকে ততটা ধরাশায়ী করতে পারছে না। আমাদের গল্প শোনানো হয়, সেই বস্তির মতো ঘিঞ্জি এক দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির, যা আতঙ্কিত করে ইসরায়েলকে। যে দেশে এমনকি হামাস তারকাঁটা-পিন-সুঁইয়ের নাগাল পেলে অস্ত্র বানাবে এই আতঙ্ক ছড়িয়ে শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীও আমদানি করতে দেওয়া হয় না। ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয় লোহা কেনার সুযোগ পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আরও বড় পরিহাস হলো, এ ভূখণ্ডের অবকাঠামো বা পুরো নির্মাণকাঠামোই ধূলিস্যাৎ করা হয় বারবার। যে দেশের প্রায় সব মানুষ কোনো না কোনোভাবে রিলিফের ওপরে নির্ভরশীল, যাদের কোনো শিল্পকারখানা নেই, সে দেশের মানুষও কিনা ভয়ংকর সশস্ত্র হয়ে উঠতে পারে! এমন ‘মিথ্যে আতঙ্ক’ অবলীলায় ছড়ানো হয় গণমাধ্যমে। আমাদের বিবেকের ওপরেও চমৎকারভাবে আছর করে এইসব ভূতের গল্প।
হ্যাঁ, ফিলিস্তিন ভূ-খণ্ডে গাজা বহু বছর হলো পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর এবং সবচেয়ে বড়ো কারাগারে পরিণত হয়েছে। এই নিরুপম কারাগার দাগি-অপরাধী তো নয়ই, এমনকি সাধারণ অপরাধীদের জন্যও নয়। কেবল নিরপরাধী, নিস্পাপ, নিরীহ সাধারণ মানুষের জন্যই নির্ধারিত। শাস্তিও যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তদের মতো তুচ্ছ কিছু নয়—একটি জীবন সমাপ্ত হলে যা শেষ হয়ে যায়! কিন্তু তাদের এ শাস্তি কখনও শেষ হবার নয়, চলতে থাকে বংশপরম্পরায়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গড়িয়ে যায়। কারো মৃত্যুই এই বিপুল দণ্ডভার একফোঁটা হ্রাস করতে পারে না।
ফিলিস্তিনের প্রখ্যাত উপন্যাসিক ও গল্পকার ঘাসান কানাফানি বলেছিলেন, আমি আমার মাতৃভূমি ফিরে পেতে সংগ্রাম চালিয়ে যাব, কারণ এটি আমার অধিকার, আমার অতীত এবং আমার একমাত্র ভবিষ্যত, কারণ এতে আমার গাছ, মেঘ এবং ছায়া, এবং সূর্য যা জ্বলে এবং মেঘ যা বৃষ্টির ঝরায়, এবং শিকড় যা উপড়ে ফেলা কঠিন...। তিনি পাশাপাশি এও বলেছিলেন, ‘প্রতিরোধের সাংস্কৃতিক রূপ সশস্ত্র প্রতিরোধের চেয়ে কম মূল্যবান নয়।’
এই কারাগারের এক প্রতিবেশী মিসর। একদিক ঘিরে রেখেছে এবং অনেক বছর ধরে বধির। ফিলিস্তিনের ওপর সীমান্ত অবরোধ দিয়ে রেখেছে। আরেক প্রতিবেশি কলোনিয়াল ও জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। যমের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে দুই দিক ঘিরে রেখেছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। নিরপরাধ মানুষগুলো অসংশোধনযোগ্য হওয়ার কারণে দান্তের মহাকাব্য ইনফারনোর সেই ক্যারন সহস্র নদীকে ধারণ করে অপার হয়ে ওঠা এই কারাগারের পাশের সমুদ্র দিয়ে পারগেটরির পরিবর্তে দূরের কোনো নরকে সরাসরি নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পালন করতে পারতো। কিন্তু ওই যমের ভয়ে ভুলেও এই পথ মাড়ান না তিনি। তিনি বরং যমেরই সহযোগী হয়ে আছেন।
আর মাঝে মাঝেই এমন সময় আসে, যখন নিজের আকাশও ওই বন্দি বাসিন্দাদের আপন নয়। বরং প্রতিবেশির মতোই বিশুদ্ধ অপর। আর পায়ের নিচে মাটিও ওই আকাশের মতোই একই স্বভাবের। পেটভর্তি বোমা নিয়ে লোহার ফড়িঙগুলো দাপিয়ে বেড়ায়। জলস্থল আকাশ সবখানেই। সবখানেই লোহার পোকাগুলোর সমান দাপট। যেখানে-সেখানে শুধু বোমাবমি করে। আর মাটি, বিধ্বস্ত ভবন প্রত্যোত্তরে শুধু নিহতদের উগড়ে দেয়—হোক শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, বড় কিংবা বুড়ি কাউকেই রেহাই দেয়া হয় না।
২০১৪ সালের জুলাই-আগস্টের কথা বলছি, তখন তো দিনের চেয়ে রাত আরও বেশি উজ্জ্বল এই ভূমিতে। উজ্জ্বল বিরামহীন বোমার আঘাতে। বন্দিদের চোখের পাতা এক হতে দেয় না। ঘুমের বদলে রাতে যেকোনো মুহূর্তে শুধু যম আসে, জাপটে ধরে দুই হাতে। শত ছটফটালেও আর ছাড়িয়ে নেয়া যায় না নিজেকে। তখন আকাশ থেকে যেমন, তেমনি ধর্ষকের দোহাই না মানা লিঙ্গের মতো কামানের নল থেকেও ঝাঁক ঝাঁক বোমা ছুটে আসে নিরীহদের বুক বরাবর। তবে প্রতিবেশি দেশের মাতৃভাষা বোমা নয়, আজও নিরাশ্রয় হিব্রু বলেই দাবি করে থাকে গোটা পশ্চিমাবিশ্ব। তারা সবসময়েই এ দাবি করে আসছে। আর সমান্তরালে আয়রন ডোমের জন্য, কামানের, ট্যাংকের নলের জন্য অর্থ-গোলা-বারুদ সরবরাহ করে আসছে।
তখন কি দিন কি রাত! দুই দিক থেকে দেয়ালগুলো হঠাৎই চেপে ধরে। শিশুদের হাড়হাড্ডি ও আত্মা চিবিয়ে খায়। বিছানা লাফ মেরে ছাদে গিয়ে ঠেকে। ছাদ ফেটে মৃতদেহ নিয়ে ওই রক্তাক্ত বিছানা ম্যাজিক কার্পেটের মতো উড়তে থাকে আকাশে আকাশে। উড়ে চলে শত শত লাল কার্পেট, আর ওইসব কার্পেট চুঁইয়ে বৃষ্টিধারার মতো রক্ত ঝরতে থাকে, নিচে, অনেক নিচে। কিছু মানুষের চোখে ভেসে ওঠে—রক্তেভেজা জুতার ঝাঁক উড়ছে আকাশ জুড়ে।
ব্রিটিশ ম্যান্ডেট অনুযায়ী ১৯৪৮ সালে কৃত্রিম ধর্মীয় রাষ্ট্র ইসরায়েল সৃষ্টির পর থেকে নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়া ফিলিস্তিনীদের দুর্ভোগের আর শেষ নেই। তাদের নিজের কণ্ঠ যেমন সেই থেকে কাঁদছে, নিজের ভূখণ্ডে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে তেমনি দাঁত কামড়ে চিৎকার করছে তারা, কিন্তু ফল হয়নি কোনো। কেননা বারবারই ইসরাইল ‘আত্মরক্ষা’র নামে বর্বরতা চালায় ফিলিস্তিনে। তাই রক্তবৃষ্টি চলতেই থাকে। কিন্তু শুকনো ধুলোয় তা কোন মানচিত্র তৈরি করতে পারে না। পশ্চিমা বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা এমন চমৎকার দৃশ্য বিশ্বের অন্য কোথাও দেখতে পায় না। তাই ভীতশ্রদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে তারা যেন আরও মুগ্ধ হয়ে পড়ে! তাই ইসরায়েলকে অস্ত্র, অর্থ ও সমর্থন সবকিছু দিয়েই বাহবা দিতে থাকে। অথচ এক বাক্স পাথরও পাঠায়নি তারা ফিলিস্তিনীদের, তাদের আত্মরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে!
তো বিশ্ববাসীর চোখের ওপর দিনরাত ভাসতে থাকে নিজের শিশুর মতো অগণন নিষ্পাপ মৃতমুখ। ভাবতে বিস্ময় লাগে, মরে যাওয়ার পরও কি শিশুরা বিবেকবানদের ‘বাবা বাবা’ বলে ডাক দেয়! না হলে, পশ্চিমা মিডিয়ার চাতুর্য সত্ত্বেও বিশ্বের অলিতে-গলিতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে কেন অগণন সাধারণ মানুষ! কবর খননকারী পেশার লোক ভেতরে ভেতরে কাঁদে কেন প্রতিটি নতুন কবর খুঁড়ে তোলার সময়! কিন্তু মুনাফালোভী পশ্চিমা ‘প্রভু’র কানে, হায়, ওই ‘বাবা-ডাক’ আর বিশ্ববাসীর ক্ষোভ আজও কত তুচ্ছ মনে হয়!
আগেই বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনীদের ওপর বহুবার সহিংস হয়ে উঠেছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের আইন অমান্য করে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে অবৈধ বসতি স্থাপন এবং সেখানকার ইহুদি বাসিন্দাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়েছে জায়নবাদি রাষ্ট্রটি। সব যেন ইঙ্গিত করছে ফিলিস্তিনীদের বিলুপ্তিই তাদের একমাত্র লক্ষ্য এবং পর্যায়ক্রমে ভূখণ্ডটি ধীরে গ্রাস করে নেয়া। এই তো ২০১৪ সালের ওই জুলাই-আগস্টে গাজায় একতরফাভাবে আগ্রাসন চালিয়েছে ইসরায়েল। টানা ৫০ দিন জল, স্থল ও আকাশ পথে চলে অবিরাম গোলাবর্ষণ। গোটা বিশ্ব হতবাক হয়ে দেখেছে, কিভাবে একের পর এক শিশু নারী আর বৃদ্ধ মানুষসহ নিরীহ মানুষের প্রাণ গেছে। হামাসের ‘সামরিক ক্ষমতা’ ধ্বংসের নামে গোটা গাজা উপত্যকাকে সুবিশাল কবরখানা বানিয়ে তবেই থেমেছে ইসরায়েল। প্রাণ গেছে দুই হাজারের বেশি মানুষের। এর মধ্য হাজারখানেকই শিশু। আহত হয় হাজার হাজার মানুষ। আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে আরও লক্ষাধিক মানুষ। ফের ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের আকস্মিক হামলার জবাবে ফের টানা ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যায় মেতে ওঠে ইসরায়েল। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলমান এ হামলায় এখন পর্যন্ত ৪২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন যাদের অধিকাংশই শিশু ও নারী। লাখের অধিক আহত হয়েছেন। উদ্বাস্তু গাজার ২৩ লাখ মানুষের প্রায় সবাই। এ হামলায় এখন পর্যন্ত ২৩ জন ফিলিস্তিনি কবি প্রাণ হারিয়েছেন। ইসরায়েলি এ বর্বরতার শেষ কোথায় কেউ জানেন না। এবং এ গণহত্যার যদি ইতি ঘটেও ফের ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনে এমন রক্তপাত ও বাসিন্দাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশংকা প্রবলই থেকে যাবে।
নিরপরাধ মানুষগুলো অসংশোধনযোগ্য হওয়ার কারণে দান্তের মহাকাব্য ইনফারনোর সেই ক্যারন সহস্র নদীকে ধারণ করে অপার হয়ে ওঠা এই কারাগারের পাশের সমুদ্র দিয়ে পারগেটরির পরিবর্তে দূরের কোনো নরকে সরাসরি নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পালন করতে পারতো। কিন্তু ওই যমের ভয়ে ভুলেও এই পথ মাড়ান না তিনি। তিনি বরং যমেরই সহযোগী হয়ে আছেন।
ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে ফিলিস্তিনবাসীর আর্তচিৎকার আর স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি কয়েকযুগ ধরে তাদের কবিতাতেও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনের কবিরা ছাড়াও বিভিন্ন দেশের আরও অনেক কবির কলমই কেঁদে উঠেছে ইসরায়েলের প্রবল বর্বরতায়। ফিলিস্তিনের প্রখ্যাত উপন্যাসিক ও গল্পকার ঘাসান কানাফানি বলেছিলেন, আমি আমার মাতৃভূমি ফিরে পেতে সংগ্রাম চালিয়ে যাব, কারণ এটি আমার অধিকার, আমার অতীত এবং আমার একমাত্র ভবিষ্যত, কারণ এতে আমার গাছ, মেঘ এবং ছায়া, এবং সূর্য যা জ্বলে এবং মেঘ যা বৃষ্টির ঝরায়, এবং শিকড় যা উপড়ে ফেলা কঠিন...। তিনি পাশাপাশি এও বলেছিলেন, ‘প্রতিরোধের সাংস্কৃতিক রূপ সশস্ত্র প্রতিরোধের চেয়ে কম মূল্যবান নয়।’ ফিলিস্তিনীদের জন্য, কবিতা ঐতিহাসিকভাবে শিল্পের একটি প্রিয়তর রূপ। আর মাহমুদ দারবিশ, ফাদওয়া তুকান, তৌফিক জায়াদ, সালেম জুবরান, সামীহ আল কাসিম প্রমুখ উল্লেখযোগ্য কবিরা কবিতার মধ্য দিয়ে সেই সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ জারি রেখেছেন, ইসরায়েলি দখলদারিত্বকে প্রতিহত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন এবং এর সমান্তরালে মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন। পরবর্তী প্রজন্মের কবিরাও এই পদাংক অনুসরণে ভুলে করেনি, বরং আরও সরব হয়েছেন।
ফিলিস্তিনি কবিতার সৌন্দর্য নিহিত রয়েছে এর গল্প বলার মধ্যে, যেভাবে এর শব্দগুলোকে একত্রিত করে জীবন, ঐতিহ্য, প্রেম ও সংস্কৃতির গল্প বলা যায় তাতে। ফিলিস্তিনি আরব জাতির আনন্দ এবং দুঃখ উভয়ই প্রকাশ করতে পারে এর কবিতা, জানাতে পারে ন্যায়বিচার ও মুক্তির আহ্বান—অস্তিত্বের বিপন্ন অভিজ্ঞতাই তাদের তা শিখিয়ে দিয়েছে। ফিলিস্তিনিরা জানে, তাদের জন্য, বিশেষ করে গাজাবাসীর জন্য কবিতার জন্ম হয় বোমার বৃষ্টিতে, শোকে, বিচ্ছিন্নতা ও বিশ্বাসঘাতকতায়, পাশাপাশি জীবন ও আশার উদযাপনে।
ফিলিস্তিনি কবিতা তাদের অস্তিত্বের প্রতিকূল বাস্তবতা, যন্ত্রণা ও আনন্দ উভয়কেই প্রকাশ করে, পাশাপাশি দখলদারিত্বের অধীনে জীবনযাপনের তীব্র যন্ত্রণা এবং এর ফলে তাদের ওপর চেপে বসা মৃত্যুর অনিবার্যতাকেও তুলে ধরে। তাদের কবিতায় অপ্রয়োজনীয় সংবেদনশীলতা নেই। মূলধারার গণমাধ্যমের ঐতিহাসিক নিষ্ক্রিয় স্বরও নেই তাতে। বর্তমান প্রজন্মের এক কবি মুসাব আবু তোহা, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলমান হামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। তিনি একাধারে কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক এবং ফিলিস্তিনে এডওয়ার্ড সাঈদ লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা। বিশ্বগণমাধ্যমের সবরতার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে দুদিন পরে মুক্তি দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। তিনি যেমন বলেছেন, ‘দখলদার বাহিনীর হামলার লক্ষ্য ফিলিস্তিনের প্রত্যেকেই।’ তাই প্রতিকূল অস্তিত্বই শিখিয়ে দিয়েছে, নিষ্ক্রিয় স্বরমাত্রই তাদের জন্য আত্মবিনাশী, এ স্বর তাদের আত্মিক পরিচয় ঢেকে ফেলে, যা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে জ্যান্ত কবর দেওয়ারই শামিল।
বন্দি করা প্রসঙ্গে আবু তোহা বলেন, দখলদাররা আমাকে অপমান করতে চেয়েছিল, মারতে চেয়েছিল, গাজায় যা দেখেছি তা বলি এবং লেখি বলে আমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল, সরব কণ্ঠকে হত্যা করার চেষ্টা করছে তারা, যারা কথা বলছে তাদের স্রেফ হত্যা করতে চায়।’ তো হত্যাকারীর সামিয়ানার নিচে বসবাস করে করে ফিলিস্তিনিরা শিখে নিয়েছে তাদের রুদ্ধস্বরের প্রতিবাদী মাতৃভাষাটি। তাদের পরিস্থিতি এমনই যে তা উচ্চারণ মাত্রই আজ কবিতা হয়ে উঠে, তা যে যেখান থেকেই উচ্চারণ করুক না কেন।
নোট: প্রতিধ্বনিতে প্রকাশিত গদ্যাংশটি রথো রাফির প্রকাশিতব্য ‘ফিলিস্তিনের কবিতা’ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। বইটি প্রকাশ করবে বেঙ্গল বুকস।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন