প্রিয় ভ্লাদিমির ও অন্যান্য কবিতা
প্রিয় ভ্লাদিমির
প্রিয় ভ্লাদিমির,
তোমার গুচ্ছ বোমা কিয়েভ সীমান্ত অতিক্রম করে যাচ্ছে;
আর তখনই আমার যুদ্ধবিরোধী গুচ্ছ কবিতা
ঝলমল করছে ইউক্রেন জোড়া ভ্যানগগীয় গমক্ষেতে, তার হলুদ আভায়
গুচ্ছবোমার বিষে জর্জর চোখগুলো ধাঁধিয়ে যায়।
ইউক্রেনের পতাকায় হলুদ গমক্ষেত ছেয়ে থাকা নীল আসমান
দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
প্রিয় ভ্লাদিমির, আর কত যুদ্ধ, আর কত প্রাণ
আর কতো ডলারের ঊর্ধশ্বাস!
—সীমান্তের পর সীমান্ত পেরিয়ে আমাদেরও অভিন্ন বেদনা।
আর কতো রিজার্ভের থলি হাতে
কাঁচাবাজারের ফুজিয়ামায় অগ্ন্যুৎপাত—
শীতল লাভাগুলো আজ
হেমন্তের ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে নিথর
উবু হয়ে থাকা
সৈনিকের লাশ।
প্রিয় ভ্লাদিমির, আমি দেখতে পাচ্ছি
তুমি অন্য ভ্লাদিমির—অর্থাৎ মায়াকোভস্কির ছদ্মবেশে
বিব্রত মুখে
ওভারকোটের পিছনে গুচ্ছ বোমা লুকিয়ে
গুচ্ছ কবিতার আবাদে ভরে দিচ্ছ সোভিয়েত প্রান্তর,
তারপর তোমার রূপান্তরিত আত্মধ্বংসী কবি সত্তার হাতে কালো পিস্তল
তাতে একটাই গুলি
করোটি অভিলাষী।
একটি ঈর্ষাকাতর কবিতা
আমার মামুলি কবিতা পড়ে কমেন্ট বক্সে ‘ওয়াও ওয়াও’ বললে তুমি। মনে হল আমার কবিতাটি তোমার চুল ও চিবুক, দেহ বিভঙ্গ জলপাই তেলের মতো পরিভ্রমণ করে তোমাকে উদ্দীপিত করেছে, আমার শব্দগুলোর এলোমেলো আদরে বিষ্ফারিত ঠোঁটে তুমি এক দীর্ঘ শীৎকার ধ্বনি তুলে সমঝদার কণ্ঠে বললে ‘ওয়াও, ওয়াও’!
আমার কবিতা সৌভাগ্যবান, যেমতি তরল জলপাই তেল, যেমতি শ্বেতশুভ্র সুগন্ধী সাবান কিংবা শীতের ঘন বাদামি লোশন। ঈর্ষান্বিত চোখে কবিতাটিতে চোখ বুলাই: কী আছে বাম হাতে লেখা এই সামান্য সৃষ্টিতে, যা আমার নাই!
ঝুলিভর্তি আরো কবিতা থাকলেও নতুন এই কবিতাটিকে আমি ছিঁড়ে ফেলতে পারব না; নিটোল ঈর্ষায়, সবুজ চোখে শব্দগুলোকে ব্যবচ্ছেদ করে দেখি আমার প্রেম, কাম, ঘামের ফসল—আমার আনন্দের আশ্রয় কবিতাটি লিখে ফেলে আমি একটা বিকল্প সুখের ঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, পড়ে পাওয়া সেই চৌদ্দ আনায় তোমার গ্রন্থিমোচন—‘ওয়াও, ওয়াও!’
আমরা কি কখনো যুগলকণ্ঠে কবিতাটি পড়ে দেখব? আমরা কি আবার কখনো কবিতাটি উদযাপন করব? আমরা কি তারপর গভীর আশ্লেষে ঘুমিয়ে পড়ব পরস্পর? আমি কি নিজস্ব স্তবকের ঘরে চুরি করে আবারও স্তব-ধ্বনির জন্য উৎকর্ণ থাকব? আমি কি উন্মাদ হয়ে যাব মৃগনাভির সুগন্ধী চক্রে?
তুমি কি আবারও ঘুমিয়ে পড়ার আগে জলপাই তেলের একনিষ্ঠ সমঝদার হয়ে, স্খলিত কণ্ঠে আরেকটি কবিতা মেখে নিবে পূর্ণাঙ্গ মানচিত্রে?
পুরনো গ্রামোফোন
যদিও বৃষ্টিবাহিত এই শীতকাল,
নতুন কিছু হয় না শীতকালে আর:
ন্যাপথলিনের নেশাভাঙা চোখে
বাক্স থেকে বেরিয়ে ছাদে রোদ পোহানো
পুরনো সোয়েটার পুরনো ব্লেজার,
পুরনো কাশি পুরনো এলাজ—
আদনান ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন
মধ্যরাতের হাপর কমায়,
পুরনো বন্ধুদের পুরনো আড্ডা
পুরনো শ্রীমঙ্গল পুরনো সুন্দরবন
আর চিরপুরাতন কক্সবাজার।
পুরনো সেই ভাস্কর চক্রবর্তী—ব্যাঙের রক্তের কবিতা পড়ান
কবিতার ইনফেকশনে ভোগা রোগাপটকাদের,
আর আছে শীতে উপেক্ষিতার চিরায়ত কাহিনি,
রায় বাবুর কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে
শীতের ক্ল্যাসিক আমেজ।
আর শীত এলেই লিস্টি ধরে ধরে
বাইফোকাল চশমার কাচ ঝাপসা করে দেয়া
পুরনো কুয়াশারা নামে,
বয়স আর অসুখের ভারে
আবার ভালোবাসিবার সাধ যখন
সতত মাইকেলি কোকোনদ—
পুরনো লেপের নিচে
বিশ্বস্ত সুর ভাঁজে বিরলে
পুরনো গ্রামোফোন।
চা’খানায় বসে
যে মানুষটি রিয়াল আনতে মরুশহরে গিয়েছিল, তাকে বুঝি চিনতাম!
দুই তিনবার সশরীরেও ফিরেছে আমাদের শহরে:
মেয়ের বিয়ের গয়না
ছেলের ক্যামেরা ল্যাপটপ
দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে প্রিয়তমার সুগন্ধি আর শাড়ি
আমাদের জন্য স্বস্তিকর রেমিট্যান্স—
সবার জন্য নির্ভেজাল দায়িত্ব পালন।
কয়েক বছর আর খোঁজ পাই না;
ফুটপাতের চায়ের দোকানে চুমুক দিতে দিতে
ঢাকাই লু হাওয়ার দুপুরে
একবারও সন্দেহ হয়নি
কফিন ভর্তি চায়ের পাতা নিয়ে ফিরতে দেরি হয়ে
গিয়েছিল তার।
অলস রাতের গজল
তোমার চিঠির কাগজ থেকে উবে গেছে কালি—
কবে কোথায় উবে গেছে কর্পূরগন্ধী প্রেমিক।
চিঠির বয়ান মকশো করে রক্তে ভরা কলম—
শিকোয়াগুলোর জবাব কোথায় আলোকবর্ষ পরে!
আসতে সহজ, স্বপ্নে আসো: হেমবর্ণ সশরীর—
চিত্রনাট্যে কে বসাবে নিষেধ রসাতলে?
রাত পোহালেই দ্বিতীয় যাম—নিঃসঙ্গতার খেলা—
মোমের শিখার উস্কানিতে: পুড়বে দলিল প্রেমের!
যামিনী না যেতে
দু’বছর স্বপ্ন দেখিনি কোনো।
অবশেষে ঘুমের বড়ি ছেড়ে দেয়ার পর
জাঁকিয়ে ঘুম আসছে স্বপ্নসমেত;
কোনো কোনো স্মৃতি
অতিরঞ্জিত—
স্বপ্নের রঙিন পাথর
কেলাসিত হয়ে ওঠে অন্ধকার খুপরিতে
মগজের গর্ভগৃহে।
কিছু স্বপ্ন আছে স্মৃতিস্থ নিরবে,
কিছু স্মৃতি নবায়ন পেয়ে যায় স্বপ্নের মোড়কে।
এইসব অহেতু স্বপ্নেরা নিরীহ দায় দাবিহীন, কিংবা
সমাজবিরোধীর মতো বিপজ্জনক হবে কিনা
সে তো আর বলে কয়ে আসতে রাজি না:
যামিনী না যেতেই জাগিয়ে যেও গো
তোমার চোখের দিকে আর চাইতে পারি না!
উইক এন্ড শেষ হয়ে এলে
ছুটির দিনের ডাহুকি নির্জনতায়
সবুজ ঘাসের টানেলে
ঘুম আসে;
ফল্গুর স্নানাগারে
দিঘল স্নায়ুগুচ্ছ ধুয়ে ফেলি
আরো কিছু অবসাদ ঝরে পড়ে হয়তো।
এক পেয়ালা চায়ের কথা ভুলি না,
চুমুকের সাথে একটা বই খুলি ব্যাকপ্যাক থেকে—
ভুলিনি দ্বীপান্তরে নেবার কেতাবের কথা।
অক্ষরের সম্মোহনে
বিভিন্ন ঝোপঝাড় থেকে
ডাহুকেরা নেমে আসে
অভিন্ন জলাশয়ে:
বাংলার মৃত কবিরা অবতীর্ণ—
আড্ডা শুরু করে দেন—
‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’
নির্জনতা খান খান হয়ে পড়ে
কাচের বহুতলে বিমান হামলায়;
উইক এন্ড শেষ হয়ে আসে।
আজ রোববার।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন