সুইডিস কবি টমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতা

অ+ অ-

 

টমাস ট্রান্সট্রোমার

সুইডিস কবি টমাস ট্রান্সটোমারকে [১৯৩১-২০১৫] নোবেল পুরস্কার দেবার সময় নোবেল কমিটি লিখেছিল, ২০১১ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের প্রাপক তিনি, কারণ তিনি আমাদেরকে তাঁর ঘনবদ্ধ, স্বচ্ছ ছবিগুলোর মাধ্যমে বাস্তবতায় নতুন একটা প্রবেশের সুযোগ দিয়েছেন। ট্রান্সট্রোমারের প্রত্যেকটি কবিতায় একটি মহাকাব্যিক সম্পূর্ণতা রয়েছে। তাঁর একেকটি কবিতা অভূতপূর্ব, আকস্মিক, পরাবাস্তব চরণে শেষ হতে পারে, কিন্তু একটি সম্পূর্ণ কবিতার পাঠ-পরবর্তী অনুভূতিটি হবে বিস্ময়কর সামগ্রিকতা: প্রেম, নির্জনতা আর নৈঃসঙ্গের মহা-উপন্যাসের এক সম্পূর্ণতা। তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য বহুমাত্রিক। অতি নির্জন এক মরমি আলোয় উদ্ভাসিত। একেকটি কবিতায় রয়েছে হীরকখণ্ডের মতো নানামাত্রিক দ্যূতি।

 

টমাস ট্রান্সট্রোমার © ক্যাফে বাবেল

 

ঈগল পাহাড়

ভাইভ্যারিয়ামের কাচের পেছনে
অদ্ভুত নিশ্চল সব সরীসৃপ।

একটি নারী নৈঃশব্দ্যের ভেতর 
ধোয়া কাপড়চোপড় মেলে দিচ্ছিল। 
মৃত্যু প্রশান্ত হলো।

মাটির গভীরে আমার আত্মা
নিঃশব্দ একটা ধূমকেতুর মতো 
ভেসে যায়।

ভাইভ্যারিয়াম [vivarium]: ছোট প্রাণী রাখার জন্যে কাচের পাত্রবিশেষ।

 

মাদ্রিগাল

উত্তরাধিকারসূত্রে আমি একটা অন্ধকার জঙ্গল পেয়েছি, যেখানে আমি খুব কমই গিয়ে থাকি। কিন্তু একদিন আসবে যখন জীবিত আর মৃতেরা তাদের জায়গা পাল্টাপাল্টি করবে। জঙ্গলটা জেগে উঠতে শুরু করবে। আমরা আশা হারাইনি। বহু পুলিশের তৎপরতা সত্ত্বেও সবচেমারাত্মক অপরাধগুলো অমীমাংসিতই থেকে যায়। ঠিক একইভাবে আমাদের জীবনের কোনো একখানে রয়ে গেছে এক বিশাল অমীমাংসিত প্রেম। উত্তরাধিকারসূত্রে আমি একটা অন্ধকার জঙ্গল পেয়েছি কিন্তু আজ আমি আরেকটা জঙ্গলে ঢুকছি, একটা আলোকিত জঙ্গলে। জ্যান্ত জিনিসগুলো সব গান গাইছে, কিলবিল করছে, ঢেউ তুলছে, হামাগুড়ি দিচ্ছে! এখন বসন্ত আর বাতাসটা খুব জোরালো। আমার বিস্মরণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ডিগ্রি রয়েছে এবং আমি দড়িতে মেলে দেওয়া শার্টের মতোই রিক্তহস্ত।

মাদ্রিগাল [Madrigal]: ১৪শ শতাব্দীতে ইতালিতে বিকশিত এক ধরনের সঙ্গীত, যা একদল গায়কের মাধ্যমে বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই পরিবেশিত হতো।

 

আলকেইক

মে’র এই অরণ্য। সারাজীবন এটা আমাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে:
অদৃশ্য চলমান গাড়ি, পাখির কূজন।
       শুনসান ডোবায়, মশক লার্ভার উচ্চণ্ড নৃত্যের 
প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

আমি একই জায়গা আর একই শব্দের দিকে পালাই।
সমুদ্র থেকে আসে শীতল হাওয়া, বরফড্রাগন আমার ঘাড়ের 
        পেছন দিকটা চাটতে থাকে যখন সূর্যটা জ্বলজ্বল করে।
শীতল শিখায় জ্বলে চলমান গাড়ি।

আলকেইক [Alcaic]: ধ্রুপদী গ্রিক কবি আলসিয়াস [Alcaeus] উদ্ভাবিত চার লাইনের স্তবক।

 

নীল ব-দ্বীপে

সারাদিন শহরটাতে ঘোরাঘুরির পর হোটেলে তার 
খাবারের ওপর তরুণী বধূটি চোখের জল ফেলছিল, যে 
শহরে সে দেখেছিল অসুস্থদের হামাগুড়ি, গাদাগাদি আর 
দারিদ্রে মৃত্যু-অবধারিত শিশু।    

সে এবং তার স্বামী তাদের ঘরে ঢুকল।
জল-টল ছিটিয়ে তারা ধুলোবালি নিরস্ত করল।
সামান্য কথাবার্তা বলে তারা যে-যার বিছানায় চলে গেল।
মেয়েটি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। লোকটি জেগেই রইল।

বাইরে অন্ধকারে বিশাল একটা কলরব বয়ে যাচ্ছিল।
ঝগড়াঝাঁটি, দাপাদাপি, কান্নাকাটি, গাড়িঘোড়া, গানবাজনা।
অভাবটা চলছেই। সেটা কখনোই থামছে না।
এবং সে একটা ‘না’-এর ভেতর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

একটা স্বপ্ন এল। সে একটা সমুদ্রযাত্রায়।
ধূসর জলের ভেতর একটা ঘূর্ণি দেখা দিল আর একটা 
কণ্ঠস্বর বলে উঠল: ‘এমন একজন আছেন যিনি মঙ্গলময়। 
এমন একজন আছেন যিনি ঘৃণা ছাড়াই সবকিছু দেখেন।’

 নীল ব-দ্বীপ: Nile Delta; নায়েল ডেল্টা হলো মিশরের নিম্নাঞ্চল, যে পথে নীল নদ প্রবাহিত হয়ে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে মিশেছে।

 

চাপের মধ্যে

নীল আকাশের প্রবল ইঞ্জিন-গর্জন।
আমরা থরথর একটা ওয়ার্কসাইটে রয়েছি 
যেখানে সাগরের অতলতা হঠাৎই নিজেকে মেলে ধরতে পারে─
শঙ্খ আর টেলিফোনের গুঞ্জন।

সুন্দর তুমি কেবল পাশ থেকেই দেখতে পারো, চকিতে।
মাঠে নিবিড় ঘন শস্যরাজি, একটা হলুদ স্রোতের ভেতর বহুতর রং।
আমার মাথার ভেতরকার অস্থির ছায়াগুলো সেখানে ছুটে যেতে চায়।
তারা হামা দিয়ে শস্যের ভেতরে ঢুকে সোনা হতে চায়।

অন্ধকার নেমে আসে। মাঝরাতে আমি বিছানায় যাই।
জাহাজের ভেতর থেকে ডিঙি নৌকা বেরিয়ে আসে।
জলের ওপরে তুমি একা।
সমাজের ঘোর কাঠামোটা দূরে, বহু দূরে ভেসে যায়।

 

শিলালিপি

রাজধানীর ভবনগুলো, খুনে মাছিদের মৌচাক, কিছু মানুষের মধু।
সেইখানে লোকটা কাজকাম করে। কিন্তু একটা অন্ধকার টানেলের ভেতরে 
সে তার ডানা মেলে উড়াল দেয় যখন কেউই তাকে দেখছিল না। তাকে 
আবার তার জীবন যাপন করতে হবে।

 

ঝরছে তুষার

আমরা যত শহরটার দিকে এগোই
ততই শবযাত্রা আসতে থাকে,
ট্রাফিক সংকেতের মতো তারা
ক্রমাগত আসতেই থাকে।

দীর্ঘ ছায়ার দেশে তাকিয়ে 
রয়েছে হাজার হাজার মানুষ।

একটি সেতু নিজেই নিজেকে 
নির্মাণ করে ধীরে ধীরে
সরাসরি মহাশূন্যের ভেতর। 

 

আরও ভেতরে

তখন আমি শহরের প্রধান প্রবেশমুখে
যখন সূর্যটা পাটে নেমে এসেছে।
যানজট গভীর হয়েছে, হামাগুড়ি দিচ্ছে।
এটা হলো ঝলমলে মন্থর একটা ড্রাগন।
আমি সেই ড্রাগনেরই একটা আঁশ।
হঠাৎ উইনশিল্ডের ঠিক সামনে সূর্যটা
খুব লাল হয়ে ভেতরে উথলে এল।
আমি স্বচ্ছ হয়ে গেলাম আর আমার 
ভেতরে একটা লেখা দৃশ্যমান হয়ে উঠল, 
অদৃশ্য কালিতে লেখা সব শব্দ, আগুনের 
ওপর কাগজ ধরলে যা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে!
আমি জানি আমাকে শহরের অনেক 
ভেতরে যেতে হবে এবং তারপর 
আরও ভেতরে, যতক্ষণ পর্যন্ত না 
শহর পার হয়ে অরণ্যের অনেক গভীরে 
হাঁটার পালা আসে। 
নেউলের পদচিহ্ন ধরে হাঁটো।
অন্ধকার হয়ে এসেছে, কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না।
সেখানে, শৈবালের ওপর, অনেক পাথর পড়ে আছে।
তার ভেতরে একটা পাথর খুবই মূল্যবান।
সেটা সবকিছুই পাল্টে দিতে পারে।
সেটা আঁধারকে উজ্জ্বল করে দিতে পারে।
সেটা হলো সারা দেশের একটা সুইচ।
সেটার ওপরেই সবকিছু নির্ভর করছে।
দ্যাখো সেটাকে, স্পর্শ করো সেটাকে...

 

নোবেল ফারের স্পর্শসহ নভেম্বর

আকাশ এত ধূসর হয়ে গেছে যে
মাঠঘাট সব উজ্জ্বল হয়ে উঠতে শুরু করেছে: 
ভীরু ভীরু সবুজ নিয়ে আছে তৃণভূমি,
পিচের মতো কালো কালো সব আবাদি জমি।

একটি গোলাবাড়ির লাল দেয়াল,
এশিয়ার উজ্জ্বল ধানক্ষেতের মতো 
জলমগ্ন সব মাঠঘাট─
সেখানে শঙ্খচিলেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে 
স্মৃতি রোমন্থন করে।

অরণ্যের গহীনে গহীনে কুয়াশা
যেগুলো পরষ্পরের প্রতি মিহি ঝংকার তোলে।
এবং অনুপ্রেরণা, যে বসবাস করে নির্জনে
আর নেইলস ডাকি’র মতো অরণ্যে পালিয়ে যায়।

নেইলস ডাকি [Nils Dacke]: দক্ষিণ সুইডেনের ১৬শ শতাব্দীর কৃষক বিদ্রোহের নেতা।

ভূমিকা ও অনুবাদ: নান্নু মাহবুব