চীনা কবিতার ঐতিহ্য এবং মাও সে-তুঙয়ের কবিতা
চীনা কবিতার ঐতিহ্য তিন হাজার বছরের অধিক। তাদের রয়েছে সাহিত্যের বর্ণাঢ্য বিশাল ভাণ্ডার। চীনাদের হাতে প্রথম কাগজ তৈরি হয়েছে। আবার চীনারা তাদের সনাতনী সাহিত্য-ঐতিহ্যকেও আদিকাল থেকে ধারণ ও সংরক্ষণ করে এসেছে।
যদিও চীনা কবিতার প্রারম্ভিক ইতিহাসের আধুনিককাল ধরা হয় অষ্টম ও নবম শতাব্দীর তিনজন শ্রেষ্ঠ কবি যথাক্রমে লি পো, তু ফু ও পাই জু-ই’কে, তবুও খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর বা তারও পূর্বকাল চতুর্থ বা পঞ্চম শতাব্দীর দীর্ঘ সময়ের অজ্ঞাত কবিদের রচিত কবিতাসমূহও চীনাদের কাছে অদ্যাবধি প্রচলিত ও জনপ্রিয়। এঁদের স্মরণ ও উল্লেখ না করে চৈনিক কাব্যধারার প্রতিনিধিত্ব পূর্ণাঙ্গ হয় না।
চীনা কাব্যসাহিত্য গত শতাব্দীর প্রথম থেকেই বিশ্ব সাহিত্যের আসরে অধিক পরিচিত হতে থাকে। তাই চীনা কবিতার সর্বাধুনিক কাল ধরা হয় গত শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশক থেকে। পাশ্চাত্যের ভাবধারা ও তার প্রকাশের গঠন প্রণালী এই সময় থেকেই অনেকটা প্রভাব বিস্তার করে আসছে চীনা কবিতায়।
চীনারা স্বভাবে লাজুক, নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী, প্রচারবিমুখ এবং অন্তর্মুখী। পাশ্চাত্যের সাহিত্য-চিন্তা ও চেতনা এবং শিক্ষা তাদের ইদানীংকালে অনেকটা বহির্মুখী করে তুলেছে। ফলে বহির্বিশ্বে চীনা সাহিত্যের বিস্তার অনেকাংশে লক্ষণীয়। এজরা পাউন্ড ১৯১৫ সালে প্রথম ইংরেজি ভাষায় ‘ক্যাথে’ নামক বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি চীনা কবিতার অনুবাদ সংকলন প্রকাশ করেন। এজরা পাউন্ড চীনের প্রখ্যাত কবিদের কিছু কবিতা গদ্যে ইংরেজি অনুবাদ করিয়ে তা পদ্যে রূপান্তর করেন। সেই গ্রন্থটিই পশ্চিমা বিশ্বে প্রথম চীনা কবিতার অনুবাদ। পরবর্তীকালে আর্থার ওয়ালে, রিউই এ্যালি, এ সি গ্রাহাম, আর্থার কুপার প্রমুখ চীনা কবিতার ইংরেজি ভাষান্তর করেন। তাদের সেই অনুবাদ থেকে অন্যান্য ভাষায় চীনা ভাষার কবিতার অনুবাদ প্রকাশ হতে থাকে।১
প্রসঙ্গক্রমে কবিতা অনুবাদ সম্পর্কে দু’একজন বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অনুবাদক কবির বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। চীনা কবিতা বিশেষজ্ঞ আর্থার কুপার মন্তব্য করেছেন, “বৈশিষ্ট্যপূর্ণ-কবিতা কোনো সময়েই অনুবাদ করা যায় না। অনুবাদে সব সময়ই কবিতার কিছু না কিছু হারিয়ে যায়।”২ অন্যদিকে জাপানী কবিতার আলোচকরূপে খ্যাত হ্যারী গাস্ট বলেছেন, “মূল থেকে অনুবাদের দূরত্ব অনেক ক্ষেত্রে পরিমাপযোগ্য নয় [...]।৩” “বিশিষ্ট সমালোচক কডওয়েল বলেছেন: ‘Poetry is not translatable’; ভলতেয়ার বলেছেন: “কবিতার অনুবাদ অসম্ভব কাজ। তুমি কি সঙ্গীতের অনুবাদ করতে পারো।”৪ এ কথা স্বীকৃত যে কবিতা অনুবাদ একটি দুরূহ সাহিত্যকর্ম। এ কেবল ভাষান্তর ও পুনঃলিখনও নয়। অপরদিকে সর্বক্ষেত্রে হুবহু অনুবাদ করতে গেলে অনূদিত বিদেশী কবিতাটির প্রকৃত অভিব্যক্তির প্রতি অবিচার করা হয়ে থাকে। যে ভাষা-দেশের কবিতা অনুবাদ করা হয়, তার বর্তমান সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ও সাহিত্যের দিকনির্দেশ এবং অতীত ও বর্তমানের মননশক্তির পরিবর্তনশীলতার দিকে লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়, বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট কবির কবি-মানস ও পরিবেশ উপেক্ষা করা যায় না।
চীনা ভাষা প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। সাহিত্য ও সংস্কৃতি সেই ধারার ঐতিহ্যে অনুসৃত হয়ে আসছে। আমাদের নিকট সেই ঐতিহ্য অনেকটাই অপরিচিত ও অনুদ্ঘাটিত। ফলে চীনা কবিতার চিত্রকল্প বা রূপকল্প, উপমা, প্রতীক ইত্যাদির ব্যবহার বৈচিত্র্যের বিকল্প অনেকাংশেই নেই এবং বোধগম্যতার কারণে এর অনুবাদও কঠিন হয়ে পড়ে। চীনা কবিদের আধুনিক জগতে প্রবেশের প্রধান অন্তরায় ছিল তাদের অন্তর্মুখিনতা, জটিল ভাষা ব্যাকরণ ও তার ব্যবহার এবং স্বাজাত্যাভিমান—যা থেকে তারা দ্রুত মুক্ত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসছেন। তবে পরবর্তীকালে এই প্রজন্মের চীনা কবিরা প্রাচীন প্রকাশভঙ্গী বা গঠন প্রণালীর মোহ ছিন্ন করে কবিতা রচনায় আধুনিক নবধারার সূচনা করে অগ্রসর হয়েছেন আন্তর্জাতিকভাবে। এঁদের মধ্যে কবি তাই ওয়াং শ্যু, মু তান, লু লি এবং আই চিঙ অন্যতম।
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কবি কৌশিক বন্দোপাধ্যায় প্রাচীন চীনা গীতিকবিতা’র একটি মনোরম সংকলন প্রকাশ করেন। তিনি তাঁর ‘পূর্বলেখ’-এ বলেন যে, “[...] চীনের অতিকায় পাঁচিলের আড়ালে যে দেশটা আর তার মানুষজনের জীবনধারা সম্বন্ধে বিশ্ববাসীর আগ্রহ বহুকালের। [...] গৌতম বুদ্ধের মৃত্যু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দে। তাঁর প্রায় সমসাময়িক কনফুসিয়াসের জন্ম হয় চীনে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৬ অব্দে। তাঁরও প্রায় পাঁচশ’ বছর আগে—খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত, এই পাঁচ শতাব্দী ধরে রচিত ৩০৫টি গীতিকবিতা সর্বপ্রথম The Book of Songs নামে সংকলিত হয়। প্রাচীনকাল থেকে চীনা সাহিত্যের ইতিহাসে এই সংকলনের একটি বিশিষ্ট স্থান রয়েছে। সে-সংকলন থেকে এখানে একটি কবিতা নেয়া হলো:
দু’কূলে দু’জনে
দক্ষিণে ছিলো সুদীর্ঘ তরু, দেয় না কাউকে আশ্রয়।
হান নদী পাড়ে দেখি এক মেয়ে, পৌঁছতে কাছে সাধ হয়।
সাঁতরে পেরোতে পারি না হান্কে এতখানি তার বিস্তার;
এতই দীর্ঘ ইয়াংসী নদী দেয় না আমাকে নিস্তার।
ঝোপেতে গজানো গাছালির থেকে বেছে আমি কেটে নেবো—
বিয়ের জন্য এলে সে কাছে তাকে ঘোড়াটিকে দেবো।
সাঁতরে পেরোতে পারি না হান্কে এতখানি তার বিস্তার;
এতই দীর্ঘ ইয়াংসী নদী দেয় না আমাকে নিস্তার।৫
কৌশিক বন্দোপাধ্যায় আরো বলেন যে, “লোকায়ত উপাদানে সমৃদ্ধ হবার ফলে এই গীতিকবিতাগুলোর সজীবতা ও সরল শব্দসৌকর্য দেশকালের সুদূর ব্যবধান পেরিয়ে আজও আমাদের মনকে স্পর্শ করে, অনুরণিত করে।”৬
এ দেশের প্রয়াত কবি ও ছড়াকার, প্রাবন্ধিক এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ—যিনি বিগত শতাব্দীর ষাট দশকে প্রতিষ্ঠাকালীন চীনের পিকিং রেডি’র বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেন ও চীনা কবিতার সংস্পর্শে আসেন এবং চীনা কবিতার মেজাজ ও মর্ম উপলব্ধি করেন। তিনি চীনের বেশকিছু প্রাচীন কবিতা ছাড়াও মাও সে-তুঙয়ের অনেকগুলি কবিতা ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। চীনের প্রাচীন ও আধুনিক কবি ও কবিতা সম্পর্কে তিনি বলেন যে, “বর্তমানে ইংরেজিসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় চীনা কবিতার অনুবাদ পাওয়া গেলেও চীনা কাব্য জগতের বিশাল ও বর্ণাঢ্য সম্ভার থেকে প্রতিনিধিত্বপূর্ণ কবিতা সংগ্রহ একটি দুরূহ কাজ। তিন হাজার বছরের পুরনো চীনা কাব্যসাহিত্য চলতি শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে প্রথম বিশ্বসাহিত্যের আসরে পরিচিত হতে থাকে। [...]
“আমাদের নিকট অপরিচিত বহু প্রতীক, উপমা বা রূপকল্প ইত্যাদি চীনা সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যের সঠিক বিকল্প নেই বলে অনুবাদে অনেক বিড়ম্বনা। চীনের প্রধানত তিনজন প্রাচীন শ্রেষ্ঠ কবি লি পো, তু ফু ও পাই জুই’কে উল্লেখ না করে চীনা কবিতার প্রতিনিধিত্ব সম্পূর্ণ করা যায় না। চীনা কবিতায় প্রথম আধুনিক কাল এখনো ধরা হয় এই তিনজন কবির অষ্টম-নবম শতাব্দীকে।
“তবে চীনা কবিতার আধুনিক কাল এখন বর্তমান শতাব্দীর প্রথম-দ্বিতীয় দশক থেকে ধরা হয়ে থাকে। পশ্চিম দেশীয় ভাবধারা ও প্রকাশ ভঙ্গী এই সময় থেকে চীনা কবিদের উপর প্রভাব বিস্তার করে আসছে। অন্তর্মুখী চীনকে এই সমস্ত আধুনিক ও অত্যাধুনিক কবি-সাহিত্যিক বিশ্বে বহির্মুখী করে তুলতে সহায়তা করেন। চীনের লং মার্চ ও মুক্তিযুদ্ধ রাজনৈতিক কারণে তাদের সাহিত্যকে বাইরের জগতে পরিচিত করেছে। ত্রিশ-চল্লিশের যুগে একই কারণে বাংলা ভাষায় প্রথম চেয়ারম্যান মাও ও কুয়ো মো-জো’র কবিতা অনূদিত হয়। পরবর্তীকালে প্রাচীন প্রকাশ ভঙ্গীর মোহ ছিন্ন করে কয়েকজন কবি আরো অগ্রসর হয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে।”৭
চীনা কবিদের মধ্যে অষ্টম ও নবম শতাব্দীর কবি হলেন লি পো, তু ফু এবং পাই-জুই। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো চীনে এখনো এঁরা শ্রেষ্ঠ কবিদের আসনে সমাসীন। ফয়েজ আহমদ চীনের অজ্ঞাত কবিদের কবিতা ছাড়া এই তিন কবির কবিতাসহ এ কালের কবিদের কবিতা এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান কমরেড মাও সে-তুঙ-এর অনেক কবিতা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। ফয়েজ আহমদ অনূদিত তাঁর দেশান্তরের কবিতা গ্রন্থ থেকে কয়েকটি চীনা কবিতার অংশ বিশেষ এখানে উদ্ধৃত হলো:৮
১. অজ্ঞাত
ক্ষমা করো
ক্ষমা করো, চুঙ য্যু,
এসো না আমাদের বসত বাড়িতে;
বাস্তুর গুল্মলতা করো না বিনষ্ট।
এ নয় যে, মায়া আছে আমার গুল্মলতার প্রতি;
কিন্তু আমার বাবা ও মাকে ভয়।
চুঙ য্যুকে ভালোবাসি প্রাণ দিয়ে;
কিন্তু আমার বাবা-মা বলবে কি,
বাস্তবিক তাতেই আমি ভীত।
ক্ষমা করো, চুঙ য্যু,
এসো না আমাদের দেয়াল বেয়ে;
ভেঙে ফেলো না আমাদের বোনা তুঁত গাছটা।
এ নয় যে, তুঁত বৃক্ষের প্রতি যত্নবান আমি;
কিন্তু ভয় আমার ভাইদের।
চুঙ য্যুর জন্যে অম্লান ভালোবাসা;
কিন্তু আমার ভাইরা কি যে বলবে,
প্রকৃতই সে কারণে ভীত আমি।
সনির্বন্ধ অনুরোধ, চুঙ য্যু,
এসো না আমাদের বাগানের মধ্যে;
বিধ্বস্ত করো না আমাদের বোনা শাল গাছের সারি।
এ নয় যে, শাল বৃক্ষের প্রতি আমি মনোযোগী;
কিন্তু সেই ভয়, কি বলবে লোকে।
চুঙ য্যুর জন্যে দুর্লভ প্রেম আমার;
কিন্তু পাছে লোকে কিছু বলে,
সত্যিই আমি তা ভেবে ভীত।
[কবির নাম অজ্ঞাত: খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী]
২. লি পো
নীরব রাত্রির ভাবনা
আমার শয্যার সম্মুখে উজ্জ্বল
চন্দ্রালোক,
তুষারে আবৃত যেন ভূমিতল।
দীপ্তিমান চন্দ্র দেখি মাথা উঁচু করে,
মস্তক যখন নত
স্বপ্ন রাজ্যে আমি যে স্বগৃহে।
* অনেকের মতে লি পো’র এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা।
৩. তু ফু
শূন্য ব্যাগ
সবুজ দারুপত্র আর বর্ণাঢ্য সূর্যদীপ্তি
হয় তো অমর জনের আহার,
কিন্তু নয় মানবের;
শ্রমসাধ্য ও বাস্তব এ বিশ্ব, আমার জীবন
নির্মম কষ্টে পরিপূর্ণ। কিছুই রান্নার নেই।
কুয়োটা বরফে কঠিন হয়ে আছে। নেই বস্ত্র
পর্যাপ্ত, তাই রাত্রির হিমে নিদ্রা; তবুও
সম্পূর্ণ শূন্য থাকা কারো ব্যাগ বিশ্রী দেখায়।
রিক্ত ব্যাগে আমার মুদ্রা রেখেছি একটি,
নিজেকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য।
৪. পাই জু-ই
অবাধ বিশ্রাম
আস্তৃত কোট, উষ্ণ টুপী আর ফেল্টের আরামপ্রদ স্লিপার;
ক্ষুদ্র টাওয়ারের নীচু জানালার ধারে বসেছি
জ্বলন্ত অঙ্গারপাত্রের পাশে।
বিশ্রামে আমার দেহ,
শান্তিতে পূর্ণ হৃদয় আমার,
প্রত্যুষে ঘুম থেকে ওঠার নেই প্রয়োজন।
পশ্চিম রাজধানীর অমাত্যগণ এসব জানেন কি না
তাই আমি ভাবছি।
৫. কুয়ো মো-জো
আমি উপাসক
আমি এক উপাসক,
সূর্যের উপাসনা আমার। পর্বতশৃঙ্গ, সমুদ্রের
উপাসনা করি আমি।
আমি অনুরাগী জলরাশি, অগ্নি আর আগ্নেয়গিরির;
বিশাল নদীর আমি অনুরাগী।
জীবনের অর্চনা করি আমি, মৃত্যুরও। আলো আর
অন্ধকারের অর্চনায় আমি রত।
আমি উপাসনা করি সুয়েজ, পানামা, মহাপ্রাচীর
আর করি উপাসনা পিরামিডকে।
সৃজনী চেতনার আমি অনুরাগী,
অর্চনা করি আমি শক্তি, রক্ত আর হৃদয়ের।
আমি উপাসক ধ্বংসের, উপাসক আমি
বোমা আর দুঃখের।
প্রতিমা ধ্বংসকারীর আমি অনুরাগী, আমার
উপাসকও আমি
কারণ প্রতিমাচূর্ণকারী আমি নিজেও একজন।
[১৯২১]
এছাড়াও ফয়েজ আহমদ বিভিন্ন দেশের অনুদিত তাঁর দেশান্তরে কবিতা শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, চীনে আধুনিক কবিদের মধ্যে তাই ওয়াংশ্যু, মু তান, আই চীঙ ও লু লি উল্লেখযোগ্য কবি। বিশ শতকের কবি তাই ওয়াংশু [১৯০৫-৫০]। চীনা কবিদের মধ্যে পুরোধা। প্রথম দিকে আধ্যাত্মিকতায় নিমজ্জিত থাকলেও কবি ওয়াংশু ক্রমেই বাস্তববাদ ও গীতিধর্মিতার অগ্রণী কবি হয়ে ওঠেন। এবং জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে যোগদানকারী দায়িত্বশীল কবিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েন। পঞ্চাশ সালে অ্যাজমা রোগের কারণে অকাল প্রয়াত হন।
চীনা কবি মু তান সম্পর্কে ফয়েজ আহমদ বলেন যে, “অত্যাধুনিক কবি মু তান চল্লিশের দশকে জাপান বিরোধী যুদ্ধের সময় যুদ্ধরত অবস্থায় বর্মা পর্যন্ত জাপানীদের পশ্চাদ্ধাবন করেন ও নৈরাশ্যের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হন। সে সময়ই তিনি প্রেমের কবিতা লিখেছেন কি না তা নিশ্চিত নয়। তিনি আধুনিক ফরাসী ও ইংরেজি কবিতার প্রতি আকৃষ্ট। বিদেশী ভাষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত কবি মু তানের প্রেমের কতিবাও ভিন্নধর্মী ও অত্যাধুনিক। নিশ্চিত আদর্শগত পথ নির্দেশের অভাবে দ্বন্দ্ব-পীড়িত হয়ে ত্রিশ বছর বয়সেই তিনি কবিতা রচনা বন্ধ করে দেন। তিনি চীনা ধ্রুপদী বা ক্ল্যাসিক্যাল রীতি গ্রহণ করেননি এবং শব্দ নির্বাচন, রূপক ব্যবহার ও প্রকাশ ভঙ্গির দিক থেকে তিনি স্বতন্ত্র।”৯
অন্যদিকে আই চীঙ সত্তর দশক এবং লু লি আশির দশকের কবি। ভিন্নমতের কারণে আই চীঙ দেশের অভ্যন্তরে অনেকদিন নজরবন্দী ছিলেন। ফয়েজ আহমদ অনুদিত উল্লেখিত কবিদের কবিতার অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত হলো:১০
১. তাই ওয়াংশ্যু
বৃষ্টি ভেজা গলি
দীর্ঘ নির্জন গলিতে উদ্দেশ্যহীন
আমি চলছি বৃষ্টিতে একাকী।
অয়েল-পেপার ছাতা আমার হাতে;
উৎকণ্ঠা আর অসন্তোষের যন্ত্রণায় সিক্ত
এক যুবতীর মুখোমুখি হব আশা করে—
এক গুচ্ছ লাইল্যাক পুষ্পের মতো যে মেয়ে।
একা আমি ঘুরছি উদ্দেশ্যহীন
বৃষ্টিতে এক দীর্ঘ নির্জন গলিতে
অয়েল-পেপার ছাতা আমার হাতে,
উৎকণ্ঠা আর অসন্তোষের যন্ত্রণায় আদ্র
এক যুবতীর পার্শ্ব করবো অতিক্রম
আশা করে—
একগুচ্ছ লাইল্যাক পুষ্পের মতো যে মেয়ে।
২. মু তান
প্রেমিকার কাছে
১. নয়ন তোমার দেখেছে এই অনলের বিপর্যয়
কিন্তু আমাকে নয়, যদিও আমি প্রজ্বালিত তোমার স্পর্শে।
হায়, দগ্ধ হচ্ছে পরিণত বয়স কেবল
তোমার ও আমার, পর্বত করেছে মোদের বিভক্ত সত্তা!
২. শব্দ দ্বারা উদ্ভাসিত জগতে
নিথর আলিঙ্গনে ছিলাম আমরা,
তখনো অসৃজিত অন্ধকারে সন্ত্রস্ত,
সম্ভব আর অসম্ভবের আবর্তে মুগ্ধ।
৩. আই চীঙ
ভ্রমণ সঙ্গিনী
মনোরম শহর ট্রিভিস
ট্রিভিসে ভ্রমণ সঙ্গিনী এক অনিন্দ্য সুন্দরী।
নাম জানি না তার
কিন্তু তার নয়ন ছিল নয়নাভিরাম।
কোমল ওষ্ঠাধরের শব্দাবলী আমাদের
করে রাখতো বিহ্বল।
যেন মেঘ চালিকা এক মেয়ে
মমতার স্পর্শে দলটি পরিচালনা করছে।
যেন ইতিহাসের শিক্ষকের মতো মেয়েটি,
যার ব্যাপক শিক্ষা ও সহনশীলতা অফুরন্ত।
পোরটা নিগরার মধ্য দিয়ে ফোয়ারার পাশে,
ক্ষণপ্রভা হাসি তার, সে বলে: বিদায়।
এবং কেউ আর তাকে দেখে না কোনোদিন,
কিন্তু এখনো তার স্ফটিক স্বচ্ছ কণ্ঠস্বর হৃদয়ে আমাদের।
৪. লু লি
আমার হৃদয়
পরিপূর্ণ শরতের সময়
আমি গিয়েছিলাম গ্রামাঞ্চলে,
পরিহার করেছিলাম বস্ত্র ও সমস্ত
উৎকণ্ঠা আমার,
উৎফুল্ল তরুণ বৃক্ষের ন্যায়
সূর্যালোকে দাঁড়িয়ে ছিলাম নগ্ন;
আমার হাত দুটো হয়েছিল
শাখা ও পত্র,
আমার শুভ্র কেশ পুষ্প,
এবং আমার হৃদয়
রক্তিম ফলের মতো।
[১৯৮০]
চীন বিপ্লবের মহান নেতা চেয়ারম্যান মাও সে-তুঙ। চীনের লং মার্চ ও মহান জনযুদ্ধের কাণ্ডারী ছিলেন তিনি। ছিলেন গণমুক্তি ফৌজের প্রধান। সাহিত্যের প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ এবং নিজে একজন কবি হওয়ার কারণে বিশেষ করে চীন বিপ্লবের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে চীনা সাহিত্য সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। আর এই কারণে চেয়ারম্যান মাও সে-তুঙ ও কুয়ো মো-জো’র কবিতা অনুদিত হয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। চীনা বিপ্লবী কথা সাহিত্যিক লু স্যুন সারা দুনিয়ার বস্তুবাদী পাঠকদের প্রিয় লেখক।
চীনারা ধ্রুপদী বা ক্ল্যাসিক্যাল ধারার অনুসারী। এই ধারা গীতিকবিতার আদলে গঠিত। এই ধারার কবিতার মূল প্রতিপাদ্য প্রেম ও রোমান্টিকতা। কমরেড মাও সে-তুঙ নিজেও এই ধারারই অনুসারী এবং এই ধারাতেই তিনি কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। তিনি যেমন ছিলেন একজন মহান বিপ্লবী তেমনি ছিলেন একজন রোমান্টিক প্রেমিক। বিপ্লব এবং রোমান্টিকতার সমন্বয়ের এক সুতোয় শব্দের মালা গেঁথে গীতিময়তার মাধুরী মিশিয়ে তিনি রচনা করেছেন অপূর্ব সব কবিতা।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও তাঁর রাজনৈতিক ও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের ফাঁকে ফাঁকে কবিতা লিখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র মার্কসবাদী ও লেনিনবাদী চিন্তাধারার আলোকে দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের মাধ্যমে জনগণের মুক্তি অর্জন সম্ভব। আর এ জন্য বন্দুকই একমাত্র ভরসা নয়; পাশাপাশি মননশীল বিপ্লবী শিল্প-সাহিত্য রচনা ও চর্চার মধ্য দিয়ে জনগণকে সচেতন করে শত্রুর দুর্গে আঘাত হানার রাজনীতি ও রণকৌশলে তিনি আস্থা রাখতেন। তাই ‘সাহিত্য ও শিল্পকলা সম্পর্কে ইয়েনানের আলোচনা সভায় প্রদত্ত ভাষণ’ [মে, ১৯৪২]-এ তিনি বলেন, “চীনা জনগণের মুক্তির জন্য আমাদের সংগ্রামে বিভিন্ন ফ্রন্ট রয়েছে, সেগুলির মধ্যে লেখনী ও বন্দুকের ফ্রন্ট অর্থাৎ সাংস্কৃতিক এবং সামরিক এই দু’টি ফ্রন্ট রয়েছে। শত্রুকে পরাজিত করার জন্য অবশ্যই আমাদের সর্বপ্রথমে বন্দুকধারী সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করতে হবে; কিন্তু কেবল এই বাহিনীই যথেষ্ট নয়, একটি সাংস্কৃতিক বাহিনীও আমাদের অবশ্যই থাকতে হবে, যে বাহিনী আমাদের নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করবার জন্য এবং শত্রুকে পরাজিত করবার জন্য নিতান্তই অপরিহার্য।”১১
মাও সে-তুঙ একজন মহান বিপ্লবী এটাই সর্বজনবিদিত। কিন্তু তিনি যে একজন বড় মাপের কবি এটা কম লোক জানতেন। তবে মাও নিজেই চাইতেন না যে, তাঁর বিপ্লবী নেতৃত্বের চেয়ে কবিসত্তা বড় হয়ে উঠুক। যে কারণে কবিতা প্রকাশে তাঁর ছিল অনীহা। অন্যদিকে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় মহান নেতা হবার কারণে মাওয়ের কবিতার রীতিবদ্ধতায় নতুন প্রজন্মের কবি ও পাঠকরা মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েন পাঠে, এই ভয় ছিল তাঁর।
মূলত, তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর কবিতা যতটা না প্রচার পেয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর তা বিস্তৃত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। সারা দুনিয়ার সমাজ পরিবর্তনে কাঙ্ক্ষিত বিপ্লবীদের কাছে মাও সে-তুঙ যেমন আদর্শ কবি তেমনি অনুসরণীয় বিপ্লবী। ভিন্ন ভাষায় তাঁর কবিতার অনুবাদ প্রকাশিত হয় পঞ্চাশের দশকে। যদিও সে সময় পূর্ণাঙ্গরূপে মাও সে-তুঙ-এর কবিতা ভিন্ন ভাষাভাষী পাঠকদের হাতে আসেনি; তবুও বাংলা ভাষায় মাও এর কবিতা সে সময়ই অনূদিত হয়। মার্কসীয় আদর্শে বিশ্বাসী বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বিষ্ণু দে মাও-এর কবিতার প্রথম অনুবাদ করেন। বলা যায়, তাঁর কাব্যিক হাতে মাও-এর কবিতা বাংলা ভাষায় নতুন প্রাণ পায়। এছাড়াও কবি সন্দীপ সেনগুপ্ত, কমলেশ সেন, জয়ন্ত চৌধুরী, অমল দত্ত, ফয়েজ আহমদ মাও-এর কবিতার অনুবাদ করেন। তাঁদের কবিতার অনুবাদ চমৎকার। পরবর্তীকালে কবি শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন, শুভ রহমান, নূরুল হুদা কাদের বক্স, মহসিন শস্ত্রপাণি, জহুরুল ইসলাম, মোজাম্মেল কে, সমুদ্র গুপ্ত ও মুস্তাফা মজিদ প্রমুখ মাও-এর কবিতার অনুবাদ করেন; যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুস্তকে প্রকাশিত হয়। তাঁদের অনূদিত কবিতাসমূহও অনেকাংশেই চমৎকার। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী ও কবি মুর্তজা বশীর মাও-এর অনেক কবিতা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন যা রীতিমত ঝরঝরে ও চমৎকার।
নিজের কবিতা সম্পর্কে মাও সে-তুঙ খুবই সচেতন ছিলেন। চীনের বিশিষ্ট কবি ও বিপ্লবী-যোদ্ধা কবি কে চিআ’কে ১২ জানুয়ারি ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিনয়াবনত চিত্তে লিখিত চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, “কমরেড কে চিআ এবং অন্যান্য কমরেড, আপনাদের চিঠি অনেকদিন হ’ল পেয়েছি, জবাব দিতে দেরির জন্য দুঃখিত। এখন, আপনার অনুজ্ঞানুসারে আমার এই সাবেক রীতির কবিতার মধ্য থেকে আঠারোটি পাঠাচ্ছি, তার মধ্যে আপনার পাঠানো আটটিও রইল। সঙ্গের কাগজে সেগুলোর কপি পাঠাচ্ছি। অনুগ্রহপূর্বক বিচার করে দেখে ব্যবহার করবেন।
“এ পর্যন্ত সর্বদাই এগুলো ছাপতে অনিচ্ছুক ছিলাম; কারণ, এসব প্রাচীন-রীতিতে লেখা এবং এগুলো চালু হলে ভুলের সম্ভাবনা থাকে। তাতে আমাদের তরুণদের সমূহ ক্ষতি হতে পারে। অধিকন্তু এগুলোতে রস সামান্য, রূপও বিশেষ কিছু নেই। কিন্তু আপনি যখন মনে করেন এগুলো ছাপা যায়, তখন আমি আর আপত্তি করব না। এবং এ সুযোগে কোনো কোনো কবিতায় মুখে-মুখে বলার ফলে যেসব ভুল এসে গিয়েছিল, সেগুলো সংশোধন করলাম।
“আমাদের কাব্য-সাহিত্যে নতুন-রীতিই নিঃসন্দেহে প্রধান রীতি হওয়া উচিত। প্রাচীন-রীতির জন্য অল্পকিছু জায়গা থাকতে পারে; কিন্তু নবীনদের শিক্ষার্থে তা খুব উপযোগী হবে না; কারণ, তাতে চিন্তার পরিধি সীমায়িত এবং এ-রীতি কষ্টসাধ্য।”১২
মাও সে-তুঙের কবিতা || ভাষান্তর: মুস্তাফা মজিদ || প্রকাশক: জার্নিম্যান বুকস || মূল্য ৪০০ টাকা
মাও সে-তুঙ একদিকে একজন বিপ্লবী অন্যদিকে একজন রোমান্টিক ব্যক্তি। এই দ্বৈতসত্তা মাওয়ের ভেতরে সব সময়ই কাজ করতো। আর মাও সারাজীবনই শ্রমসাধ্য পড়াশোনা করেছেন। তৎকালীন পিকিং [বেজিং] গ্রন্থাগারে মাও দিনের পর দিন পড়াশোনা করেছেন ও সাহিত্যে বিচরণ করেছেন এবং অধ্যায়ন করেছেন নানা দর্শন-শাস্ত্র ও ইতিহাস। ফলে সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ আজন্ম ছিল। এবং একজন কবি হয়ে ওঠার জন্য যা যা প্রয়োজন মাও তা অর্জন করেছিলেন অতি অল্প বয়সে। এ কথা তো সত্য যে—একজন রোমান্টিক ব্যক্তিই একজন খাঁটি বিপ্লবী হতে পারেন। কেননা, রোমান্টিকতা বিপ্লবেরই পূর্ব শর্ত। একজন রোমান্টিক ব্যক্তির পক্ষেই বিপ্লবে অংশ গ্রহণ ও নেতৃত্ব দান সম্ভব।
পুনরুল্লেখ্য যে, মাও প্রাচীন চীনা ধ্রুপদী রীতিতে কবিতা রচনা করেছেন। এবং চীনা পুরাণ, লোককাহিনী, কিংবদন্তী ব্যবহার করেছেন। যে কথা তিনি নিজেই তার ভাষ্যে বলেছেন। কিন্তু সেটি সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এবং বিষয়বস্তুতে আধুনিকতায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামও প্রাচীন রীতি ও প্রাচীন পুরাণ তাদের কাব্য উপস্থাপিত করে আধুনিকতার সর্বোচ্চ অবস্থানে দাঁড় করিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের গীতিকবিতা ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী বা অন্যান্য কবিতা তো ওই ধারারই শ্রেষ্ঠ অর্জন! তেমনি নজরুলের গীতিকবিতাসমূহ ও সঞ্চিতা বা অন্যান্য কবিতাবলী। আর ইউরোপের অতি আধুনিক কবিরাও এই কাজটিই করে আসছেন।
মাওয়ের কবিতায় সনাতনী ধ্রুপদী বা ক্ল্যাসিক্যাল রীতির ব্যবহার কিংবা পুরাণ আর লোককাহিনীর সমাবেশ সম্পর্কে জর্জ টমসন উল্লেখ করেছেন যে, “জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে, কেন মাও ৎসে-তুঙ, যিনি নিজেই যেখানে পুরাণের বিবর্তনগুলোকে ‘শিশুসুলভ, কাল্পনিক, আত্মগত’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, তাঁর নিজের কবিতায় সেগুলোকে এত ঢোকালেন? উত্তরটি নিশ্চয়ই এই, কবি হিসেবে তিনি সেগুলোর মূল্য অনুভব করেন মানুষের সাফল্যের প্রতিরূপ হিসেবে। আজকের চীন বাস্তবে সেই বিরুদ্ধ শক্তিগুলোকে জয় করছে, যেগুলোকে তাঁদের পূর্বপুরুষরা দমন করেছিলেন নিতান্তই ‘কল্পনায় এবং কল্পনার মাধ্যমে’।
“দানবীয় কাজুবাদাম বৃক্ষ পপলার এবং উইলোর কাছে ছোট হয়ে গেছে; পৃথিবীর সর্বশেষ কোনো বিজয়ের সঙ্গে তুলনা করার মতো কোনো সংবাদ স্বর্গে নেই। কবিতার ছন্দের গঠন এবং পৌরাণিক বিষয়, উভয়ই খুবই প্রাচীন; কিন্তু পৌরাণিক বিষয়টির গভীরে আছে একটি রাজনৈতিক বিষয়; আর তা সম্পূর্ণ নতুন; জগতের সমস্ত জিনিসের চেয়ে জনগণই সবচেয়ে মূল্যবান। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যতদিন জনগণ থাকবেন, বিস্ময়কর সবকিছু করা যাবে।”১৩
পুনরুল্লেখ্য যে, মাওয়ের অনেক কবিতা বাংলা ভাষায় প্রথম অনুবাদ করেন মার্কসবাদী কবি বিষ্ণু দে। তিনি বাংলা ভাষার আধুনিক কবিদের একজন পুরোধা। মাও এবং তাঁর কবিতা সম্পর্কে কবি বিষ্ণু দে বলেন যে, “চৈনিক থেকে অনুবাদ দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রথমত, সে-ভাষায় অক্ষরের বা শব্দের মৌলিক চিত্রধর্ম ও টেলিগ্রামের ভাষার মতো শব্দ-সংক্ষেপ এবং সংক্ষিপ্ত শব্দ ও ধাতুরূপ অন্য ভাষায় আনা অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, ধ্রুপদী চৈনিক কবিতার ভিত্তি অত্যন্ত রূপকঠিন বিন্যাসের ঐতিহ্যে। শব্দের সংখ্যা পদে পদে স্থির, পদসংখ্যা ও বিন্যাস নির্দিষ্ট, মিলগুলোও বাঁধাধরা। তাছাড়া আছে স্বরমাত্রায় ভিন্ন ভিন্ন বিন্যাস। অধিকন্তু এ কবিতায় নানা উল্লেখ-উদ্ধৃতি মিতভাষী ইশারায় সংহত। মাও ৎসু-তুঙ এই ধ্রুপদী কাব্যের চর্চাই করেছেন, যদিও এ কালের বিখ্যাত কবিরা, যথা, আই চিং, তীন্চীন, কে চিআ, এরা আধুনিক পশ্চিমা-রীতির বাক্বহুল স্বাধীন ঢঙের লেখক। অথচ মাও-ৎসু-তুঙ-এর রীতিতেই ইউরোপের প্রতীকী কবিদের উন্মার্গ সাধনা ঐতিহ্যে সিদ্ধ। অবশ্যই এ-কবিতা আপাত-দুর্বোধ্য ও পরিশ্রমসাপেক্ষ। কিন্তু চীনের পাঠকেরা কবিতার বিষয়ে যত্ন নেন।১৪
“মাওয়ের বিখ্যাত দু’টি কবিতা ‘চাঙশা’ ও ‘পীত সারস মিনার’ [Yellow Crane Tower] অনুবাদ করতে গিয়ে এ কবিতার বিষয়ে কবি বিষ্ণু দে বলেন যে, “প্রথমত কবিতা : চাঙশা। হুনানের এই শহরে কবির ছোটবেলা কেটেছে। অনেক উৎসাহ, অত্যাচার, গৌরবের স্মৃতিজড়িত এই শহর ও অঞ্চল; এখানে বিপ্লবের সাফল্যের পূর্বযুগে নেতৃত্বে ভুল হয়েছে, অনেক চাষীর আশাভঙ্গ ও মৃত্যুতে এর ইতিহাস। কবিতাটি ‘চিন বাগানের বসন্ত’ নামক সাবেক কালের কবিতার বা গীতের রীতিতে, সুং রাজত্বে লিউ কাই চি তার রচয়িতা। এর নির্দিষ্ট পদসংখ্যা, প্রতি পদে কথার সংখ্যা, মিলের বিন্যাস এবং স্বর বা সুরের মাত্রা পরে একটি বাঁধাধরা কাঠামোয় দাঁড়িয়ে গেল। মাও ৎসু-তুঙ-এর কবিতায় এসব ধ্রুপদী নিয়মই রক্ষিত। অনুবাদে মিলের বিন্যাস ও অর্থ, এই দু’টি যথাযথ রাখতে গিয়ে অন্যগুলো সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করা অনুবাদকের ক্ষমতায় কুলোয়নি, দিও পদের। হ্রস্ব-দীর্ঘে মূলের আভাস আছে।
“দ্বিতীয় কবিতাটি তাং যুগের লেখা পু শা মান্ রীতিতে। ইয়াংসি নদীর ধারে উচাঙের একটি প্রাচীন ইমারত এই মিনার। কথিত আছে যে, সেখানে এক পীত সারস থাকত, একদিন জনৈক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি তার পিঠে চেপে উধাও হন। এই গল্পটির এক ভাষ্য বোধহয় কলকাতায় সোভিয়েত ফিল্ম মারফত কার্টুন-ছবিতে দেখানো হয়েছিল। ফিল্মের গল্পটিতে দেখি একটি বিচিত্র মানুষকে, যে বাদশার সামনে কিছুতেই মাথা নোয়াত না। সে রাজার কোটালদের এড়িয়ে লোকদের খুশি করে, বাঁশি বাজিয়ে গান করে। কিন্তু শেষ অবধি তাকে পালাতেই হলো, সে একটা হলুদ সারস বা বক আঁকলো দেয়ালে লোকদের আনন্দ দিতে। তারপরে সে নিরুদ্দেশ, কিন্তু বকটি রোজ নাচে, লোকে দেখে। তবে বাদশার সামনে সে নাচবে না শত চেষ্টা সত্ত্বেও। বৃথাই দেয়াল কেটে নিয়ে যাওয়া, বাদশার হুকুমে যতই নানা রঙ দিয়ে বককে ঢাকা হয়, ততই তার মৌলিক পীত ফুটে ওঠে। এমন সময় দূর নদী থেকে বাঁশির সুর ভেসে এলো, রাজার প্রহরীদের বাধা তুচ্ছ করে বক উড়ে চলে এলো বংশীবাদকের কাছে, কাঁধে বসে চলে গেল নদী বেয়ে।”১৫
কবি বিষ্ণু দে অনুদিত মাও সেতুং-এর ‘চাঙশা’ কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত হলো:
চাঙশা
একলা ছিলুম হেমন্ত হিমে দাঁড়িয়ে
সিআং নদীর স্রোত বয় উত্তরে
নারংগ দ্বীপ ঐখানে মুখ বাড়িয়ে।
চারদিকে দেখি লাল পাহাড়ের সার,
বনে উপবনে সবখানে রংছিট;
বিস্তৃত নদী স্বচ্ছ সুনীল,
শতেক নৌকা চলেছে পাল্লা দিয়ে।
ক্ষিপ্র ঈগল পাখসাট মারে আকাশে,
অগভীর জলে মাছ সাঁতরায়,
লাখো জীব লড়ে তুহিন আলোয়—অধীনতা দেব তাড়িয়ে।
নির্জন ঘরে ভাবি
শুধাই এ যে ব্যাপ্ত অন্তরীক্ষে
দুনিয়ার এত উঠতি পড়তি সে কার দণ্ড নাড়িয়ে।
এখানে এসেছি শত শত সাথী নিয়ে,
মনে করি গত অদ্ভুত যুগ বহু মাস বহু বছর স্মরণে মাড়িয়ে
তখন আমরা ছিলুম তরুণ সহচর,
নবযৌবন ফুটেছে সদ্য হৃদয়মানস চারিয়ে,
আমাদের যত পুঁথিঘাঁটা ভাবভাবনায়;
তখন মাত্র এসেছি লেখা ও তর্কাতর্কি ছাড়িয়ে:
আমরা ভেবেছি আজকে দেশের দশা কি,
আমাদের নদী পাহাড়িয়া ভাষা উদ্বেল
যখনই একেলে লাটবেলাটকে নস্যাৎ করি ফাড়িয়ে।
দেব আরো মনে পড়িয়ে:
একদা কেমন নিচের নদীতে গেলুম স্রোতকে হারাতে,
ঢেউএ ঢেউএ দিলে আমাদের সব নৌকা আটকে হারিয়ে?
চাঙশা চীনের হুনান প্রদেশের রাজধানী। চাঙশার সাথ মাওয়ের সম্পর্ক স্মৃতি বিজরিত ও নিগুঢ় আবেগ-ঘন এবং ভালোবাসার। কবি মাও সে-তুঙ হুনান প্রদেশের শাওসান-এ ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং চাঙশার First Provincial Normal School-এ পড়াশোনা করেন ১৯১৩ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত; তখন তিনি অনেক ছাত্র আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯১১ সালে চীনে প্রথম বুর্জোয়া জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে। যদিও এ বিপ্লব ফরাসী বিপ্লবের মতোই গণ মানুষের কোনো কাজে আসেনি। বিপ্লবের ফসল চলে যায় বুর্জোয়া পুঁজিপতিদের হাতে। ১৯১৭ সালের ১ এপ্রিল মাও New People’s Study Circle গঠনের প্রস্তাব রাখেন। এর উদ্দেশ্য হলো সর্বোতভাবে দেশ ও জাতিকে সর্বোচ্চ আদর্শে দীক্ষিত করা এবং দেশ ও জাতিকে সেবা করা। ৪ মে’র আন্দোলনে এর সভ্য সংখ্যা সাতের ঘরে পৌঁছায়।
১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউয়ান-শি-কাই শাসনকর্তা তাং সিয়াং মিং-এর সমর্থনপুষ্ট হয়ে নিজেকে সম্রাট রূপে ঘোষণা করে। মাও সে-তুঙের নেতৃত্বে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন এই ঘোষণার বিরোধিতা করে এবং বিভিন্ন কার্যক্রম, হ্যান্ডিবিল ও পোস্টারের মাধ্যমে তীব্র আন্দোলন চালায়। ফলে রাজ্যপাল তাং সিয়াং মিং-এর আমলাতান্ত্রিক দমনপীড়নের বীভৎস তাণ্ডব ছাত্রদের উপরে নেমে আসে। এতে ছাত্র আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে ও জনসমর্থন এই আন্দোলনের পেছনে এসে শক্তি যোগায় এবং ছাত্র আন্দোলন জয়লাভে সমর্থ হয়। বিভিন্ন প্রদেশের রণপতি শাসনকর্তা [Warlords]—যাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল—অভ্যুত্থানের সময় জেনারেল চু-তে সহ বহু সমরপতি বিপ্লবীদের দলে যোগদান করেন।
কবি বিষ্ণু দে অনুদিত মাওয়ের ‘পীত সারস মিনার’ কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত হলো:১৬
পীত সারস মিনার
ব্যাপ্ত নয়টি নদী বয়ে যায় মধ্য রাজ্যদেশে,
দক্ষিণে আর উত্তরে কাটে একটি সন্নিবেশে।
কুহেলিকা ধোঁয়ায় বৃষ্টি ধারায় নীলিমার লাগে ধাঁধা,
কচ্ছপগিরি নাগপর্বতে মহানদী বাহু বাঁধা।
কে জানে সে পীত সারস উড়েছে কোথায়
এখন কেবল যাত্রীরা দেখে যায়।
পান করি খুব বিভোর স্বাস্থ্যপান,
হৃদয়ের ঢেউ কিছু ধাওয়া করে নদীর প্রবল বান।
এই কবিতার বিষয়-বিশ্লেষণ কবি বিষ্ণু দে করেছেন তা সত্ত্বেও এই কবিতার টীকা বিশ্লেষণ করে যে বিষয়বস্তু জানা যায়, তাহলো: সোনালী সারস পাহাড় ইয়ূহানের পশ্চিমে ইংয়াসী নদীর তীরে অবস্থিত। চীনা পুরাণে কথিত আছে যে সু-আন মৃত্যুহীন সোনালি সারসে চড়ে এখানে এসে অমরতা লাভ করে। এই পৌরাণিক গল্পকে স্মরণ করে এখানে একটি হলুদ সারস স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীকালে ভ্রমণকারী পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এবং বিশেষত প্রাজ্ঞ-দার্শনিক ও কবিদের কাছে তীর্থস্থান রূপে বিবেচিত হয়। জায়গাটি আরও বিখ্যাত যে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে সিয়া রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ইউ চীন দেশের প্লাবন রোধ করবার জন্য জীবনের অর্ধেক সময় ব্যয় করেন এবং পাঁচটি শাখা নদীর উপর বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ক্যান্টন [গুয়াংজু] থেকে পিকিং [বেজিং] পর্যন্ত দীর্ঘ রেলপথ এখান দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। এখানে ইয়াংসী নদীর মুখোমুখি দুটো পাহাড় এবং খরস্রোতা এই নদীর নান্দনিক সৌন্দর্য কবি মাওকে যেমন অভিভ‚ত করে, তেমনি কবি সুশির বিখ্যাত কবিতা Memories at Red Cliff থেকে মাও অনুপ্রাণিত হন।
পশ্চিমবঙ্গের কবি সন্দীপ সেনগুপ্ত তাঁর মাও সে-তুঙের কবিতা শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, “কবিতাকে প্রাচীন যুগে বলা হতো মন্ত্র, অবশ্য আধুনিককালে কেউ কেউ কবিতাকে নিয়ে মন্ত্রভাবনায় তন্বিষ্ঠ। কিন্তু আজকের দিনে এ কথাটাতো জলের মতো পরিষ্কার যে, মন নয়—মস্তিষ্কই প্রধান এবং প্রাথমিক ও সর্বশেষ বিচারে ভাববাদের গুরু হেগেলকে পেরিয়ে এসে অবশ্যই বলতে হবে—বহির্বিশ্বে বস্তুর অবস্থান ও তার পারিপার্শ্বিক সম্পর্কেই মস্তিষ্কে বিভিন্ন ভাবনার বিস্তার ঘটায় সঠিক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার মতো এবং বিবর্তনবাদের নিছক সেই অর্থেই কবি যে কোনো সার্বিক পরিবর্তনের অগ্রভাবে তাঁর স্থান; ফলত কবিতামাত্রই প্রত্যয়সিদ্ধ ইতিহাস। মাও সে-তুঙের কবিতা সে কারণেই এক ঐতিহাসিক দলিল। যুদ্ধক্ষেত্রে বসে কবিতা লেখার নজির এমন কিছু নতুন নয়। কিংবা পৃথিবীর সর্বাধুনিক কাব্যসৃষ্টির কালে বোধহয় এ কথা বলাই ঠিক যে, যুদ্ধক্ষেত্রই সদর্থে সার্থক ও চিরায়ত কবিতা রচনার প্রকৃষ্ট স্থান। [...]
“বিস্ময়ের কথা, সর্বহারা বিপ্লবের এহেন সর্বাধিনায়কের কলম থেকে রচিত হয়েছে এমন কবিতা, যার সাহিত্যমূল্যের তুলনা মেলা ভার। সারাজীবন অপরিসীম বিপ্লবী কর্মতৎপরতার মধ্যে এহেন কাব্যসৃষ্টির ইতিহাস পৃথিবীতে দ্বিতীয় নেই। মাও সে-তুঙের কবিতা ও শিল্প সাহিত্য বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের পাঠক্রম। ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৫৮ ও তৎপরবর্তীকালে মাও রচিত প্রতিটি কবিতা গণ-আন্দোলনের ভিত্তিভূমির উপর দণ্ডায়মান। মানুষ, সংগ্রাম ও প্রকৃতি, একে অন্যের অপরিহার্য পরিপূরকরূপে প্রাণ পেয়েছে।”১৭
চীনের বিপ্লবী যুদ্ধের প্রধানতম দিকই ছিল কমরেড মাওয়ের নেতৃত্বে লং মার্চ। এই লং মার্চের মধ্য দিয়ে চীনা জনগণের মুক্তি তিনি এনে দিয়েছেন। কোটি কোটি মানুষের অংশগ্রহণ আর লক্ষ লক্ষ পার্টি কর্মী ও লালফৌজের আত্মদানের মধ্য দিয়ে এই বিজয় অর্জিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া এ রকম আত্মত্যাগ বিশেষত গণমানুষের মুক্তির এত বড় কর্মযজ্ঞ আর পৃথিবীতে কখনো ঘটেনি। পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তবেই চীনা জনগণের মুক্তি ঘটে। লং মার্চের যুদ্ধকালীন অনেক কবিতা মাও রচনা করেছেন। লং মার্চকালীন কয়েকটি কবিতা ব্যাখ্যাসহ এখানে তুলে ধলা হলো—
চিং কাঙশান
পাহাড়ের নিচে ওড়ে আমাদের ঝাণ্ডা ও নিশান,
আমাদের রণশিঙ্গা আর ডঙ্কা গিরিশীর্ষে তুলিছে নিনাদ।
বৃত্তাকারে আমাদের ঘিরেছে শত্রু হাজারো গুণে—তারা প্রবল,
তবুও রয়েছি খাড়া দৃঢ়পদে জমিনে আমরা।
[অনুবাদ: মুর্তজা বশীর]১৮
এ কবিতা প্রসঙ্গে জানা যায়, চিঙকাঙশান পর্বতমালার বিশাল এলাকা—যার দীর্ঘ একশ’ লি আর পরিধি পাঁচশ’ লি বিস্তৃত। মাও সে-তুঙ বিপ্লবীদের নিয়ে ১৯২৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এখানে ঘাঁটি তৈরি করেন। এবং বিপ্লবীদের সমর নায়ক চু-তে ১৯২৮ সালের এপ্রিল মাসে এদের সঙ্গে যোগ দেন। শত্রুপক্ষ কুঙমিঙতান বাহিনী ১৯২৭-২৮ সালে এই সকল ঘাঁটি এলাকা আক্রমণ করে এবং ঘিরে রাখে। মাও রণকৌশলগত কারণে পাহাড়ি অঞ্চলের একটি জেলা উদ্দেশ্যমূলকভাবে উন্মুক্ত রেখেছিলেন শত্রুপক্ষকে অতর্কিতে আক্রমণ করার জন্য।
শত্রুপক্ষ রণপতিদের যুদ্ধ
হঠাৎ দখিনা বাতাসের সাথে এক পশলা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল জমিন
পুনরায় শত্রুপক্ষের রণপতিরা যুদ্ধের দিকে ধাবমান
এ যেন সোনা রঙ ভুট্টা ক্ষেতে আগুনের হলকার স্বপ্ন!
দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় লুঙইয়েন ও শাঙঘাঙ্ঘ অতিক্রম করে
লাল ব্যানারের উদাত্ত পাল উদ্দাম তালে তালে
টিঙ নদী পেরিয়ে এলো লালফৌজ—
আনত-বিনয়ের খ্যাতির কৌশল আমাদের জানা আছে
আমরা ব্যস্ত এখন যৌথ খামারের সোনালী শস্য ফলানোর কাজে।
[অনুবাদ: মুস্তাফা মজিদ]১৯
এই কবিতার প্রেক্ষাপট হলো ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে প্রতিক্রিয়াশীল রণপাতিরা নতুন করে বিপ্লবী লালফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। মে মাসের শেষ থেকে শুরু করে ১৯ জুন পর্যন্ত লালফৌজ তিনবার লুঙইয়েন দখল করে এবং ২১ সেপ্টেম্বর সকালে লালফৌজ শাঙ্ঘঘাঙ্ঘ দখল করে। এই কবিতায় চীনের উর্বরা এই ভূমিকে তুলনা করা হয়েছে একটি সোনার পুষ্পাধারের সঙ্গে। যখন শত্রুপক্ষর রণপতিরা এই ভূমিকে টুকরো টুকরো করে আর তখন মাও তা জোড়া লাগাতে ব্যস্ত। এই কবিতায়ও মাও পুরাণ কাহিনী তাঙ বংশের রাজত্বকালের হানটনের কোনো পান্থশালায় অভুক্ত লু-শেং-এর সাথে অমর লু ওয়েং-এর স্বপ্নে কাল্পনিক দেখা হওয়ার বর্ণনার উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন।
শত্রুপক্ষ রণপতিদের যুদ্ধ
হঠাৎ দখিনা বাতাসের সাথে এক পশলা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল জমিন
পুনরায় শত্রুপক্ষের রণপতিরা যুদ্ধের দিকে ধাবমান
এ যেন সোনা রঙ ভুট্টা ক্ষেতে আগুনের হলকার স্বপ্ন!
দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় লুঙইয়েন ও শাঙঘাঙ্ঘ অতিক্রম করে
লাল ব্যানারের উদাত্ত পাল উদ্দাম তালে তালে
টিঙ নদী পেরিয়ে এলো লালফৌজ—
আনত-বিনয়ের খ্যাতির কৌশল আমাদের জানা আছে
আমরা ব্যস্ত এখন যৌথ খামারের সোনালী শস্য ফলানোর কাজে।
[অনুবাদ: মুস্তাফা মজিদ]১৯
এই কবিতাটি দু’ভাগে লেখা হয়। প্রথমত মাও চাঙশায় ঘাঁটিকালীন শত্রুপক্ষের অধিপতি চিয়াং কাইশেক এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে যখন আক্রমণ চালায় এবং অবরোধ করে তখন প্রথম স্তবক লেখা হয়। অবশ্য এ রকম অবস্থা বেশিদিন টেকেনি। লালফৌজ চল্লিশ হাজার সৈন্য নিয়ে ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩০-এ পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং মাত্র পাঁচ দিনে অবরোধ মুক্ত করে। পরবর্তী স্তবক লেখা হয় দ্বিতীয় অবরোধের পর। এই সময় চিয়াং কাইশেক দুই লক্ষ সৈন্য নিয়োগ করে। এই যুদ্ধ ১৯৩১ সালের মে মাসের ১৬ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এবং লালফৌজ বিজয় লাভ করে।
এই কবিতায় কবি মাওয়ের একটি চমৎকার রূপকথার কাহিনী-ভাষ্য আছে। ভাষ্যটি হলো:২১
পুচৌশান পর্বতের পাদদেশে কুঙ কুঙ এর ধাক্কা দেয়ার কাহিনী
হুয়াই নান জু গ্রন্থের ‘জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রসঙ্গ’ অধ্যায়ে উল্লিখিত হয়েছে যে, ‘প্রাচীনকালে সিংহাসন দখল নিয়ে কুঙ কুঙ এবং চুয়ান সু পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। উন্মত্ততায় দিশেহারা হয়ে কুঙ কুঙ প্রচণ্ড জোরে পুচৌশান পর্বতে ধাক্কা দেয়। ফলে স্বর্গের খুঁটিগুলো ভেঙ্গে পড়ে এবং স্বর্গ-মর্ত্যরে বিচ্ছিন্নতা ঘটে। এ সময় সূর্য, চন্দ্র এবং তারকারাজিকে দ্রুত সঞ্চারমান করে আকাশ উত্তর-পশ্চিম দিকে ধাবিত হয়। পৃথিবী দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হেলে যায় এবং যেখানে ধুলা আর জল জমা হয়।’
কুয়ো ইয়ু গ্রন্থে’র ‘চৌ-এর কালপঞ্জি’ অংশে বলা হয়েছে যে, ‘প্রাচীনকালে কুঙ কুঙ ন্যায়ের পথ ছেড়ে আনন্দ-উৎসব ও লাগামহীন লাম্পট্য ও উচ্ছৃংখল জীবন যাপনে গা ভাসিয়ে দেন। তিনি শত শত নদীর প্রবাহ থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন, চেষ্টা করেন পাহাড়-পর্বত ধ্বংস করে দেয়ার এবং নিম্ন অঞ্চলসমূহ কাদা-মাটিতে ভরাট করে ফেলা। এভাবে সমগ্র পৃথিবীতে তিনি এক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি স্বর্গের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হন। এমন কি জনগণও তার সমর্থনে এগিয়ে আসেননি। দুর্বিপাক আর সমস্যাবহুল ঘটনাবলী কুঙ কুঙ-এর ধ্বংস ডেকে আনে।’ প্রাচীনকালের এক বিশ্লেষক উই চাউ রাজপ্রাসাদের রাজন্য চিয়া অর্থাৎ পরবর্তী হান রাজতন্ত্রের চিয়া কুয়িকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘কুঙ কুঙ ছিলেন ফেইরি সম্রাটের বংশোদ্ভ‚ত কিয়াং গোত্রের একজন নৃপতি। সম্রাট চুয়ান সু’র ক্ষমতা যখন ক্ষীয়মাণ তখন তার অধীনস্থ অন্যান্য রাজন্যবর্গের উপর আক্রমণ চালাতে শুরু করেন এবং তিনি সিংহাসন দখলের জন্য কাও সিং-এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন।’
যুমা চেন তাঁর ঐতিহাসিক দলিল-এর সংযোজনী ‘তিন সম্রাটের বর্ষপঞ্জি’ অংশে বলেন যে, “সম্রাজ্ঞী নূউয়া’র রাজত্বের শেষ দিকে কুঙ কুঙ নামে এক নৃপতি নিজ ধন-ঐশ্বর্যের জোরে এবং কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা আরোপের মাধ্যমে প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে উঠেন। রাজা হিসেবে নয় বরং স্বৈরাচারী শাসক হিসেবেই তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি নিজে জলের প্রতিনিধি হিসেবে বনের প্রতিনিধি সম্রাজ্ঞী নূউয়া’র স্থলাভিষিক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। তিনি চুয়াং-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং পরাজিত হন। উন্মত্ততায় দিশেহারা হয়ে তিনি এক পর্যায়ে পুচৌশান পর্বত-গাত্রে প্রচণ্ড বেগে মাথা খুঁড়তে শুরু করেন। এর ফলে স্বর্গের খুঁটিগুলো ভেঙ্গে গিয়ে স্বর্গ-মর্ত্যরে বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়।
এগুলোই হলো লোকগীতিটির ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য। তবে আমি হুয়াই নু নান্-এর ভাষ্যটিকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি। এই ভাষ্যে কুঙ কুঙকে একজন বিজয়ী বীর হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। লক্ষ্য করুন— ‘উন্মত্ততায় দিশেহারা হয়ে কুঙ কুঙ প্রচণ্ড জোরে পুচৌশান পর্বতে ধাক্কা দেয়। ফলে স্বর্গের খুঁটিগুলো ভেঙ্গে পড়ে এবং স্বর্গ-মর্ত্যরে বিচ্ছিন্নতা ঘটে। এ সময় সূর্য, চন্দ্র এবং তারকারাজিকে দ্রুত সঞ্চারমান করে আকাশ উত্তর-পশ্চিম দিকে ধাবিত হয়। পৃথিবী দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হেলে যায় এবং সেখানে ধুলা আর জল জমা হয়।’ প্রশ্ন জাগে এই কর্মযজ্ঞ চালাতে গিয়ে কুঙ কুঙ কি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল? হুয়াই নান জু অবশ্য এই প্রশ্নে নীরব ছিলেন। তবে আমরা অনুমান করতে পছন্দ করি যে, কুঙ কুঙ ধ্বংস তো হনই নি বরং এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি বিজয়ী বীর হিসেবে আবির্ভূত হন।
[বাংলা ভাষান্তর: মুস্তাফা মজিদ]
মাও সে-তুঙ রচিত বিশেষ আলোচিত কবিতা ‘লং মার্চ’। এটি এখানে উদ্ধৃত হলো:
লং মার্চ
কিসের ভয়, সাহসী মন, লাল ফৌজের, লাফিয়ে হই পার
থাক না হাজার, অযুত বাধা, দীর্ঘ দূর যাত্রার।
হাজার পাহাড়, লক্ষ নদী, কিছুই নেই ভাবার,
শিখর পাঁচ, যেন বুঝি, ছোট্ট নদী ঢেউ বাহার।
উমুং পাহাড়, মাটির টিলা, সবুজ আহা, লাফিয়ে হই পার,
আকাশ ছোঁয়া, পাহাড় আগুন, আঘাত হানে, সোনালি স্রোত যার।
লোহার সাঁকো, তাতুর বুকে, হিমশীতল, পথেই হই পার,
তুষার ঝরে, নিযুত শিখর, রোদ ঝলমল, মিন পাহাড়।
লাফিয়ে পার, লালফৌজ, আহা, হাসির মেজাজ সবার।
[অনুবাদ: কমলেশ সেন]২২
এই কবিতাটি ১৯৩৫ সালে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি মিন্মান্ দখলের জন্য সাফল্যমণ্ডিত যুদ্ধের উপর লেখা হয়। ১৯৩৪ সালে ১৬ অক্টোবর লালফৌজ [Red Army] কিয়াংসির ঘাঁটি অঞ্চল থেকে যাত্রা শুরু করে এবং তারপর তারা একাদিক্রমে দশটি প্রদেশে যুদ্ধ চালায়। পঁচিশ হাজার লি [আট হাজার মাইল] ঐতিহাসিক পথ পরিক্রমার পর পরের বছর অক্টোবর মাসে লালফৌজ তাদের গন্তব্যস্থল শেনসিতে পৌঁছায়, এবং এখানে লালফৌজ জাপবিরোধী ঘাঁটি স্থাপন করে। এক লক্ষ মানুষের মধ্যে এই অভিযানের শেষে দশজনের একজন মাত্র বেঁচে ছিল।
এই পাহাড়গুলি চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হাতের পাঁচটি আঙুলের মতো ছড়িয়ে আছে। এই উচ্চ পর্বত শ্রেণী কিয়াইচাও এবং উইননান প্রদেশের সীমান্তকে পায়ের নিচে ধরে রেখেছে।
চীনদেশীয় নাম হলো চিন্ শা। ইউন্নানের নদী ইয়াংসী—তার ঊর্ধ্বাঞ্চল, এই অঞ্চলে নদী খুব দ্রুত বেগে প্রবাহিত হয়।
ইয়াংসীর শাখা নদীর নাম তাতু। সেই নদীর উপরে সেতু। ১৩টি লৌহ শৃঙ্খলের উপর আলগা পাটাতন দিয়ে তৈরি। দু’শ’ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট সেতুটির নিচে প্রবাহিত জলধারা দারুণ খরস্রোতা এবং বরফগলা জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার মতো ভীষণ ঠাণ্ডা। শত্রু সৈন্য দুর্ধর্ষ আক্রমণ চালিয়ে সেতুর অধিকাংশ দখল করে এবং সেতুটিকে বন্দুক দিয়ে ঘিরে রাখে। লং মার্চের সময় মাত্র চব্বিশজন স্বেচ্ছাসেবক প্রথম শত্রুর মুখোমুখি হয় এবং এক একে সেতুর শৃঙ্খলগুলি অধিকার করে।
সীমান্ত অঞ্চলের রফাচ্ছাদিত পর্বতমালা। এই পর্বতটি ছিল লং মার্চের শেষ বৃহত্তম বাধা। ১৪ সেপ্টেম্বর কিয়াইচাও [Kweichow] অঞ্চলের মিয়াও [Miao] উপজাতি বাহিনী দ্বারা এই সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আক্রান্ত ও বিধ্বস্ত হয়। নানারকম দুঃসাহসী অভিযান, আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর আনন্দ-বেদনার কাহিনী জড়িয়ে আছে এই লং মার্চে।
লং মার্চ কবিতা কবি বিষ্ণু দে’ও অনুবাদ করেছেন। বলা যায় মাওয়ের সর্বাধিক সংখ্যক কবিতা কবি বিষ্ণু দে অনুবাদ করেছেন। লং মার্চ নিয়ে অনুদিত কবিতার ভাষ্যে কবি বিষ্ণু দে বলেন যে, “কিয়াংসি অঞ্চলে কমিউনিস্ট তত্ত্ব প্রয়োগের ভুলে এবং চিয়াং কাইশেকের আক্রমণে লক্ষ লক্ষ লোকের অপরিসীম ক্ষয়ক্ষতির পরে চৌত্রিশের হেমন্তে এই দীর্ঘ অভিযানের শুরু। মাস তিনেক পরে কো এই চাউতে একচক্ষু গোঁড়া তাত্ত্বিকদের সরিয়ে মাও ৎসু তুঙ-কে নেতা মানা হ’ল। শুরু হলো পৃথিবীর মধ্যে অতুলনীয় সেই ডাকসাইটে দুর্গম জনপদ, জঙ্গল-পাহাড় নদীর উপর দিয়ে আট হাজার মাইলের অভিযান: দক্ষিণে, পশ্চিমে, তারপরে উত্তরে। গোটা আঠারো পর্বতমালা, চব্বিশটি মহানদী পার হয়ে, চিয়াং সরকারি ফৌজের সঙ্গে যুদ্ধ করে হারিয়ে, এড়িয়ে, দশজন জঙ্গী-সামন্তরাজাকে ল’ড়ে বাষট্টিটা শহর জয় করে ছ’টি আদিবাসী হিমঊষর জেলার মধ্য দিয়ে একেবারে পশ্চিমে নির্বাসিত প্রান্তর পেরিয়ে। অবিশ্বাস্য রকম বহু বীরত্বের কাহিনী এই অভিযানের ইতিহাস। যেমন, দুরন্ত ঠাণ্ডায় তাতু নদীর সাঁকোর ওদিকে শত্রæর গোলাবর্ষণের মধ্যে সাঁকো ঝোলানো শিকল হাতে-হাতে ধরে তিরিশজন স্বেচ্ছাসৈনিক নদী পার হয়ে মেশিনগানগুলো অধিকার করে সাঁকো খুলে দিলো লালফৌজকে। কমরেড মাও এক পদে বলেছেন উচাং অঞ্চলের গ্রীষ্মের কথা এবং তারপরের পদে বহু দূরে তাতু-তে ফৌজ পৌঁছল শীতের মুখে। শেষটা মোঙ্গল মরুভূমির প্রান্তে ঊষর পাহাড়ে ই-এনানে পৌঁছে অভিযান ক্ষান্ত। সারাপথ অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে চলল চাষীদের মধ্যে সংগঠন ও পৌঁছে তার বেতার সংযোগের জের। তারপরে ই-এনানে পৌঁছে ঘরবাড়িহীন প্রান্তর, পাহাড়ের গুহায় বারো বছর ধরে ফসল-ফল-ফলানো, জাপ-তাড়ানো প্রাত্যহিক বীরত্বের দীর্ঘ যুগ। আট লাইনের এই কবিতায় স্বয়ং ইতিহাসের নায়ক কবি যে প্রচণ্ড সঞ্চারী আবেগ সংযত করেছেন, তার উত্তেজনা অজ্ঞ অনুবাদকও বোধ করেছে। চীনাবাসীর কাছে এর পদে পদে বর্তমান বীরত্ব জড়িয়ে আছে চীনের প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে, মহাদেশের বিরাট ভ‚গোলের সঙ্গে। স্থান-নামের স্মৃতিমাহাত্ম্য, অনুষঙ্গের ঐশ্বর্য আরো তীব্র হয়ে ওঠে মিতভাষিতায়, ছন্দের নিয়মকাঠিন্যে, মিলের বন্ধনে, এমনকি, লালফৌজের লাল, প্রাচ্যদেশের লাল, ফুলফলের লাল, কৈশোর-যৌবনের স্বাস্থ্যের লাল। কম কথায় বড় অভিজ্ঞতার সমগ্রতার প্রকাশ, এই হল ধ্রুপদী কবি কমরেড মাও ৎসে-তুঙ-এর রীতি।”২৩
কবি সন্দীপ সেনগুপ্ত মাওয়ের নেতৃত্বে চীনা গণমুক্তি ফৌজের যে এই দীর্ঘ যাত্রা এবং আত্মত্যাগ ও বিজয়ের গাথা এবং মাওয়ের যুদ্ধকালীন কবিতা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, “একটা দেশ যখন শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদী বুনিয়াদকে ধ্বংস করবার জন্য তোলপাড়, যখন চিয়াং কাইশেকের জার্মান সেনাপতি উপদিষ্ট wall attack-এর মুখোমুখি হয়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম শ্রমিক-কৃষকের সামরিক অভিযান নদী-পর্বত-গিরিপথ সমাচ্ছন্ন আট হাজার মাইল পথ পশ্চাদপসরণে তৎপর—যে পশ্চাদপসরণ মূলত বিজয় অভিযান ভিন্ন কিছু নয়, যে বিজয় অভিযান শুরু হয়েছিল এক লাখ নর-নারীর বাহিনী নিয়ে এবং যার শেষে দেখা গেল অবশিষ্ট আছে মাত্র এক-দশমাংশ সেনানী, সেই অভিযানের পুরোভাগে থেকে অসহ্য দুর্দশা-অনাহার এবং বীভৎস অত্যাচারের বাস্তবতাকে সামনে রেখে মাইলের পর মাইল বরফাচ্ছাদিত বন্ধুর পর্বতমালা পদদলিত করে হাসিমুখে প্রাণ বলিদানের অঙ্গীকার নিয়ে ইতিহাসে এ ধরনের কাব্যসৃষ্টির কোনো দ্বিতীয় নজির নেই। একমাত্র সে-কারণেই মাও সে-তুঙের কবিতা বিশ্বের সাহিত্যসৃষ্টির ইতিহাসে বিশেষভাবে বিশেষ এবং চিরায়ত শিল্পসৃষ্টির ব্যাপারে উত্তেজনা ও কৌত‚হলোদ্দীপক গবেষণার বিষয়।”[...]২৩
মাও সে-তুঙ একজন খাঁটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী শিক্ষকই নন, তিনি মার্কসবাদ লেনিনবাদ-এর দর্শন—দ্বান্দ্বিক-বস্তুবাদ ও শ্রেণী-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ লড়াই শেষে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে দেশ থেকে হটিয়ে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন চীনে। তিনি বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের আদর্শবাদী একজন লড়াকু নেতাই নন, তিনি সংগ্রামী মানুষের কবিও। শুধু মাও সে-তুঙ-এর কবিতা নয়, যুগযুগ ধরে বিদেশীদের কাছে চীনা কবিতারও একটি ঐতিহ্যগত বিশেষ স্বাদ আছে।
আর চীনা কবিতা আমরা প্রধানত ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই পেয়েছি। বিদেশীদের সংগৃহীত ও অনূদিত এসব চীনা কবিতার মাধুর্য, রূপকল্প, কাঠামো ও বিষয়বস্তু মূলত একই ধরনের এবং সেই বিশেষ রূপকে কেন্দ্র করেই চীনা কবিতা সম্পর্কে আমাদের একটি নির্দিষ্ট ধরনের মানসিকতা গড়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মূল চৈনিক ভাষা থেকে প্রথম ইংরেজি এবং পরে বাংলায় রূপান্তরের ফলে স্বভাবতই মূল কবিতার সৌন্দর্য ও বক্তব্য অনেকাংশেই হ্রাস পায়। তাছাড়া, চিত্রকল্প, শব্দের বহুমাত্রিক প্রয়োগ ইত্যাদি হুবহু অন্য ভাষায় সঠিকভাবে প্রকাশ অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। তবুও বাংলায় রূপান্তরিত সৃজনশীল অনুবাদকদের আন্তরিকতার উপরই নির্ভরশীল হতে হয়।
এ কথা বলা প্রয়োজন যে, বাংলা ভাষায় অনুদিত চীনা কবিতা সরাসরি চীনা ভাষা থেকে খুব কমই অনুদিত হয়েছে। সাধারণত দ্বিতীয় মাধ্যম তথা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনূদিত হয়েছে। বেশির ভাগ কবিতাই গণপ্রজতন্ত্রী চীন থেকে প্রকাশিত Mao TseTung Poems নামে গ্রন্থিত ইংরেজি ভাষায় অনুদিত মাওয়ের কবিতা থেকেই কবিতাসমূহ অনুদিত হয়েছে। আর ওই ইংরেজি গ্রন্থে সর্বমোট কবিতা আছে একচল্লিশটি। তারমধ্যে পাঁচটি গীতিকবিতার উত্তরে মাও সে-তুঙ পাঁচটি পদ্য রচনা করেন।
ইতোপূর্বে বাংলা ভাষায় মাও-এর কবিতা সম্পর্কে আলোচনা ও মন্তব্য বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও পুস্তকে প্রকাশিত হয়েছে, বিশেষ করে ভারতের কলকাতা থেকে গত শতকের পঞ্চাশ দশকে প্রকাশিত বিষ্ণু দে’র বিদেশী ফুল ও ষাট দশকে প্রকাশিত সন্দীপ সেনগুপ্ত’র মাও সে-তুঙের কবিতা এবং গত ২০০১ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত আহমাদ কাফিল সম্পাদিত মাও সে-তুঙের কাব্যসমগ্র উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বক্ষ্যমাণ এই প্রবন্ধকারের সম্পাদিত কবিতাসমগ্র: মাও সে-তুঙ ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়। এ সকল পুস্তকে মাওয়ের উপর সম্পাদকীয়, ভূমিকা, মন্তব্য ও মতামত এবং নিবন্ধনসমূহ সংযোজিত হয়। যাতে পাঠকবৃন্দ মাও-এর কবিতা সম্পর্কে অন্তত কিছুটা হলেও একটি প্রাথমিক ধারণা লাভ করতে পারেন।
যাই হোক, বাংলা ভাষায় চীনের কবিতা বিশেষ করে চীনের গণমানুষের কবি মাও সে-তুঙ-এর কবিতার অনুবাদ অনেকেই করেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন। সবার শব্দচয়ন, বাক্যগঠন রীতি এক রকম হবে না। আর না হওয়াই স্বাভাবিক। তবুও মাও সে-তুঙ সহ চীনা কবিদের কবিতার অকৃত্রিম আস্বাদটি পুরো মাত্রায় যাতে পাঠকরা পেতে পারেন তারই চেষ্টা করেন সকল বিদেশী ভাষার অনুবাদকরাই।
তথ্য নির্দেশ
১. ফয়েজ আহমদ, ‘চীন: প্রাচীন ও আধুনিক কবি’, দেশান্তরের কবিতা, বাংলা একডেমি, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃ. ৫৫
২. ঐ, ‘ভূমিকা’, ১৯৯৩, পৃ. ৫৫
৩. ঐ, পৃ. ৬
৪. চিত্ত মণ্ডল “নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’র ভাষান্তর এবং তৎসংক্রান্ত জটিলতা”, ড. মুস্তাফা মজিদ, সম্পাদিত, অনীক, বিজ্ঞান-সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ৪র্থ বর্ষ, ১ম সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ ২০২৩, ১৫৩/৩ ক্রিসেন্ট রোড, ঢাকা-১২০৫
৫. কৌশিক বন্দোপাধ্যায়, প্রাচীন চীনা গীতিকবিতা, কলকাতা, ১৯৯০; উদ্ধৃত: আহমেদ কাফিল, মাও সে-তুঙের কাব্যসমগ্র, জোছনালো প্রকাশন, ১৬২ আরামবাগ, ঢাকা ২০০১
৬. ঐ
৭. ফয়েজ আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৬
৮. ঐ, পৃ. ৫৫-৬৮
৯. ঐ. পৃ. ৬৬
১০. ঐ. পৃ. ৫৫-৫৮
১১. মাও সে-তুঙ, ‘সাহিত্য ও শিল্পকলা সম্পর্কে ইয়েনানের আলোচনা সভায় প্রদত্ত ভাষণ’, মে, ১৯৪২, মাও সে-তুঙ সমগ্র, বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, পিকিং, ১৯৭৬
১২. Mao Tse-Tung Poems, Foreign Language Press, Peking 1976; উদ্ধৃত: সন্দীপ সেনগুপ্ত, অনুদিত, মাও সেতুঙের কবিতা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স, কলকাতা, কার্তিক, ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ
১৩. জর্জ টমসন-এর উদ্ধৃতি: [ভাষান্তর: জয়ন্ত চৌধুরী], আহমেদ কাফিল, প্রাগুক্ত এবং মুস্তাফা মজিদ, সম্পাদিত, কবিতাসমগ্র : মাও সে-তুঙ, উত্তরণ, বাংলাবাজার, ঢাকা, ২০০৯, পৃ, ৯৮-৯৯
১৪. বিষ্ণু দে, বিদেশী ফুল, কোলকাতা, ১৯৫৭; উদ্ধৃত, আহমেদ কাফিল, পূর্বোক্ত; এবং মুস্তাফা মজিদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০০-১০১
১৫. উদ্ধৃত: ঐ, পৃ. ১৭-১৮
১৬. উদ্ধৃত: ঐ, পৃ. ২০
১৭. সন্দীপ সেনগুপ্ত, প্রাগুক্ত; উদ্ধৃত: মুস্তাফা মজিদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৩
১৮. উদ্ধৃত: ঐ, পৃ. ২২
১৯. উদ্ধৃত: ঐ, পৃ. ২৪
২০. উদ্ধৃত: ঐ. পৃ. ৩৩
২১. মাওয়ের এ বর্ণনা Mao Tse-Tung Poems, Foreign Language Press, Peking 1970: পুস্তক থেকে অনুবাদ করেন মুস্তাফা মজিদ, উদ্ধৃত: ঐ, পৃ. ৩৩-৩৪
২২. উদ্ধৃত: মুস্তাফা মজিদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬
২৩. বিষ্ণু দে, প্রাগুক্ত, উদ্ধৃত: ঐ, পৃ. ১০০-১০২
২৪. সন্দীপ সেনগুপ্ত, প্রাগুক্ত, উদ্ধৃত: ঐ, পৃ. ১০৩
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন