চেয়ার চরিত

অ+ অ-

 

বুধবার সকাল

বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ মনে হলো আমি একটি চেয়ার হয়ে গেছি, বেশ সুন্দর গদিওয়ালা চেয়ার। আমার হালকা মেদযুক্ত ভুঁড়িটা হয়ে গেল চেয়ারের তুলতুলে গদি। আর সেই গদিতে এখন বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছেন আজাদ সাহেব। আগে উনি প্রায় সময় আসতেন, হুদাই আলাপ জমাতে চাইতেন। আমি কপাল কুঁচকে বিরক্তভাবে তাকিয়ে থাকতাম। কিছুক্ষণ  আশপাশে ঘুরঘুর করে অন্যত্র চলে যেতেন দাঁত খিলাল করতে করতে। আজ হঠাৎ আমার চেয়ার হয়ে যাবার খবরটা উনি কিভাবে যেন পেয়ে যান, জানি না, তবে এসেই অনুমতির অপেক্ষা না করে বসে পড়েন আমি নামক সদ্য নির্মিত গদিওয়ালা চেয়ারে।

 

সাতদিন পরে

আজাদ সাহেব বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছেন গদিতে, পা দোলাচ্ছেন, মুখে তার চেমনবাহার জর্দা দেয়া এক খিলি পান। বেশ আমুদে আলাপের কারণে মুখ থেকে একটু পানের পিক অসতর্কতা বশত তুলতুলে গদিতে পড়ে যায়। তিনি সেই রক্তের মতো লাল টকটকে রস গদিতেই মোছেন, তারপরে বাইশটি দাঁত বিকশিত করে হাসি দেন, বাকি দাঁতগুলো তার মাংসবহুল গালের পাশে চাপা পড়ে থাকে। আমিও হাসি দেয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু হঠাৎ আমিত্বের শক্ত ইমেজটা ভেঙে যাবার কারণে বিবেক নামক নরম থকথকে স্বচ্ছ অংশে পচন শুরু হয়। সেই পচনের দুর্গন্ধটা দাঁতের কোনায় কোনায় আটকে থাকায় ঠোঁট দুটো হালকা বিকশিত করি। ওটাকে মুচকি হাসি বলা হয়অনেক সময় সম্মতি বোঝাতে এই হাসি ব্যবহার করা হয়। ক্ষয়ে যাওয়া আদর্শের কিছু কিছু অংশ শিথিল না হওয়ায় আজাদ সাহেবকে কষে একটা চড় দিতে ইচ্ছে করে। হাত দুটো অসাড় হয়ে নীচের দিকে ঝুলে পড়ায় আমি আজাদ সাহেবের জামার কলারটা ধরতে পারি না। গদিতে লেগে থাকা রক্তাভ পিকটুকু আমাকে অবজ্ঞা করে।

ওদিকে অসাড় হাত দুটো পায়ের সঙ্গে ঠিকঠাক ব্যালেন্স রাখতে পারে না। আজাদ সাহেবের বসতে সমস্যা হয়, বিরক্ত হয়ে গদি ছেড়ে উঠে যেতে চায়। নতুন চেয়ার হওয়ায় ভেতরের তুলা, স্প্রিং, কাপড়ের ছোবড়াগুলোর সঙ্গে তেমন সন্ধি গড়ে তুলতে পারিনি। তাই তো চেয়ারটা আরামদায়ক মনে হয় না আজাদ সাহেবের। হাসিটা মলিন হয়ে এলে তার মুখটাকে ফণা তোলা সাপের মতো মনে হয়। আমি তোষামোদির বীণাকে বের করে তার সামনে নাগিনের মতো বীণ বাজানো শুরু করি। ফণা তোলা সাপ বীণের সুরের মূর্ছনায় যেমন একেবারে আহ্লাদী শিশুর মতো শুয়ে পড়ে, আজাদ সাহেব তেমন বাকবাণে মুগ্ধ হয়ে দাঁতগুলো বিকশিত করেন। প্রয়োজনের তুলনায় একটু স্বাস্থ্যের আধিক্যের কারণে আজাদ সাহেব পুরোপুরিভাবে ডুবে যান আমার তুলতুলে গদিতে। উঠতে চাইলেও উঠতে পারেন না। দুই একবার আমার আবেগ ও বিবেক মাথা চাড়া দেয়। চেয়ার হতে অস্বীকৃতি জানায়। তখনই আমার গুলশানে বুকিং দেয়া নতুন ফ্ল্যাটের কথা মনে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে গলার কিঞ্চিৎ প্রসারিত অংশ চেয়ারের পিছনের অংশ হয়ে যায়বেশ চওড়া। আজাদ সাহেব আরাম করে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়। প্রত্যাশা অনুযায়ী সবকিছুর আশ্বাস দিয়ে নতুন আশার আলো দেখিয়ে আজাদ সাহেবকে বিদায় দেই, আগামীকাল আসতে বলি।

আমার পাশের টেবিলের সোলায়মান সাহেব অনেক আগেই চেয়ার হয়ে গেছেন। চেয়ার হিসেবে তিনি অনেক মজবুত। তার চেয়ারটাকে আগলে রাখার জন্য অনেক ছোট ছোট চেয়ার আশপাশে অপেক্ষা করে। আজাদ সাহেব উঠে যাবার পরে সামাদ সাহেব, সামাদ সাহেবের পর হাশেম সাহেব আসেন, গল্প করেন। আমি স্কেল মেপে কথা বলি। আগে অবশ্য মশা ও মাছির সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ হতো, এখন ভীষণ ব্যস্ততায় মাছি মারা অপবাদটি আমার ঘুচে যায়।

এতোদিন নিতান্তই ম্যাংগো পিপল ছিলাম, কেউ চিনত না, পাত্তা তো দূরের বিষয়। জীব থেকে জড় পদার্থ হবার কারণে আজ আমার বেশ মূল্য। ভেতরে ভেতরে পুলকিত হই! আমাকে এখন কেউ কেউ আদর করে কেদারাও ডাকে। তবে সেটা কাল ভাদ্রে। ওটা যে অবজ্ঞার ডাক সেটা আমি বুঝতে পারি।

অফিস থেকে বের হয়ে এখন আর আমার ঝালুমুড়ি হতে হয় না, আগে সকাল ও বিকেল দুইবেলা মুড়ির টিনের ঝালমুড়ি হয়ে, ছোলা ও কাবলির সঙ্গে আদর সোহাগ মাখিয়ে, মাঝেমধ্যে কাঁচা মরিচের ঝাঁঝ সহ্য করে ব্যস্ত নগরের পথিক হয়ে মিশে যেতাম সুদূর মগ্নতায়, মাঝেমধ্যে বিরিয়ানির হতাম, তবে সেটা মাসের প্রথমদিনে, বেশি হলে বড়জোড় তিনদিন।

 

১০ বছর পরে

আমিও এখন মজবুত চেয়ার, আজাদ সাহেব এখন আমার গদিতেই বেশি বসতে পছন্দ করেন, যখন আসেন সরাসরি আমার গদিতে এসে বসেন, তারপরে আশপাশে নজর বুলিয়ে যান। তাই তো তিনি এলেই পাশের চেয়ারগুলো পায়া ফ্লোরের সঙ্গে ঝগড়া জুড়ে দেয়, শব্দদূষণ সহ্য করতে হয়। ওদিকে আজাদ সাহেব তার ফুলে ফেঁপে উঠা সম্পদকে সৌন্দর্যের খাঁচায় বন্দী করেছেন, ইংরেজিতে যাকে বলে ফার্ম হাউজ। সেই ফার্ম হাউজের কথা এখন সবার মুখে মুখে, এই সৌন্দর্যকে খাঁচায় বন্দী করতে আজাদ সাহেব ও আমাকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। কত নিয়মকে অনিয়ম, আবার কত অনিয়মকে নিয়ম করেছি এই ফার্ম হাউজের পিলারগুলোকে শক্ত করতে। এখন যদি কেউ এই ফার্ম হাউজের নির্মাণ ইতিহাস কষতে বসেন তাহলে আমি হয়তো চেয়ার থেকে টুল হয়ে যেতে পারি।

তবে সেই সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, এমনভাবে অভিনব কায়দায় সাজিয়েছি সবকিছু, চেয়ারের গদির তলে পড়ে নদী হয়েছে সরু খাল, খাল হয়েছে মেঠো পথ, আর ধানী জমির মাটি হয়েছে লালচে অনুর্বর জমি, সেখানে কোনো ফসল হয় না।

চেয়ার হবার পর থেকে মিস্ত্রিরা আমার আশপাশে ঘুরঘুর করেন। অপেক্ষা করেন কখন কি দরকার হয়। নাট-বল্টু, গদির রং সবকিছু ঠিকঠাক রাখার জন্য অনেক মিস্ত্রি চেয়ারের হাতলে ঝুলে থাকেন। আমি ঝুলিয়ে রাখি, যখন যাকে অপ্রয়োজনীয় মনে হয় সুতা কেটে ফেলে দেই। ১০ বছরে আমিও বিশাল উদ্যানসহ প্রাসাদ গড়ে তুলেছি। অফিসে চেয়ার হলেও সেখানে আমিই রাজা, রানী দুই রাজপুত্র ও এক রাজকন্যা নিয়ে সাজানো আমার প্রাসাদ। সন্তানদের সঙ্গে তেমন দেখা হয় না গদিতে তুলার ভারসাম্য, সাপ্লাই ঠিকঠাক রাখার জন্য। চেয়ার হবার পর থেকে আমি স্থির হয়ে গেলেও আমার রানী ঘূর্ণিঝড় হয়ে যায়, তার ঘূর্ণনে পড়ে অনেকেরই দিশাহারা অবস্থা, সন্তানরা মায়ের ঘূর্ণনের বাতাস পেয়ে অশান্ত হয়ে উঠেছেন। রানীকে প্রাসাদ সামলাতে হয়, সঙ্গে আধুনিক সমাজের রূপ, গন্ধ ও স্বাদ নিতে হয়। তবে এখন মাঝেমধ্যে আবারও সেই ঝালমুড়ি হতে মন চায়। পুরনো মানুষগুলোকে একসঙ্গে জড়ো করে কোথাও হারিয়ে যেতে মন চায় কিছু সময়ের জন্য, তবে একবার চেয়ার হয়ে গেলে কোথাও হারিয়ে যাওয়া উপায় থাকে না, অবশ্য আমি পুরোপুরিভাবে হারিয়ে গেলে আত্মীয়স্বজনরা বেশ খুশি হবেন, যেহেতু আমার প্রায় সম্পদের মালিকানার দলিল দূরসম্পর্কের আত্মীয় স্বজনের নামে।

আজকের সন্ধ্যাটা একটু অন্যরকম, সবার আর্কষণ আজ চন্দ্রবিন্দু ফার্ম হাউজ। আজ এখানে বর্ষবরণ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে, এই পার্টির বিশেষত্ব হলো, সবাইকে মুখোশ পরতে হবে, আজাদ সাহেব তার কিছু সুহৃদকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এই হাল আমালের মুখোশ পার্টিতে, সেখানে আমাদের মতো কিছু চেয়ারকে তার প্রয়োজন সুহৃদ বরদের বসতে দেয়ার জন্য। মহীরুহ, বৃক্ষের সঙ্গে সময় কাটাতে রাজি হয়ে যাই, এমন সুযোগ তো সবসময় আসবে না। তা ছাড়া আজাদ সাহেবের মতো আরো অনেক ভুড়িওয়ালা পানের পিক ছিটানো খদ্দরদের সন্ধান পাওয়া যাবে। তাদের আদর-যত্নে চেয়ার থেকে সিংহাসন হয়ে যেতে পারি। সবাই তো আশায় বাঁচে, তা সে মানুষ হোক বা চেয়ার হোক। ফার্ম হাউজে নেয়ার জন্য আমাদের সবাইকে বিশাল বড় একটা লরিতে তোলা হয়, মজবুত হবার কারণে আমাদের খাতির যত্ন একটু বেশি। আগেই খবর পাইআজ এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর পাখি আসবে। পাখিগুলোকে ছেড়ে দেয়া হবে। ফার্ম হাউজের উদ্যানে ছোটাছুটি করবে। মন চাইলে যে কেউ পাখি নিয়ে খেলাও করতে পারবে। পাখিরাও এসেছে খেলতে, আমি ঠিক করি আজ আমি পাখি নিয়ে খেলবো। পাখি যদি রাজি থাকে তাহলে খাঁচায় আটকে রাখবো, দরকার হলে শহরের সব দালান ভেঙে বন বানিয়ে ফেলবো, এমন একটা পাখির শখ যে আমার বহু দিনের, সমস্যা তৈরি করবে আমার প্রাসাদে পোষা বাজপাখি, তার কর্কশ গলা শুনে না জানি পাখি আবার উড়ে যায়।

আজাদ সাহেবের ভোজনশালা গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ডশত পদের আহার। কোনটা রেখে কোনটা খাবো। আমার আবার খিদে নেই। জড় পদার্থের খিদে লাগে না। তাদের তেল ও পলিশ দিলেই হয়। পলিশ দিলেই তারা চকচক করে। চারপাশে পাখিদের ছোটাছুটি দেখে ছোট, বড়, মাঝারি সব চেয়ারের মড়মড়ে ব্যথা শুরু হয়। আসলে ওই ব্যথা হলো চেয়ার থেকে পেরেক ছুটে যাওয়ার ব্যথা। পেরেকগুলো ফেলে আমি নীলকণ্ঠ চঞ্চলা পাখির পিছনে ছুটতে থাকি। আমাকে মোহিত করেআমি ছুটি। আমাকে ডাকেআমি ছুটি। সারা ফার্ম হাউজ আমি চষে বেড়াই, চঞ্চলা নীলকণ্ঠ পাখিকে তাড়া করি। বাঘের মুখোশ পরে আমি নীলকণ্ঠ পাখিকে এক থাবায় আটকে ফেলি।

রাত বাড়ে, আমার নেশা বাড়ে, আমি চেয়ার থেকে একটু একটু করে আবার মানুষ হয়ে উঠি। অনেক ছোটাছুটি পরে পাখিটাকে হাতের মুঠে নিয়ে খেলা করি। নরম তুলতুলে পাখি, যাকে শুধুই আদর করতে ইচ্ছে হয়। নেশার চোখে পাখিটাকে নিয়ে নিরালায় চলে যাই। শরীরের সঙ্গে শরীরের ভাব শুরু হয়। আমার আদুরে পাখিটা নেশায় বুদ হয়ে আছে। সেও বেহুঁশের মতো আমাকে কাছে চায়, কাছে গিয়ে আমার কেন যেন পাখিটা পরিচিত মনে হয়। মনে হয় কোথাও দেখেছি। কোথায় দেখেছি মনে পড়ে না। তখন আমি মনে করতে চাই না। প্রতিদিন আমার চেয়ারে কতজন বসতে আসেকেউ হাগে, কেউ পানের পিক ফেলে, কেউ থুতু ছিটায়। কিন্তু ভালোবাসার কথা কেউ বলে না। আমি আজ ভালোবাসা চাই। আমার হৃদয় বলে আদর কর, বিবেক বলে, না। হৃদয় ও বিবেকের হেড টেলের টসে হৃদয় জয়ী হয়, আমি অনেকদিন পরে নিজেকে সঁপে দেই গহীন কোন গহ্বরে, সব টেনশনকে মুক্তি দেই।

সূর্য আলো পর্দা ভেদ করে চন্দ্রবিন্দু ফার্ম হাউজে আমার জানালায় উঁকি দেয়, মেজাজ খারাপ হয় সূর্যের ওপরে! এতো তাড়াতাড়ি আমার জানালায় আলো ছড়ানোর কি দরকার ছিলো। আলোতে নেশার তাল কাটে আমার। আমি পাশে শুয়ে থাকা মেয়েটার চুলগুলো সরিয়ে দেই সজ্ঞানে ছুঁয়ে দেখার লোভ বা ইচ্ছে থেকে, আবারও ভালোবাসতে মন চায়। মুখটা দেখে আমি চিৎকার করে উঠি। আমার চিৎকারে সেও চিৎকার করে ওঠে।

তার ডাক আমার কানে আসে না। আমার মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। দিকশূন্য হয়ে ছুটতে থাকি। আজ সব পাপ ধুয়ে মুছে শুদ্ধ হতে হবে। সময় বড্ড অল্প।

আকাশে চকচকে নীলের মাঝে সাদা মেঘের ছোপ ছোপ আদর। দিগন্ত জোড়া পদ্মফুলের মেলা, পদ্মপাতার ওপর টলমল করছে পানি। দম বন্ধ হয়ে আসে, বিশাল পদ্মপুকুরে নিজেকে সঁপে দেই।

০২/০১/ সাল আজানা থাক।

একটি দৈনিক পত্রিকার দেশের খবর পাতায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, চন্দ্রবিন্দু ফার্ম হাউজের পদ্মপুকুরে থেকে এক কর্মকতার লাশ উদ্ধার। পিচ্ছিল সিঁড়িতে পা ফঁসকে পড়ে যান তিনি, ধারণা করা হচ্ছে মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।

অন্য একটি দৈনিক পত্রিকার পঞ্চম পাতায় ছোট একটা খবর প্রকাশিত হয়, পিতার শোক সামলাতে না পেয়ে ১৯ বছরের কিশোরীর আত্মহত্যা।

সেদিন দেশের সবগুলো দৈনিকের প্রথম পাতায়  বেশ  বড় হেডলাইন দিয়ে প্রকাশিত হয় বিখ্যাত এক নায়কের মৃত্যুর রহস্য উম্মোচন। ।

তাই তো পাঠকের সেই কৌতূহলি ঘ্রাণের নিচে চাপা পড়ে যায় মর্মান্তিক এই দুটো মৃত্যুর সংবাদ। কারো হয়তো চোখে পড়েছিল, কাজের তাড়ায় সময়টা সবারই বেশ স্বল্প ছিল।