গদ্য-বায়োপিক || দিঘলী

অ+ অ-

 

|| মায়ের পেটের আন্ডাগ্রাউন্ডে ||

এক ভাদ্রে আণ্ডা থেইকা জন্ম। তার ৫ সপ্তাহ পরে ব্যাঙাচির মতো লাফাচ্ছিলাম মায়ের পেটে। কার্তিকের শেষে তখনো আমার লেজ আছে, আর তা দিয়া জরায়ুর সাথে ঝুলে বাঁদরামি করি। মা তখন জেনে যায়, আমি তৈরি হচ্ছি পেটে।

*

জরায়ুর ভিতর পুকুরে ভেসে আছি। সাঁতার কাটি। মনে হয়,খেলতেছি বেহেশতের খেলা। শরীরে নাই ভার। নুনু বড় হয়ে গেছে, ঢেউয়ে লাগে সুড়সুড়ি। মা বলে, বুজিগো,প্যাডে একটা ফড়িং। শুনে ডিগবাজি খাই। উল্টা হয়ে থাকি।

একদিন মা বলে তার শইল্লে পানি আসছে। মাথাটা যে ঘোরে। পায়ে খিল ধরে। দুষ্টু মাটা পুতুলখেলা রেখে আমারে নিয়া কতরকম কাণ্ডই না করে!

*

|| পুকাই বেপারী ||

যে বাড়িতে আমার জন্ম তার কর্তার নাম পুকাই বেপারী। ওনার পদবী বেপারী, এই অঞ্চলের প্রায় সবার টাইটেল যেন এটা। ব্যবসায় থাকলেই বেপারী। উনি বিশাল দিঘলী বাজারের একজন হর্তাকর্তা। একজন ঘাট ডাককারী, গঞ্জের কর আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের প্রভু। আমার মায়ের নানা। দেখতে চিকন চাকন, মুখে ছাগলা দাড়ি। চঞ্চল তার চলাফেরা। যাই হোক, আমার জন্মের আগে থেকে উনি একধরনের প্লেবয় জীবন-যাপন করেছেন। গঞ্জের ঘাটে আসা নৌকা আর বিক্রি হওয়া শস্যাদির মাসুল সংগ্রহ করে তার ঘরে লোহার সিন্দুকে থরে-থরে টাকা-পয়সা। সারা বছর কর আদায় করে, নতুন বছরে আবার নিলামে ঘাট ডেকে চুক্তি নবায়ন করতে হয়। আমি একটু বড় হবার পর তার টাকা গুণে দেবার কামলা দেই। একদিকে সাজানো কাগজের টাকার বান্ডিল, অন্যদিকে ধাতুর মুদ্রা। সিন্দুকে লালসালু কাপড়ে মোড়ানো অনেকগুলি খাতা। বড় হয়ে বুঝেছি, সেসব হলো ময়মনসিংহের হাওর অঞ্চলে ধানের টাকা লগ্নি করার হিসাব। রায়তদের নামধাম।

*

দিঘলী বা লৌহজং বেশ প্রসিদ্ধ জায়গা। কলকাতার সাথে সহজ যোগাযোগ। নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা স্টিমারে তারাপাশায় উঠে ভোরে গোয়ালন্দ ঘাট, সেখান থেকে রেলে দুপুর নাগাদ শিয়ালদা। দিঘলীতেই আছে প্রসিদ্ধ পতিতালয়। গঞ্জ বলে কথা! যৌবনেই তরুণ কর-আদায়কারী বখে গিয়েছিলেন। নামকরা বেপারীর পারিবারিক ঘরানা থেকে পুকাই বেপারীর আসল নাম সেই কবে হারায়ে গেছিল! এখন রয়েছে শুধু তার নিঃসঙ্গ ঠাঁটবাট। পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে দিয়ে বৌকে নিয়া আলাদা বাড়িতে থাকেন। কিন্তু বৌটানাম তার আমিরন, শে বাজা। মানে তার সন্তান হয় না। আমিরনের বড় বোন মারা গেলে তার যমজ ছেলেমেয়েরে পালক নিয়ে আসছেন বেপারীর সংসারে। নিঃসন্তান পুকাই পরিবারে আমিরনের কোলে বড় হয়েছে আমার নানি রোকেয়া বা রুকি। রুকিরে বিয়া দিছেন মজিবরের সাথে।

মজিবর ছিল তার গদিঘরের সরকার। ৫০ টাকা বেতন। সৎ ও কর্মঠ, স্বভাব-চরিত্রে খুব ভালো। ভালো পাত্র দেখে রুকিরে বিয়া দিলেন। জামাইয়ের বাবার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের কাজির কসবা-রামপালের সিপাইপাড়া। আকন বা আখন্দ বংশএদের পূর্বপুরুষ নাকি একসময় ফার্সি শিখাইতো। রামপাল হলো পালযুগের বিক্রমপুরের রাজধানী। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের বাড়ির কাছে বাড়ি। বল্লাল সেনের পালায়ে আসা বিক্রমপুর। সেই হিসেবে আমার রক্তে বৌদ্ধ-হিন্দু-সুলতানি প্রভাব বয়ে যায় বলা যায়। রুকির বড় মেয়ে হচ্ছে আমার মা সুরাইয়া বা সুরি। বেপারীর নয়নের মনি।

*

|| সুরাইয়ার শৈশবকাল ||

আষাঢ়ের আগেই জোয়ার চলে আসে। হুড়হুড় করে ভরে যায় সব কিছু... মায়ের কিশোরী দেহে পদ্মার ঘোলা পানি... পাটক্ষেত হাঁটুতক ভরে ওঠে একরাতেই। ঘোলাপানির সাথে ছাডা ইচা! পাটের শিকড় কামড়াইয়া ঝুলতেছে ইয়া বড় শাদা-শাদা ইচা। বাড়ি থেকে খালুই আনবে কী, তার আগেই হাত ভরে যায়। খুশিতে চেঁচাইয়া জানান দেয় সবাইরে তার এই কথা। কিশোরী সুরি, ফুরফুরে প্রায় বালেগ। হাফপ্যান্ট পরে সারাদিন মাস্তানি করে বাড়ির আনাচে-কানাচে। গাছে উঠে বরই পাড়ে, ছিটকি বনে পাখির ডিম খুঁজতে যায়। পকেটভর্তি কুল-বরই নিয়া বাড়ির উঠান থেকে কোলা পর্যন্ত খেলাধূলা করে। পাটায় ছেইচা বরই ভর্তা করে। আমগাছে ঢিল দিতে ওস্তাদ। পুষ্কুনিতে নাইমা একডুবে মাঝপুকুরে। একলা সাঁতার কাটে। ঘাট থেকে ধরে নিয়ে আসা হাঁসের বাচ্চা পকেটে নিয়া উঁকি দেয় ডিমপাড়া মুরগির খোঁয়ারে। পকেটে থাকে সেই বাচ্চা, তারপর ভুলে যায়। বিকালে যখন মনে হয়, তখন সেটা ইন্তেকাল করছে। সারা সন্ধ্যা কানতে কানতে চোখ ফুলাইয়া ঘুমাইয়া যায় না-খাইয়া।

*

|| পুকাই বেপারীর বাড়ি ||

তোলা আদায়কারীর বাড়িতে প্রায় প্রতি শীতে আমরা আসি। তবে ২/৩ বছর পরপর আমাদের একটা করে নতুন ভাই হবার সময় অবশ্যই আসা হয়, সেটা শীত-বর্ষা যখনই হোক। এই বাড়ি থেকে দাদার বাড়ি বেজগাঁও কয়েকটা চক দূরে, হাঁটতে-হাঁটতে যাওয়া যায়।

বাড়ির একধারে ছোট্ট একটা জঙ্গল। উঠানে শাদা ধূলা-ধূলা পলিমাটি, জোরে হাঁটলে পায়ের পাতার দাগ পড়ে। সামান্য একটু বিষ্টি হলেই উঠানে জমে পানি। কিছুক্ষণ থাকে থৈ-থৈ। তখন আমরা শিশুরা টলোমলো পায়ে পানিতে নামার জন্য অস্থির। কয়েকটা বড়-বড় গাছ তাকে পাহারায়। বেতের ঝোপে কাঁটাঅলা লতায় চিকন পাতা। থোকা-থোকা বেত্তুন। খোসা ছাড়ালে ভিতরে শক্ত বিচি, কৌটা ঝাঁকায়ে লবণ মাখায়ে ভত্তা খাওয়া হয়।

উঠানের আরেক পাশে মান্দার গাছ। বড় গাছটা আমার জন্মের আগের দিন ঝড়ে পড়ে গেছে। শুয়ে থাকা সেই গাছটার ঠাইল গজায়া নতুন মাথা হৈছে। মান্দার ঠাইলে নাটবল্টুর মতো কাঁটা। চোকখা কাঁটায় ধার কম, গাছ জুইড়া থাকে, তবে গাছে ওঠা যায় না। ঘুড্ডি উইড়া গেলে ফেরত আনা যায় না, আটকাইয়া থাকে।

মান্দারের পাশে জংলি আইট্টা কলার ঝোপ। গাছগুলারে কেউ যত্ন করে না। তার বিরাট-বিরাট পাতা, অনেক উঁচুতে ছোট্ট একটা ফানা, তাতে অল্প কিছু কলা। ফানার মাথায় শুকনা ফুল। নারকেলের মতো মোচা ঝুলতেছে। ঘন পাতার ভিতরে দেখা যায় কি যায় না। কাছে গিয়া দেখি, একটা ঘুঘু সেখানে বাসা বান্ধছে। কেউ দেখলে বলে, কাছে যাইস না, সাপ আছে। কিন্তু ঝোপজঙ্গল আমার টান। পাশের বাড়ির সীমানায় পাকিস্তানি লতা। লতার ফাঁকে হলুদ-শাদা বুটিবুটি ফুল। কোনোটা ফুটতেছে, কোনোটা ঘুমায়া আছে।

বাড়ির পশ্চিমে ছিটকি বন। ছিটকি ডালে দাঁত মাজার ব্রাশ বানাই। হালকা চাপ দিলেই মট করে ডাল ভাইঙা যায়। অ্যাটাক করে ডাল ভাঙি। ফাঁকে-ফাঁকে তোকমা গাছ। তোকমা দানার কুচকানো পাতায় বেগুনি রঙের ছোট ছোট ফুল। অবিকল তুলসির মতো ছোট এই গাছে সবুজ রঙের শিম। ফল পাকলে কালো হয়। পানিতে ভিজালে বীজগুলি বড় হয়ে পিছলা দানা হয়। ইফতারের শরবতে লাগে। ফোঁড়ার ওপর তোকমা লাগালে ফোঁড়া ফাটে। মাঝে কয়েকটা সৃষ্টিগাছ। লম্বা চিকন গাছগুলিরে দেখলে হাসি পায়। কেউ তাদের পাত্তা দেয় না। বছর-বছর বড় হয় শুধু। আমার জন্মের সময় যেগুলি ছোট ছিল, এখন তা নানার চাইতে বড় হৈয়া গেছে।

বাড়ির উত্তরে আর পূবে কোলা। সেখানে জ্যৈষ্ঠ মাসে অল্প কিছু পাটের চাষ করে। লেদু তা দিয়া বাড়ির কাজের দড়ি বানায়ে বাঁধাছাদার কাজে লাগায়। আষাঢ় মাসের ঢল পানিতে সব ডুবে যায়। তখন অনেক বাড়ির উঠানে পানি ওঠে। এই বাড়ি উঁচা, পানি ওঠে না।

নোট: কবি ও কথা সাহিত্যিক কাজল শাহনেওয়াজের লেখাটি নেওয়া হয়েছে গদ্য-বায়োপিক দিঘলী থেকে। বইটি প্রকাশ করেছে বৈভব। বইটি মেলায় পাওয়া যাচ্ছে।