জীবন চেনা যায় না ও অন্যান্য কবিতা
মরমপুরে
তোমাকে গিঁট দিয়ে রেখেছি সুরের সরোদে
এ-ও সারল্য আমার।
সম্ভাব্য গোধূলি নাক ফুল হয়ে আমাকে রেখেছে স্থির
যেন অনাসক্ত, পরীক্ষাপাশের শ্রুতি ও লিপিকা
রেখে দূরে বনের সন্তের মতো শঙ্কাহীন
ভাষাকবুতর হয়ে নিজের দিকেই উড়ছি।
এ সমাজ, মজলিস অনাত্মীয় নয়।
তবু, প্রান্তরের পাখি থেকে দূরে
গজলের স্থিরতায় বসে আছি
মরমপুষ্পের নিচে
ছড়িয়ে রেখেছি হৃদয়বোধের অচিনমাণিক্য।
মানুষের যাতায়াত ছাড়াও এখানে
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মাটি, ঋতু, শিমুল ফুলের চিতা।
খোলস খুলতে থাকা নদী স্বভাবত দূরে চলে যায়।
কবি
সমাজ যেখানে মৃত ইলিশের চোখ
সেখানে কবি হয়তো শহরের ছোট্ট ল্যাম্প
স্টেশনের পলাশ-শিমুল।
বসুন্ধরার কিরণে
মানুষের লাভালাভে
ব্রহ্মপুত্রের তাগড়া স্রোত হারিয়ে গেলেও
কবি কিছু দেখে, আঁকে , লিখে
বুকের খননে লেখা আছে আত্মবাস।
কবিকে গ্রেফতার করে কি লাভ!
কবি হলো খেলার মাঠের প্রজাপতি!
পরশ
হলে হলো, না হলে নাই
প্রকৃতির হাসি ছুঁয়ে কাঁদতে নাই।
দুঃখের কি বীজ আছে
না হলে কেন সে ফিরে পুরনো ডেরায়!
ওরসের প্রেমপাখি তসবি দানায়
জিকিরে জিকিরে কেঁদে নিজেকে জানায়।
যে যাকে উজাড় করে শোনায় সে গান
আলিফের পাশে মিম পেয়েছে সম্মান।
জমিনের দেখাদেখি এই শরীর ছেদন
মাজারের ফ্লোরে দিল করে সমর্পণ।
সুখ-অসুখের জলাভূমি দ্বন্দ্ব-সংহারে
জিজ্ঞাসার পাখি রাখে গলা বের করে।
কান্নাও মোহিনী হয়ে গোলাকার হবে
পূর্ণিমার জমায়েতে জাত ভেসে যাবে।
নিজেকে দেখার এই বার্ষিক ওরস
কে-বা আমি, কে-বা তুমি, জাপটে ধরেছি
প্রেমের পরশ।
মাহফিলে রাত বাড়ে ছোট হয় মন
পুবাকাশে দেখা দেয় সূর্যের শমন।
একটা মুখের থাকে অনেক সে মুখ
কথা বলা, না-বলার অসুখ-বিসুখ।
ডাক দেয়
জলের উপরে অপরূপ জল
মর্ম দীঘিটার ভাসা অন্তস্থল।
সাঁকো পেরুলেই মন ভাবুকের বহুরূপি দেশ
কর্দম খালের ওই পাড়ে ভাঙা ভাবের প্রদেশ।
এড়াতে চেয়েছি দিন-দুনিয়ার মোহ-পার্শ্বধ্বনি
নদীর কিনারে রাখা আছে সাধু তোমার তরণী।
মাটিতে দাঁড়ালে ডাক দেয় মাটি
আমি হবো রাধা কৃষ্ণের দোপাটি।
নুন বিনা দেখ আদর জমে না।
ভাদ্রে খালি পেটে ভাবনা নামে না।
জলের উপরে সাধু হইয়াছি দ্বিগুণ চৌচির।
গরম ভাতের গরম দিলটা হয়েছে অস্থির।
পৈত্রিক মন্দিরে মর্ম দীঘিটায় ভাসতে চেয়েছি
এই দেখ সাধু সমস্ত শরীর ধুইয়ে এসেছি।
শাপলা ফুলের চারপাশ ঘুরে লুকিয়ে রয়েছি
জলের উপরে সাধুর অন্তরে ভাসতে চেয়েছি।
উপস্থিতি
আমার কবরেও থাকবে বৃষ্টি
জলপাই ফুলের আদর।
বাতাবি ফুলের নির্জনতা
চিনিয়ে-জানিয়ে মুর্শিদ আসবে।
ঘাটে নাও বেঁধে
তুমি এসো একদিন।
নদীর রোমাঞ্চে
ছিন্ন বকুলের গন্ধ রেখে যেও।
পথ
এই পথ কি ইতিহাসের আমের মুকুল!
যেতে যেতে এই পথও কি
পালবাড়ির মূর্তির মতো ক্ষয়ে যায়!
মানুষ যে বলে নাটমন্দিরের গাত্রে গাত্রে
যুগলেরা থাকে যুগ যুগান্তর!
কেন বলে? এ-ও আত্মবাসনার সমর্থন!
শুধু কি থাকার আকুতিতে
বিবর্ণ হয়েছে গৃহস্থ বাড়ির লেবুর বাগান!
এই ভিড় মুখরিত শাব্দিক পৃথিবী থেকে
শয়ন কক্ষের অবিরত দুঃখ রেখে
বন্ধু, পথে নেমে আয়।
এই স্তব্ধ, অবরুদ্ধ শতাব্দীতে
যাওয়াকে জাগ্রত রেখেছে একেকটা পথ।
মানুষের
সূর্য ও ছুটির ঘণ্টা বার বার বাজে।
ছয় মাস বিশ্রামের পর
উঠানে এসেছে গন্ধরাজ।
জেল কয়েদির ছুটি মঞ্জুর হলে
ওরা যাবে আমের মুকুলে
নিজের উঠোনে।
জীবনে সবাই ছুটি পাবে!
সিরিয়ার নিষ্পাপ শিশুরা
চেরি ফুলের মতো হাসছে।
শীতের আনন্দ দেখার আশায়
বসন্তের গন্ধ শুকে দেখার আশায়
ওরা, পুতিনের কাছে ছয় মাস ছুটি চাইছে।
ষাটোর্ধ পুতিন শালা বহুত হারামি
ওর ওভারকোটে মটার সেলের স্রোত।
মাইন ও কামান ব্যাবসায়ী পুতিন কাউকে ছুটি দিতে জানেন না।
ভলগা নদীর তীরে
পুতিন নামের দানবেরা
নারী নয়, শিশু নয়, মুসলমান নয়,
মানুষের কবর খুঁড়ছে।
জীবন চেনা যায় না
জমিন দেখা মানুষ
শোয়েছে রেল লাইনে।
ভজন দা রিপোর্ট লিখছে
কল্লাটা বিচ্ছিন্ন। স্লিপারে স্লিপারে রক্ত।
কুয়াশা ভঙ্গিত নারী। চরণে নূপুর।
স্টেশনের কয়েকটা কাক
বালক বন্ধুর মতো
বিচ্ছিন্ন খুলিকে ঘুরে ঘুরে দেখে।
দারোগা-পুলিশ যে কোন চক্ষুকে অবিশ্বাস করে।
উলটে -পালটে নির্ধারণ করে
লোকটার রক্ত কতটা অবৈধ
শরীরে কয়টা তিল।
হাতদুটি কী চাইতো!
গর্দান থেকে কল্লাটা
ঠিক কত ফুট দূরে,
আর তাল গাছ দেখা কোন গ্রামটার নাগরিক।
ভিড়ের ভেতরে
জগত দেখা দার্শনিকেরা বলে,
ঔষধ ভর্তি ফার্মিসি
টিউব লাইটের আলো
কোন রাত পরির বিছানা ও বালিশ
রেল লাইনে শোয়ার বেদনাকে থামাতে পারে না।
নাস্তার টেবিলে একটা জানালা
এই দৃশ্য উন্মোচন করে।
ভজন দার রিপর্টো উর্ধমুখী।
কল্লা সেলাইয়ের আগে-পরে
মাতাল ডোমকে কোন দিন
স্বাভাবিক দেখেনি জনতা।
পৃথিবী সেলাই করা খুব কষ্ট।
উৎসর্গ
কবি রানা নাগ
কবি রুবাইয়াৎ আহমেদ
[এই উৎসর্গের কথা রানা দা জানতেন। বন্ধু রুবাইকে তিনি খুব ভালবাসতেন। তারা দুই ভাই, মগরার তীরে জন্মকান্না শুনে পৃথিবীতে এসেছেন।]
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন