আহাজারি ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-

 

আহাজারি

গরুর জন্য ঘাসের জোগাড় আমার একখান কাজ
বিকাল বেলা নরম রোদে কাচি দিয়া কাটি।
মায়ের পেট আর ধানরঙ কেমন মাখামাখি
আইলের উপর শুই রই পিঠের চামড়ায় পড়ে ভাজ।

প্রজাপতির ডানায় চড়ার না পারোনের ক্ষোভ
ছিল এক কালে, এসব পুরানা কথার নাই কোনো দাম
থাক, থাক আরও, ডাকত আমারে বোয়াল ডাঙার মাঠ
তারা জানত আমার একটা ছিল ভালা নাম।

অন্য গ্রামে ছিলাম আমি এই গ্রামের ন কেউ
এই গ্রামেতে আসছি কার গলা ধাক্কা খাই?
এখন দেখি ভালোই  হইল কদম তলার ঘাট
ডাকে আমায় নানির মতো, তার কাছেতে যাই

কোন আনন্দে মাতি আমি আমার নাম নাই
কেনে তবু লাগে ভালো বাঁশ বনে নাই বক
বকের সাদা পূরণ করে জঙ্গলের ভাট ফুল
মাছরাঙার হারানো রঙে হইছিনি মশগুল!

শীত রাতরে অন্ধকারে বাসছি কত ভালো
খড়ের চালে শুনছি কান পাতি কত ডানার স্বর
নতুন প্যাঁচা কান্দে জড়ায় পুরানা প্যাঁচারে ধরি
বুঝছি তহন শীত রাতটা বড়ই মনোহর।

দেখছি আমি জোছনা পরা বুনা হাঁস আর 
শিকারী আর গুলির আঘাত মাছরাঙা ঘাস
রক্তে ভিজা বট ফল আর বেতের বাগান যত
বলে, রইদ, কুয়াশায় গড়বা হ্যানে আবাস!

আমার খোঁজে আসে নাই কেউ নাই তো আমার ভিটে
মাছের ডুবে ছড়াই পড়া তুচ্ছ কোনো ঢেউ
মিলায়ে যাওয়ার পর করে না ভাসি উঠার দাবি...
সময়ই ইনি দেয়াল তোলেন কুসুমে ও কীটে।

খেত কোপানো, খেত বানানো, পানের বরজ দেখা
সোঁদালি বনের পাখির নাচন আমায় যখন ডাকে
কুঁচ ঝোপের টুনির কোদন শান্ত কোনো ফাঁকে
দেখিয়া লই, চিলের রোদন, যখন আমি, একা

কড়ই গাছে জৈষ্ঠ মাসে রুটি রঙা ফল
বিলের জলে চান্দা মাছের ঝিলিক দেয়া পেট
থোকা থোকা বুনা জামে হইছি বিহ্বল
কাঠঠোকরার ঠোকরগুলা ছিল বা সংকেত

বুঝছি কি আর, কাকের গলার মার খাওয়া রঙ 
বকুল তলার পালানো দুপার, কেউ আসি বল
হলুদ পাতা ঢাকে ক্যানে সবুজ পাতার টঙ!
কে কোনদিন পাইছে নাকি থির স্ব আদল!

মাঠের পারের দূরের পথটা হারাই গেছে কনে
গুলঞ্চ লতা জড়াই ধরা জগডুমুরের ডাল 
চড়াই পাখির দোল খাওয়াতে আরও একটু ঝোলে
স্বপ্নে দোলা বাকি থাকে পাখিটার সকাল!

অন্য গ্রামে ছিলাম আমি এই গ্রামের ন কেউ
এই গেরামে কুড়াইতে আসছি ময়ূরের পালক
এই বছরে হিজল গাছেরে জিগাস কর কেউ 
ফুল আকারে ফুটবো কিনা জানার আমার শখ।

অন্য গ্রামে ছিলাম আমি এই গ্রামের ন কেউ!

উড়াল কবিতা


কোকিলের ডাকের আগের বা পরেতে 
হইলদা পাতাগুলিন দলবান্ধি ঝরতে চাচ্ছে।
নিচে কার কার কোলে গিয়া পড়ে!
সে দিকে তাকাইলে
আরেকটা দৃশ্য পুরা হইবে।


এত দূর আসি গাড়িরতে নামি
সিগারেট টানতে বিলের কিনারে
উনিশটা হাঁস ভাসতেছে যেন কয়শ বছর ধরি
হাঁসের ডানার ঝাপটা, ল্যাজের লাড়ানি,
বিলেরই শোভার অংশ হিসাবেই দেখতেছি না তো!


বসন্ত বাওরি অশথের ডালে
অনাগত ফুল শুকে আর
অবিরাম ডাকি ডাকি কোনো অভিযোগ তুলি
অনুতাপহীন দুপারের রোদরে কেবলি
ক্লান্ত করতেছে!


জানালার পাশে জিয়ল গাছে টুনটুনি 
আর কাক কী কী খুজে!
আমি কাকদের ফেলিয়া টুনটুনির লড়চড় দেখতেছি
তার থাকি মিহি কোনো গান শুনিবার মতলব
আছে নাকি আমার আবার!


বহুত সময় যেনবা আমার আছে!
কদম ডালেতে একটানা শুই আছি 
আমার দুপার বেলা 
বিকাল বেলারা
মেগ হইতে উড়ি উড়ি মরা শিশুর মতন
যেন আর বাহাদুরি করতে নাই আসে!


কদমছাট ঐ যে পাতা খসা দেবদারু
আমলকী কিশলয় রঙ বদলের ফজিলতে
সবুজ সবুজ জামা গায় 
যেন একজন দস্তুর সবুজ মওলানা
দখিন হাওয়ারে বরণ করতে 
দাড়াই তরুণ তাজপরা লালেলাল পলাশমান্দার 
অদের ডালেতে শালিকের হইচই আজ আর গোনায় ধরবো না!
 


আজ সারাদিন বকুল তলেতে বসি
বকুল ফুলের ঝরা দেখতে দেখতে
আমি হইছি এক বকুলফুলের গাছ।
গা্ছই যন হইছি
বাবা আমি 
আমার কষ্টের কোনো ফোটা ফুল ঝরতেই দিব না!


গায়ে পড়ি আজ আমি সব 
ছায়ারে জড়ায়ে ধরুম রে! 
কিসের আমোদে
ফুল হইতে আসি আমি
ফল হইতে আসি
শিকড় না হই ক্যানে
গাছের উড়াল পক্ষী হইলাম রে!


গৃহের অন্তরে একটা দিন ছিল ভাবের আটক
শুধু একবার গোত্তা খাইতে চাইলো 
সে নাগেশ্বরের সাদা ফুলে!
তারপর ফের খোলা কপাটের ঘরের ভিতর
আসি চুপ মারি রইল
তারে আমি বলি, কহু ও কেকা আমার,
ও আমার একটা দিন
তুমারে জড়ায়ে ধরি একবার!

১০
শেকলছিড়া পাগল
আমার কাছে আসছে!
আমি কী ওর 
আপন, বসন্তকাল?

আমার দোলখেলা

বাঁশঝাড়ে দোল দিতাম আমি।
এক ঝুলে দোল দিই আকাশের দিকে উঠি
আবার নামতাম নিচে। এই ভাবে বহুবার।
এর মাঝে কত দৃশ্যের নিচে তলায়ে
আবার জাগি উঠতাম-
এইগুলাও দেখার এক প্রকার অংশ!

নিমগাছে অন্ধকার কাঁপতো
অনেক উপার হইতে দেখতে পাইতাম!

আমাদের বাড়ির সামনে দিয়া যাইতো
ভোরে দূর স্কুলে সাইকেলে ৫টা বালক
ওরা কী নিয়া কথা কইতো শোনা যাইত না!

একদল ছাতারের কাইজ্যা শুনতাম
ঐ বাঁশঝাড়ে!

কলাবনের মধ্যে জাগি থাকা টগরের কিছু চাহনি
সন্ধ্যার মধ্যেও তাকায় থাকত
যেন কেহ তাদের খোঁজ নেয় শেষমেশ!

দেয়ালের উপারে রোদঝোলা আম
তারাও আছে!

শিমুল তুলার সাদা আহত দশা
মাটিতে শুকনা পাতার কোলে!

পান্ডুরঙা করমচা মার কানের হারানো দুলের মতো দুলত যারা
ফটিক জলের হৈলদা রঙের মতো একা
সেই গাছটাও আমারে ডাকত
যেন তার ডালে দোল খেলি!

দিনে রাতে ধীরে বাড়ে যেইগুলা সুখি দম্পতির মতো
আব্বার লেবু-বনে কাঁঠাল বিয়ানো কাঁঠাল তাদের
যেন কাছে চলি যাইতাম এক একবার!

টুনিদের পুকুর পাড়ের তেঁতুল গাছে বাসায়
ঝুট শালিকের আনচান বাচ্চাদের এট্টু এট্টু দেখা যাইত!
সন্ধ্যার আগে
আমি একজন মুসাফির যেন আর শেষ কয়েকটা
ঝুল শেষ হইলেই মাথা ঘুরত
দেখা দৃশ্যগুলা
রঙের আধারিতে নিঃস্ব হই যাইত।
রূপবানের সব নাচ
যেন আমার দোল খেলানির সাথেই শেষ হয়া যাইত!

পলাতক


ঘরের ভিতরে কেউ একজন ভিন্নতর আছে
না হয় আমরা অভিনীত হইতে যাবো কেনে,
নইলে কেনে কেউ এর চারপাশে একবার ফুল 
একবার কেউ কাঁটা হই ফুটি কেনে!


আমি অন্য রকমের কুয়াশা মাখছি গায়
মাড়ায়ে আসছি ঘাস
তোমরা এটুকু বিশ্বাস করলেই হবে!


তোমরা বিশ্বাস কর
এইখানে ভীষণ ছিলাম আমি 
পথগুলি গেছে মুছি
নইলে পাইতা করুণ পায়ের ছাপ
কোনো এক পাতার গোপন তলে!

একটা হাঁসের চোখে

অনেক হাঁসেরা ছিল তার পাশে। বিলের কিনারে।
সবাই ছাড়িয়া গেছে তারে।
একা তাও দেয় একারে সে তার ডিমে যেন 
সফেদা গাছের তলে।
সে এখন চোখ বুজি আছে।
অপেক্ষা করতেছে আরেকটা দিন রাত বছর আসুক, 
যাক চলি যাক, সবাই চলিয়া যায় যেইদিকে।
একা রহি যাবে একা সেই একজন 
জলের কিনারে, শুক্না পাতাও ঘাসের মধ্যে।
কত কত রোদ ছায়া মেঘ শিশিরের জামানা গড়ায়ে যায়
সে পাখনা ঝাড়তে চায় না আর।
পাখনা ঝাড়ান আর লহমা ছিটানো একই কথা।
সে সঙ্গী হাসেরে দেখে, তারা ভাসে, 
গুগলি টোকায়, ডিম পাড়ে পাড়ে,
পালক শুকায় বিলের বাতাসে
সে ঝাড়ে না ডানা তাই।
কেউ তারে দেখতে পায় না আর।
কোনো যাতনাই আর লাগুড় পায় না হাঁসটিরে।
একথা লিখতে আমি চাই নাই, তবু লিখি রাখি।