ডাইনী যুগের ছিন্ন ডায়েরি

|| ১ ||
জায়গাটার নাম: মহাখালি; শব্দান্তরে বলা যায় মহাশূন্য; এর বেশি তেমন কিছুই ভেবে দেখিনি; কিংবা বিশ্বনাথ জায়গাটা দেখতে কেমন, কোনো অবসরে, ইমাজিনেশানেও আনিনি; অথবা সেখানে যে মায়ের নাম সূর্যবান বিবি, তাঁর সস্নেহ চোখ প্রতীক্ষা নিয়ে প্রহর গুণতে গুণতে কতটা ঘোলা হয়ে ওঠে—তার কোনো চিত্রকল্প নির্মাণ করবার কথাও মাথায় আসেনি—
‘ইদার আর্ট ইজ ক্রুয়েল অর এপ্রিল’—
ইংরেজিতে এই বাক্যটা ভেবেছি বহুবার, ভাবতে ভাবতে, মহাখালি কিংবা শব্দান্তরের সেই মহাশূন্যকে অনেক অনেকবার অতিক্রম করেছি; মধ্যরাতে, প্রাইভেট একটা গাড়ি মহা খালি হয়ে বসে আছে—চালক নেই, যাত্রী নেই—পৃথিবীতে নেমে আসছে মধ্যদুপুর, মধ্যরাত; লোকনাথ পঞ্জিকার ধুলোজীর্ণ পৃষ্ঠাগুলোর ভিতরে লুকোচুরি খেলছে বৈশাখ ও এপ্রিল; অপহরণ, গুপ্তহত্যা, গুম—এইসব মহান রাজনৈতিক শব্দমালা নয়—
আমার মনের মধ্যে গুঞ্জরন তুলছে এক মহাশূন্যতা: মধ্যরাতের মহাখালি—
|| ২ ||
মেঘের উল্টোদিকে, ভেসে যাচ্ছে—চাঁদ
বাতাসের উল্টোদিকে—ঈর্ষার মমি
বিচূর্ণ কাচের ছায়া, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, পথে;
লিখিত ভাষার ছায়া, কথিত শব্দের প্রতিধ্বনি,
ঘূর্ণি-হাওয়ার কেন্দ্রে পাক খেতে খেতে, হঠাৎ
দেখিয়ে দিচ্ছে, আবহাওয়ার আভাস-ইঙ্গিত;
পর্বতের শীর্ষে উঠে, অবতরণের পথ
হারিয়ে ফেলেছে, কিছু নির্বোধ আরোহী—
তাদের উদ্দেশে কেউ ছুঁড়ে দিচ্ছে না কেন
দুর্গমের অতিতুচ্ছ রচনা কৌশল?
তাদেরকে জানাতে হবে—চাঁদ নয়,
ভেসে যাচ্ছে, প্রগলভ মেঘেরা...
তাদেরকে জানাতে হবে—যে মমিরা
টিকে আছে, সহস্র বছর—তারা কিন্তু মৃত!
|| ৩ ||
একটি জীবন, অপচয়ে গেল চলে,
রাজার উঠানে, সার্কাস দেখে দেখে—
‘অতিথি পাখিরা এসেছে সব, লেকে’
প্রতিবেশিনী, এইটুকু শুধু বলে,
হয়তো কোথাও ছিন্নকেশই রেখে,
নিরাকার হলো, অন্য কোনোখানে—
দাঁড়াশ সাপের গতিতে, এঁকেবেঁকে;
আকার হারালে, কেউ কি কখনও জানে?
প্রশ্ন কেবলই এদিকে-সেদিকে চায়;
উত্তরে আসে: প্রশ্ন প্রতিধ্বনি—
ম্যাজিক তো খুব! রিয়েলিটি গোঙায়!
দেশময় জাগে খুন ও খুনের খনি...
একটি জীবন, চলে যায় অপচয়ে,
মৃত্যুরও আগে—মৃত্যুর মতো ভয়ে—
|| ৪ ||
কোনো স্বপ্নই আর অবশিষ্ট নেই মানুষের মনে
সমস্ত নৃত্যই এখন ব্যঙ্গাত্মক
এবং সমুদয় নিরাবয়ব উড়ছে
অবয়ব নিয়ে
অক্ষরগুলো নিভৃতির দিকে ছুটে যাচ্ছে
পরিণত হবে শব্দে
শব্দেরা উড়ে যাচ্ছে ধ্বনির দিকে
আর তারা নিজেরাই গঠন করবে বাক্য
বস্তু ও ধারণা সব কিছুই ডানাময়
কেবল মানুষই শুয়ে আছে নিশ্চেতনে
দুপুরের ওয়েটার-শূন্য বারে, হাই তুলছে পেইন্টার
আর তার ক্যানভাসে স্বয়ং ফুটে উঠছে
বিচিত্র সব মোটিফ ও ফিগার
সুস্বাদু মাছেরা অধীর, অস্থির
টোপ বা টোপহীন বড়শি খুঁজছে
মানুষের রান্নাঘরে, বলিতে চড়বে...
|| ৫ ||
চরাচরে কেউ নাই। রাখাল বালিকা মাঠে,
পেঁচিয়ে ধরেছে তাকে, সাপ;
নিকটেই কাঁটাবাবলা, জংলি গোলাপ
দূরে, কাঁপে—নির্জনের মধ্যাহ্ন বিভ্রাটে—
নগরীতে এন্টিভেনম, রেফ্রিজারেটরে
সুরক্ষিত থাকে; জনপদ, তারও চে’ দূরে!
রাখাল বালিকাও মাঠের অন্তরে
একবার দেখা দেয়—তারপর, বিষণ্ন কর্পুরে
উবে যায়। ও জননী, বদ্বীপ বধির!
আমাদেরও কণ্ঠনালী, ঘায়ের দখলে—
আমাদের দাপাদাপি, দু’দিনেই থির,
সমাধির নীরবতা শুধু কথা বলে:
‘প্রতীজ্ঞারও হাত থেকে, খসে গেছে লাঠি—
কে ছোঁয়ালো, কোটি চোখে, এত নিদ্রাকাঠি?’
|| ৬ ||
ঈশ্বরের জানালা থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে আলো,
প্রবাহিত হচ্ছে সুগন্ধি বাতাস; আর এখানে
কারও কারও না-থাকার হাহাকার জুড়ে
আলোর চাকতির মতো ঘুরছে জ্যোতির্বলয়;
স্মৃতির মানচিত্রে যেমন অনন্যতা, প্রবাহিত
সেই বাতাসও তেমনি, সাদৃশ্য ও তুলনারহিত।
এখানে, এই অনুপস্থিতির শূন্যতার মধ্যে,
বয়ে যাচ্ছে মাছের হাড়ের মতো ঝকঝকে
বাতাস, স্মৃতির উজ্জ্বল মানচিত্র; এইসব চিত্র
আমরা অঙ্কন করছি গোলাকৃতি কাচের পৃষ্ঠায়—
চত্বরগুলো বলতে কিছু নেই—চত্বর বা প্রান্তর
সর্বদাই বহুবচন। যেমন ক্ষতির কোনো বহুবচন
দরকার পড়ে না—জলপ্রপাতের ভিতর থেকে
আমরাই তুলে আনবো আলো ও আগুনের ফুলকি;
হঠাৎ ভেঙ্গে পড়বে পাহাড়, কল্পবিজ্ঞানে নির্মিত
চলচ্চিত্রের অবিশ্বাস্য দৃশ্যে, প্রাসাদ ও মিনার ডুবে যাবে;
স্বঘোষিত ঈশ্বরকে বলো, বন্ধ করুক জানালা; এই চত্বরে,
নিহত ও নিরুদ্দিষ্টের ঘরে ঘরে, আমরাই আলো জ্বালবো—
|| ৭ ||
সব সুর, সুর নয়—
কিছু থাকে সুরেরও প্রমাদ;
কিছু খরগোশ আছে
আজীবন ভালোবাসে ফাঁদ;
তারা হয়তো সুখি হয়।
হয়তো বা শিকারীর কাছে
আত্মসমর্পণে, হরিণেরও
কোনো লাভ আছে।
এই সবই অরণ্যের রীতি;
অধিক সুন্দরী পাখিদেরও
আমি কি দেখিনি সর্পপ্রীতি?
তা হলে কেন যে মন, জঙ্গলের গাছে
অযথা এসব কথা কয়!
কেন সে ফেরে না মূল কাজে?
কে না-জানে, কপালের গেরো:
কিছু বাঁশি, চিরদিন, ভুল সুরে বাজে!
|| ৮ ||
দুয়েকটি তারকা, ছিলো তো সাজঘরে
আকাশে—স্তব্ধ গহন অন্ধরাত
তুমি ছিলে, আলো, তৃষিত অন্তরে
রাজদণ্ড চেয়েছে: ছুরিকাঘাত
বন্ধ করুক যতখানে যত গান—
তবু ভোর ফোটে, কালোগাছ শাখেশাখে
তবু পাখি গায় রক্তবুকে ও ঠোঁটে
কে কার হন্তাা? কে রোখে আজ কাকে?
মৃতে ও জীবিতে পুনরায় জেগে ওঠে—
মাঠে মাঠে নাচে নয়া ফসলের ঘ্রাণ;
একটি দু’টি স্বপ্ন যে লাশঘরে
করছে এখনও অঝোর অশ্রুপাত—
কোন্ দেবতার অভিষেক হলে, পরে,
ছেঁটে দেবো কোন্ অসুরের কালোহাত!
|| ৯ ||
ভবিষ্যতে, একটা সুদিন আসবে—শুধু এই আশায়, পঞ্চাশটা কাঠেরগুঁড়ি কাঁধে, এতগুলো বছর, আমি হেঁটে যেতে পারবো না—নিজেদের রোঁয়া-ওঠা ঘাড়ে, হাত বোলাচ্ছে বুড়ো শালিখেরা; ধানঋতুর হাওয়া তামাদি হতে না হতেই, প্রমোদবজরায়, কাঠের বাক্স ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে... তোমার নাচ, কেত্তন, হাসির মুচকিমারা ভঙ্গিমা—
এ কোন জলান্তরের নাপাক জীবন? কাঁধে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে, রাজলক্ষ্মী, ভার কমাও! নয় তো, একটা বনভূমির জন্মান্তর দাও, আমাকে!
অনেকগুলো বৃক্ষচোখে, তাণ্ডব দেখি; আর মনে মনে বলি: তোমাদের পা নেই? রাজলক্ষ্মী!
|| ১০ ||
যথেষ্ট হয়েছে—মৃতঘাস ও শুকনো পাপড়ির মতো উড়ছে—পাথর, জলশূন্য নদীর আলোকচিত্র এবং বড় বড় কাচের টুকরো—আর আমাদের কণ্ঠে কণ্ঠে লোহিত সংগীত; রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে—দীর্ঘশ্বাস; রাজপ্রাসাদের কাচ ভেদ করে ঠিকরে বেরোচ্ছে বর্ণিল আলো;
এ্ইসব অন্যমনষ্ক জল পানকালে, আমাদের কণ্ঠনালীতে আটকে গেছে কাচের টুকরো।
যথেষ্ট হয়েছে—ফায়ারপ্লেস থেকে উড়ে আসা আগুন, শীতের মঠ পেরিয়ে, চলে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে—ঝড় হবে; দীর্ঘতম বৃষ্টিঋতুর পর, হেমন্তের হাসপাতাল থেকে আরোগ্য সংবাদ আসবে; আর আমাদের কণ্ঠনালীতে জন্ম নেবে অফুরন্ত গানের উৎসব—

খুব ভালো লাগলো
খন্দকার আব্দুস সবুর বেলাল
এপ্রিল ১০, ২০২৫ ০৮:৪৮

খুব ভালো লাগলো
খন্দকার আব্দুস সবুর বেলাল
এপ্রিল ১০, ২০২৫ ০৮:৫২

চমৎকার। অসাধারণ।
রেজাউল করিম রেজা
এপ্রিল ১০, ২০২৫ ১০:৩৮
জায়গাটার নাম: মহাখালি; শব্দান্তরে বলা যায় মহাশূন্য; অসাধারণ
পাঠক
এপ্রিল ১০, ২০২৫ ০৮:০৭