উত্তরাধুনিক মফিজ ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-

 

ঠিকানা ঠিকানা খেলা

সামান্য একটা সুতায় গাছপালাসহ একটা গোটা বাড়ি
ঝুলিয়ে রাখার মতোই এই ঠিকানা ঠিকানা খেলা।
নেই মাটি, নেই কোনো শিকড়-বাকড়ের বন্ধন—
তবু আছে অদৃশ্যে ঐ ঝুলন্ত সুতার অভয় প্রদর্শন।

সামান্য সুতায় বা নিজেরই একটা লম্বা চুলের বাঁধনে
সে থেকে যায়। সে থেকে যায়, আজ বাদে কাল হয়তো ঝরেই যায়—
তবু আজকের দিনটা এক সমুদ্র চিন্তার হাঙর থেকে রক্ষা পায়।

সামান্য সুতায় ঝুলে আছে গাছপালা, উঠোন, পুকুরসহ 
একটা ঠিকানা। হয়তো মাকড়সার জালের মতো পলকা,
হয়তো বৃষ্টির পানির ভরেই ঝরে পড়বে, 
হয়তো প্রজাপতির নিঃশ্বাসে কেঁপে উঠবে—তবু তো আছে! 

মহাকাশচারী যেন পিঠে অক্সিজেনের সিলিন্ডারের বদলে
একটা ঠিকানাওয়ালা চিঠির বাক্স নিয়ে চাঁদের পাহাড় পাড়ি দিচ্ছে।

 

উত্তরাধুনিক মফিজ

নরকেও থাকে কিছু আশ্চর্য কুসুম, যার মায়াতে
নরকের মায়া ছাড়তে পারে না এলাকার নরকবাসী।
ভালোবাসাতেও থাকে কিছু বিদীর্ণ পেরেকের সংলাপ—
যার কারণে আমরা ভালোবাসতে হই রাজি।
বেদনার অমৃতভান্ডার খালি হলে বেদনা সংগ্রহে বের হয়
ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি আর নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও
মাকড়সারা গর্ভবতী হয় সন্তানের কাছে ফাঁসি উপহার পেতে।
সমুদ্রের নোনা জলে জলপাই ডুবিয়ে খেতে খেতে
তুমি জেনে গেছো নিজের কান্নাও এভাবে গিলে ফেলা যায়।
সেখানে ছিল না কোনো নিভৃত কান্নাঘর, অভিসম্পাত নিয়ে
মুখোশেরা ছিল চিরহাস্যোজ্জ্বল। তেমনি ছিল না
প্রেমময় বাসর, প্রতারণার ফুল দিয়ে ফুলশয্যা পেতেছিল
অন্ধ চাঁদ—বিশ্বাস তাই গন্তব্য ফেলে উল্টো হেঁটে 
চলে গিয়েছিল ফের অরণ্যে। সেখানে ধ্যানে বসেছিল
গৌতম বুদ্ধ আর একটা লোক পাশ দিয়ে যেতে যেতে
চিৎকার করছিল: সহনশীলতা, সহনশীলতা!! চোখ খুলে
বুদ্ধ দেখে, সহনশীলতার উদগ্র প্রদীপের নিচে
পতঙ্গের মতো আত্মাহুতি দিয়েছে উত্তরাধুনিক মফিজ।
তার কণ্ঠনালী শুকিয়ে রিকশার ফাটা টায়ারের মতো চুপসে গিয়েছিল,
কারণ সে কখনো চিৎকার করেনি। তার চোখ দুটো শুষ্কতায়
নরকের মরুভূমির মতো ঝলকাচ্ছিল, কারণ সে কখনো কাঁদেনি।
তার ঠোঁট মাছের বরশির মতো বাঁকা হয়ে গিয়েছিল, 
সবসময় নকল হাসি হাসতে গিয়ে। তার পাকস্থলি 
বাড়তে বাড়তে জাদুকরের ঝোলার মতো বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিল
সবসময় তোষামোদ খেতে খেতে আর তার হৃদয় 
একটা মৃত পাখির ডানার মতো গুটিসুটি মেরে ছিল
কখনো ভালোবাসার আকাশে উড়তে না পারার ব্যর্থতায়।
তবু মৃত্যুই নয়—তার মৃত মনের সমাধি জুড়ে
শিকড়ের জাল বুনে বেড়ে উঠেছিল এক সুরের বৃক্ষ।
বাতাস এলেই তার পাতাগুলো পিয়ানোর মতো বাজতো।

 

এইসব গ্রীষ্মের খরতাপ ভালো লাগে

এইসব গ্রীষ্মের খরতাপ ভালো লাগে।
ঠিক যেন মাতৃগর্ভের উষ্ণতা ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর পরে।
পানির গ্লাসে এক টুকরো ভাসমান বরফ
ভেসে যাওয়া গ্লেসিয়ার আর তাতে ছানাপোনাসহ বসে আছে
পেঙ্গুইন আর রকমারি গাংচিল।
এইসব গ্রীষ্মের খরতাপ ভালো লাগে।
চোখে সানগ্লাস, ঠোঁটে পাইপ শীতল ডাবের গহ্বরে—
দুইটা বিন্দাস পিঁপড়া হয়ে আমরা হারিয়ে যাই
সেই ডাবের পানির সমুদ্রে। পিতামাতারা আমাদের খুঁজে না পেয়ে 
নিখোঁজ সংবাদ রটিয়ে দেয় শহরের দেয়ালে।
এইসব গ্রীষ্মের খরতাপ ভালো লাগে।
যেন আমি এক বোকাসোকা জামাই, কাঁঠাল মাথায়
চলে আসি শ্বশুরবাড়ির নিমন্ত্রণে। তুমি পাশে বসে করো তালপাখার বাতাস
শাশুড়ি তুলে দেয় পাতে ভুনা রাজহাঁস।
ঘামতে ঘামতে খেয়ে চলি আউশ চালের ভাত।
কিংবা অনেক বছর পরে আমাদের এক কুড়ি ছেলেমেয়ে
এমনি এক গ্রীষ্মের দুপুরে পুকুরের জল ঘোলা করে,
কারণ তারা নাকি মানুষ হলেও হাঁসের ছানা আদতে।

 

চান্দের গাড়ির ড্রাইভার

আমি প্রায় ভালো থাকি,
মানে ভালো থাকার একটু নিচে থাকি।
আর আঙ্গুর ফলকে টক ঘোষণা করা সেই 
শিয়ালের মতো ভাবি, সমুদ্রের তলদেশে 
একটু নিচে থাকাই উত্তম। তাহলে
ছোঁ মেরে নিয়ে যেতে পারবে না মাছরাঙা কিংবা ঈগল।
আমি প্রায় ভালো থাকি,
মানে ভালো থাকার একটু নিচে থাকি।
হয়তো আমার জীবন যাপনে মসলা কম।
তবু তা স্বাস্থ্যসম্মত, দূরে থাকবে যম।
জোয়ান বায়েজের মতো নব্বই বছরেও
গেয়ে উঠতে চাই প্রেমের গান। মাটিতে শিকড় 
পেতে আকাশে চাষ করি ডানার বাগান।
আমি প্রায় ভালো থাকি,
মানে ভালো থাকার একটু নিচে থাকি
কিন্তু উপরে থাকি খারাপ থাকার।
দুইদিকের অতি উচ্ছ্বাসের মাঝখানে এক
শান্তশিষ্ট পাহাড়ি পথ। দুইপাশের চড়াই উৎরাই
সাবধানে এড়িয়ে নিয়ে যাই গাড়ি,
আমি এক চান্দের গাড়ির ড্রাইভার।

 

কিছু অংক মেলে না 

কিছু অংক মেলে না, অংকগুলো কক্সবাজারের শুটকির মতো 
হ্যাং হয়ে থাকে শুষ্ক ঠোঁটে হাঁ করে। মাঝে মাঝে
মাছি যায় আসে সে গহ্বরে। মাঝে মাঝে তারা ওঠে
সামনের আকাশ জুড়ে। তখন মনে হয় মাছের হাঁ-এর মধ্যে
একটা তারা চকলেটের মতো ঢুকে যেতে চাচ্ছে। 
কিন্তু অংকগুলো কোনোভাবে মিলছে না...
না মেলা অংকের খাতাটা খোলা আর বাতাসে পৃষ্ঠাগুলো
উড়ছে শব্দ করে। মাছের হাঁ-এর কাছে মাছিগুলোও শব্দ করে
কয়ার গাইতে থাকে। আর তুমি এসব কিছু থেকে দূরের
কোনো বন্দরে বসে বাজাও বাঁশি। লাইট হাউজ ভর্তি
অন্ধকার নিয়ে থমকে থাকে উপকূল। ঝড় আসবে তাই
মাঝি ও পাখিরা ব্যস্ত, বিদ্যুতের লাঙল চষে জলের জমিন।
হাঁ করা মাছগুলো এতোদিন পর দুলে ওঠে
যেন একটু পর সাঁতার কাটতে নেমে যাবে সমুদ্রে।
আর মাছের কাঁটাগুলো বিঁধে থাকে সমকালের বিড়ালের গলায়
না মেলা অংক হয়ে, না মেলা ভালোবাসায়। 

 

সবিনয়ে ফেরত চাই 

সবিনয়ে ফেরত চাই পথের ধুলা—
বাতাসে যতো ধুলা হয়েছিল জমা গাছের পাতায়
সব ধুলা জমা দিতে হবে বৃষ্টির পানশালায়।

সবিনয়ে ফেরত চাই শেকড়-বাকড়
গাছের সাথে সম্পর্কে জড়াতে যতো শিকড়
মেলে দিয়েছিল বনভূমি অন্তরীক্ষ বরাবর...

সবিনয়ে ফেরত চাই অশ্রুবিন্দু
শিশিরের কাছে তাদের গচ্ছিত রেখে গিয়েছিল চোখ
রোদের দেশে হাসিগুলোকে জীবাণুমুক্ত করে নিতে।

সবিনয়ে ফেরত চাই ডানা জোড়া
যাদের ছাড়া প্রাণ অচল,
ভিতরে চুলায় রান্না হচ্ছে ষড়যন্ত্র অতল।
কিন্তু চাই না ফেরত ভালোবাসা—
ভালোবাসা গচ্ছিত থাকলে আরো অনেক 
ছানাপোনা দিতে থাকবে ভালোবাসার।
কিন্তু ভালাবাসা ঘাতক হয়ে উঠলে 
পাখিরাও ছেড়ে যায় নীলাকাশের আলিঙ্গন।
সবিনয়ে ফেরত চাই অভিমান, যা কিছু কথা ছিল হবে,
যা কিছু বাসন্তী পোশাকের মতো জড়িয়ে ছিল গায়ে
যা কিছু নিঃশ্বাসের নিচে ছিল সবুজ নদীর মতো গহন
যা কিছু অভিনয়ে মলিন দেবদারু বন—
সবকিছু ফেরত চাই। শুধু ফেরত চাই না পুরানো আমিকে,
সে থেকে যাক ছায়াসঙ্গী হয়ে মায়া সভ্যতার 
নদীর পাশে বসে, থেকে যাক সুশীতল বাতাস হয়ে  
পুরানো আড্ডার জায়গার নিরুপদ্রব ঘাসে।