জেরিনের সংকল্প

অ+ অ-

 

||||

শীতকাল। জেরিন একটি সিএনজি করে ছুটছে বাংলা মটরের কাছে ওর উকিলের অফিস অভিমুখে। এক সপ্তাহ আগে সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ওর স্বামী ফয়সালকে ডিভোর্স দিবে। জেরিন সারা জীবনই ছিল জেদি এবং একরোখা। সে যখনই কোন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় তখন অন্য কেউ হোক তার বাবা বা বড় ভাই বা বোন কেউই তাকে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরাতে পারেনি। ছাত্র জীবনে সে চেয়েছিল বাংলায় অনার্স পড়বে। বাসার সবাই বলেছিল ইংরেজিতে অনার্স পড়তে। কিন্তু সে কারো কথা শুনেনি। সে ঠিকই বাংলায় পড়েছে। সে যখন ফয়সালকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন সবাই নিষেধ করেছিল। বলেছিল, আরো ভাল ভাল পাত্র তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। কিন্তু সকলের নিষেধ অবজ্ঞা করে সে ফয়সালকেই ঠিকই বিয়ে করেছিল। এখন সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফয়সালকে ডিভোর্স দিয়ে তার পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনের ইতি টানবে। সে তার তিন বছরের শিশু পুত্র ফাহিমকে নিয়ে বাকী জীবন একা একাই কাটিয়ে দিবে। ফয়সালকে সে ভালবেসে বিয়ে করেছিল। কিন্তু ফয়সাল এতো নিচে নামতে পারে এটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। জেরিনের সিএনজি মালিবাগ ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে খুব দ্রুত গতিতে ছুটছে তো ছুটছেই।

 

|| ২ ||

রাত দশটা। বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হওয়াতে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। চিড়চিড় করে কনকনে হাওয়া বইছে। ক্রেতা নেই বলে তালতলা মার্কেটের দোকানীরা একটু আগেভাগেই দোকান বন্ধ করে চলে গেছে। কোন কোন দোকান এই মাত্র বন্ধ হচ্ছে। শাটার নামানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। প্রত্যেকটা দোকানের বাইরে লাগান বাতি জ্বলতে থাকায় মার্কেটটা আলোকিত হয়ে আছে। আকাশে এখন কোন মেঘ নেই। কিন্তু কুয়াশার কারণে চাঁদের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। নক্ষত্রেরা কোথায় লুকিয়ে আছে কে জানে! মার্কেটের পাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকে যে রাস্তাটা গেছে সেটার কোথাও আলো আছে আবার কোথাও-বা অন্ধকারে ডুবে আছে। রাস্তা-ঘাটে লোকজনের চলাচল কম। বেশ কয়েকটি কুকুর ইতস্তত ঘুরাঘুরি করছে। কোথাও-বা দুএকটি শীতার্ত কুকুর একটু উষ্ণতা পাওয়ার আশায় রাস্তায় পড়ে থাকা পরিত্যক্ত পাটের বস্তার উপর শুয়ে ঘুমাচ্ছে। রাস্তার দুপাশেই রয়েছে দোকান। কোনটা মুদীর কোনটা ষ্টেশনারীর আবার কোনটা ঔষধের দোকান। এরই মাঝে আবার লন্ড্রি এবং খাবারের হোটেলও আছে। এসব দোকান রাত বারটা অবধি খোলা থাকে। এই রাস্তারই আরেকটু ভেতরে গেলে জেরিনের বাবার ফ্ল্যাট। তার বাবা অবসরে গেছেন বছর তিনেক হলো। পেনশনের টাকা দিয়ে তিনি এই ফ্ল্যাটটি কিনেছেন। জেরিনের এক ভাই ও এক বোন আছে। ভাইয়া বিয়ে করে মিরপুরে থাকে স্ত্রী নিয়ে। আর বোন থাকে মগবাজারে তার শ্বশুর বাড়িতে। ভাই-বোনের মধ্যে জেরিন সবার ছোট। সে স্বামীর বাসা থেকে বাবার বাসায় এসেছে আজ প্রায় ছমাস হলো। এখান থেকেই সে অফিস করে। আর তখন তার ছেলেটির দেখাশুনা করে তার মা।

জেরিন ড্রইং রুমে সোফার উপর বসে চকলেট রঙের ভারী শাল গায়ে দিয়ে একটা বই পড়ার চেষ্টা করছে। তাদের বাসায় খাওয়া-দাওয়ার পালা শেষ। তার ছেলে ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। মোটা জাম্পার পরিহিত তার বাবা মোবাইল হাতে সেই কক্ষে প্রবেশ করে জেরিনকে বলল: ফয়সাল আমার মোবাইলে ফোন দিয়েছে। লাইনে আছে। তোর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। জেরিন বিরক্ত হয়ে বলল

: বাবা, তোমাকে না কতবার নিষেধ করেছি ওর ফোন ধরতে। তুমি কথা শুন না কেন! আমি তো অনেকবার বলেছি ওর সাথে আমি কোন সম্পর্ক রাখব না।

কিভাবে মেয়েকে বুঝালে সে বুঝবে সেটা তিনি এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারেন নাই। তাই শুধু বললেন

: ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখ কোনটা তোর জন্য মঙ্গলজনক হবে। মাথা গরম করে কোন সিদ্ধান্ত নিলে সেটার ফল শুভ হয় না। ফয়সাল তো অনেকবারই বলেছে সে যা করেছে সেটার জন্য সে অনুতপ্ত। সে অনেকবার ক্ষমা পর্যন্ত চেয়েছে। ভবিষ্যতে আর কোনোদিন সেরকম করবে না সেটা পর্যন্ত বলেছে।

: বলুক। আমি কোনোদিনই ওকে ক্ষমা করতে পারব না। আমি ওই নীচ লোকটার সাথ কোনমতেই ঘর করতে পারব না।

তার বাবা আর কোন কথা খুঁজে না পেয়ে শুধু বললেনতোর যা মনে হয় তাই কর।

একথা বলে তিনি কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। জেরিন তার ফোনে ফয়সালকে ব্লক করে দিয়েছে এবং অপরিচিত নাম্বার থেকে কোন কল আসলে সে তা রিসিভ করে না। তাই ফয়সাল জেরিনের বাবার ফোন নাম্বারে কল দেয়।  জেরিন বই পড়ায় মনোযোগ দিতে চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই পড়ায় মনোনিবেশ করতে পারল না। বই বন্ধ করে সে চোখ বুজল। টের পেল মাথা ব্যথাটা আবার আসছে। সে মাথা ব্যথার একটা টেবলেট খেয়ে শোবার ঘরে গিয়ে তার ছেলের পাশে নিঃশব্দে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। চেষ্টা করল ঘুমাতে। কিন্তু মাথা ব্যথাটা ক্রমশ বাড়ছে। ঘুম আসছে না। সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। তার চোখে একটি দৃশ্যপট ভেসে উঠল। সে দেখতে পাচ্ছে তারা স্বামী স্ত্রী তুমুল ঝগড়া করছে। উত্তেজনার এক পর্যায়ে সে ফয়সালকে ইতর, চরিত্রহীন, লম্পট, প্রতারক বলল। প্রতি-উত্তুরে ফয়সাল জেরিনের দুগালে কষে দুটো চড় মারল। জেরিন তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শুধু বলল—‘কী তুমি আমার গায়ে হাত তুললে! এই বলে সে কাঁদতে কাঁদতে পাশের ঘরে চলে গেল। তন্দ্রা আরো গভীরতর হলে জেরিন কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল তা সে নিজেও বলতে পারবে না।

ঝগড়ার পরদিনই ফয়সাল অফিসে চলে গেলে জেরিন তার জামা-কাপড় লাগেজে বোঝাই করে তার শিশু পুত্রকে নিয়ে বাবার বাড়িতে এসে আশ্রয় নিল।

বিয়ের পর তাদের সংসার মোটামুটি সুখেরই ছিল বলা চলে। মত-ভিন্নতা যে একেবারে ছিল না সেকথা বলা যাবে না। এরকম মত পার্থক্য সব সংসারেই থাকে। টুকটাক মান-অভিমান ছিল এবং সেটা আপনা-আপনিই মিটে যেতো। ফয়সালের এক খালাত বোন ছিল। নাম টুম্পা। ফয়সালের সমবয়সী। ছোটবেলা থেকেই তাদের দুজনের মধ্যে খুব ভাব ছিল। দুজনে একসাথে খেলত, কথা বলত, খুনসুটি করত, ঝগড়াঝাঁটিও বাদ যেতো না। বড় হওয়ার পরও তাদের সম্পর্ক আগের মতোই গভীর ও নিবিড় ছিল। এই সম্পর্ক ঠিক ভাই-বোনের সম্পর্কের মতো ছিল না। তার চেয়ে আরো কিছু বেশী আরো ঘনিষ্ঠ ছিল। সেটা ভালবাসায় রূপান্তরিত হয়েছিল কিনা বলা সম্ভব না। কারণ কেউই মুখ ফুটে ওই বিশেষ শব্দটি অপরকে বলেনি। ফয়সাল যখন ভার্সিটিতে প্রথম বর্ষে পড়ে তখন হুট করে টুম্পার বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু তাতে দুজনের সম্পর্কে চির ধরেনি। তারা ফোনে কথা বলত। পরস্পরের বাসায় আসা যাওয়া করত। টুম্পার যদি বিয়ে না হতো ওই সময়ে তাহলে ফয়সাল জেরিনের প্রেমে পড়ত কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। বর্তমানে টুম্পার এক ছেলে আর এক মেয়ে আছে। ফয়সালের বিয়ের পরও তারা দুজনে পরিবার নিয়ে পরস্পরের বাসায় দাওয়াত খেতে আসত। জেরিন ফয়সাল ও টুম্পার যে সম্পর্ক সে বিষয়ে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। ফয়সালই তাকে বলেছে। ঝগড়ার প্রায় ছমাস আগে টুম্পার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তারপর থেকেই জেরিন কেন জানি টুম্পাকে আর সহ্য করতে পারে না। অবচেতন মনের কোথাও হয়তো টুম্পাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয়। তাই এখন ফয়সাল যখন টুম্পার সাথে ফোনে কথা বলে সেটা জেরিনের কাছে অসহ্য লাগে। ফয়সাল যখন টুম্পাদের বাসায় যায় তখন সে সম্পর্কের সীমা অতিক্রম করছে বলে জেরিনের কাছে মনে হয়। তাই একদিন জেরিন স্পষ্ট করে ফয়সালকে জানিয়ে দেয় যে টুম্পার সাথে অতো মাখামাখি অতো ঘনিষ্ঠতা রাখা যাবে না। দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। কিন্তু ফয়সাল জেরিনের কথায় কর্ণপাত করেনি। সে আগের মতোই টুম্পার সাথে কথা বলত এবং ওদের বাসায় যেতো। এটা নিয়েই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রথমে মনোমালিন্য তারপর কথা কাটাকটি শেষে ঝগড়া-ঝাটি হতে থাকে। এসব কথা জানার পর টুম্পা ফয়সালদের বাসায় যাতায়াত বন্ধ করে দেয় এবং ফোনে কথা বলাও অনেক কমিয়ে দেয়। কিন্তু ফয়সাল লুকিয়ে লুকিয়ে টুম্পার সাথে কথা বলত টুম্পার বারণ সত্ত্বেও।

 

|| ৩ ||

শরতের বিকেল। নীল আকাশে মেঘেরা দল বেধে ঘুরাঘুরি করছে এদিক-অদিক। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। মেঘের দল যখন সূর্যটাকে ঢেকে দেয় তখন মেঘের চারিদিক দিয়ে লাল,নীল, বেগুনি, হলুদ, সোনালী প্রভৃতি নানা রঙের আলোক রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে দিগন্তকে দেয় অপরূপ শোভা। সুউচ্চ অট্টালিকার সমারোহে সাজান এই শহরের বিস্তীর্ণ আকাশে ঘুরে ঘুরে চক্কর দিচ্ছে তিনটে চিল। উড়ে বেড়ানোতে যে বিস্ময়কর স্বাধীনতা আছে সেটার পরিপূর্ণ স্বাদ নিচ্ছে এক ঝাঁক পায়রার দল। একটি বড় উড়োজাহাজ আকাশের অখণ্ড নীরবতাকে খান খান করে দিয়ে সশব্দে উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম দিকে। নিচে একটি পুরনো ভবনের আঙ্গিনায় যে কাঁঠাল গাছটা আছে তার ডালে বসে একটি দাঁড়কাক তারস্বরে ডেকে যাচ্ছিল। এরকমই এক বিকেলে সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা, ত্রিশ বছর বয়সী সুঠাম দেহের অধিকারী গোলগাল চেহারার শ্যামলা বর্ণের ফয়সাল জেরিনের বাবার বাসায় হাজির। পরনে জিনস, টি-শার্ট আর জুতো। মুখের দাড়ি ট্রিমার দিয়ে অতি যত্ন করে ছাটা। হাতে মিষ্টি আর দধি। সে জেরিনের বাবাকে জানিয়েই আজকে এসেছে। আজ শুক্রবার। তাই জেরিনের বাসায় থাকার কথা। কিন্তু সে আসবে জেনে জেরিন সকাল বেলাই তার বান্ধবীর বাসায় চলে যায়। জেরিনের মা-বাবা দুজনেই জামাইকে ভালভাবে আপ্যায়ন করার চেষ্টা করেন। ফয়সাল তার ছেলেটাকে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ আদর করে। জেরিন বাসায় নাই জানতে পেরে প্রায় দুঘণ্টা সেখানে অবস্থান করে হতাশ হয়ে অবশেষে নিজের বাসায় চলে যায়। সে এর আগেও আরেকবার জেরিনকে নিয়ে যেতে এখানে এসেছিল।

 

|| ৪ ||

মালিবাগ মোর। ধীর গতিতে চলছে রিকশা, মোটর সাইকেল, প্রাইভেট কার, সিএনজি এবং বাস। রিকশার টুংটাং, গাড়ির হর্ন, মানুষের কলরব সব মিলিয়ে ব্যস্ততায় মুখরিত এলাকাটি। প্রতিটা ভবনের নিচে কোনো না কোনো কিছুর দোকান অবশ্যই আছে। এই দোকানগুলোর মাঝ দিয়েই দালানগুলোর উপরে উঠার সিঁড়ি। আজ শীত কিছুটা কম। লোকজন যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী গরম কাপড় গায়ে দিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে। সবার মধ্যেই ব্যস্ততার লক্ষণ দৃশ্যমান। এতো উঁচু উঁচু ভবন এবং রাস্তার মাঝখান দিয়ে যে ফ্লাইওভার গেছে তার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা কঠিন। রাস্তায় পথচারী এবং গাড়ির যাত্রীদের ফেলে দেয়া আবর্জনা এদিকওদিক পড়ে আছে। বাতাস নেই। বৃক্ষের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কয়েকটি শালিক ময়লার স্তূপ থেকে খাদ্য খুঁজে খাচ্ছে। এই রাস্তারই পাশের এক ভবনে জেরিনের অফিস। সে একটি ডেস্কে বসে কথা বলছে তার সহকর্মী দিলারার সাথে। জেরিনের লম্বাটে চেহারা, খাড়া নাক এবং বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটো যে কাউকে আকৃষ্ট করবে। পাতলা ঠোঁটে শালের সাথে মিলিয়ে লাল রঙের লিপস্টিক দেয়া। মুখে হালকা মেকআপ। বুক নিতম্ব ভারী। মেয়েরা পরিপূর্ণ নারীত্ব অর্জন করলে যে মোহনীয়তা তাদের মধ্যে থাকে সেটা তার মাঝেও আছে। সে আজ পরেছে সিল্কের থ্রি-পিস। পঁয়ত্রিশ বছরের দিলারা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে প্রায় দুবছর হলো। বর্তমানে তার চেয়ে বয়সে ছোট কোন এক কনিষ্ঠ সহকর্মীর সাথে প্রেম করছে বলে কানাঘুষা আছে। সে বলল

: একটা কথা কিন্তু একেবারে সঠিক। পুরুষ মানুষ সব সময়ই স্বার্থপর হয়। দেখবে বিছানায় ওদের চাহিদাটুকু পূরণ হলে ওরা উপর থেকে নেমে যাবে। তোমার চাহিদা পূরণ হলো কী হলো সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই ওরা করবে না।

জেরিন মাথা নেরে মৃদু মৃদু হাসছে।

দিলারা আরো বলল

: সব সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়। ওদেরকে ছাড় দিতে নেই। দেখোনা আমাকে। আমি উচিৎ শিক্ষা দিয়ে তবে ছেড়েছি। এখন উঠি। ডেস্কে অনেক কাজ পড়ে আছে।

একথা বলে দিলারা নিজের ডেস্কের দিকে রওয়ানা দিল। জেরিন তখন গম্ভীর হয়ে কিছু একটা নিয়ে ভাবতে লাগল।

 

|| ৫ ||

জেরিনের সিএনজিটা দ্রুত গতিতে চলে বাংলা মটরের সামনে এসে যানজটে আটকে গেল। এই যানজট পেরুলেই উকিলের অফিস। ক্রুদ্ধ জেরিনের ভেতরে তখন অন্য এক অনুভূতি কাজ করতে লাগল। সে উপলব্ধি করতে লাগল যে উকিলের অফিসে স্বাক্ষরটা দিলেই তার এতো দিনের পরিপূর্ণ জীবনটা অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে। তার জীবনটা শূন্যতায় ছেয়ে যাবে। এই শূন্যতা সে এখনই হৃদয়ঙ্গম করতে লাগল। সে তার শূন্য জীবনের চিৎকার ধ্বনি শুনতে পেল। শূন্যতার হা-হা-কা-র তার কানের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে হৃদয়ের গভীরতর প্রদেশে পৌঁছে সেখানে রক্তপাত ঘটাতে লাগল। সেই রক্তস্নাত হৃদয় নিয়ে সে জীবন কাটাবে কিভাবে? সে বাঁচবে কিভাবে? তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুততর হলো, এই শীতের দিনেও সে ঘামতে লাগল। তার এতো দিনের দৃঢ়তা, এতো দিনের সংকল্প, এতো দিনের প্রত্যয় বানের স্রোতে খড়কুটো যেভাবে ভেসে যায় সেভাবে মুহূর্তের মধ্যে ভেসে গেল। সিএনজি ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করল। এখনই বাংলামটর পার হবে। ঠিক সেই সময় জেরিন ড্রাইভারকে বলল, গাড়ি ঘুরান। যেখান থেকে এসেছেন সেখানে নিয়ে চলুন।

সে নিশ্চিত যে সে ফয়সালকে ছাড়া বাঁচবে না। বুঝতে পারল তার বুকের ভেতরে এতোদিন ধরে যে ভারী পাথরটা জেঁকে বসেছিল সেটা এখন নেমে গেছে। সে হালকা বোধ করতে লাগল।