অড্রি হেপবার্ন ও একটি গরম দুপুর

অ+ অ-

 

অনেকদিন পর পীযুষ কাকার সঙ্গে দেখা। ছুটিতে বাড়ি গিয়েছি। বাজার থেকে ফেরার সময় রিকশা রেলওয়ে স্টেশনটা পার হতেই দেখি কে যেন হাত তুলে থামতে ইশারা করছে। তবে চিনতে এক সেকেন্ডেরও বেশি লাগল না।

বয়স বাড়লেও তেমন একটা বদলাননি। আগের মতোই লম্বা চুল টেনে টাক ঢেকে রাখেন। এখন সেই চুলে কলপ। বাড়ির সবার খবর নিলাম। একজন বাদে। পীযুষ কাকা নিজেই সেই মানুষটার খোঁজ দিলেন, তোমার কাকী তো অসুখ-বিসুখে জড়ায়ে গেছে, মামণি। একবার আসো দেখতে।

মঞ্জু কাকীর কথা বলছেন কাকা।

কাকা ফোন নাম্বার নিয়ে চলে গেলেন। ফেরার পথে, রিকশার হালকা ঝাকুনি খেতে খেতে ভাবছিলাম, বড় হওয়ার পথে কেউ কেউ আমাদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। তারা হয়তো কোনোদিন তা জানতেও পারে না। আমার জীবনে তেমন একজন মঞ্জু কাকী।

আমার বয়স তখন তেরো। পড়ি ক্লাস এইটে। পীযুষ কাকা আর আমরা পাশাপাশি থাকি। বাবার বদলির চাকরি। কয়েক বছর পরপর একটা ট্রাকে সব তল্পিতল্পা গুছিয়ে নতুন জায়গায় যেতে হয়। ওই বছর আমরা তালপাড়ায় এলাম।

বাড়িওয়ালার আয়ের উৎস ঘুষের টাকায় তিল তিল করে বানানো এলোপাতারি কয়েকটা ঘর। নানা রকম কাপড় দিয়ে যেমন একটা কাঁথা তৈরি হয়, তেমনি অগোছালো সেই বাড়ি। বাড়িতে ঢোকার সময় শুরুতেই টিনশেড ঘর। জরাজীর্ণ অখ্যাত এক এনজিওর সাইনবোর্ড ঝোলানো। কালেভদ্রে অফিসটা খোলে। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে, টিনের চালে ফুটো, সাইনবোর্ডের এক কোণা নেমে এসেছে।

তার পাশে এক ইঞ্চিও জায়গা খালি না রেখে একতলা বিল্ডিং। সেটার ছাদের ওপর ইতিউতি লোহার রড খাড়া হয়ে সম্ভাবনা ঘোষণা করছে ভবিষ্যতে বহুতল হওয়ার। এই একতলাতে আমরা থাকি। আমাদের ঘর থেকে আরেকটু দূরে নিচু দেয়ালের ওপাশে একটা খাপছাড়া দোতলা বাড়ি। জানালাগুলোর গ্রিলের একেক ডিজাইন, একেক রং। দোতলায় এক ধরনের ঘরবারান্দা, নিচে আরেক ধরনের। দোতলায় বাড়িওয়ালা থাকেন। আমরা আসার কিছুদিন পরই নিচতলার একপাশে থাকতে এলেন পীযুষ কাকারা। ওপর-নিচ মিলিয়ে চারটি পরিবার।

পীযুষ কাকার স্ত্রী মঞ্জুশ্রী সরকার। মঞ্জু কাকী। অদ্ভুত সুন্দর। বড় বড় বাঙ্ময় চোখ সবসময় উৎসাহে ঝিকমিক করে, চওড়া কপাল, কোকড়ানো চুলগুলো নেমে এসেছে কোমল গলার পাশ দিয়ে। শরীরটা নিখুঁত প্রতীমার মতো বাহুল্যবর্জিত।

পীযুষ কাকা সরকারি ব্যাংকের অফিসার। মাঝারি উচ্চতা, টাকমাথা, গোঁফওয়ালা। চোখগুলো নিরুৎসক, উত্তেজনাবিহীন, সবসময় কিছুটা বিরক্ত। সমস্ত অবয়বে একটা গোলগাল এবং জড়সড় ভাব। কাকীর পাশে বেমানান, অনুজ্জ্বল এবং খুব সাধারণ।

ওই বাড়ির সমস্ত মহিলাদের মধ্যে কাকী একটু আলাদা। রুচিশীল, সৌখিন। খুব সুন্দর আল্পনা আঁকেন, নকশা করে পিঠা বানান, আসন বানান। প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো বই পড়েন, মাঝে মাঝেই সিনেমা দেখেন। রোজ বিকেলে সুন্দর শাড়ি পড়ে ছেলের হাত ধরে ঘুরতে বের হন। কোনো কোনো দিন দেখি দুপুরে স্নান শেষে কাকী এলোচুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে মোড়ায় বসে আছেন। হাতে হয়তো রবীন্দ্রনাথ বা সুনীলের কোনো বই অথবা কোনো ম্যাগাজিন। সামনে কাঁচের বোতলে আচার অথবা ডালের বড়ি রোদে দেওয়া। তাকে ঘিরে সবসময় একটা বিভা। সেটা রোদ, কাঁচের বোতল কিংবা লালচে গালযে কারণেই হোক।

কাকী আর কাকার প্রাইমারি স্কুল পড়ুয়া ছেলে পরশ। কিছু ব্যাপার ধরতে ওর একটু দেরি হয়ে যায়। পড়ায় এগোতে পারে না। প্রতি সন্ধ্যায় কাকা অফিস থেকে ফিরে খুব ধৈর্য্য ধরে পরশকে পড়াতে বসেন।

বাপী, বলো সএ আকার সা।

পরশ বলে, এ আকার সা।

কাকা বলে, গ র। সাগর।

পরশ বলে, গ র। সাগর।

বাপী, এবার সাগর বানান করো তো।

এ আকার সা, গএ আকার গা।

কাকা আবার প্রথম থেকে শুরু করেন, বাপী, বলো সএ আকার সা।

পরশকে নিয়ে কাকা খুব চিন্তায় থাকেন। অফিস বাদে সারাক্ষণ ওকে নিয়েই ব্যস্ত। কাকীকে দেখলে অবশ্য চিন্তার ব্যাপারটা বোঝা যায় না, মনে হয় জীবনকে সহজ স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন। নিজের কিছু গুণ পরশের মধ্যে দিতে পেরেছেন। তার মধ্যে একটা হলো মোমের মূর্তি বানানো। ছাঁচে ফেলা পরশের মোমের পুতুলগুলো দেখলে অবাক হতে হতো।

এই বাড়িসহ পাশে কয়েকটি ভাড়াটিয়া পরিবারের সবার মধ্যে খুব সদ্ভাব থাকলেও মঞ্জু কাকীর সঙ্গে সবার কেমন যেন একটা দূরত্ব। সবাই তার সাথে কথাবার্তা বলে ঠিকই, কিন্তু মেশে না। ওই বাড়ির সবাইকে দেখলে মনে হতো, তারা এক জগতের বাসিন্দা আর মঞ্জু কাকী অন্য জগতের।

কাকীর সঙ্গে খুব দ্রুত আমার ভাব হয়ে গেল। সম্বোধন নেমে এলো তুমিতে। তার ঘরে গিয়ে বইপত্র, ম্যাগাজিন উল্টেপাল্টে দেখি। তার আঁকা ছবি, সুতার নকশা, মোমের মূর্তি খুঁটিয়ে দেখি আর কায়দাকানুন শিখি। ওই বাসায় যত থাকি, ততই ভালো লাগে। তাদের মধ্যবিত্ত বাসায় একটা মাত্র ঘর, সঙ্গে ছোট্ট একটা ডাইনিং স্পেস। কিন্তু সব গোছানো, ছিমছাম, ছবির মতো।

ওই পত্রিকাগুলোর মধ্যেই একবার একটা সিনে ম্যাগাজিনে আমার চোখ পড়ল। ভেতরের দুপাতা জুড়ে এক বিদেশি নায়িকার ছবি। একবার সেই ছবি আর একবার কাকীর দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, তোমার সাথে এত মিল!

কাকী খিলখিল করে হেসে দিল। ছবির ওই নায়িকাকে ইঙ্গিত করে বলল, সে বলে সুখী মেয়েরা সবচাইতে সুন্দর। তাহলে হয়তো আমি অনেক সুখী।

আমি বললাম, তুমি ওর চেয়েও সুন্দর। তাহলে তুমি ওর চেয়েও অনেক সুখী।

স্কুলের অনেক গল্প আমি কাকীর কাছে বলতাম। কাকী খুব আগ্রহ নিয়ে শুনত। নিজের ছোটবেলার গল্প করত। তার বাম হাতে বড় একটা কাটা দাগ। এক বন্যা ডোবা ধানক্ষেতে নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে কেটে গিয়েছিল। আরেকবার সে যখন ক্লাস ফাইভে, একটা ছেলে তাকে চিঠি লিখেছিল। যেখানে ছিল অনেক রকম ফুলের উপমা, ফুলের বাগানে কত ফুল ফোটে, নাম নাহি কেহ জানে/ কিন্তু গোলাপ, চম্পা, চামেলি, শেফালিরে সবে চেনে। আরও অনেকেই কাকীকে চিঠিতে লিখত। কিন্তু সেই চিঠিটা ছিল বিশেষ। কারণ তাতে ছিল অনেক ফুলের পাপড়ি।

কখনো কখনো কাকীর সঙ্গে বিকেলে কলেজের মাঠ, পুকুরপাড়, আশেপাশের এলাকায় চায়ের দোকান এসব জায়গায় যেতাম। লাশকাটা ঘরের জানালাটা ছিল অনেক ওপরে। কাকী লাফ দিয়ে দেখার চেষ্টা করত ভেতরটা। আমিও করতাম। এসব করার সময় মনে হতো আমাদের বয়সে কোনো পার্থক্য নেই।

এই রুটিনে ব্যতিক্রম হতো যখন তার বাসায় কোনো মেহমান আসত। প্রায় প্রতি মাসেই তাদের বাড়িতে মেহমান আসত। ওই কয়দিন কাকীকে সারাদিন প্রায় পাওয়াই যেত না। তবে বিকেলের রুটিন বদলাত না। সুন্দর শাড়ি পরে, কপালে টকটকে নতুন লাল টিপ দিয়ে অতিথিদের নিয়ে সে হাঁটতে বের হতো।

এরকমই এক দিন। গরমকাল। সেদিন পেট ব্যথার জন্য স্কুলে যাইনি। দুপুরে ভাত খেয়ে উঠেই পরশদের ঘরের দিকে দৌড় দেব, মা থামিয়ে দিয়ে বলল, সামনে পরীক্ষা। হয় ঘুমাও না হয় পড়তে বসো। ভর দুপুর কারো বাসায় যাওয়ার সময় না। ...আর ওদের বাসায় মেহমানও আসছে।

পড়তে বসার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। বিরক্ত লাগল। ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলাম। তারপর পেছনের দরজা দিয়ে ঘুরে বের হলাম যাতে মা না দেখে। আস্তে আস্তে ওই বাসার দিকে যেয়ে দেখি ওদের ঘরের দুটো দরজাই বন্ধ। সামনের দিকের দুটো জানালাও বন্ধ। দরজায় তালা নেই। ভেতর থেকে বন্ধ। পরশ স্কুল থেকে আসে চারটায়। কাকা অফিসে। আমার মনটা একটু মিইয়ে গেল।

তখন বাসায় ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই। তাই পাশের বাসার বেলি আপাদের বাসায় গেলাম। বেলি আপা আমার সে বছর কলেজে ভর্তি হবে। মঞ্জু কাকী আসার আগে আমি মূলত বেলি আপার সাথেই সময় কাটাতাম। তার প্রধান সাগরেদ রুনু, যে আমাদের প্রতিবেশি এবং আমার ক্লাসমেট।

বেলি আপাকে একটা দায়িত্ব না দিলেও সে নিজ থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করত। সেটা হলো, প্রাপ্তবয়স্ক দুনিয়ার খুঁটিনাটি বিষয়ে আমাকে জ্ঞান দেওয়া। যৌনতা থেকে শুরু করে ছেলেদের বিশেষ অঙ্গ, চুমু খাওয়ার কৌশল, ব্রা-প্যান্টি, নায়িকাদের শরীরের মাপ ইত্যাদি বিষয়ে তার জ্ঞানভান্ডার সীমাহীন। রুনু এবং তার আলোচনার মূল বিষয় এগুলো। আশেপাশে থাকলে যে কোনো মুহূর্তে এই সব জ্ঞান লাভের ভয়ে থাকতে হতো।

রুনু আর আমার সঙ্গে বেলি আপা মাঝেমধ্যেই একটা খেলা খেলত। খেলাটা হলো কে কত অশ্লীল কৌতুক বলতে পারে। বেলি আপার কৌতুক বলা সাধারণত শুরু হতো এভাবে, ভিনগ্রহ থেকে এক এলিয়েন আসছে। এসে পৃথিবীর তিনজন পুরুষের হাতে ধরা পড়ল। তারা ঠিক করল এলিয়েনটার সঙ্গে সেক্স করবে। কিন্তু একটা কঠিন সমস্যা’ এরপর শুরু হতো সেই কঠিন সমস্যার খুঁটিনাটি বিবরণ যা শুনলে গায়ের রোম খাড়া হয়ে যায়। বেলি আপার এইসব গল্পের সংগ্রহ ছিল বিস্ময়কর, অসীম ও বিস্তারিত। রুনুর এগুলোতে খুব আগ্রহ থাকায় তার অংশগ্রহণ ছিল সন্তোষজনক। তবে আমার স্কোর হতো খুব লজ্জাজনক। সেই কারণে আমাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও হতো। এসব কারণে, আমি বেলি আপাকে মনে মনে বেশ ভয় পেতাম।

মঞ্জু কাকী আসার পর বেলি আপা এবং রুনুর সাথে ঘোরাঘুরি কমে আসে আমার। মাঝে মাঝে বিকেলগুলোতে তারা দুজন আমাকে খুঁজতে এসে ফিরে যেত।

তাই আপা আমাকে দেখেই বলল, কী রে গীমা! আজকে হঠাৎ আমার কথা মনে পড়ল?

গীমা একটা গালি। সবার সামনে সুন্দরভাবে গালি দেওয়ার সুবিধার্থে বেলি আপা গালিটা উল্টে নিয়েছে। এসব কারণেই আমি তাকে ভয় পাই।

যাই হোক, বেলি আপার সম্বোধনকে পাত্তা না দিয়ে বললাম, কী করো?

নাচতেছি।

সে তখন একটা জুতার বাক্সের ভেতর থেকে গোলাপি রঙের ইঁদুরের বাচ্চা বের করছে। এগুলোকে বিদায় করা হবে। আমি দুয়েকটা কথার পর বললাম, আচ্ছা, মঞ্জু কাকী দরজা-জানালা আটকে কী করে।

বেলী আপা ঠোঁট একটু বাকিয়ে বলল, মাদাম কুরির আজ কী হইছে? স্কুল নাই?

আমি বললাম, যাই নাই।

পেটব্যথার কথাটা বললাম না, কারণ বললে আবার বিশ্রী কিছু শুনতে হবে। তাড়াতাড়ি বললাম, এমনি। মঞ্জু কাকীর ওখানে গেছিলাম। দরজায় তালা নাই। দরজা খুলল না।

তুমি তো মঞ্জু কাকীর ওখানেই যাবা। এইসব মহিলাই তো তোমার পছন্দ।

আমি বেশ ক্ষেপে উঠে বললাম, তো, সমস্যা কী?

সে চোখ টিপ দিয়ে বলল, জানিস না?

আমি বললাম, কী?

মঞ্জু কাকী শোয়।

শোয় মানে?

শোয় মানে শোয়। শোয়া মানে জানো না তুমি খুকি? একটা লোক যখন একটা মহিলার উপরে উঠে...

আমি তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিয়ে বলি, মানে কী? পীযুষ কাকা তো অফিসে।

আমার চোখে অবিশ্বাস দেখেই হয়তো বেলি আপা আমার হাতে এক হ্যাচকা টান দিয়ে নিয়ে গেল। ওদের বাসার ঠিক সামনে একটা আন্ডারকনস্ট্রাকশন বিল্ডিংয়ের দোতলায়। এখানে প্রায়ই আড্ডা দেই আমরা।

দরজা জানালা বন্ধ কেন জানিস না? পীযুষ কাকার অসুখ। মঞ্জু কাকী তার সঙ্গে শুতে পারে না। হুহ্। অন্য লোকদের সঙ্গে শোয়। ...দেখিস না বাসায় কত পুরুষ আত্মীয় আসে ওদের। দেখিস, এ বাড়ির কেউ ওদের বাসায় যায় না।

আমার মাথায় তখন তোলপাড়। বেলি আপা আরও অনেক কিছু বলল। তবে আমার মাথায় সেসব ঢুকল না। বিল্ডিংয়ের সামনে বিশাল একটা পুকুর। ঝিরঝিরে বাতাস। সেই বাতাসে পুকুরপাড় থেকে ইঁদুর মরার মতো তীব্র কোনো একটা গন্ধ ভেসে আসছিল। আমার গা গুলিয়ে আসল। কিছু বলতে পারলাম না।

সেই রাতে আমি ঘুমাতে পারলাম না। পৃথিবীটা হঠাৎ খুব দ্বিধাময়, অশান্ত একটা জায়গা হয়ে গেল। কী সত্য, কী মিথ্যা জানি না। কিন্তু মঞ্জু কাকী এবং বন্ধ দরজার ওপাশে থাকা না দেখা কোনো লোককে নিয়ে একটার পর একটা অযাচিত ভাবনা আমার মাথায় খেলে যেতে লাগল।

পরদিন ও বাড়িতে ঢুকতে প্রচণ্ড সংকোচ লাগল। দিন দিন এই সংকোচ কমার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না।

এ কয়দিন কাকী আমাকে আগের মতোই খুঁজল। এক পর্যায়ে আমার মনোভাব বুঝতে পেরে অবাক হয়ে গেলো, ক্রমাগত আমাকে বোঝার চেষ্টা এক সময় বাদ দিল। হয়তো ভেবে নিল, এই বয়সে কত খেয়াল আসতে পারেকদিন পর আবার আমি আগের মতো তার কাছে ঘুরঘুর করব। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও সেটা হলো না, ততদিনে অনভ্যস্ততার দীর্ঘ দেয়াল এসে আমাদের জীবনের মাঝে দাঁড়িয়ে গেছে।

আবার আমি একা হয়ে পড়লাম।

দূর থেকে চোখে পড়ে পীযুষ কাকার রুটিন আছে সেই একই। সন্ধ্যায় ফিরে পরশকে পড়াতে বসান। আমাদের উঠানের একপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালে দেয়ালের ওপাশে তাদের ঘরের ভেতরটা দেখা যায়। কাকী গরম লুচি আর চা এগিয়ে দিচ্ছেন। তার নকশা করা আসনে বসে পিতা-পুত্র একসঙ্গে খাচ্ছে। নিটোল তাদের সংসার।

এত সময় কোনোভাবে কাটানোর উপায় খুঁজে না পেয়ে আমি একদিন পড়ার টেবিলে ফিরে গেলাম। পড়ার টেবিলের সাথে দিন দিন গাঢ় হতে লাগল আমার সম্পর্ক। ক্লাস এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলাম, জেলায় প্রথম। তারাশঙ্করের কবি কিনে মার কাছে রেখে গেল কাকী। আমি আর পরশদের ঘরে ঢুকতাম না। সবাই জানত আমি হঠাৎ খুব সিরিয়াস স্টুডেন্ট হয়ে গেছি। আগের মতো ঘোরাঘুরি করি না। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। এর পরের মাসে বাসা বদলে হয়ে উকিলপাড়া চলে আসতে হলো আমাদের। সবার ওপর দিয়ে বেশ ঝক্কি-ঝামেলা গেলেও আমি মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

বাড়ি বদলালে লোটাকম্বলের সাথে সাথে মানুষ স্মৃতির বোঝাও বয়ে নিয়ে যায়, পুরনো বাড়িতে তবু অনেক কিছু ফেলে চলে আসা যায়, স্মৃতির কিছুই ফেলে আসা যায় না। অনেকদিন পর একদিন মার সঙ্গে রিকশা দিয়ে নোয়াডাঙ্গার দিকে যাচ্ছি। ডিসি অফিস পার হওয়ার পর মা আমাকে একটা বাসা দেখিয়ে বলল, ওই যে, পরশরা এখন ওই বাসায় থাকে।

একটা ঝকঝকে চুনকাম করা নতুন বাড়ি। দোতলায় দুটো ঘর। সেদিকে তাকাতেই পুরনো জ্বর আমার ওপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। মাকে বললাম, আমাকে কাকীর কথা বলবা না আর।

মা অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না।

আজ এত বছর পর পীযুষ কাকার সঙ্গে দেখা হয়ে এত কথা আর প্রশ্ন মনে পড়ে যাচ্ছিল যে সেগুলোর চাপে আমি অনেকটা হাঁপিয়ে উঠছিলাম।

ফোন নাম্বার নেওয়ার পর কাকাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পরশ কী করে কাকা? কোথায় আছে?

লাইফ ইনস্যুরেন্সে চাকরি করে। বিয়ে করছে, আমি তো ঠাকুর্দা হয়ে গেছি রে মামণি। হা হা হা।

একবার জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল ও এখনও মোমের পুতুল বানায় কিনা। কিন্তু কথাটা জিজ্ঞেস করলাম না। কাকা বিদায় নেওয়ার আগে বলেছিলেন, তোমার কাকী তো অসুখ-বিসুখে জড়ায়ে গেছে, মামণি। একবার আসো দেখতে।

মনে করতে না চাইলেও কাকীকে মনে পড়ত না তা না। মনে পড়েছে তারাশঙ্করের কবি’ পড়ার সময়। যে কোনো লাশকাটা ঘর দেখে। সেগুনগাছের নতুন পাতা দেখে তার ভেতরের লাল রঙকে ভেবে। যেদিন কাকীর কাছে ম্যাগাজিনে প্রথম দেখা সেই অড্রি হেপবার্নের রোমান হলিডে দেখতে গেলাম, কাকতালীয়ভাবে প্রেমিক টেক্সট করল, দ্য বেস্ট থিং ইন লাইফ ইজ টু হোল্ড অন টু ইচ আদার সেদিন ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠতে উঠতে আচমকা আমি যার কথা ভেবেছিলাম সে মঞ্জু কাকী।

একদিন এক নিথর দুপুরে টিউশনিতে গিয়ে আমার টিনেইজ ছাত্রী মারিয়ার কাছে তার স্কুলের দুই বান্ধবীর মাঝে তৃতীয় একজন নতুন বান্ধবী ঢুকে পড়ায় কী ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে সেই সব গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎ আমার মঞ্জু কাকি বিষয়ক রহস্যের সমাধান হয়।

জলের মতো সহজভাবে চোখের সামনে ঝুলতে থাকে বেলি আপার কল্পনাশক্তি আর ছোট্ট একটা প্রতিশোধ নেওয়ার দৌড়। বেলি আপা আসলে সামান্য একটু খেলেছিল আমাকে নিয়ে। কৈশোরের দ্বন্দ্বমুখর সত্তা আর কল্পনার জোর দিয়ে আমি কেবল সেই খেলায় অংশ নিয়েছি। সরলতা, আপাত ভালমানুষির মতো অপছন্দের বিষয়গুলো সত্ত্বেও আমি ছিলাম বেলি আপার একজন পছন্দের মানুষ, যা আমি কখনো তেমন করে বুঝিনি। হয়তো সেও বোঝেনি আমাদের জীবনে মঞ্জু কাকী আসার আগে। রুনু এবং আমাকে নিয়েছিল তার একার যে রাজত্ব সেটা ভেঙে আমি চলে যাই, দেবীপ্রতিম মঞ্জু কাকীর আকর্ষণে। দিনের পর দিন সাড়া না পেয়ে আহত বেলি আপা, আমাকে একদিন কাছে পেয়ে সে আমারই মুখ থেকে শোনা কিছু শব্দ আর চিরাচরিত গল্প বানানোর অভ্যাস দিয়ে সেদিন বানিয়েছিল আরেকটা কৌতুক। কালো, অন্ধকার, অস্বস্তিকর সেই কৌতুক।

এতদিন পর সব বুঝেও আমি মঞ্জু কাকীর সামনে গিয়ে আর দাঁড়াতে পারিনি। পুরনো সময়গুলোর সাথে সাথে আমি আমার শৈশবকেও ফেলে এসেছিলাম ধরাছোঁয়ার বাইরে। মঞ্জু কাকী, আমার ব্যক্তিগত অড্রি হেপবার্নকে ভেবে একদিন যে আমি ঘৃণায় কেঁপে উঠেছিলাম, সেই বিকট মূর্তির আমিকে বিস্মরণের পাতায় কখনোই পাঠাতে পারিনি।।