ঘর, পর, নির্বাসন

অ+ অ-


|| ১ ||

কিছু নয়। বাঁচার উত্তরে বাঁচা। ভালোবেসে বাঁচা।
একদিন, প্রতিদিন, দিনকে দিন, উন্মুক্ত সঙ্গমে
মেলে ধরা নিষ্ঠুর গোপন কারণটাকে; না, না,
বাঁচা আরো কিছু, আরো ভালোবাসতে পারা, বাসা!
বাড়ির নিকটে বাড়ি, সারাদিন সুযোগ্য সন্ধানে
শূন্যতাকে অর্থে ভরে তোলা, বাড়তি করা; কিছু
পারাপার, কিছু মুখ, স্মৃতি, কিছু আড়ালে-আবডালে
ডেকে আনা হারানো চুম্বন, সত্যিকার যা অমেয়!
একদিন, প্রতিদিন, নির্বোধের মতো সহ্য করা,
কিছু নয়, বাঁচার উত্তরে বাঁচা, ভালোবাসা, ভালোবেসে বাঁচা!

 

||  ||

Your only problem, perhaps, is that you scream without letting yourself cry.
—Friedrich Nietzsche

যে জানে, সে সুখী নয়—এই কথা মেনেই সর্বদা
প্রাণের পসরা সাজিয়েছি; তাই এ প্রাণ কখনো
নক্ষত্র হয়েছে, আর কখনো নিজেরই ধুলো চেটে
পেয়েছে অমৃতস্বাদ। ভালোবেসে না হোক, জগতে
বা হৃদয়ে যেটুকু আনন্দ ছিলো, হারাতে চাইনি!
হে এলিজাবেথ, কাঁদছো কেনো? বসো, ভাবো,
আমরা কি সুখী নই? অস্তিত্বের বিনীত বাগানে
কিছু অবিকল ফুল ফোঁটাইনি? এর চেয়ে বেশি
কে পায়? কে পেতে পারে? অমৃত মন্থনে ক্লান্ত
আমরা। একথা জানি, দুঃখই প্রকৃত জীবন,
যন্ত্রণাই বিশুদ্ধ মাধুরী; আর হৃদয়ে যা কিছু
আনে উদ্ভাস, ধরো, ভালোবাসা, কিংবা ধরো, নারী—
তাও কি দুঃখ নয়? মৃত্যু নয়? এসবের মানে
হে এলিজাবেথ, জানে, যে ভুগেছে, সে-ই শুধু জানে!

 

|| ৩ ||

ইচ্ছে হচ্ছে, যন্ত্রণা থাক, প্রাণ ভরে থাক অন্তর্জ্বালা,
আগুন ভেবে উসকে দিচ্ছি, উনুনে তা-ও ফুলের মালা!
স্মৃতির ভারে নুয়ে পড়ছি, কোমল ধুলোয় শুয়ে থাকছি,
              হাত ধরে কেউ তুলে না দিক, নয়।
ইচ্ছে হচ্ছে, অভিশাপের আগুন লেগে হোক পুড়ে ছাই
এই অচেনা জীবন; আমার মুখে লাগুক বিষ;
ইচ্ছে হচ্ছে, আবার ভালোবাসি!
চোখের আলো চোখ খেয়েছে, হৃদয় বুকে হৃদয়দীন দেহে,
তুলো এখন লোহার চেয়ে ভারি, ইচ্ছে হচ্ছে, আবার মেপে দেখি।
স্মৃতির মতো পরম সে কি আজো? ব্যথা আজো?
নুয়ে পড়ছি, ঝরে পড়ছি, কোমল ধুলোয় শুয়ে থাকছি, থাকি,
          ইচ্ছে হচ্ছে, এমনই শুয়ে থাকি!

 

||  ||

ঘরে ফেরো, ঘরে ফেরো, হে ওডেসীয়ুস, এসো,
এই সুখের অত্যাচার, বিধবার মতো অবিশ্রাম
শান্তির সেলাই বোনা! অসহ্য, অসহ্য! আমি দুঃখ হতে চাই,
দুঃখী হতে চাই, ঘরে ফেরো, ঢেউয়ের শরণ,
হে ওডেসীয়ুস, ভাঙা পাখা জুড়ে দাও আমার দু’কাঁধে,
ভাঙা নৌকো ভাসাও সাগরে, ঘরে ফিরে
অতীতের পঞ্জরাস্থি ভেঙে ফেলো, সুখের রুমাল
মুখ মুছে দূরে ফেলে দাও, কাছে এসো, হে ওডেসীয়ুস,
নিঃশব্দে গড়ে তোলো আমাকে, দরকারে
বারবার ভাঙো, গড়ো, বারবার বেদনার দিকে
তুলে ধরো আমার সর্বস্ব, অস্থি, মাংস, মজ্জা, মেদ,
শুধু ফেরো, দেহে ও হৃদয়ে ফেরো, হে ওডেসীয়ুস, ফিরে
জীবনে একটু এনে দাও পরিতাপ, বর্ষা, ঢেউয়ের ফক্কিকার, মেঘ!

 

||  ||

চাঁদের চারা পুঁতেছো ফুলবাগানে,
ওখানে চাঁদ নয়, ফুল নয়,
ওখানে রক্ত ফুটবে, ডাইনী ফুটবে,
ফুলের হাসির বদলে মিলবে শয়তানের টিটকিরি,

চাঁদের চারা উপড়ে ফেলো
গোড়াসুদ্ধু, বদলে মাটির খাঁজে খাঁজে
নিজেরই হৃৎপিণ্ড লুকোও, ফুল ফুটবে,
পাখি গাইবে হৃৎপিণ্ডের পাতায় পাতায়!

চাঁদের চারা ছাই হয়ে যাক!
ফুলবাগানের ফুলের মতো হনন করো
নিজের বুকের চাঁদ, তবেই রক্ত নয়,
চাঁদ ফুটবে, কেবল নিজের আলো নিভিয়ে দাও!

 

|| ৬ ||

[বিদায়ঘাট]

দাঁড়াতে পারবো না, সে মুখ রাখিনি,
আজ কারো চোখে খুশির লেশ নেই।
আমাকে দেখে দেখি সবারই লজ্জা!
এ-ই কি পুত্রের চরম স্বস্থান?

জীর্ণ লোকালয়, শূন্য হাঁটখোলা,
নিঃস্ব ধুলো ওড়ে পথের তুফানে;
কেউ তো ডাকে না, ‘আয় রে, ফিরে আয়!’
আমি কি দাঁড়াবো না? আমি কি পালাবো?

এ ঘাট স্মৃতিময়, এ ঘাট প্রেমিকা,
খুচরো পয়সায় থাকবো তাঁবু গেড়ে!
ধ্বস্ত যে মানুষ, থেকে বা না থেকে
তার কি এসে যায়? তার তো পলায়ন!

যেদিন দুঃখের তরণী ফাঁকা ছিলো,
যেদিন মৃত্যুয় ছিলো না লজ্জা,
সে দিন গত, আজ আমি তো অচ্ছুৎ,
অচেনা, পড়ে পাওয়া, ঘৃণ্য খ্রিস্টান!

শূন্যে উড়ে যায় প্রাচীন শৈশব,
আমাকে নদী-মাটি-বৃক্ষ চেনে না,
এ কাঠ-বাদাম গাছ, এ মাতৃভূমি
কেঁদেও কাঁদে না পুত্রশোকে!

শরীরে বুনো ঘাস, শূন্য অন্ত্র!
দিনকে দিন যাবে, ধর্ম আসবে না
নিঃস্বে ঠাঁই দিতে! আমি আগন্তুক!
প্রত্যাবর্তন যাক উচ্ছন্নে!

দাঁড়াতে পারবো না, তাই ছুটছি;
কোথাও থামবো যে, সে মুখ রাখিনি!
আমাকে দেখে দেখি আমারই লজ্জা!
আমি কি কখনো বিরাম পাবো?

 

|| ৭ ||

যখন তোমার দু’চোখে ঢুকে গেছে ছারপোকা,
ভীষণ শীত করছে, অথচ পেট-পিঠ খোলা,
মনে পড়ছে মায়ের মুখ, মায়ের গায়ের চুমকি-বসানো চাদর,
অথচ তুমি পালিয়ে যেতে পাগল, মরার নেশা
তোমাকে ছাড়েনি; তখনও প্রসাব হলুদ হচ্ছে জেনেও
একটুও ভয় করে না; তুমি চাও মরতে, মরতে
এবং মরতে, এবং তখনও আতর মাখো জামায়,
ঘাড়ের কাছে আঁচিল দেখে আঁতকে ওঠো ভয়ে,
তখনও সঙ্গোপনে নিজেকে আদর করো,
ভালোবাসো, কল্পনা করো অনেকেই ভালোবাসছে,
এবং তখনই বেরিয়ে পড়ো অচিন রাস্তায়,
ভীষণ শীতে পেট-পিঠ খোলা, দু’চোখে কুয়াশা;
পালিয়ে কোথায় যাবে জানো না, খালি ছাড়া পেয়ে
মরবে, মরবে, এবং মরবে, এই ভাবনায় কাতর;
এবং তখনও তোমার দু'চোখে কান্না, মনে বিতণ্ডা,
আদরের লোভ, ভাপা পিঠে, ঘর, ভাঙা ও গড়ার অগাধ ইচ্ছা!