‘ভাঙা নাও’ ও ওয়াকিলুর রহমানের ‘মনোভূমি’

অ+ অ-

 

যেকোনো কিছু দেখার সাধারণ দুটি উপায় খোলা থাকে। এক. যিনি নির্মাণ করছেন, তার চোখে দেখা; আর দুই নম্বর উপায়টি হলো মুক্ত মনে নিজের চোখে দেখা। এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য কেমন হবে, কতটুকু হবে বা আদৌ হবে কিনা, তা নির্ভর করে এই দুই ভিন্ন ব্যক্তিত্বের অবস্থা ও অবস্থানের ওপর। তবে শিল্পীর সাথে আমার দর্শক হিসেবে একটি সাধারণ বাস্তবতার মিল রয়েছে। তা হলো শিল্পী যে পটভূমিতে বসে মননকে খুঁড়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছেন, তার রাজনৈতিক পটভূমি আমাদের জন্য এক।

 

চিত্র: দিনের আলোয় চলমান প্রদর্শনীর একাংশ

শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান নৌকা নিয়ে কাজ করেছেন। নৌকা যতটা সাংস্কৃতিক, তার চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক। আর বর্তমান বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই বস্তুটি নানাভাবেই রাজনৈতিক অর্থনীতির স্মারক। এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রত্নবস্তু হওয়ার পথে। নৌকা এমন এক অর্থনীতির স্মারক, যার সাথে ভূগোলের পরিচয় না চাইলেও জড়িয়ে থাকে। ফলে নৌকা ডেকে আনে থিকথিকে কাদা-মাটি, জল, বৃষ্টি, নদী, সাগর, কৈবর্তের ইতিহাস। আর এই জলের সাথে প্লাবন, প্লাবনের সাথে বন্যা, বন্যার সাথে এ অঞ্চলের মানুষের আপসের গল্প। এই আপস, এই মানিয়ে নেওয়ার মধ্যে এই অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ইতিহাস ছড়িয়ে আছে। ওয়াকিলুর একেই কি বলছেন'অস্তিত্ব বিনির্মাণের সংস্কৃতি'?

তিনি তার প্রদশর্নী সম্পর্কে লিখেছেনঅস্তিত্ব বিনির্মাণের সংস্কৃতি ও আমাদের মনোজগতের জট খোলার জন্য, বোঝার জন্যই মনন খনন।

একদিকে নদী, জলা শুকিয়ে যাচ্ছে, নৌকা বিনোদন ছাড়া আর টিকে থাকছে না। জাদুঘরে চলে গেছে অনেক আগেই বহু ধরনের নৌকা। জাদুঘরের বস্তু-সংস্কৃতির মতোই ওয়াকিলুর নৌকা নিয়ে গ্যালারিতে এসেছেন? প্রশ্ন হলোকেন? জনপ্রিয় ও বহুল প্রচারের সূত্র ধরে, নাকি হারিয়ে যাওয়া বস্তুর প্রতি স্মৃতি তাড়িত হয়ে? নাকি অন্য কিছু?

প্রথম সম্ভাবনাটি কি ওয়াকিলুর বাতিল করেন? তার কাজ দেখে কি আমরা বাতিল করতে পারি যে, বর্তমান সময়ের প্রভাব তার ছবিতে পড়েনি? নৌকাকে ঘিরে নূহের প্লাবনের মিথ থেকে আমাদের বর্তমান সময়ে নির্বাচনী গান, সবই রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ; সন্দেহ নেই। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে যারা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করেন ও মতামত রাখেন, তাদের বয়ানও রাজনৈতিক পটভূমি থেকে জাত। লালন সামাজিক-রাজনৈতিক দুর্দশার পরিণাম। এইসব কিছু ওয়াকিলুরের জানা, তবু একটা সন্দিগ্ধ প্রশ্ন তো মনে জাগেই যে, শিল্পী কেন এই সময়ে নৌকা নিয়ে আমাদের অস্তিত্বের ইতিহাসের নদী পথ দেখাতে বৈঠা হাতে নিলেন। অস্বীকারের জো নেই, প্রচারেই প্রসার। অস্বীকার করা যায় না, প্রচার সম্মতি উৎপাদনের জন্য কাজ করে। ওয়াকিলুর সম্মত হননি; যদিও দর্শক হিসেবে আমি তার কাজে প্রথম সম্ভাবনাটি উড়িয়ে দিই না, অথবা দিতে চাই না সময়ের পরিপ্রেক্ষিতের কারণেই।

তাহলে দ্বিতীয় সম্ভাবনায় আসি। যদি ওয়াকিল স্মৃতি তাড়িত হয়ে থাকেন, তবে কেন? ওয়াকিলের জন্ম ঢাকার সাভারে। কৈবর্ত সংস্কৃতি বা জলায় ডুবে থাকা পাট তোলার অভ্যাস তার নেই, নেই পরিচয় আবু ইসহাকের জোঁকের সাথে। তাহলে নৌকা কী করে দেখা দেয় তার এমন নিরেট নাগরিক জীবনে? দর্শক হিসেবে এই সকল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।

গ্যালারিতে ঢুকে আপনার শাহ আব্দুল করিমের নাম মনে না এলেও মাথায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো অবিরত গুঞ্জন তুলতে পারে তার গান। যেমন

...
একে আমার ভাঙা নাও
তার উপরে তুফান বাও,
পলকে পলকে ওঠে পানি রে।
কইয়ো দয়ালের ঠাঁই, এ তরীর ভরসা নাই
...

বা

...
কোন মেস্তরি নাও বানাইলো কেমন দেখা যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।

এখানে নাও উপমামাত্র। শরীরকে বোঝাতে রূপক হিসেবে নাও বারবার ঘুরেফিরে এ অঞ্চলের গানে এসেছে। ওয়াকিল বলেন, এ অঞ্চলের গান সবচেয়ে বেশি ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে মুক্ত। তার এই ভাবনা, এই খোঁজের যাত্রা বোধকরি আজকের নয়। এমনকি নৌকাও তার কাজে প্রথমবার আসেনি। ২০১৯ সালে শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের আঁকা ২২টি শিল্পকর্ম নিয়ে লালমাটিয়ার দ্বীপ গ্যালারিতে একটি প্রদর্শনী হয়েছিল দেহজমি/মনোভূমি শিরোনামে। মোস্তাফা জামানের কিউরেশনে অনুষ্ঠিত এই প্রদর্শনীর প্রেসকিটে বলা হয়এই ২২টি ছবি শিল্পী এঁকেছিলেন তার প্রবাস জীবনের শুরুর পরিবর্তনমুখী সময়ে [১৯৮৯-১৯৯১]। এই সময়ের ছবিতে সম্ভবত ওয়াকিলুর প্রথম নৌকা আঁকেন। আউটডোর স্টাডি হিসেবে নয়, নিজস্ব শিল্পকর্মের বিষয় হিসেবে তার ছবিতে নৌকা দৃশ্যমান হয়। ২২টি ছবি একসাথে দেখলে, খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়…’—লালনের এই গান আপনার মনে পড়ে যাবেই। ছবিগুলোতে মাংসল শরীর নয়, মূল কাঠামোটি বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। সেই শরীরে আছে নানা ফাঁক ফোকর হেনরী মুর বা নভেরার ভাস্কর্যের মতো। আর সেই নেতিবাচক পরিসরগুলোতে পাখির ফর্ম ঢুকে পড়েছে। এই ভঙ্গুর শরীরের সাথে তার একাধিক ছবিতে তিনি নৌকার ভঙ্গুর কাঠামোও এঁকেছেন। নৌকা নশ্বর শরীরের ক্ষয়ের দিকে যাত্রার প্রতীক।

১৯৮৯-১৯৯১ সালে করা এই দ্বিমাত্রিক কাজগুলোর আরও পরিশীলিত বা সংক্ষিপ্ত, কিন্তু ত্রিমাত্রিক উপস্থাপন বলা যায় তার ধানমন্ডির ২৭-এ বেঙ্গল গ্যালারিতে চলমান বর্তমান প্রদর্শনীকে। ফলে প্রাথমিকভাবে আমরা ওয়াকিলুরের সাথে একমত হতে পারি যে, তিনি এই সময়ের রাজনৈতিক প্রচারযন্ত্রের আস্ফালন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নৌকা ফর্মটি তার শিল্পকর্মের জন্য বেছে নেননি।

কিন্তু প্রশ্ন হলোতিনি জার্মানিতে বসে কেন নশ্বর শরীর, অচিন পাখি, পারাবারের নৌকা আঁকেন? কেন লালনের ক্যাসেট সংগ্রহ করে নিয়ে যান এবং দেশ থেকে সুদূরে বসে লালন শুনতে থাকেন?

 

ভাঙ্গা নৌকা ও মানুষ, tempera on board, 21x30cm, 1990

পুনরাবৃত্তিমূলকভাবে? ওয়াকিলুর ২০১৯ সালে দেহজমি/মনোভূমি প্রদর্শনী উপলক্ষে তা ব্যক্ত করেছেন সেই প্রেসকিটেই

১৯৮৮ সালের শেষের দিকে তৎকালীন পূর্ব বার্লিনে আমার প্রবাস জীবন শুরু হয়। জার্মান ভাষাতে ছিলাম অজ্ঞ, নৃত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাও ছিল না। ইউরোপীয় শিল্পকলার ইতিহাস সম্পর্কে পুস্তকনির্ভর তথ্য ও জ্ঞান নিয়ে বিখ্যাত জাদুঘরগুলোতে ঘুরে বেড়াই, দেখতে থাকি।

ঐতিহ্য, আত্মপরিচয়, আমাদের শিল্প, আমার শিল্প ইত্যাদি বিষয়ে সংকট ও উত্তরণ সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনা আগে থেকেই ছিল। বন্ধু-বান্ধবহীন সেই নতুন ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে যা কিনা আরো প্রকট হয়ে ওঠে।

ভারতীয় দর্শন, বাউল ও অন্যান্য লোকায়িত, সনাতন ভাবনাগুলো আকৃষ্ট করতে থাকে। মিনিয়েচার, পট, সরা, তান্ত্রিক শিল্পের গঠন, ভাষা, উপস্থাপনা নজরে আসতে থাকে। শিক্ষক, শিল্পী শহিদ কবীর ও গণেশ পাইনের চিত্র অভিজ্ঞতা উৎসাহিত করে। ছোট পরিসরে, স্বল্প উপকরণে এই ছবিগুলো আমার শিল্প চর্চার পথে খোঁজাখুঁজি, খোঁড়াড়ির একটি পর্যায়। ছবিগুলো ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সালে বার্লিনে আঁকা।

 

দেহজমি/ মনোভূমি ৩, tempera on wood, 11x24cm, 1989

অর্থাৎ, একাকিত্ত্ব ওয়াকিলুরকে লালন, তথা দেহের নশ্বর ভাবনার দিকে টেনে নিয়েছে। ওয়াকিলুরের নতুন প্রবাস জীবনে কোনো সামাজিক জীবন নেই। ফলে বিচ্ছিন্নতা তাকে জীবনের এক মৌন ও গভীর ভাবাবেগের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। এই পর্বের ছবিগুলোতে যদিও রঙের অভাব নেই। তবু গহীন অন্ধকারে ভেসে থাকা, হঠাৎ ঝলকে দৃশ্যমান হওয়ার মতো শরীর ও নৌকা জমে আছে ক্যানভাসে। 

১৯৮৪ সালে ওয়াকিলুর ঢাকা ত্যাগ করেন। চীনের পর বার্লিনে প্রবেশ করেন ১৯৮৮ সালে। তৎকালীন বাংলাদেশে সামরিক শাসন চলছিল। বাংলাদেশে ছাত্রজীবনে ওয়াকিলুরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, চীন হয়ে বিভক্ত ও রাজনৈতিকভাবে অস্থির পূর্ব বার্লিনে ওয়াকিলুর যখন স্থিত হলেন, তখন তার সঙ্গী বিদেশি জীবনসঙ্গী। এই প্রবাস জীবনে বোধ থাকে, কিন্তু ক্রিয়াশীল হওয়ার জন্য কোনো রাস্তা খোলা থাকে না। পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের কারণ হয়ে ওঠার সুযোগ নেই। কেবল আছি-এই অস্তিত্বই একমাত্র বাস্তবতা। ওয়াকিলুর কি এই আছি, কেবল টিকে থাকার, কেবল রক্ত-মাংসে অস্তিত্বশীল হওয়ার সাথে মানাতে পারেন না? তাই অস্তিত্বের প্রশ্ন তুলে নশ্বরতার দিকে তাকান? বস্তুবাদী মার্ক্সের দেশে বসে এই প্রবণতা কি আত্মহননমুখী? জানা নেই।  তবে, ওয়াকিলুর আত্মমুখী-এটা নিশ্চিত। না হলে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সালে করা কাজ তিনি প্রথম ২০১৯ সাথে প্রদর্শন করতেন না।

বেঙ্গলের বর্তমান প্রদর্শনীটি কি একই রকম বিচ্ছিন্নতার পটভূমে জন্ম নিয়েছে? হ্যাঁ, ওয়াকিলুর এখন দেশে আছেন। স্বজন, বন্ধুদের সাথে আছেন। তবু কি বোধসম্পন্ন মানুষেরা বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত-এই সময়ে?

প্রথম বিষয় হলো, ওয়াকিলুর যে কিছু করার তাড়না বোধ করেন, তার প্রমাণ তার পরিচালিত কলাকেন্দ্র আর্ট স্পেস। একটি অলাভজনক পরিসর নিজ শ্রমে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রায় ৯ বছর ধরে।

আর দ্বিতীয় বিষয় হলো, ওয়াকিলুর যদি কর্মী হতে পছন্দ করেন, তাহলে নিষ্কর্মা সময়কে তিনি মানবেন কেন! শরীরের নশ্বরতার ভাবনা থেকে আমরা দেখি ওয়াকিলুর ক্রমেই যাত্রা করেন একটি শূন্যতার দিকে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার এই সময়ের কাজগুলোকে মিনিমাল/ফর্মাল ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে। শিল্পের উপাদান নির্ভর এইসব শিল্পকে বিমানবিক শিল্পও বলা হয়। আসলে ওয়াকিলুর কী করেন? বিমানবিক শিল্প বা বিমূর্ত শিল্প নির্মাণ করেন, নাকি শূন্যতা বোধ করেন বলে তার ছবি থেকে চেনা বস্তুগুলো দূরে সরে যায়?

২০১৩ সালে খবরখাদ্য শিরোনামের প্রদর্শনী বা ২০১৬ সালে শিল্পীর সেন্সরড ইমেজ প্রদর্শনী ওয়াকিলুরকে মিনিমাল হলেও বিমূর্ত হতে দেয় না। ২০২২ সালে সংযম প্রদর্শনীর কাজগুলো রেখা প্রধান, মিনিমাল নিঃসন্দেহে। কিন্তু শিরোনাম তার ভাবনার কাছে নিয়ে যায় এবং নিজের যাপনের মধ্য দিয়ে কিছু করার একটা প্রবণতার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। শরীরকেন্দ্রিক ভাবনা শুধু নশ্বরতায় গিয়ে আটকে থাকেনি। বরং ওয়াকিলুর শরীরকে একটি নিদির্ষ্ট রীতির যাপনের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্ট করেছেন। তার ছবি নয়, তার যাপিত জীবনকেও সংযমের মধ্যে আনার চেষ্টা করেছেন। সেদিক থেকে তার কর্মপ্রয়াসেরই উপস্থাপন তার মিনিমাল পর্বও। মজার বিষয়, ২০১০ থেকে ওয়াকিলুর দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সংযম শিরোনামের প্রদর্শনীতে তিনি মোট ২৬টি কাজ প্রদর্শন করেন। তার মধ্যে একটি মাত্র রঙিন কাজ, যা ২০২২ সালে বাংলাদেশে করা।

 

চিত্র: রাতের আলোয় চলমান প্রদর্শনীর একাংশ

চলমান প্রদর্শনীতেও তিনি নশ্বরতায় মনোযোগী, মিনিমাল, কিন্তু বিমূর্ত কী? পুরো গ্যালারিকে তিনি চারটি রেখায় ভাগ করেছেন। চারটি রেখার মাঝে এক জায়গায় একটি কৌণিক রেখা ব্যবহার করেছেন। কালো রেখাগুলো তৈরি হয়েছে নৌকার নানা খণ্ডিত অংশ দিয়ে। কালো রেখারগুলোকে আলো আঁধারিতে এমনভাবে রেখেছেন যে, স্যাঁতস্যাঁতে না হলেও আলোর বৈপরীত্য দিয়ে চাকচিক্য তৈরি করতে চাননি, এড়িয়ে যেতে পেরেছেন প্রকাণ্ড বস্তুর নিজস্ব শব্দের আতিশয্য। বর্ষার কারণে দিনের আলো পর্যাপ্ত নয়। ফলে প্রাকৃতিক আলো যতটুকু আসতে পারত গ্যালারিতে, তা সচরাচর পাওয়া যায় না। কিছু রেখা তৈরি করা হয়েছে মাটিতে, আর কিছু রেখা ঝুলে আছে গ্যালারির ছাদ থেকে মাটিমুখী হয়ে। ওয়াকিলুর ক্যানভাসে শিল্পের উপাদানের যে বিন্যাস প্রকরণ ব্যবহার করেন, এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। বিন্যাস করার কাঠামোটি তার ২০২২ সালে প্রদর্শিত ছবিগুলোর কাঠামোর সাথে মিলিয়ে দেখে নিতে পারেন। সেদিক থেকে তার এই প্রদর্শনী তার শিল্পী জীবনের প্রথম পর্ব ও মধ্য পর্বের সমন্বয়। ওয়াকিলুরের পুরো শিল্পী জীবনের মধ্যে একটা অর্ন্তনিহিত মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। তার ব্যক্তি সত্ত্বা ও শিল্পী সত্ত্বাও আবার পরিপূরক।

ওয়াকিল খুব শকিং কোনো বস্তু বা বিষয় তার কাজের জন্য নির্বাচন করেন না। চলমান অভ্যস্ত জীবনের সাংস্কৃতিক মৌলিক প্রবণতা থেকে একটি বস্তু এমনভাবে নির্বাচন করেন, যা আপনার-আমার সাংস্কৃতিক যাপনের স্বাভাবিকতার অংশ হয়ে আছে। তিনি সেখান থেকে আলাদা করে কোনো বস্তুকে গ্যালারিতে যখন ফেলেন (চকচকে তকতকে বস্তু করে তোলার প্রবণতা কম থাকে) তখন মনে হয় আপনার চলমান জীবনের রিল থেকে একটা অংশ কেটে যেন এখানে আনা হলো। আর তখনই আপনি দর্শক হিসেবে প্রশ্ন করেন, এটা এখানে কেন? এটাতো আমরা দেখি, করি, খাই ইত্যাদি। দর্শকের যদি এরপরও সময় থাকে, তখন ভাবনারা আসবে, তারাও আপনার অপরিচিত নয়। সেলফ সার্ভেইলেন্স, খবরের আড়ালে নিজেদের বাস্তবতাকে হারিয়ে ফেলা, পীড়িত হওয়া ও পীড়ন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় যে সকল ঘটনা আপনাকে পীড়িত করত, এখনও করে অথচ আপনি যা যাপন করতে করতে ভুলে যান, ওয়াকিলুর তাই গ্যালারিতে আনার পর প্রশ্ন আসে-এরা এখানে কেন? নৌকা এখানে কেন? নৌকা কঙ্কাল হয়ে গেছে কেন? নৌকার কি তবে দুদর্শার কাল? নৌকার ভৌগোলিক সত্তা যদি এমন জীবাশ্মের পথে, তবুও এত উচ্চারিত হয় কেন?

 

চিত্র: রাতের আলোয় চলমান প্রদর্শনীর একাংশ, আলোকচিত্র: ওয়াকিলুর রহমান

ওয়াকিলুর এই গ্যালারিতে প্রায় আঁধারে কালো বস্তুগুলো বিন্যস্ত করেছেন। ফলে কোনো শব্দ নয়, বরং একটা ধ্যানমগ্ন পরিসর তৈরি হয়েছে। স্থাপত্য বিভাগের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা বস্তুগুলো বিন্যাসের মধ্যে ধরা পড়ে। সেলফি তোলার জন্য উদ্দীপক পরিসর তিনি তৈরি করেননি। দর্শক আধা আলোতে তুলনামূলক বেশি মনোযোগী হয়। ওয়াকিলুর একটি মাত্র বস্তুকে কেন্দ্র করে পুরো একটি প্রদর্শনী নকশা করেছেন। এ কারণেই বস্তুকে নানাভাবে দেখার, তথা বস্তুকে বস্তুসত্তা অতিক্রম করে দেখার প্রস্তাব করে তার এই প্রদর্শনী।

রাতে বাইরে অন্ধকার নেমে এলে আলোর বৈপরীত্য বাড়ে। পূর্ণিমার রাতে চরে জেগে থাকা আলো-আঁধারির খেলায় কিছু দেখেছেন কখনো? চরাচরে জেগে নেই কেউ যখন? একা সময় নিয়ে ঘুরে আসেন ওয়াকিলুরের প্রদর্শনী। তর্কের সুযোগ এখানে থাকলো।

নোট: ঢাকার বেঙ্গল গ্যালারিতে প্রদর্শনীটি শুরু হয় ৫ জুলাই ২০২৪ সালে, এটি চলবে ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত।