পাবলো নেরুদার তিনটি কবিতা

অ+ অ-

 

|| পাবলো নেরুদা ||

পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩), যাঁর পুরো নাম নেফতালি রিকার্দো রেইয়েস বাসোআল্‌তো, জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৪ সালে, চিলের পার্‌রাল শহরে। কবি তাঁর শৈশব এবং যৌবন কাটিয়েছেন তেমুকো শহরে, যেখানে তাঁর সঙ্গে চিলের অপর এক নোবেলজয়ী কবি গাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের সঙ্গে পরিচয় হয়। মাত্র তেরো বছর বয়সে তিনি স্থানীয় দৈনিকে লিখতে শুরু করেন। ১৯২০ সালে তিনি চেকোস্লোভাক কবি জান নেরুদার (১৮৩৪-১৮৯১) কাছ থেকে তাঁর কবিনাম ধার করেন। নেরুদার প্রথম কবিতার বই ক্রেপাসকুলারিও ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয়। পরের বছর তাঁর সবচেয়ে পরিচিত এবং সবচেয়ে অনূদিত রচনাগুলোর মধ্যে একটি, টোয়েন্টি লাভ পোয়েমস অ্যান্ড আ সং অভ ডিসপেয়ার প্রকাশ পায়। ১৯২৭ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে, সরকার তাঁকে বেশ কয়েকটি এশীয় দেশে সাম্মানিক রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে নিযুক্ত করে, যার মধ্যে তৎকালীন বার্মা, সিলোন, জাভা, সিঙ্গাপুর অন্যতম। সেসব কথা পরবর্তীকালে তাঁর আত্মস্মৃতিতে উঠে আসে। এই অভিজ্ঞতার আলোকেই রচিত হয় তাঁর পরাবাস্তববাদী কবিতার সংকলন, রেসিডেন্স অন আর্থ (১৯৩৩), যা তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মের একটি মাইলফলক বিশেষ।

স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হলে নেরুদা তাতে যোগ দেন এবং ফ্রাঙ্কোর স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেন, যার প্রত্যক্ষ ফসল তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ স্পেন ইন হার্ট (১৯৩৭)। ১৯৩৯ সালে তাঁকে মেহিকোতে সরকারি দূত হিসেবে নিয়োগ করা হয়, যেখানে তিনি তাঁর মহাকাব্যিক গ্রন্থ Canto General রচনা করেন, যা ১৯৫০ সালে মেহিকো থেকেই প্রকাশিত হয় এবং বিশ্বময় সাড়া ফেলে; এতটাই যে, প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তা দশটিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯৪৩ সালে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন, যদিও স্বৈরাচারী সরকারের প্রতিবাদ করাতে দ্রুতই তাঁকে আবারও দেশান্তরী হতে হয়। বছর দশেক বাদে স্থায়ীভাবে দেশে ফেরার আগপর্যন্ত তাঁর আরও বেশ কয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: The Heights of Macchu Picchu (1948), The Captain's Verses (1952), All the Love (1953), Grapes and the Wind (1954)। ১৯৫২ সালে থেকে ১৯৭৩ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি স্বদেশেই থাকেন এবং বহুবিধ লেখালেখি ও সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। এই সময় তিনি তাঁর তৃতীয় পত্নী মাতিল্‌দে উর্‌রুতিয়াকে উৎসর্গ করে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Hundred Sonnets of Love (1959) রচনা করেন। তাঁর এই সময়কার অন্যান্য বিখ্যাত গ্রন্থ হচ্ছে: Art of Birds (1966), The Hands of the Day (1968), End of the World (1969), Stones of the Sky (1970) ইত্যাদি। ১৯৭১ সালে পাবলো নেরুদা নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন।

 

ছবিটি অ্যাসোসিয়েশান অব রাইটার্স এন্ড রাইটিং প্রোগ্রামের সৌজন্যে

 

তিনটি কবিতা || পাবলো নেরুদা

অনুবাদ ও ভূমিকা || আলম খোরশেদ


সর্বদা

আমার সম্মুখে যা ঘটেছে
আমি তার জন্য ঈর্ষান্বিত নই।

তোমার কাঁধে একজন পুরুষকে চড়িয়ে 
তুমি আস, 
তোমার চুলে শত নাগরকে নিয়ে তুমি আস,
তোমার পা ও স্তনজোড়ার মাঝখানে সহস্র পুরুষ নিয়ে তুমি আস,
নিমজ্জিত মানুষে পরিপূর্ণ 
কোনো নদীর মতো আস,
যে নদী বয়ে চলে বুনো সমুদ্রের পানে,
শাশ্বত ফেনিল সময়ের দিকে।

তাদের সবাইকে নিয়ে আস
আমি যেখানে তোমার জন্য অপেক্ষমাণ;
আমরা সর্বদাই একাই থাকব,
আমরা সর্বদা তুমি আর আমিই থাকব,
একলা এই পৃথিবীতে
আমাদের জীবন শুরু করব বলে।

 

জবুথবু আত্মা

আমরা এমনকি এই গোধূলিকেও হারিয়ে ফেলেছি।
আজ সন্ধ্যায় যখন পৃথিবীর বুকে নেমেছিল নীল রাত্রি
তখন কেউ আমাদেরকে হাতে হাত ধরা দেখেনি।

আমি আমার জানালা দিয়ে দেখেছি 
দূরের পর্বতশিখরে সূর্যাস্তের উৎসব।

কখনো কখনো সূর্যের একটি টুকরো
আমার মুঠোতে বন্দি মুদ্রার মতো জ্বলে উঠেছিল।

তুমি যে বিষণ্ণতা কথা জানো তাতে জবুথবু
আমার আত্মাকে নিয়ে আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম।

তুমি তখন কোথায় ছিলে?
আর কে ছিল তোমার সঙ্গে?
কী বলছিলে তোমরা?
আমি যখন বিষণ্ণ এবং ভাবি যে তুমি অনেক দূরে
তখনই কেন সবটুকু ভালোবাসা অমন আচমকা জড়িয়ে ধরে আমাকে?

বরাবরের মতো ঠিক গোধূলিবেলায় শেষ হওয়া বইখানি হাত থেকে খসে পড়ে
পায়ের নিচে কুঁকড়ে থাকা আহত কুকুরের মতো গোটানো আমার নীল সোয়েটার।

সর্বদা, সর্বদাই তুমি সন্ধ্যার ভেতর দিয়ে
গোধূলি মুছে দেওয়া মূর্তিগুলোর  দিকে ক্রমে অপসৃত হয়ে যাও।

 

একটি কুকুরের মৃত্যু

আমার কুকুর মারা গেছে।

আমি তাকে বাগানে, একটি পুরনো
জংধরা যন্ত্রের পাশে সমাহিত করেছি।

একদিন আমিও ঠিক সেখানেই তার সঙ্গে যোগ দেব,
তবে এখন সে তার গা-ভরা লম্বা লোম,
বিচ্ছিরি স্বভাব আর ঠান্ডা নাকসহ বিদায় নিয়েছে,
এবং আমি, এই বস্তুবাদী, যে কি-না কোনোদিন কোনো মানুষের জন্যই
আকাশের ওপারে কোনো প্রতিশ্রুত স্বর্গে বিশ্বাস করেনি,
সেই আমি এখন এমন এক স্বর্গে বিশ্বাসী, যেখানে নিজে কখনো যাব না।

হ্যাঁ, এখন আমি সমগ্র কুকুরজাতির জন্য এক স্বর্গলোকে বিশ্বাস করি
যেখানে আমার কুকুর তার পাখার মতো লেজখানি দুলিয়ে
আমার জন্য অপেক্ষা করছে বন্ধুর মমতায়।