সায়ীদ সায়ীদ বলে রব করে মাটি ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-

 

সায়ীদ সায়ীদ বলে রব করে মাটি

যদি আমি কথা বলে উঠি
যদি আমি মেপে দেখি সীমানা আমার
চারিদিকে খাঁ খাঁ রোদন কারবালা।

হুতাশনে জ্বলে ওঠে সর্বজ্ঞ আকাশ
সীমার সীমার বলে ডেকে ওঠে পাখি
সায়ীদ সায়ীদ বলে রব করে মাটি
এত শহীদের লাশ বলো কিসে ঢাকি!

আমার ইতিহাসে রক্ত
আমার পতাকায় রক্ত,
আমার বুক থেকে নামে গুলিবিদ্ধ নদী
আর কত রূহ-রক্ত দিয়ে যাব আমি?

আমার মাসুম বুকে যদি তারা করে ফের খুনের নিশানা
আমরাও খুঁজে নেব শোধের চানমারি
মানুষের হাড়ে শাদা ওই পাপার্ত মুকুট

জানে না কখন কার বুকে টানটান দাঁড়াবে স্বদেশ।
রক্তের এ ধারা যেন পেছনে না হঠে
শহীদেরা দিয়ে গেছে সরল আদেশ।

 

শহীদি বেতার

এখন আমি মুগ্ধের সাথে কথা বলছি,
কথা বলছি তাহমিদের সাথে।
বড় ভাইদের সাথে এসেছে রিয়াজ;
সাঈদকে দেখে কী যে খুশি ইরফান।
সাজাহানের ছেঁড়া শার্ট, গা ভরা রক্ত
এই রক্ত কোনোদিন মিথ্যা বলে নাই
ফারহানের শেষ হাসি এখনো উন্মুক্ত
এখনো কারুকে চুমু খায়নি ওই ঠোঁট।

একে একে তারা বলেছে আমায়, 
সব কিছু মনে পড়ে ভাই?
রক্তের ধারা কি পেছনে গড়ায়?
তখনই আমার পাশে কথা বলে কেউ,
জলের ডুবান থেকে উঠে আসে
রুদ্র সেন ছেলেটার হাত

সব মার ফেরত দেয়া হবে,
বলে গেছে কর্ণফুলীর বাঁক।

কথা বলে কিশোর সাইমন;
জান্নাতের বাবা আব্দুল গণি
শিশুদের নাম ধরে ডাকে,
লাল পরী রিয়া গোপ
গুলি খাওয়া বুকে খেলে যাচ্ছে ছাদে।

একে একে এসেছে সবাই
শাহরিয়ার, ওয়াসিম হৃদয় তড়ুয়া
গায়ে গায়ে দাঁড়িয়েছে বন্ধুদের দল 
শূন্যস্থানে একে একে ফিরেছে নিজেই।

যেন ‘রাফি’ বলে দিলে ডাক 
ভরে যাবে মিছিলের বুক,
সারা বাংলা আজ কান পেতে
উপস্থিত শহীদের জবানি শুনুন:

প্রেসনোটে মাননীয় ভুলভাল লেখা,
হত্যার নায়েব তুই খোল টালি খাতা
প্রতিটি পাতায় দ্যাখ, তোরই নাম লেখা।

 

এজাহার

কী দেশে এলাম!
প্রহারের পরে রক্ত জমে নীল,
মেয়েটির গায়ে কালশিটে দাগ
তরুণ শরীরে কালশিরা,
আকাশে আকাশে ঝলকায় বিদ্যুৎ
তবু জেনে রেখো মহারাণী
যদি ফিনকি দিয়ে রক্ত নামে ফের
প্রতিশোধের দাদন তুলবে সময়।

আমরা পারিনি, পরে যারা আছে তারা
তিল তিল শুধে নেবে বকেয়া বিচার;
এই দেশে শিশু ফের জন্ম দেব বলে,
আমাদের হতে হবে মায়ের মতন
ব্যথার পাঁজর থেকে দিতে হবে চাপ;
হতে হবে বিশুদ্ধ কঠিন, সরলতা ভোর।
হাজির হয়েছি সোনা, রক্তাক্ত শিয়রে তোর

ঝড়ের তরঙ্গে পাখি
আয় তোরা আগুনের স্রোত
তোমার আমার দেখা, রক্তমিতা,
সে মিছিলে হোক।

 

তুলে এনে দেখি লাশ, খোয়াজ খিজির

সময়ের দেবতাকে আমি দেখেছি সেদিন
কালের কার্নিশে একা বসে আছে হায়
কোথায় সান্ত্বনা বলো রহমের হাত—
ঝাঁপিয়ে পড়েছে ডেকে, ফাঁকা ইঁদারায়।
খিজির তোমার লাশ দেখেছি কোথায়
বেওয়ারিশ পড়ে আছ মীরপুর ডেমরায়।

তুঙ্গ ছুঁয়ে থামে যদি জীবনের মীড়,
তুলে এনে দেখি লাশ খোয়াজ খিজির।

কালের কেতুর জমা চোখে আমি দেখি,
সরল গাছেরা নেই—কচুরির ঠেক

এদিকে শহর পোড়ে ওদিকে বেহেশত।
দেশে দেশে বুকে বুকে জ্বলে আছে চিতা

জবানের কালি আর ফেনারক্ত দিয়ে
লেখা এ সফরনামা, এই কালো গীতা।

তুঙ্গ ছুঁয়ে থামে যদি জীবনের মীড়,
তুলে এনে দেখি লাশ, খোয়াজ খিজির।

কারবালায় বালি ওড়ে—নদীটা কোথায়?
জলের আবছায়া কাঁপে পথের মাথায়,

বাদুড়ের মাড়ি দেখে মহলে বিতানে
বোঁটায় শুকায় দুধ, ফুল যায় বুঁজে।

এমন দারুণ দিনে সভাপাখি ডাকে
বায়ু খুব হুশিয়ার বহে দেখেশুনে।

তুঙ্গ ছুঁয়ে থামে যদি জীবনের মীড়,
তুলে এনে দেখি লাশ খোয়াজ খিজির।

সোনাভান নাকি তুমি আছ আলোআরা
স্মৃতির প্রথম ফুল রেখেছ খাতায়,

জড়াজড়ি করে থাকা বুকের তিমির
ডানায় আগুন নিয়ে কত দূরে যায়!

কতদূর দেখা যায় ভাগ্যকুল–বাঁক
আমাদের বাকি কথা সেই পারে থাক।

তুঙ্গ ছুঁয়ে থামে যদি জীবনের মীড়,
তুলে এনে দেখি লাশ খোয়াজ খিজির।

আমার লেখার বিষে মুছে গেছে চিঠি
আমার পায়ের তলে মরে গেছে মাটি

আরেক পৃথিবী খুঁজে খোদাও হাঁপায়
কথা বলি তাই মৃতবৎসা ভাষায়।

তুঙ্গ ছুঁয়ে থামে যদি জীবনের মীড়,
তুলে এনে দেখি লাশ খোয়াজ খিজির।

জলের ভঙ্গিতে হাঁটে শরণার্থী স্রোত,
তোমার আমার দেখা সে মিছিলে হোক।

 

যখন গোধূলি নেমে আসছে বাংলাদেশে

যখন গোধূলি নেমে আসছে বাংলাদেশে
অকালসন্ধ্যা ঝুলে থাকে সারাবেলা,
আশা ও অপেক্ষা নামে দুই বোন
এক সাথে হারাকিরি করে প্রতিদিন।

তাদের গর্ভের রক্তে যে পথ পিছল,
তার শেষে আছে এক অন্তিম দরজা—
এই ছাড়া আর কোনো প্রফেসি আসেনি!
কারণ কবাটবন্ধ ইতিহাস,
কারণ সীমান্তকাঁটা গেঁথেছে বাতাস;
এই নিপাখি আকাশ আর লোমহর্ষ রাতে,
কুরুক্ষেত্রের রক্তিম ধূলা ওড়ে
              কারবালার আকাশে।
তখন কে দিল এই কালো দুধ;
          এই অভিশাপ ভরা বাটি!

মড়কে শোভিত দেশ কে দিয়েছে,
চোখের কোমল পাতা কেটেছে বলো কে?
কে চালাচ্ছে গরম হাওয়ার হাপর
কার বুকে জমা এত বারুদ গন্ধক?

যখন গোধূলি নেমে আসে বাংলাদেশে
শিরদাঁড়া খামচায় রাজকীয় নখের দাঁতাল,
যখন গোধূলি  নেমে আসে বাংলাদেশে
মহামায়ার গাধারা অট্টহাস করে;
আয়না থেকে খসে যায় সত্যের পারদ,
মিথ্যাবাদী ধোঁয়া ভরে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে।

গোধূলি যখন নেমে আসছে বাংলাদেশে
তখন তোমাকে মনে পড়ে বিড়ালিনী,
আর খুঁড়ে চলি মাটি যার যার বুকের ভেতর
আরো গভীর আরো গভীরে ছুঁড়ে দাও দড়ি।
যতক্ষণ না শোনা যায় বন্দি দ্বীপবাসীর ডাক,
যতক্ষণ না তোমার শাবল ঠন করে পাথরে,
যতক্ষণ না পাথর-প্রমাণ রাত তুলে নিচ্ছ হাতে।
আরো কঠিন আরো কঠিন, ঘণ্টাচুক্তি মন
আরো জোরো আরো জোরে, গানের অক্ষর—
নদীর দিকে মুখ করে সাজাও কাতার
পুড়ে দাও দশকের অবসাদ;
খোঁড়ো মাটি, ধূপকাঠি, সাজো চিতাকাঠ—
যেন ফের জন্ম নিতে পারো,
যেন তুমিই আগামীকাল,
তোমার চুলের বেণী থেকে
যেন পুনর্বার শুরু হয় পথ।