‘আমাদের গ্রাম’ ও অন্যান্য কবিতা
‘আমাদের গ্রাম’
সবাই সুদূর। কথা বলছে আদিগন্ত সবুজ সমাধি।
হত্যাকারীর প্রশংসামুখর এ গ্রামে
মানুষের ভাষা পাখির গানের মতো মনে হয়।
এখন ঠোঁটে আঙুল রেখে তুমিও বলো
নীরবতাই নিরাপদ
কবরখানাই চমৎকার আশ্রয়
জীবন মৃতকে ঈর্ষা করে যদি
সেটাই সেরা সফলতা
দেখো না তারা কেমন নিশ্চিত আজ
নিজেদের সিংহাসন নিয়ে
আর কৌতুকে মাত করে রাখছে
সজাগ যতো পাড়া
প্রশংসা, নয় নীরবতা—যেকোনো একটাকে
মানুষ বেছে নিচ্ছে আজ!
আমি তবু ভাবি, প্রত্নজগত থেকে উঠে আসা
প্রকাশ্য ও গোপন যুবরাজদের কথা
যারা কেটে নেয় কলমধরা আঙুল
না হয় জিভকে করে ফেলে অনড় স্তব্দ শিলা
যাতে তাদের উচ্চারিত শব্দমালাই
একমাত্র সত্য হয়ে উঠে
তাদের কথাই যেনো
হয়ে ওঠে গ্রামের একমাত্র আলো!
তারা বলে এই নীরবতাই নাকি
তাদের সফলতার একমাত্র ব্যারোমিটার!
আমি ভাবি আর আঁতকে উঠি
ফের টের পাই
আমার এই জিভ নড়লে চরলেও
অন্তত শব্দ হচ্ছে না আর
আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি!
সবাই সুদূর। একথা কানে এলে কত ভয় লাগে
মনে হয় ঈশ্বরনিন্দা!
ঘনিষ্ঠতাই কি তার এ সমাধির
আসল লক্ষ্য নয়?
ভাবি হত্যাকারীরাই ঈশ্বরের প্রকৃত সন্তান
তারাই আমাদের এখানে আসার
ঠিক যোগ্য করে তোলে!
যারা বলতো, এখানে মৃতরা
শুধু একে অপরের গা ঘেষে পড়ে থাকে।
আর টের পায় তারা সত্যি সুদূর।
যারা বাস্তবতা মেনে নেয় তারাই নাকি মৃত।
বাস্তবের ডাকে
শুধু মৃতরাই নাকি পারে না সাড়া দিতে।
এসব কথা বলতো যারা
সেসব মানুষ বহুদিন ধরে নিখোঁজ
পালিয়েছে নাকি স্বেচ্ছায়!
আর আজ মুখর যারা তারা তো বলছে শুধু
এ গ্রামই সবচেয়ে জীবিত
কোথাও কোনো অভিযোগ নেই
আর যেদিকেই তাকাও দেখতে পাবে
সুমহান সবুজ নীরবতা
এখন নিন্দুকেও বলে স্বর্গে আছে সবাই
পূর্বে ছিল না যা তাই কি অভূতপূর্ব নয়!
আমি ভাবি মৃত্যু ছাড়া
কেন স্বর্গে যেতে পারি না আমরা!
ভাবি আর ভয় পাই
স্বস্তি পাই নড়চড় করলেও এই জিভ
ভাবনাকে ধ্বনিভূত করে না!
তোমাকে বললাম, আমার ইচ্ছে হলে
কোনো কথাই আমি উচ্চারণ করবো না
আমিও কি বাক-স্বাধীন নই!
তোমার বিষণ্নতার দিনে এমন কথা শুনে
তুমিও স্বস্তি পেলে খুব যেনো নিজেরই
অস্তিত্বের আশ্বাস পেলে আজ!
বিন্দু বিন্দু তারা
কালো চুলে তোমার জোনাক খেলা করে। ঝাঁক ঝাঁক, ঝাঁক ঝাঁক। আর রাত হয়ে ওঠে কী যে অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্নময়। আমি আর ঘুমাতে পারি না। পলকে স্বপ্নের হাতে ধরা পড়ে যাই। পলক পড়ে না আর চোখে। আকাশ হাসে, তারার ঝাঁক প্রতিধ্বনি করে সারারাত। তোমার ঝর্ণায় কি সোনালি স্ফটিক খেলা করে তখন? ইস্ত্রি গরম হলে পোশাকের ভাঁজ মুছে যায়, তোমার পরশে পুরুষও ভাঁজ খোলে কী সহজ সাহসী আর সোজা হয়ে দাঁড়ায়! আর তুমি যদি দেহজুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘামের জননী, আমার শরীরেও তারা ফোটে অবিরাম, তোমার ওই জোনাকি আলোয়! জলের উচ্ছ্বাস কী সহজে বিরামহীন আছড়ে পড়ে এই সৈকতে! হায় স্বপ্ন, হায় গান, না ঘোমানোর সুখ নামে দুচোখে আমার, যে দেখতে পায় সহস্র জোনাক জ্বলে রাতের সেই কালো চুলে!
আত্মবিলীনের দিন
পুষ্পই জানে বসন্ত আসলে
কতোটা জীবনের গান,
কতোটা মৃত্যুর হারাকিরি!
কে জানে, বসন্তে,
জীবনের না মৃত্যুর পরাজয়!
জীবন না মৃত্যু—বলো তো,
পুষ্প আসলে কী চায়!
দেখো, সাত রঙে জীবনকে
ডাকতে ডাকতে
হাসতে হাসতে
প্রতিটি পুষ্প মৃত্যুর দিকেই চলে যায়!
বসন্তের শেষে, বলো,
বীজ না পুষ্প কার দিকে তাকাবে তুমি!
আত্মবিলীনের দিন
কখন যে কাছে এসে পড়ে!
ধাঁধা
কেউ কেউ বলে, বাহিরে তাকাও যদি
কোথাও সমাধান দেখতে পাবে না!
কারণ তা নেই, ছিল না কখনও!
কেউ কেউ বলে, ভেতরে তাকাও যদি
তুমি চিনবে না এমনকি নিজেকেই!
এমনকি ছিলেও না চেনা কখনও!
কেউ কেউ বলে
নিজেকে চেনো না তাই
বাহিরে তাকাও যদি, ভুলই দেখবে শুধু!
আর কেউ কেউ বলে
বাহির চেনো না বলে
অসম্ভব হয়ে আছে নিজেকেও চেনা!
কেঁদে উঠি মাঝে মাঝে, কেউ কি নেই যে বাহির চিনেছে?
ফের ভাবি, কেউ কি নেই যে ভেতর চিনেছে?
ভাবি মাঝে মাঝে, ইতিহাসে যা নেই,
তার ওপর কতটা ভরসা রাখা যায়!
ইতিহাস যা দিয়ে ভরপুর বরং
তার ওপর ভরসা করাই কি ভালো নয়!
কেউ কেউ বলে, হ্যাঁ, অন্তরেই জগতের আবাস!
আর কেউ কেউ বলে, না না, জগতেই অন্তরের বসবাস!
কিভাবে তার পার্থক্য করি আমি!
কী করে বলি, কোনটা জগত আর কোনটা মন!
ধাঁধার দেশেই কি শেষে হারাবো আমি? কোনভাবেই
ভাঙতে পারছি না যে এই ইতিহাস!
দিন শেষের সূর্যটা
প্রেমে পড়েছো, তাহলে দুঃখ খুব দূরে নয়!
এই যে হেসে উঠেছো, কী বিরল এ দৃশ্য
জানবে হয়তো কিছু দিন পরেই
টানা আর পোড়েন মিলে টানাপোড়েন
ছন্দে বাজে যতোদিন ততদিন আলো
না হলে কালো হবে না কি আবার দিন!
একদিন ধর্মকে দোষে
একদিন সমাজের দিকে আঙুল তুলে
একদিন পরিবারকে দোষে
তবু শেষ হয়নি দোষা
অপরকে দোষে তবু শান্তি পেলো না মন
অথচ এসবের কোনটাইতো মিথ্যে ছিল না!
এবার নিজেকে দোষে শেষ দৃশ্যে
কী থাকবে বাকি!
এমনকি তুমিও না থাকো যদি
তবু প্রেম, অবশিষ্ট থেকে যাবে
বলতে পারো যদি, দেখো না চেষ্টা করে!
প্রেমে পড়েছো, তবে দুঃখ খুব দূরে নয়!
এ মিথ্যে কথা কিংবা মিথ্যে নয়,
তবু এই যে হেসে উঠেছো, কী বিরল এ দৃশ্য
তোমাকে যেনো জানতে না হয়
কোনো দিন, দেখো, এতো ভয় দেখিয়ে
এই আমিও বলছি কিনা
প্রেমে পড়েছো, ভালো ভালো নিশ্চয়, তবু
হাসির ছবি নয়, হাসিতে থাকো চিরদিন
বলছি, দিন শেষের সূর্যটা কিন্তু আসলে রঙিন!
শঙ্কর কুমার দাশ, মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
Rotho Rafi
সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৪ ১৬:০৪
পুষ্পই জানে বসন্ত আসলে কতটা জীবনের গান, কতটা মৃত্যুর হারাকিরি ........অসাধারণ উচ্চারণ ////////////////////////////////////////////////////// 'আমাদের গ্রাম' কবিতাটি বাংলাদেশের প্রতিবাদহীনতা-নীরবতা এবং উত্তরণের দিকে জোরালো ইঙ্গিত আছে.... কবিতার ভাষা বাংময়, জোরালো, বর্তমানকে ধারণ করেছে........
শঙ্কর কুমার দাশ
সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২৪ ১৫:৫০