দেখা-অদেখায় ও অন্যান্য কবিতা
কোন কয়েদী নম্বর
তুমি বিছিয়েছ স্মৃতির উঠোনে
বিস্মরণের শীতলপাটি
কতটা দায় এপার-ওপার
এক্কাদোক্কা খেলে,
না তোমার বা আমার
আমরাই বরং খেলনা হয়ে যাই
খেলা আর শেষ হয় না তাই।
নিয়তি দেবীর দরগায়
বিনা বিচারে আমি যাবজ্জীবন কয়েদি,
আর তুমি আজীবন নির্দয় ফেরার আসামী।
নির্দয়তার দায়ে তোমাকে
মোটা জরিমানার বোঝা বইতে হয়।
এদিকে হাজতকালের এপারে ঝড় জল
আর কখনো নির্বিকার উত্তুরে হাওয়া
উড়ে যায় সব বিস্মৃতির গরাদের ওপারে
খেলায় আজন্ম পরাজয় টের পেয়ে
তোমার পালানোটাই জোছনা জয়ী
আর ওটুকু জয়ে তোমার সন্ত্তষ্টি।
এদিকে আমার হাজতকালে
সব খেলাই বুঝি ভুলতে বসেছি
শীতলপাটির নকশা ভুলেছি
ভুলেছি এককালের মানবজন্ম
নিজস্ব নাম, আমার আকার
এখন আমি মানেই যে—
সাজা প্রাপ্ত কোন কয়েদী নম্বর।
হিম জমা দূরের শহর
তুমি আর তোমার হিম জমা—
দূরের শহর,
ক্রমশ আসবে চলে
কাঞ্চন ফোটাতে,
আমার গালে কপালে।
তারপর অজস্র দূর মাখা
ধূসরিত আঁধারির গায়—
গনগনে প্রেম জন্মায়
আমরা একাকার হব বলে।
তোমার পথে আমার শহর এগিয়ে গেলে
অথবা তোমার ঠিকানা
আমার চোখে, কপোলে
ঠোঁটে আঁকা হলে,
চাঁদের একক প্রেম জাগে
আদুরে জোছনার মায়ায়
কোন অপার্থিব প্রতীক্ষায়!
গল্পের নিঃসঙ্গ নিমগাছ
দুজনের গল্পে আমরা নিজেদের জায়গা করে নিতে নিতে
দূরত্বের ফাঁকা জায়গাটা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে,
গল্পের একা আর দেখা না দেখার নিমগাছ।
ওর বাঁধানো কোলে
আমাদের অজস্র রাত্রি ভোর হয়।
আমাদের প্রথম আলিঙ্গনের অপেক্ষায়,
প্রথম চুমুর প্রতিজ্ঞায় নিমগাছ দাঁড়িয়ে ঠায়।
কত দূরে ও অথচ বিস্মরণ সেঁকে নেয় আত্মার উত্তাপে—
দূরত্বের চুমুর প্রলাপে।
তবুও আমার তীব্র ঈর্ষাকাতর দৃষ্টি
ঝাঁকড়া নিমের ডাল পাশ কাটিয়ে
সূর্যের প্রথম চুমুটা দাবি করেছে
নিজের না দেখা চোখের শান্ত পাতায়।
আমাদের গল্পের অগুনতি রাত্রি চোখ মুদছে
রোজ রোজ নিমের হিম আদরে।
কত শত তারা জাগা রাতের উল্টোপৃষ্ঠায়
ভোরের উষ্ণ চুম্বনে কাতর হয়েছে
কমলা সকাল নিমের তলায়।
নিমের নিঃসঙ্গতা কে ম্লান করতে—
তুমুল কোন সবুজিয়া প্রেমের জন্ম হয়।
বাদামি চোখ
ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ভেসে আসা
সেই যে একজোড়া বাদামি চোখ
তাকিয়ে থাকা,
অস্থির প্রতীক্ষায় অপলক।
এরপরে অজস্র শরৎ পার করে
আরো জোড়া কালো, গাঢ় বাদামি,
ধূসর, নীলচে চোখের দৃষ্টি স্রোতের সীমানায়
প্রজাপতির পাখা আটকে যায়।
কখনো পদ্মা, কখনো গঙ্গা, কখনো রাইন
কখনো টেমসের জলজ পাহারায়
ধুয়ে যায় বিষাদমতি আবেগী জলছবি
অব্যক্ত গাঢ় মায়ায় বোনা নকশিকাঁথায়
আটকে থাকা হাজার রজনীর কথকতায়
ভাসিয়ে দিয়ে স্রেফ ভেসে থাকার দায়।
এখনো কি সেই জোড়া বাদামি চোখ
জলে ডুবে—ভেসে যায়
সুতীব্র ‘আমি’ হীনতায়?
এখনো কি আমি ভেসে যাই
আজন্ম ভাসানের পালায়?
তারপর কোন গাঢ় বাদামি চোখে
খুঁজে ফিরি ম্লান বেতফল?
চোখ তবু ঝাপসা করে
আহা-ময়ী গাঢ় লোনা জল
সব নদীর স্রোতে একাকার হয়
বিভ্রমে, মায়াবতীর কাজল।
দেখা-অদেখায়
তোমাকে যত না দেখায় দেখি
তারচেয়েও বেশি দেখি অদেখায়।
দেখলেই কেমন জাদুকাঠি ফুরিয়ে যায়
অথবা অনন্ত তৃষ্ণার্ত করে যায়
চাতক প্রায় কপোলে স্পর্শের জল গড়ায়
ভয়ে কাঁপা চিবুকের আর্দ্র ছায়ায়।
ভোরের ব্যস্ততায় হঠাৎ গালে রোদের চুমু
ছুঁয়ে গেলেই তোমার প্রেম আঁকা হয়ে যায়,
তোমার না থাকা মুহূর্তদের জলসায়
যে কণ্ঠস্বর মৃদু সঙ্গত করে সে মৃদুভাষ
আর তোমার একরোখা দেখার অভ্যাস
আলাপে বিস্তারে শেষের ’পরে হেঁটে যায়
তোমাকে না দেখলেও বড্ড দেখি অদেখায়।
শহুরে বর্ষার গাঢ় নীল আঁধার করে না চোখ
দেখতে চায় মেঘদূতের চিঠির ভাঁজে—
থমথমে জমাট বিরহী শোক,
তারপর বৃষ্টির আখরে সব আহা ঝরাতে চায়
দেখার আকাশ ভাসে অদেখার বেদনায়।
আষাঢ়ের দীর্ঘবেলা শেষে একটু দেখন হেসে
উঁকি দেয় শরতের মস্ত ওই তুলট আকাশ,
অসময়ের শরৎ জানে যত্তসব উদাসী অভ্যাস
মন ভোলানো বৃথা আয়োজন জাগে উষ্ণ প্রহরায়
অদেখার দায় বুনে চলি দেখন মায়ায়।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন