পরানসখা বন্ধু হে আমার
|| তারা তিনজন ||
এই যে এখানে, টিএসসিঘেরা এই অর্ধবৃত্তাকার খাটো দেয়ালের ওপর বসে সে অপেক্ষা করছিল বিনীতার জন্য। সেলুন থেকে চুল কেটে, শেভিং শেষে স্ক্রাব ঘষে মুখের মরা চামড়ার পরত তুলে পরিপাটি ভদ্রছেলের চেহারা বানিয়েছিল সে। নার্ভাসনেসে বুকের ভেতরটা ঢিবঢিব করছিল, দুই কান হালকা চুলকাচ্ছিল, মানে সে দেখতে না পেলেও তারা নির্ঘাৎ লালচে হয়ে গেছিল। সে প্রায় বছর পনের আগের কথা। পরের পাঁচে অগুণতিবার এখানে এসেছে। দলেবলে, যুগলে, একলাও। তারপর এক দশকে একটিবারের জন্যও না। যে কয়বার দেশে এসেছে, টিএসসির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রিকশা নয় গাড়ি থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে স্মৃতিকাতর চোখে তাকানো পর্যন্তই। আজ বহু বহু দিনের মান-অভিমান শেষে একান্তে কুশল-আলাপ করবে বলে নির্ধারিত সময়ের আগে হাজির। বিনীতা আর ফরহাদের পাঁচটার দিকে আসার কথা। সে সাড়ে চারটা নাগাদ চলে আসার নিয়ত করেছিল। জ্যামের কথা ভেবে যথেষ্ট সময় হাতে বেরিয়ে কপালগুণে সোয়া চারটাতে হাজির। এ জায়গাটার চেহারা-চরিত্রের কত বদল। কিন্তু সে অনায়াসে পনের বছর আগে ফিরে যেতে পারছে। স্মৃতি ভাঙাচোরা রঙওঠা খানাখন্দে ভরা; তাও ঠিকঠিক মনে আছে প্রথম দেখা করবার সেই দিনে বিনীতার পরনে ছিল জামরঙ সালোয়ার-কামিজ।
এখানকার অনেক টি-স্টলের কোনোটাতেই চেনা দোকানীর হদিস পাওয়া যায় না। কোথাকার চা ভালো আন্দাজ করতে না পেরে সবচেয়ে কম ভিড়েরটায় (ভিড় কম মানে চা খারাপ হওয়ার চান্স বেশি হলেও) গিয়ে এক কাপ রঙ চা নেয়। সেদিনের মতোই দেয়ালে ঘাড় নুইয়ে বসে থাকে। স্মৃতিরা বিশৃঙ্খল এলোমেলো হাওয়ার মতো এদিক-ওদিক আলোড়ন তুলছে। ভ্রম হয়, এই তো, বছর খানেক আগের কথা।
‘নির্ঝর ভাই!’ নির্ঝর মাথা তুলে দেখে সামনে ফরহাদ দাঁড়িয়ে। সে হাত বাড়িয়ে দেয়, তারপর ফরহাদই বুক মেলানোর জন্য এগিয়ে আসে।
‘কতক্ষণ এখানে?’
‘এই ৫ মিনিট। আপনিও আগে চলে আসলেন?’
‘হ্যাঁ, লেট করতে চাইনি।’
‘আপনি তো ভার্সিটিতে টেনিউর পাইছেন শুনলাম। কংগ্রাচুলেশন্স!’
‘থ্যাংকস। এইটা তেমন কিছু না! আগেও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ছিলাম, এখনো তাই। আপনিও তো একটা প্রোমোশন পাইছেন শুনছি। কংগ্রাটস টু ইউ টু। নাইজেরিয়ায় চলে যাবেন নাকি?’
‘হ্যাঁ, এখান থেকে ফিরেই। আসলে লন্ডনে হেডকোয়ার্টারে বসে কাজ করতে ভালো লাগতেছিল না। দেশ ছাড়লামই তো দুনিয়া দেখার নেশায়। নাইজেরিয়া থেকে জাম্বিয়া-কেনিয়া…আফ্রিকার টোটাল ৯টা দেশে আমাদের কাজের স্কোপ। ইন্ডিয়াতেও অনেক প্রজেক্ট রানিং। তবে আগে দূরের দেশগুলা চষে ফেলি।’
জানা খবরগুলোই আবার ফরহাদের মুখ থেকে শুনল নির্ঝর। পিঠচাপড়ানি মার্কা গলায় বলল,
‘বাহ্, খুব ভাল খবর!’
‘হাহা… বাট আই হ্যাভেন্ট ফরগটেন দ্যাট ইউ আর ক্রিটিক্যাল অব দিজ ইন্টারন্যাশনাল এনজিওস।’
‘নাও ইউ আর অ্যান ইনসাইডার… বায়াসফ্রি হয়ে কি কিছু বলতে পারবেন?’
‘ওই সিরিয়াস আলাপে পরে যাই। আপনি তো আমার ভিউ কিছুটা জানেনই, না?’
‘ঠিক। এই টপিক পরের জন্য তোলা থাক। গত বছর লন্ডনে যে বাসাটায় গেলাম, ওখানেই আছেন এখনো?’
‘না, স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বড় বাসা নিছি এখন।’
‘তাই! ওটা তো সুন্দর ছিল! আই রিয়েলি হ্যাড আ গ্রেট টাইম অ্যাট ইয়োর প্লেস। আপনি মেলা প্যারা নিছিলেন… কী সুন্দর রান্নাবান্না করছিলেন…তারপর আমাকে বেড ছেড়ে দিয়ে নিজে ঘুমাইলেন কাউচে… একেবারে ভিভিআইপি ট্রিটমেন্ট!’
‘আরে প্যারা হবে কেন! We had a great heart-to-heart, right? আমিই না নাছোড়বান্দার মতো আপনাকে ধরে আনছিলাম আমার বাসায়! আর কয় ঘন্টাই বা ঘুমাইছি আমরা ওই রাতে? আপনি তো বোধহয় এক ফোঁটাও ঘুমান নাই!’
‘নতুন জায়গায় প্রথম রাতে ঘুম হয় না আমার।’
ফরহাদ মনে মনে বলে, আপনার যত মুদ্রাদোষ জানতে কি আর বাকি আমার!
‘তা আপনার কি কনফারেন্স পড়বে আফ্রিকান কান্ট্রিগুলোতে? আর না পড়লেই বা কী! এমনিই ঘুরতে যাবেন।’
‘হ্যাঁ, ওইদিকে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। আপনি ঘুরে যান না কেন ফ্লোরিডা?’
‘নেক্সট ইয়ার স্টেটসে যাওয়ার প্ল্যান আছে। আপনার ওইদিকেও হয়ত যাওয়া হবে।’
‘হ্যাঁ, বিনীতা বলছে। নিউ ইয়র্কে আপনার বড় বোনের বাসায় যাবেন।’
হো হো করে হেসে ওঠে ফরহাদ, ‘আমাদের কি কোনো ইনফরমেশন, কোনো আপডেট আছে শেয়ার করার মতো? আই থিংক উই অলরেডি নো এভ্রিথিং অ্যাবাউট ইচ আদার! হোয়াটস অন ইয়োর প্লেলিস্ট, হোয়াট সংস ইউ হাম ইন দ্য শাওয়ার…’
নির্ঝর এক দফা হেসে নিয়ে একটু ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আই অ্যাম নট সো শিওর অ্যাবাউট দ্যাট।’ তারপর আবার শব্দ করে হেসে ওঠে। গতকাল রাতে যে তার মাইগ্রেন উঠেছিল, সেই সামান্য খবরটাও হয়তো ফরহাদের জানতে বাকি নাই! আর মাইগ্রেন উঠলে অব্যর্থ দাওয়াই হিসাবে সে যে মাস্টারবেট করে তাও কি ব্যাটা জেনে গেছে? কিন্তু নিজের দাবির জোর বাড়াতে বলে, ‘না, না, সব জানেন না। এই যে, এখানে আসতে আসতে শুনতেছিলাম আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার। তা এই গানটার লাস্ট লাইন গভীর কোন্ অন্ধকারে হতেছ তুমি পার; বহু বছর এই লাইনটাকে আমি ‘গভীর কোন্ অন্ধকারে হতেছ তুমি কার’ মনে করতাম। আপনি জানতেন সেইটা?’
ফরহাদ হো হো করে হেসে ওঠে, ‘না, এইটা জানা ছিল না। অভিসারের ব্যাপার তো, সেখানে প্রেমাস্পদ কার না কার হয়ে যাচ্ছে এই কল্পনা অমূলক না।’ তারপর মনে মনে বলে, আপনি যে পজেসিভ আর জেলাস টাইপ ছিলেন একসময়, তা কি আর জানি না!
নির্ঝর জিতে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘হা হা! তাইলে দেখছেন, অনেক আননোন সাইডস ডিসকাভার করার সুযোগ আছে আমাদের!’
ফরহাদের মনে পড়ে, একবার ঘুম তাড়ানোর দাওয়াই হিসাবে বিনীতা তাকে পর্ন দেখার পরামর্শ দিয়েছিল। সেটা যে নির্ঝর মারফত প্রাপ্ত জ্ঞান, তা বুঝতেও তার একমুহূর্তও লাগেনি। দৈনন্দিন জীবনে যার এমন অশরীরী উপস্থিতি ছিল, তাকে নতুন করে আর কী চিনবে! হঠাৎ খেদসূচক ‘চ্চ’ শব্দ তুলে নির্ঝর বলে, ‘ইশ, আমি একা চা খাচ্ছি!’ চাঅলাকে ইশারা করে, ‘মামা, আরেকটা দাও তো!’
‘আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন! ক্যাম্পাস তো আমার।’
‘এই যে, আমার-আপনার হয়ে যাচ্ছে! আমাকে আউটসাইডার বানায় দিলেন। বিনীতা আসার পর আপনারা তো ক্যাম্পাসের জোরে জোট বাঁধবেন! ঢাবিয়ান পরিবার!’
‘সেই সাধ্য আমার আছে? আপনারা হচ্ছেন পুরান-পাপী!’
ফরহাদের মাথায় আউটসাইডার শব্দটা ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্রের মতো চৌদ্দ বছর আগে কলাভবনের বটতলায় ঘটা ঘটনার পর্দা এক ঝটকায় তুলে নেয়। এ কাহিনী (এক দুপুরে সেই বটতলায় বসেই চরে বেড়ানো কাঠবিড়ালী-ঘুঘুদের দেখতে দেখতে বিনীতার মুখ থেকে) শোনারও তো মেলা বছর হলো। নির্ঝরেরও মনে পড়ে যায় সে ঘটনা। তখন ধোঁয়াওঠা টগবগে প্রেম তাদের। সেসময় সন্ধ্যা নামলে কলাভবনের দুই ঝাঁকড়া বটতলা প্রেমকুঞ্জে পরিণত হতো। আশপাশের লাইটগুলো কারা যেন নিভিয়ে দিত। কলাভবনের বারান্দার টিমটিমে আলোয় অন্ধকার রহস্যময় হয়ে উঠত। সেই আলো-আঁধারীতে প্রেমিক-প্রেমিকারা বেপরোয়া হয়ে যায়। নির্ঝর-বিনীতা তখন নতুন প্রেমে দিশাহারা। কৈশোরের ফ্যান্টাসি প্রথমবার অভিজ্ঞতায়; কল্পনার শরীর রক্ত-মাংস-স্বেদ-ঘ্রাণ-স্পন্দন সমেত জলজ্যান্ত হাতের মুঠোয়। এ এক দুর্ধর্ষ নেশা। হাত দেড়েক দূরত্ব রেখে বসা যুগলদের সারিতে তারা রোজ জায়গা করে নেয়। প্রেমিক-প্রেমিকারা নিজেদের মধ্যে এমন মগ্ন থাকে যে পাশের যুগলের দিকে তাকানোর ফুরসত পায় না। কিংবা তাকাতে লজ্জা পায়, যেন তাকালেই চেনামুখ। তেমনি এক সন্ধ্যায় বিনীতা-নির্ঝরের থেকে কয়েক হাত দূরে রঙ্গনের ঝোঁপের পাশে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পাসের এক ছাত্র অনন্তকাল ধরে পেশাব করছিল আর দাঁত কেলিয়ে হাসছিল। সাথে অশ্লীল মুখ ভেঙ্গানি। বিনীতা রেগেমেগে সেই পেশাবকারীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিল, ‘আহারে, ভাইটা একটা প্রেমিকা জোটাইতে পারে নাই তো, তাই দেখেই যা সুখ!’ কথাটা ইলেক্ট্রিক শকের মতো কাজ করেছিল, কানে পৌঁছানো মাত্র ব্যাটা এক ঝটকায় জিপার টেনে উধাও। বিনীতা হাতে হাতে ফল পাওয়ার তুষ্টিতে আদুরে বেড়ালের মতো গাল ঘষছিল নির্ঝরের গালে। কিন্তু মিনিট পনের যেতে না যেতেই সেই পেশাবকারী দর্শক হল থেকে সাঙ্গপাঙ্গ সমেত হাজির। মাস্তানি দেখিয়ে অন্য যুগলদের উঠে যেতে বলে তারা ঘিরে ফেলেছিল বিনীতা-নির্ঝরকে।
‘কোন হল? কত সেশন?’ নির্ঝরকে জিজ্ঞেস করেছিল দলের নেতাগোছের ছাত্রটা, যার পাশে সেই পেশাবকারী রাগে ফুঁসছিল।
চুপ করে ছিল নির্ঝর।
‘হালায় বাকপ্রতিবন্ধী কোটায় ভর্তি হইছে নাকি?’
নির্ঝর নিচুগলায় বলেছিল, ‘আমি এই ক্যাম্পাসের না।’
‘আউটসাইডার তুই! তাইলে সাহস কেমনে হয় আমাদের ক্যাম্পাসে এসে নষ্টামি করার রে বাইনচোদ?’
জোরথাপ্পর মারে সে নির্ঝরকে। নির্ঝর মুখ থুবড়ে পড়তে না পড়তে আরেক গালে ঝড়ের বেগে চড়।
ডুকরে কেঁদে উঠেছিল বিনীতা। ‘এই, তুই তো এই ক্যাম্পাসের, না? ছিঃ! ছিঃ! থাম বেটি! চিনে রাখলাম তোকে আমরা! ভদ্রভাবে চলবি এখন থেকে!’
বিনীতা আরও জোরে ডুকরে ওঠায়, ওরা ভড়কে যায় হয়ত কিংবা ভাবে, যথেষ্ট হয়েছে। ওদের তখন বটতলা থেকে উঠিয়ে দিয়ে হলের সেই ভাইবেরাদাররাও সরে পড়ে। তারপর বহুদিন নির্ঝর আর এই ক্যাম্পাসের ত্রিসীমায় ঘেঁষেনি। বিনীতা ক্লাসে যায়নি এক সপ্তাহ। দুজনে দেখা করত ক্যাম্পাসের বাইরে। রমনা পার্কের গাছতলায় বসে রাগে-অপমানে ফোঁসফোঁস করত, কখনো হতাশায় দীইইর্ঘ দীইইর্ঘ শ্বাস ফেলত।
তবে সেই ঘটনা তাদের দমাতেও পারেনি। বেয়াড়া রগ ছিল দুইজনের ঘাড়ে। যদ্দিন বিনীতা হলের বাসিন্দা ছিল, এই ক্যাম্পাসে বৃষ্টির দিনে রিকশায় পর্দার ঘেরাটোপে চুমু খাওয়া কি হল-গেটের সামনের গাছের আড়ালে চকিত চুমু, আশ্লেষ-আদর কিছুই বাদ যায়নি। ফরহাদ এই ক্যাম্পাসেরই ছাত্র হলেও এখানে তার আর বিনীতার অন্তরঙ্গতা আলতো জড়িয়ে ধরা পর্যন্তই। প্রেম শুরুর পরপরই দুজনে চাকরি জুটিয়েছে। ভালোবাসাবাসির বহু নিরাপদ জায়গা নাগালে এসেছে। সংসার পাততে দেরি করারও কারণ ছিল না কারও তরফে।
নির্ঝর হাতঘড়িকে উপেক্ষা করে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখে। পৌনে ৫টা। ফরহাদের একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করে। আবার একলা খেতেও কেমন লাগে। নির্ঝর স্মোকার ছিল এক সময়। বছর কয়েক আগে ছেড়ে দিয়েছে। আর ফরহাদ গোটা কৈশোর-তরুণকাল ‘সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না, টানলে হাঁচি আসে’ টাইপ ডায়ালগ দিয়ে বছর দুয়েক হলো সিগারেট ধরেছে। নির্ঝর কীভাবে যেন ফরহাদের মনের ভাব বুঝে ফেলে। কিংবা, ধরে ফেলাটা হয়ত অত কঠিন নয়, বিনীতার মুখে ফরহাদের নব্যসিগারেটপ্রীতির গল্প সে শুনেছে। উসখুসে ফরহাদকে রেহাই দিতে সে বলে,
‘সিগারেট হবে একটা?’
‘অবশ্যই!’ খুব আন্তরিকতায় জিন্সের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে ফরহাদ। যত্ন নিয়ে ধরিয়ে দেয়।
সিগারেটের ধোঁয়া দুজনকে ঘিরে বলয় তৈরি করে। যেন একের প্রশ্বাস অন্যের শ্বাস হয়ে ভেতরে ঢুকছে। শান্ত-শিথিল শান্তিশান্তিভাব নেমে আসে। আপনমনে মিটিমিটি হাসে দুজন। তারা ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। ঘুরছে, উড়ছে যার যার অতীত ধরে এবং পরস্পরের অতীতেও ঢুকে পড়ছে অনধিকার চর্চার বারণ ছাড়াই।
|| বিনীতা ||
বেস্ট ফ্রেন্ড বলেন বা হাল আমলের বেস্টি, কিংবা ধরেন, খানিক নাটকীয়তায়, আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—তোমার পরানের বান্ধব কে? আমি সৎভাবে উত্তর দেব—নির্ঝর আর ফরহাদ। নির্ঝরকে একই প্রশ্ন করা হলে ও আমার নাম বলবে; ফরহাদের নাম যদি উচ্চারণ না-ও করে, মনে মনে নিশ্চয়ই স্বীকার করে নেবে। ফরহাদের বেলায়ও আমার নামের সাথে নির্ঝর জোড়া বাঁধবে (উহ্য থাকলেও)।
যদি জিজ্ঞাসা করেন—কীভাবে জানি? শুধু জানি যে জানি।
নির্ঝর ও ফরহাদ—যথাক্রমে আমার প্রাক্তন প্রেমিক ও প্রাক্তন স্বামী। দীর্ঘ নির্ঝরকাল শেষে ঋতুবদলের নিয়মে দীর্ঘ ফরহাদকাল শুরু। আমার এমন গড়ন, দীর্ঘ মেয়াদে জুড়ে থাকি। আমার আত্মায় বেড়ে ওঠে আমার সঙ্গী, তার সত্তায় আমি বিকশিত হই। নির্ঝরকে কেমন ভালোবাসতাম বলি। ঝালাই কারখানায় আগুনের ফুলকি যেমন ছিটকে ছিটকে আসে, ওইরকম গনগনে শিখার ফিনকির মতোন ছিল আমাদের প্রেম। সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ আমার প্রথম পুরুষ। এমন প্রেম কেন ভাঙল তা আজ আর বিতং করে বলার দরকার নেই। জাগতিক বাস্তবতায় দুইজন দুই দিকে যেতে চাইলাম। ঘেঁষেঘেঁষে থাকা আমাদের হলো না। এমনই বুঁদ হয়ে ছিলাম আমরা পরস্পরে, আমাদের তেমন বন্ধু ছিল না। আড্ডায়-সামাজিকতায় উপরিতলের হাসিঠাট্টা, একটু শিল্পসাহিত্য, বেশুমার গীবত-আঙুলগোনা প্রশংসা, পিঠ চাপড়াচাপড়ি, সিদ্ধ-নিষিদ্ধ খানাপিনা, ফিল্ম-সিরিজ-থিয়েটার, ফুটবল-ক্রিকেটলীগময় হৈহুল্লোড়ে শামিল হওয়ার বিস্তর মানুষ ছিল। কিন্তু হৃদয়গহন-দ্বারে গোপন কথা শুনিবারে কান পেতে রবে, এমন বন্ধু ছিল না। দুজনের পৃথক যাত্রায় আমাদের আবার সঙ্গীর প্রয়োজন হবে, বন্ধুর কাঁধ লাগবে। তাই আমরা সচেতনভাবেই সংযোগ ছিন্ন করেছিলাম। অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়া একটা অঙ্গ কেটে ফেলা হলে যে সর্বগ্রাসী ব্যথা সারা শরীরকে আক্রান্ত করে, আমি তখন সেই অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। বিচ্ছেদের এমন জান্তব শরীরী প্রতিক্রিয়া হয়, কে জানত! কোনো কোনো দিন আবার এমন অবশ হয়ে থাকত শরীর-মন, শ্বাস নিতেও যেন পারতাম না; বেঁচে আছি তো? আত্মার একটা অংশ হঠাৎ নিস্পন্দ হয়ে গেলে, সকল ইন্দ্রিয় বিকল হয়ে যায়। এত মানুষে দুনিয়া মুখর, কেউ আমার ভাষা বোঝে না।
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! আমি উলটা ব্যথা উপশমের আশায় হৃদয় খুঁড়ে নির্ঝরের গল্প তুলে ফরহাদকে দেখাতাম। নির্ঝর বলে কখনো কারও অস্তিত্ব ছিল না কিংবা তাকে মৃত ভেবে নিয়ে মুভ অন করার চিন্তাকে আত্মঘাতী জ্ঞান করতাম। মনে হতো, আরেকজনের স্মৃতিতে তাকে সযত্নে গেঁথে দেই। আমার স্মৃতিকোষ থেকে কিছু হারিয়ে গেলে তার কাছে চাওয়া যাবে। আমার কাছে স্মৃতি জীবনের সবচেয়ে দামী সঞ্চয়। স্মৃতিহারারা নিঃস্ব মানুষ। যে ছিল আমার অস্তিত্বের অংশ, তাকে ভুলে যাওয়ার ভানে নিজেকে হারাতে চাইনি।
ফরহাদ নির্ঝরকে দূর থেকে চিনত, সামনাসামনি আলাপ হয়নি কখনো। আমি পরান খুলে বলি যখন, সমস্ত অনুভব সমেত বলি। মুহূর্তে সেই সময়ে, সেই জায়গায় চলে যাই। আরেকবার, পুরোপুরি না হলেও অনেকখানি, যাপন করি অতীত। সে সময়কার আনন্দ, সুখ, বেদনা, কৌতূহল, রাগ-ক্ষোভ-বিস্ময় সবকিছুর অনুরণন ওঠে। ফরহাদ সেই ঘোরে বুঁদ হয়ে বলত—তুমি এমনভাবে বলো, তোমার গলার স্বরে কী যেন একটা হয়! তোমার চেহারা সেই ঘটনাটাকে ধারণ করে। আমি সব দেখতে পাই, জানো! খালি দর্শকের মতোন না। আমি তোমাদের ভিতরেও যেন ঢুকে পড়ি। সময়সময় এতই জ্যান্ত অনুভূতি হয় যে, আমি ভাবি, ‘আল্লাহ, আমার জীবনেই এইসব ঘটতেছে নাকি! আউটসাইডার লাগে না নিজেকে।’ আমার ভাঙা প্রেমের বিরহস্রোতে শামিল হয়ে ভেসে যেতে যেতে ফরহাদ আমাকে টেনে নিয়ে গেল আরেক স্রোতে। শুরু হল বিনীতা-ফরহাদের মিলিত ধারা। আমি ফরহাদকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘নির্ঝরের অত গল্প শুনে তোমার অস্বস্তি হয়নি? মনে হয়নি, নির্ঝর কখনো নাই হয়ে যাবে না আমার জীবন থেকে? ওকে পাশে নিয়েই থাকতে হবে আমার সাথে?’
‘কাহিনিতে মজে গিয়ে আমার নিজেরেই নির্ঝর মনে হইত। আর ওইরকম একটা প্রেমের খুব সাধ হইত। তোমার প্রেমে একটা নিবেদন আছে, সমর্পণ আছে! বাইরের সিনসিয়ারিটি-কেয়ারিংনেস-মেইনটেন্যান্সের ব্যাপার এইটা না। তুমি একদম আত্মার গভীর থেকে ভালোবাসো। ভাংচুর-বিস্ফোরণ একেবারে!’ তারপর ভাবুক গলায় বলেছিল, ‘ওইরকম বিস্ফোরণ না হলে বড় কিছু হয়? বিগ ব্যাং না হইলে আমাদের সোলার সিস্টেমের জন্ম হইত?’
ফরহাদের সাথে প্রেম যে নির্ভরতায় পৌঁছে গেল তাতে বিয়ে ছিল নিশ্চিত গন্তব্য। আমাদের বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোত্থেকে উদভ্রান্তের মতো উদয় হলো নির্ঝর। পুরনো প্রেমের দাবি সমেত। তার বিশ্বাস ছিল, আমি তার চিরকালীন ঘর। যে কোনোদিন সে ফিরতে পারবে। কারণ, Home is the place where, when you have to go there, they have to take you in। কিন্তু ততদিনে ফরহাদ আমার অস্তিত্বের অংশ হয়ে গেছে। নির্ঝরের সাথে যে আমার আবার যোগাযোগ শুরু হয়েছে, সেটা ফরহাদ জানত। স্বামীগিরি দেখিয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি সে। বিচলিত না, কৌতূহলী হয়েছিল বরং। গভীর, অবিচল বিশ্বাস ছিল তার আমাদের যৌথতায়। নির্ঝর যেন আর রক্তমাংসের মানুষ নয়; অতীতের ছায়া, নস্টালজিয়া, স্মারক; সযত্নে রক্ষিত মমি। ফরহাদের বরং নতুন গল্পের নেশা হচ্ছিল।
নির্ঝর আমার নতুন জীবন ছুঁয়েছেনে দেখতে চাইত। কোথাও কি সে আছে, কোথাও কি আছে ছিদ্র কোনো তার প্রবেশের? আমার কাছে শুনতে চাইত সব। সে গল্পের অর্ধেকেরও বেশি জুড়ে ফরহাদ থাকত। হৃদয়হীনের মতো ফরহাদের গল্প বলে নির্ঝরকে শাস্তি দিতে চাইতাম এমন না। কিংবা, দেখো, তুমি চলে যাওয়ার পর আমার ভালোবাসার অভাব হয়নি টাইপ দেখনদারি থেকেও না। ও যদি সত্যি সত্যি আমার গল্প শুনতে চায়, তবে ফরহাদের গল্পও শুনতে হবে যে। ফরহাদকে কাটছাঁট করলে সেই পরিমার্জিত সংস্করণে আসলটাকে পাবে না। নির্ঝর তাও বাগড়া দিত প্রায়ই। অধৈর্য হয়ে বলত, ‘ফরহাদের কথা বাদ দেও তো এবার।’ তারপর ওর গলাটা করুণ হয়ে যেত, ‘তুমি বোঝো না, এতে আমি কত অ্যাফেক্টেড হই? এত ইনসেনসিটিভ তুমি কবে হইলা?’ ফরহাদের নাম মুখে না এনে যেদিন যেদিন কথা বলতাম, নির্ঝর ঠিকই বুঝত ছায়ার মতো ফরহাদ সর্বত্র বিরাজমান। আমি যে সঙ্গীকে আমার ভেতর বাড়তে দেই, তাতে আমার প্রকৃতিতে কিছু অবশ্যম্ভাবী বদল আসে। নির্ঝর অবাক হয়ে দেখত আমার নতুন সব রঙ, নতুন সব অভ্যাস। তার অজান্তে যা যা ঘটে গেছে, সব আত্মস্থ করে নিতে চাইত। এভাবেই একদিন আমাকে ফরহাদসমেত মেনে নিতে শিখল সে; ফরহাদ আর উটকো বহিরাগতের মতো অস্বস্তি আনত না। তদ্দিনে আমি যা জানি নির্ঝরের, তা ফরহাদ; আর ফরহাদের যদ্দূর জানি, তার প্রায় আগাগোড়া নির্ঝর জেনে গেছে। দোষ-গুণ-সীমাবদ্ধতা, স্বভাবের যত অদ্ভুত দিক-পাগলামী-মুদ্রাদোষ ইত্যাদি ইত্যাদি। শুরুতে যখন ফরহাদের সামনে আমার আর নির্ঝরের সুখস্মৃতি তুলে আনতাম এই ভেবে যে, আজ আর না থাকলে কী হবে, একদিন ছিল আমার এক অতি দুর্লভ প্রেম। ও যে আমার মধ্যে আছে, আর আমি যে ওর মধ্যে আছি এবং আমরা পরস্পরের মধ্যেই থেকে যাব এই বিশ্বাস থেকে আমি যা যা বলতাম নিজের জীবনের গল্প ভেবেই বলতাম। নির্ঝর যে স্বতন্ত্র মানুষ, আমি যে নির্ঝরের গোপনীয়তা কিংবা আমাদের যৌথ গোপনীয়তা তৃতীয় আরেকজনের সামনে উন্মুক্ত করছি, তাতে প্রাইভেসির সীমা লঙ্ঘন হচ্ছে কি না—এই অপরাধবোধ ক্ষীণ দুর্বল হাতে আমার বিবেকের গায়ে আঁচড় কাটত। আমি না হয় গভীর ভালোবাসায় আচ্ছন্ন, দোষগুণ মেনে নিয়ে মানুষটাকে আপাদমস্তক ভালোবাসি। আরেকজন যখন শুনছে, যার মনে ওই প্রেম নেই, দোষগুলোকে সে হয়ত ঘৃণাই করে বসবে। কিন্তু দেখতাম, এই ছোঁয়াচে ভালোবাসায় ফরহাদও নির্ঝরকে ভালোমন্দ মিলিয়ে ভালোবাসতে শিখেছে। সময়সময় নির্ঝরের পক্ষ নিয়ে সাফাই গাইত—‘ফেরেশতা তো আর না। মানুষের ওইরকম দোষ-ত্রুটি থাকবেই।’ কিংবা, ‘এই ঘটনায় তোমার দোষ বেশি, বিনি।’ এমনকি ‘আমি তো নির্ঝর ভাইয়ের ফ্যান হয়ে যাচ্ছি!’ আমার মানুষ চেনার সহজাত ক্ষমতায় বুঝতাম, ফরহাদ বড় ভদ্রলোক, এইসব গোপন তথ্য নির্ঝরের বিপক্ষে অস্ত্র হিসাবে সে ব্যবহার করবে না কোনোদিন। ভালোবাসার স্বীকারোক্তির পর ফরহাদ বলেছিল, ‘আমি তো শুরু থেকেই তোমার প্রেমে পড়ে ছিলাম। নির্ঝরের দোষ-ত্রুটির সাথে নিজেকে মিলায় স্বস্তি পাইতাম। তাকে যদি ওইসব সত্ত্বেও ভালোবাসতে পারো, তাইলে আমাকেও বাসবা না কেন? আর আমি শিখতে চাইতাম, বুঝছ! নির্ঝর ভাইয়ের ভুলগুলা যেন আমি না করি।’
নির্ঝরকে ফরহাদের গল্প বলার বেলায় মনে হতো, এবারে বেশ একটা ভারসাম্য রক্ষা করা গেল। কেন একা ফরহাদ নির্ঝরের গল্প জানবে! এসবের কিছুই ফরহাদের অগোচর ছিল না। ঠিক সরাসরি না, একটু ঘুরিয়ে সে বলতো, ‘উদাম হইতেও ভয় নাই আমার! আমি নিজের দোষগুণ সব ওউন করি। বুকে হাত দিয়া বলতে পারি, বেশিরভাগ মানুষের চাইতে আমার অন্তর পরিষ্কার।’
এই হঠাৎফেরা নির্ঝরের নতুন নতুন গল্প ফরহাদ শুনত। নির্ঝর শুনত ফরহাদের গল্প। আমি গল্পকথক একটা সেতুর মতো ওদের সংযোগ ঘটিয়েছিলাম। আমার ভেতর দিয়ে ফরহাদের গল্প নির্ঝরের কাছে, নির্ঝরের গল্প ফরহাদের কাছে পৌঁছাত। কখনো কখনো গল্পেরা মিলেমিশে একাকার হতো। তবে ওদের সামনাসামনি আলাপ হয়নি তখনো। নির্ঝর থাকত ফ্লোরিডায়। সেটা একটা বড় কারণ, তবে একমাত্র না। দেশে তো আসতই নির্ঝর, দুই বছরে একবার, গ্রীষ্মের ছুটিতে, জুন-জুলাইয়ের দিকে। দেখা হলে, কী জানি কী হয়, সেই ভয় থেকে দূরত্ব বজায় রাখত। সেই সময়টা আমার জীবনের এক পরিতৃপ্তিময় কাল। সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের মতো ফরহাদ-নির্ঝর, আমার দুই হাত ধরে থেকে নিজেরাও মিলে গেছে।
|| তারা তিনজন ||
বিনীতা হেঁটে আসছে এদিকে। প্রথমে দেখতে পায় নির্ঝর। ওর মুখে খুশির আভা অনুসরণ করে ফরহাদ সামনে তাকায়। নির্ঝরের আবার সেই পনের বছর আগের বিনীতাকে মনে পড়ে। কী মিষ্টি হাসিমুখ ছিল ওর। মায়ামায়া। একটু অগোছালো-আলুথালু। কৈশোর পেরোনোর বহু বছর পরও যুবতীর লাস্যের চেয়ে কিশোরীর সারল্য ছিল শরীরে। জড়িয়ে ধরলে মনে হতো পাখির ছাও, এমন নরম আর আদুরে। এখনকার তেজী-প্রত্যয়ী-পরিপাটি নারীটির সাথে তার সামান্যই মিল। পনের বছর কি কম সময়! ফরহাদের মনে হয়, একই সাথে কী আপন আর কী দূরের সে এখন। বছর তিনেক আগেও ঘুম ভাঙলে বাসীমুখে কথা হতো মুখোমুখি। তিন বছর তো বেশি সময় না। কিন্তু আজ আর একসাথে এক বাসায় ফেরা হবে না। এই তিন বছরে চেহারা খানিকটা ভারী হলেও ধার এসেছে চাউনিতে। খানিক গাম্ভীর্য। ফরহাদ নিজের কথা ভাবে। লন্ডনে থাকে সে এখন। তার চেহারায়ও কী কসমোপলিটান ধারালো ঝকঝকেভাব এসেছে? নাকি পরিত্যক্ত বাড়ির মতো অযত্নের শ্যাওলা জমেছে?
টিএসসির হট্টগোলের মধ্যে নির্ঝর-ফরহাদকে একসাথে দেখে বিনীতার যেমন লাগে, তেমন অনুভূতি আগে কখনো হয়নি। অনাস্বাদিতপূর্ব শব্দটা ওর মাথায় আসে। পরিপূর্ণ নিবিড় শান্তি, মনোরম আরাম। দীর্ঘ বছর পর ঘরে ফিরল যেন তারা তিনজন। মনে মনে তারিখটা আওড়ায় সে। এ দিনটাকে কখনো ভুলবে না। তারা তিনজন একইভাবে হাসে। এই দিনটা অতুলনীয়। এক পা এ সময়ে, আরেক পা পুরনো দিনে হেঁটে বেড়ায়।
দুজনের সাথেই বিনীতার বিস্তর স্মৃতি আছে এই এলাকায়। রাস্তায়, ধুলায়, ঘাসে, গাছে, বেঞ্চে, টঙে, দেয়ালে, দেয়াল লিখনে, ভাস্কর্যে, ফুলওয়ালীর ডালায়, উৎসবে ও মেলায়, আকাশে, বাতাসে… এদিনে নিজের অজান্তে যদি কোনো একজনের প্রতি পক্ষপাত প্রকাশ পায়, যদি কেউ আঘাত পায়, বিনীতা তাই ওদের ওপরই ছেড়ে দেয়—‘কোনদিকে যাব আমরা?’ ফরহাদের মনে হয়, বিনীতা-ই চালিয়ে নিক না তাদের যেদিকে সে যেতে চায়। নির্ঝর বলে ওঠে,
‘চলো, শহীদ মিনারের সামনে। মোকাররম ভবন।’
ফরহাদ তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলে। নির্ঝর যে আড়চোখে তাকে দেখে একবার, তা-ও নজর এড়ায় না। নির্ঝর কি নিবিড়তা খুঁজছে? তার আর বিনীতার স্মৃতির সামনে সে কি অনাকাঙ্ক্ষিত উটকো লোক, যে নির্জনতার মর্ম বোঝে না? কিন্তু এই যে তাদের নিয়তি।
বিরাটাকায় সোনালু আর কৃষ্ণচূড়ায় লাল-হলুদে আকাশ ছাওয়া নিবিড় ছায়া। কী মায়া, কী মায়া!
ঢোকার গেটে ‘আন্দালীবের সাত চান্দ’ নাটকের পোস্টার সাঁটা। সেটা খেয়াল করে শিল্পকলায় আগামীকাল সন্ধ্যা ৭টার শো-টা দেখা যায় কিনা, সে আলাপ তোলে ফরহাদ।
অন্যমনস্কভাবে নির্ঝর বলে, ‘দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেইদার অ্যাডাপটেশন। শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধের কাহিনীকে বাংলাদেশের কনটেক্সটে অ্যাডাপ্ট করা।’
‘দেশে আসছি দুই বছর পর। মঞ্চ নাটক তো দেখবই। বিনীতা, অন্য কোনো ভালো নাটক কি আসবে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে? সাত চান্দ দেখবা তুমি?’
‘দেখা যায়… ফিলিস্তিনের এক নাট্যকারের নাটকের অ্যাডাপ্টেশন একটা আসতেছে। স্যাডলি, নাটক বা নাট্যকার কারো নামই এই মুহূর্তে মনে আসতেছে না। আচ্ছা দাঁড়াও… লেট মি চেক…’
‘খালি অ্যাডাপ্টেশন বের হচ্ছে কেন? বাংলাদেশী নাট্যকারদের মৌলিক চিন্তা নাই? আমাদের নিজেদের যথেষ্ট গল্প নাই? ভিনদেশী গল্পের আড়াল নিতে হবে কেন?’
‘খালি নাট্যকারের দোষ ধরো কেন। সবাই তো গৃহপালিত গরু-ছাগল-ভেড়ার মতো সরকারপালিত। কে চায় নিষিদ্ধ হইতে, কোপ খাইতে, গুম হইতে?’
বিনীতা মোবাইল বের করে স্ক্রল করতে থাকে। কিন্তু তার মাথার ভেতর কাহিনী চালু হয়ে গেছে। দেখতে পায় ১৪ বছর আগের সেই সন্ধ্যা। এই এখানে ওড়নায় মাথামুখ ঢেকে সে হাঁটছে নির্ঝরের হাত ধরে। দুই চোখ লাল আর ফোলা। খানিক আগেই কেঁদেছে। পানি লাগানো নিষেধ বলে মুখে পানির ঝাপটা দেয় না দশ দিন, কিন্তু এই দশদিনে কতবার চোখের পানিতে যে মুখ ভিজিয়েছে! দীর্ঘ দশদিন পর সে বাইরের আলো-হাওয়ায়। এতদিন যেন জেলখানার সলিটারি সেলে আটকা ছিল। সামনের মেডিকেল সেন্টারের আইসোলেশন ওয়ার্ডে তার বন্দীদশা ছিল ওরকমই। চিকেন পক্সের রোগী অচ্ছুৎ। ছোঁয়াচে রোগের ভয়ে কেউ দেখতে আসে না। সমস্ত মুখ, শরীর জলজ গোটায় ভরা। গলার ভেতরটাও বাদ যায়নি বলে গিলতেও কষ্ট। এর মধ্যেই ডিপার্টমেন্টের প্রথম টার্ম-ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। দশদিন গোসল করেনি ডাক্তারের বারণে। এই আইসোলেশন ওয়ার্ডে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সকালসন্ধ্যা তার সাথে থাকে নির্ঝর। মফস্বলের বাড়ি থেকে মা আসেনি। ঢাকার আত্মীয়স্বজনদের কেউ কেউ টিফিন ক্যারিয়ারে দুবেলার খাবার এনে দূর থেকে এক ঝলক চেহারা দেখিয়ে দায়িত্ব সেরেছে। আইসোলেশন ওয়ার্ডের বাইরে বেরোনো মানা। তবে এই সন্ধ্যাবেলা ওয়ার্ডবয়রা ডিউটি ছেড়ে যার যার চরকায় তেল দিয়ে বেড়াচ্ছে বলে নির্ঝর সহজেই তাকে বাইরে বের করে এনেছে। কৃষ্ণচূড়া-সোনালুর শামিয়ানার নিচে নির্ঝরের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিনীতা দেখছিল হাস্যোজ্জ্বল সুবেশী-সুগন্ধী যুগলদের। ভাবছিল, তার এই গোটায় ভরা, ঘাম-তেলে প্যাঁচপ্যাঁচে মুখ, স্নানহীন শরীরের বাসী গন্ধে নির্ঝরের নিশ্চয়ই ঘেন্না লাগছে। কী কষ্টে না বেচারা তাকে সহ্য করছে এতগুলো দিন! ভাবনাটা টিকটিক করতে করতে এমন টিটকারী শুরু করে দেয়, আর সহ্য করতে না পেরে নির্ঝরের হাত ছেড়ে দিয়ে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। নির্ঝর হয়তো বুঝে ফেলেছিল। কোনো কথা না বলে কাছে এসে গোটায়ভরা ক্যালামাইন লোশন লাগানো কপালে চুমু দিয়েছিল। আহ্! ভালবাসা, আদর, মমতা, ভরসা, যত্ন, দায়িত্ববোধ… আরও কী কী ছিল সে চুমুতে… বিনীতার ভেজা চোখে পানি এসেছিল আবার।
নির্ঝরের মাথার ভেতর চলছে সেই আইসোলেশন ওয়ার্ডের আরেকদিনের স্মৃতি। এক নির্জন দুপুর, যেদিন জেনারেল ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি নেই বলে স্টাফরা সব যে যার মতো হাওয়া। ওই বদ্ধ আইসোলেশন ওয়ার্ডে প্রথমবারের মতো সে বিনীতাকে পোশাকের আবরণ থেকে বের করে এনেছিল। পক্সের গোটাভরা শরীর। কই, ঘেন্না তো লাগেনি। বাসনা ছিল, সাথে হীনম্মন্য প্রেমিকাকে ভরসা দেওয়ার ইচ্ছা। আইসোলেশন ওয়ার্ডের দরজাজানালাবন্ধ অন্ধকার। গাঢ় ঘ্রাণ, নোনতা বুনো স্বাদ, অপ্রতিরোধ্য আদিম টান।
ফরহাদের পুরো কাহিনী জানা। বিনীতার ভাষ্যের সাথে নিজের কল্পনা মিশিয়ে সে আরেক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে। এক মুহূর্তের জন্য ঈর্ষাও জাগে। বিনীতার সাথে তার প্রেম হয়েছিল পরিণত বয়সে, কাঁচাবয়সের প্রথম অভিজ্ঞতাগুলো যার যার আগেই হয়ে গেছিল।
একটা সিএনজিতে তারা তিনজন উঠে পড়ে। দূরত্ব অনুযায়ী রিকশাই উপযুক্ত বাহন, কিন্তু তিনজনে এক রিকশায় উঠে বেচারা রিকশাওয়ালাকে আর কষ্ট দিতে চায়নি। গন্তব্য হাতিরপুলের ফ্রি স্কুল স্ট্রিট। মুখে ব্যাম্বুশুট ক্যাফের কথা বললেও আদতে ফরহাদের ইচ্ছা, সে আর বিনীতা প্রথম সংসার পেতেছিল যেই বাসায়, বাগানবিলাসের ঝাড়ে ঢাকা সেই বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে আসে।
ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের মুখে ফরহাদ বলে, ‘সিএনজির ভেতর গরমে হাঁসফাঁস লাগছে। রাস্তা তো বেশিদূর না। হেঁটেই যাই?’
বিনীতা-নির্ঝর চুপচাপ তাকে অনুসরণ করে। ফরহাদ মূল রাস্তা ছেড়ে গলির দিকে বাঁক নিলে তাদের বুঝতে বাকি থাকে না।
চাকরি পাওয়ার পর ফরহাদ ওই বাসাটা ভাড়া নিয়েছিল। শুরুতে মাকে সাথে রেখেছিল। বাড়িওয়ালাকে বুঝ দিয়েছিল মায়েতে-ছেলেতে থাকবে। বাড়িওয়ালার আস্থা অর্জন করিয়ে ব্যাচেলর ছেলেকে রেখে মা চলে গেল গ্রামে। বিনীতাও তদ্দিনে চাকরি পেয়েছে। শেয়ারড ফ্ল্যাটে থাকে দুই কলিগের সাথে। প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে ফরহাদের বাসায় এসে শনিবার সন্ধ্যায় চলে যেত। বকশিশে দারোয়ানের চোখ বুজিয়ে দিয়েছিল। সংসারের প্রাথমিক চর্চা সেই বাসাতেই। বিনীতার ওপর তখন বৌ-ভাব ভর করেছিল। কোনোদিন রান্নাবান্নায় আগ্রহ না পাওয়া মেয়েটা ঘরকন্যা খেলার উৎসাহে এটা ওটা বানাত। রান্না ভালো হলে চোখে-মুখে বিজয়ীর হাসি চকমকিয়ে উঠত। সবচেয়ে ভালো বানাত টিকিয়া কাবাব। তুলতুলে, ফোলাফোলা, অপূর্ব মাংসল স্বাদ। মুখে দিলে আপনিই চোখ বুজে আসত আবেশে। নিরাভরণ বাসাটায় বাড়ি-বাড়ি ভাব আনতে ফরহাদ কিনেছিল কয়েকটা ল্যাম্প শেড। বিনীতা এনেছিল লম্বা লম্বা ফুলদানী, কারুকাজ করা কাঠের আয়না। ফরহাদ যোগাড় করত বিয়ার-ভোদকা-ওয়াইন। বিনীতা আনত নানান ডিজাইনের গ্লাস, কেতা অনুযায়ী ড্রিংক পরিবেশনের জন্য।
বিনীতা আরও আনত নানান জাতের ঘরোয়া গাছ। জঙ্গুলে বারান্দায় মধ্যরাতের নির্জনতায় তাদের কত কত ভালোবাসাবাসি হয়েছে। ঠান্ডা মেঝেয় নগ্ন শুয়ে থেকেছে কত রাত। ফরহাদের প্রায়ই ইচ্ছা করে ঐ ফ্ল্যাটটা বিক্রি হবে কি না খোঁজ নেয়। সুযোগ থাকলে কিনে নেবে। দেশে আসবে যখন, এখানেই থাকবে স্মৃতি পরিবেষ্টিত হয়ে। এই ভাবনাটা সুন্দর। একে সে পুষে রাখে। বাস্তব যেকোনো কিছুর চেয়ে তার আইডিয়া আর কল্পনা যেমন বেশি সুন্দর।
সেই বাড়ি, যার নাম ‘অতলান্ত’, পার হয়ে যায় তিনজন। বিনীতা গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফরহাদ দেখে, নস্টালজিক হাসি বিনীতার মুখে। দীর্ঘশ্বাস ছোঁয়াচে, নির্ঝরও শামিল হয়।
অতলান্তকে ঝাপসা করে দিয়ে তারা তিনজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে ব্যাম্বুশুটের সামনে। নিজের জায়গায় ফেরার অনুভূতি হয় ফরহাদের। ওখানেই তো তাদের প্রেমচর্চার শুরু। বিনীতার আহত হৃদয়ের শুশ্রূষা করতে করতে নিজেকে যখন সে একটু একটু করে মিশিয়ে দিচ্ছে বিনীতার রক্তে, তেমনই এক দিনে এখানে আসা। তারপর এটা তাদের ফেভরিট ক্যাফে বনে গেল। নিয়মিত আসা হতো। নির্ঝর এ গল্প জানে। তাকে এখানে বসিয়েই সেসবের বিবরণ দিয়েছে বিনীতা। চাইনিজ বাঁশগাছঘেরা এই ক্যাফেতে।
বিনীতা খুঁজতে থাকে রাসেলকে। চটপটে হাসিখুশি সপ্রতিভ একটা ছেলে। ফরহাদ-বিনীতাকে দেখলে আন্তরিক হাসি নিয়ে এগিয়ে আসত। সাহস করে বলেও ছিল, ‘আপনাদের দুজনকে দেখতে যে কী ভালো লাগে, জানেন!’ ফরহাদ-বিনীতাকে নিয়মিত প্রেম করতে দেখা রাসেল অবাক হয়ে গেছিল যখন নির্ঝরকে নিয়ে আসা শুরু করেছিল বিনীতা। তারপর আবার ফরহাদসহ আসত যখন, বেশ তালগোলপাকানো চেহারা হয়েছিল তার। আজ দুইজনই তার সাথে আছে। ওদের চেহারা মনে আছে তো রাসেলের?
বিনীতা ফরহাদকে জিজ্ঞেস করে, ‘রাসেলকে তোর মনে আছে?’ বিনীতার মুখে তুই ডাক শুনে ভালো লাগে। তারা বিয়ের আগে-পরে তুই বলেই সম্বোধন করত বেশিরভাগ সময়।
‘থাকবে না কেন!’
‘তোর মনে আছে, নির্ঝর?’
নির্ঝর তিন বছরের সিনিয়র বলে তুই ডাকের চল ছিল না তাদের মধ্যে। শুধু লাভ মেকিংয়ের বেলা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তুই ডাক বেরোত দুজনের মুখ থেকে। সমতা বিধানের মতো দুজনকে এই ‘তুই’ করে বলা ভালো লাগে নির্ঝরের, বিশেষত অন্তরঙ্গ স্মৃতিগুলো এক ঝটকায় সামনে আসে বলে।
‘হ্যাঁ, মনে আছে তো।’ আস্তে করে বলে সে।
এগিয়ে আসা ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করে বিনীতা, ‘রাসেল বলে একজন আমাদের রেগুলার অ্যাটেন্ড করতেন এখানে। ওনার আজ ডিউটি নাই?’
‘ম্যাম, এই নামে তো কেউ নাই এখানে।’
‘নাই! আপনি এখানে কত বছর?’
‘সাড়ে তিন বছরের মতো।’
বিনীতা মনে মনে হিসাব করে। প্রায় চার-পাঁচ বছর আসা হয়নি এখানে। রাসেল থাকলে ভালো হতো, ওর উচ্ছ্বাসে মনে হতো, কেউ এখানে অপেক্ষা করে ছিল তাদের জন্য। এই ত্রয়ীর সাক্ষী কৌতূহলী দুটি চোখ দূর থেকে ধাঁধা ভাঙতে চাইত।
ফরহাদ-নির্ঝরের চোখাচোখি হয়। ফরহাদের মনে পড়ে, এই এখানেই কতদিন বিনীতা উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকত জানালার বাইরে। ছলছল চোখে নির্ঝরের গল্প বলত। ফরহাদ ভাবত, নির্ঝরের স্মৃতিচারণের স্মৃতিগুলো ঢেকে দিতে হবে তাদের নিজেদের গল্পের বুননে। তাই প্রেমের প্রথম-প্রথম এখানেই বসত। তারপর যেন স্মৃতির ভার থেকে হালকা হতে তারা সরে পড়েছিল। নতুন আকাশের খোঁজে নীল অপরাজিতায় রেলিং-মোড়া একটা রুফটপ ক্যাফেতে বসত তারা। নির্ঝরের মনে পড়ে, এখানেই সে অনেকদিনের চেনা বিনীতার সদ্যলব্ধ চিহ্নগুলো অবাক চোখে চিনতে শুরু করেছিল। ফরহাদকে আবিষ্কার করা এখানে।
ফরহাদ-নির্ঝরের চোখাচোখি হয়। এখানে, একজন আরেকজনের অনুপস্থিতিতে পরস্পরকে চিনে নিয়েছিল বিনীতার বয়ানে। তাদের রিলায়েবল ন্যারেটর। জানালার দিকে তাকিয়ে বিনীতা বলে যেত। যেন বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে সে বাহিরকে ভেতরে আনছে। নির্ঝর তাতে দেখতে পেয়েছিল ফরহাদের জীবন। ফরহাদ নির্ঝরের জীবন। এক অতীন্দ্রিয় বলয়ে তাদের সংযোগ ঘটেছিল। তারা একাত্ম হয়েছিল। তারা দুজনেই যে আছে বিনীতার ভেতরে। বিনীতার ভেতরে বাসরত তাদের সেই অংশগুলো মিলেমিশে থাকে নাকি ঠোকাঠুকি করে? নাকি তারা এখন জাদুঘরে সংরক্ষিত পুরানো দিনের স্মারকের মতো অকেজো-নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে থাকে পাশাপাশি?
|| নির্ঝর ||
লন্ডনে ফরহাদের মধ্যে আমি নিজেকে দেখতে পেয়েছিলাম। যেন আমারই একটা ভার্সন আমার মুখোমুখি হয়েছে কিংবা আমিই আরেকটা জীবন যাপন করছি। ভিন্নতাগুলোয় আমার চোখ পড়ছিল কম, আমি মূলত অভিন্নতা খুঁজছিলাম। সেদিন কোনো ঈর্ষা, কোনো দ্বন্দ্ব আমার ওপর আছর করেনি। আজ আবার দীর্ঘদিনের পুরানো বন্ধুর সাথে পুনর্মিলনের অনুভূতি হলো। একদিন বিনীতাকে ঘিরে ভালোবাসার পাশাপাশি যে রাগ-ক্ষোভ-হিংসা-অভিমান ছিল, ছিল উচিত জবাব-শাস্তি দেওয়ার বাসনা, এতদিনে তারা বিদায় নিয়েছে। এখন ভালোবাসা মূলত মায়া। সেই মায়া ফরহাদ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তাই সুহৃদ-শুভার্থী কিংবা আপনজনের মতো আমরা পাশাপাশি হাঁটলাম।
প্রাক্তন প্রেমিকার প্রাক্তন স্বামীর অতিথি হওয়াটা সহজ না। যখন ফরহাদ প্রাক্তন হয়নি, তখন অবশ্য আরও কঠিন ছিল ব্যাপারটা। যদিও দূর থেকেই আমার জীবনের একটা বর্ধিত অংশ হয়ে আছে সে বহুবছর।
বিনীতার মুখে ইউসিএল-এর এক কনফারেন্সে আমার পেপার প্রেজেন্ট করার কথা শুনে ফরহাদ ওকে বলেছিল আমি যেন ওর বাসায় উঠি। আমি সে প্রস্তাব নাকচ করে দেই সাথে সাথে। এমনিতেই, অন্যের বাসায় আড়ষ্ট লাগে, আরাম পাই না। (যদিও আমার কীসে আরাম, কীসে খচখচানি তা ফরহাদ ভালোমতোই জানত); তার ওপর প্রাক্তনের প্রাক্তনের সাথে দেখা করার এই বাড়তি চাপ নেওয়ার কী দরকার। ফরহাদ সম্বন্ধে আমার যে আইডিয়া, তা নিয়েই থাকি না! বাস্তবের মানুষটার মুখোমুখি হয়ে কল্পনার ছবিতে কাটাকুটি করার কী দরকার!
কিন্তু ফরহাদ আমার মতো ভাবত না। কল্পনার বায়বীয়তায় তার ঈমান নাই, সে চায় সরেজমিন অভিজ্ঞতা। ওর জোরাজুরিতে এক সন্ধ্যায় দেখা করতে চাইলাম কোনো বার বা ক্যাফেতে। কিন্তু ফরহাদ নিয়ে গেল তার বাসায়। প্রতিমুহূর্তে আমার যে অনুভূতি হচ্ছিল তা অদ্ভুত, অভূতপূর্ব। একধরনের দ্বিধা-সংকোচ-বাধা, আবার কৌতূহল, টান, উষ্ণতা। শুনে শুনে, দূর থেকে দেখে যে অবয়ব দাঁড় করিয়েছি তার সাথে বাস্তবের মানুষটাকে মিলিয়ে নেওয়া।
আমরা দুজন দুজনকে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। ওর চোখ কোঁচকানো, হাসিতে জ্বলে ওঠা মণি, গজদাঁত, মসৃণ বামগাল বনাম ভাঁজপড়া ডানগাল, একমাথা ঝাঁকড়া চুল, ওর মনোযোগের ভঙ্গি, তারল্য-সারল্য, ঠোঁট কামড়ানো, সপ্তাহখানেক না কামানো দাড়ি, আরও অনেক অনেক চাউনি ও ভঙ্গি এবং অবয়বের নানান সূক্ষ্ম দিক। ওর গলার স্বরের চড়াই–উৎরাই, লঘুগুরু ছন্দ খেয়াল করছিলাম। এসব আমাকে একেকটা কাহিনীতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। আমার মুখোমুখি যেন শুধু ফরহাদ না, ফরহাদ-বিনীতা একসাথে। আমি বেশ দেখতে পাচ্ছিলাম ওরা রেস্তোরাঁয় বসে হাসিতে ফেটে পড়ছে। বিনীতার যা যা বেশি প্রিয়, তুলে নিচ্ছে ফরহাদের প্লেট থেকে। আমি দেখছিলাম ওদের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। কখন ফরহাদের এক্সপ্রেশন কেমন হয়, ওর রিফ্লেক্স, চোখের চাউনি, বাসনাজর্জর চেহারা সব আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি ওর বেদনার্ত চেহারাও দেখছিলাম। দুজনই হয়ত দুজনকে আশ মিটিয়ে দেখছিলাম। আত্মস্থ করতে চাইছিলাম। আবার সতর্কও ছিলাম নিজের ইমেজ রক্ষায়, নির্মাণে। তাই হয়ত শুরুতে আমাদের আলাপ তরতর করে এগোচ্ছিল না।
ফরহাদ জানত আমি ভোদকা পছন্দ করি। স্মিরনফের নতুন একটা বোতল। বেকড স্যামন, সাথে মাশরুম-বেল পেপার-টমেটো। পনিরের স্লাইস।
কৃতিত্বের দাবি নিয়ে চোখমুখ ঝলকানো হাসিতে ফরহাদ বলেছিল, ‘বেকড স্যামন কিন্তু আমি বানাইছি।’
ওর আগ্রহ টের পেয়ে আমি রেসিপি জিজ্ঞেস করেছিলাম। খেয়াল করে শুনিনি কিছুই। আমি তো আসলে ওর এক্সপ্রেশন খেয়াল করছিলাম। দেশে শখের রাঁধুনি ছিল। বিনীতার মুখে ওর পাস্তা বোলোনেজ, পায়েইয়া বানানোর গল্প তো শুনেছিলাম। শৌখিন মানুষ ফরহাদ।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘রান্না করেন নাকি রেগুলার?’
‘রান্না বলা চলে না। কোনো রকমে পেট ভরানো। বিভিন্ন রকম সালাদ বানাই। মাঝেসাঝে খিচুড়ি, ফ্রাইড রাইস। দিনে একটা মিল বাইরে করি। স্পেশাল রান্না করি শুধু গেস্টের অসিলায়।’
ভোদকা কয়েক পেগ খাওয়ার পর আমাদের মাথা যখন ঝিমঝিম করছে আর জড়তা কেটে যাচ্ছে, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেমন যাচ্ছে লাইফের এই নতুন চ্যাপ্টার?’
একটুখানি হেসেছিল ফরহাদ।
‘অ্যাম আই লাভিং ইট? মাঝেমাঝে কী মনে হয় জানেন, আই অ্যাম ইন এগজাইল। সেলফ-ইমপোজড এগজাইল। আমার ড্রিম তো পুরা রিয়ালাইজ হয়নি। স্টাক ইন লন্ডন। সামটাইমস আই টেল মাইসেলফ দ্যাট আই নিডেড দীজ চেঞ্জেজ ইন লাইফ। বাট দেয়ার আর সাম ডেইজ, হোয়েন আই রিগ্রেট মাই চয়েস।’
ফরহাদের চোখ ঝাপসা হয়ে গেছিল।
‘এরকম হয় তো।’ বলে আমি চুপ করে ছিলাম। যা বলিনি তা হলো—প্রায়ই পোর্টেবল হার্ড ডিস্কে জমিয়ে রাখা ছবির অ্যালবামগুলো আমি দেখি। একটা ৮ মেগা পিক্সেলের সাধারণ ডিজিটাল ক্যামেরা, তারপর বিনীতার পীড়াপীড়িতে কেনা ডিএসএলআর—দুই ক্যামেরায় তোলা অগুণতি ছবিতে জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল-উচ্ছল অধ্যায়ের নানান মুহূর্ত, বিনীতাহীন কোনো ছবি যেখানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কোনো কোনো দিন স্বপ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে চলে যাই। টাঙ্গুয়ার হাওড়ে গেছি, নয় বান্দরবানে পাহাড়ে বাইছি। বিনীতার পা মচকে গেছে নাহয় সে ট্যুরে নতুন পরিচয় হওয়া কোনো ছেলের সাথে খুব হাহা-হিহি করছে। আমি ওর পা মালিশ করে দিচ্ছি, আমার কাঁধে ভর দিয়ে ও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে… না হয় অন্য ছেলের সাথে ওর ঘনিষ্ঠতায় মুখ কালো করে আছি। কুল নাই-কিনার নাই এমন হাওড়ে বুকটা আমার মোচড়াচ্ছে, হুহু করে উঠছে। এমন স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলে সেই দিনটা বিষণ্ন হয়ে যায়।
ফরহাদ অত হিসাব-নিকাশ করে মেপে কথা বলে না। সে বলতে থাকে, ‘জানেন, মাঝেমাঝে ভাবি, এখনকার জীবনটা আসল জীবন কি? নাকি এটা একটা লম্বা দুঃস্বপ্ন যেটা শেষ হচ্ছেই না… ঘুম ভাঙলে আমি আমার আগের জীবনে ফিরে যাব। দূর থেকে আগের জীবনের তিক্ত স্মৃতিগুলা ঝাপসা লাগে, শুধু ভালো ভালো মুহূর্তগুলাই জ্বলজ্বল করে। কী জ্বালা বলেন তো!’
সান্ত্বনা খুঁজতেই হয়ত সে আমার দিকে বল ছুঁড়ে দেয়, ‘আপনার কথা বলেন, নির্ঝর ভাই। আপনি নয় বছর ধরে স্টেটসে। ইউ হ্যাড হাই অ্যাম্বিশানস। একাডেমিয়ায় খুব অরিজিনাল কিছু করবেন। অন এ স্কেল অব ওয়ান টু টেন, আপনার ফুলফিলমেন্টের স্কোর কত অ্যাট দিস স্টেজ?’
স্কোরিং! হাউ নাইভ! মনে মনে বলছিলাম আমি।
ওর প্রশ্নটাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম, ‘শোনেন, দেশে থাকতে আড্ডাবাজি করতাম। সিরিয়াস একাডেমিক কাজ হয়ে উঠতই না। এত বন্ধুবান্ধব, এত ডিস্ট্রাকশনস! ব্যাক ইন বাংলাদেশ আই ফেল্ট লাইক আ সেলিব্রিটি। এখানে এসে বুঝলাম, আয়্যাম সিম্পলি নাথিং, নোবডি! এখানে নিজের কাজে ডুব দিতে পারি। দেশে একপাল ধান্দাওয়ালা শর্টকাট খোঁজা মিডিওকার লোকের সাথে ওঠাবসা ছিল আমার। বুঝছেন, There are sorrows in this world, far beyond the anguish of love. There is more to happiness than the relief of reunion.’
ঝটপট কুইজের উত্তর দেওয়ার ভঙ্গিতে ফরহাদ বলে উঠেছিল, ‘ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, না? এই ট্রান্সলেশনটা অবশ্য আমার পছন্দ না।’
তারপর বোধকরি হাস্যকর একটা প্রশ্নের ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য বলেছিল, ‘যাই বলি না কেন, এই ফ্রিডমটা অসাধারণ, তাই না? লিভিং লাইফ অন ইয়োর ওউন টার্মস। নো রেসপন্সিবিলিটি, নো পিছুটান।’
রাত যত গভীর হচ্ছিল, আমার ওকে তত আপন লাগছিল। শান্তি পাচ্ছিলাম, ভরসা পাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, আমাদের দুজনেরই কেন দেশ ছাড়তে হলো?
ফরহাদ এমনিতেই খুব অকপট। অ্যালকোহলের খেলে আগাপাশতলা খোলামেলা হয়ে গেল।
‘ডেটিং সাকস হিয়ার, না? দেশে প্রেম করা বেশ সহজ ছিল। এইখানে আমরা বেঁটেখাটো আগলি ইন্ডিয়ান। আই থট আই কুড ডু ক্যাজুয়াল। এখন দেখি পোষায় না। পেট ভরে, কিন্তু তৃপ্তি হয় না। সাবলাইমের ফিলিং আসে না।’
আমি হেসে বলেছিলাম, ‘আপনি আজকে আর ড্রিংক কইরেন না মিয়া।’
ফরহাদ এরকম নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করে। তার আশা, আমি গড়গড় করে উগড়ে দেব আমার যত হতাশা। তাতে যদি তার হতাশারা কাঁধে মাথা রাখার সঙ্গী পায়। কিন্তু আমি তো এসব কাউকে বলব না। এমনকি নিজের কাছেও স্বীকার করব না।
ফরহাদ একলাই বকতে থাকে।
‘পার্টস অব আস আর লাইক প্যারাসাইটস অ্যান্ড বিনীতা ইজ আওয়ার হোস্ট।’
শুরু থেকেই আমাদের মাঝে ছায়া ফেলছিল বিনীতা। এবার যেন একদম আছর করে বসল। সে আমাদের দুজনের কাছেই আলাদা আলাদাভাবে এই সাক্ষাতের বৃত্তান্ত জানতে চাইবে। এইখানে আর বিনীতাকে মাধ্যম মেনে কী হবে, যখন আমরাই হৃদয় খুলে আলাপ করছি?
আমি হঠাৎ বলি, ‘বিনীতাকে আমরা আমাদের এই আলাপের তেমন কিছু বলব না, ওকে? ইট উইল বি বিটুইন জাস্ট টু অব আস, ওকে?’
ফরহাদ হেসে বলেছিলেন, ‘বিনীতার কি কিছু জানতে বাকি আছে বলেন?’
‘না, তাও।’ একটা প্যাক্ট গড়ে ফেললাম মনে হচ্ছিল আমাদের। তারপর ষড়যন্ত্রীর মতো মুখ করে হেসে বললাম, ‘শি শুড ফীল লেফট আউট!’
|| তারা তিনজন ||
ব্যাম্বুশুট থেকে বেরিয়ে তারা ঢুকে পড়ে সাবেকীতে। পুরাতন বইয়ের দোকান। নীলক্ষেতের ফুটপাতে কিংবা সরু গলির ভেতরে চিপাচাপা পোকায়কাটা ধুলার পরত জমা বইয়ের দোকান না। বিশাল পরিসরের একপাশে আর্কাইভ। দুর্লভ বইয়ের প্রথম এডিশন কিংবা বিখ্যাত ব্যক্তিদের সংগ্রহশালার বই। এগুলো বিক্রি হয় না, কেবল প্রদর্শনের জন্য। আর তার পাশে পুরাতন বইয়ের সম্ভার। পুরাতন বইও বহু যত্নে বাছাই-সারাই শেষে সাজিয়ে রাখা। যেন সস্তায় কেনার জন্য না, গল্প আর অভিজ্ঞতার খোঁজে পুরাতনকে ছোঁয়া।
সাবেকীকে বীজ থেকে প্রকাণ্ড মহীরূহ হয়ে উঠতে দেখেছে তারা।
এরকম একটা দোকানের আইডিয়া ছিল বিনীতার। নামটা পর্যন্ত ওর দেওয়া। সে কথা মনে করে ফরহাদ। নির্ঝর যেন শুনতে পেয়েছে ফরহাদের ভাবনা, ওর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ‘বিনীতার আসলে প্রফিটের শেয়ার চাওয়া উচিত, না?’ তখন নির্ঝরের মনে পড়তে থাকে সেই ঘটনা। এক আড্ডায় বিনীতা এই আইডিয়া শেয়ার করেছিল। সেখানে সাবেকীর প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন, তখন তিনি ছোটখাট প্রকাশক। বিনীতা অত সহজে নিজের দেওয়া নামটাও কেন ব্যবহার করতে দিল, সে আজও কূলকিনারা পায় না। ফরহাদ স্বগতোক্তির মতো বলে ওঠে, ‘আইডিয়াটাকে বিনীতার অত অরিজিনাল মনে হয়নি, যার জন্য ক্রেডিট ক্লেইম করা যায়। বরং ও একরকম কৃতজ্ঞ যে এমন একটা বইয়ের দোকান তার নাম নিয়ে বেঁচে আছে। আর প্রকাশক ভদ্রলোক আড্ডায়-মজলিশে বিনীতার নাম তো নেন, যদি কেউ নামের প্রসঙ্গ ওঠায়।’
আজ কিছু একটা ঘটছে। সচরাচর যা ঘটে না। তাদের যোগাযোগ ঘটছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার বাইরে। একজন যা ভাবছে অন্যজনের মধ্যে তা সংক্রমিত হচ্ছে। ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যই বোধহয় নির্ঝর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কথা ভাবতে থাকে। ওই গল্পসমগ্রটা কি বিনীতা সযত্নে রেখে দিয়েছে এখনো?
ফরহাদের চোখ চলে যায় ভারতীয় বইয়ের অংশটাতে। রাজশেখর বসুর মহাভারত, ভৈকম মুহম্মদ বশীরের শ্রেষ্ঠ গল্প উল্টেপাল্টে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পসমগ্রটা সে হাতে নেয়। আকস্মিকভাবে খুলে যায় ‘অংশু সম্পর্কে ২টা-১টা কথা যা আমি জানি’ গল্পটা। যে গল্পটা নির্ঝর পড়তে বলেছিল বিনীতাকে, আজ থেকে বহু বহু বছর আগে। যেন জড়তা খসে গিয়ে শরীর এগিয়ে নেয় নিজস্ব আলাপ। ফরহাদ সেই অংশটায় এখন চোখ বোলায়।
অংশুর যা মনে নেই যে তার মনে নেই যে তার মনে নেই, তা হল, তারপর খাটের নিচে থেকে অতি সন্তর্পণ সে টেনে এনেছিল কৌমার্যহারা তার রাঙাবউদির বিবাহের ট্রাঙ্ক, আঙটা খুলতেই চাপে লাফিয়ে ওঠে ডালাটি এবং ঠাসা জামা-কাপড়ের ওপর বিছানো বিবাহের জোড়ের ওপর কয়েকটি চকচকে বই তার চোখে পড়ে। যার মধ্যে, কিছু না-বুঝে, ক্লাস-নাইনের ফার্স্টবয় অংশু অতি অবোধভাবে তুলে নেয় মারি স্টোপস-এর ‘বিবাহ ও জীবন’ নামে অনূদিত বইটি এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাঙাদা এসে কান মুলে বইটা তার হাত থেকে কেড়ে নেয় এবং পুনরায় ট্রাঙ্কের ভেতর রেখে এবার চাবি দিয়ে দেয়। কিন্তু ইতিমধ্যেই বইটা আন্দাজে খুলে বিনা আয়াসে অংশু পেয়ে গিয়েছিল প্রয়োজনীয় পাতাটি, সত্যত, বইটির শেষাশেষি বাঁদিকের পাতার মাঝ বরাবর অবশ্যম্ভাবী কটি পঙক্তিই কেবল টেনে নিয়েছিল তার চোখের তারা যা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে অবিলম্বে পড়ে ফ্যালে সঙ্গমের পর পুরুষের উচিত, সে পড়েছিল, তার পুরুষাঙ্গ নারী-শরীরের মধ্যে রেখে এবং নারীর উচিত পুরুষাঙ্গ তার শরীরের অভ্যন্তরে নিয়ে ও রেখে, আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় ঘুমিয়ে-পড়া। এতে করে, শ্রীমতী স্টোপস দেখেছেন, ‘গভীরতর রাতে তাদের একসঙ্গে নিঃশ্বাস নিতে ও প্রশ্বাস ফেলতে দেখা যায়।’ এটুকু পড়েই ঝপ করে অংশু বইটি বন্ধ করে ফেলে। এর মানে কী?
এর মানে বুঝতে বিনীতার এক দণ্ড দেরি হয়নি।
নির্ঝর আর বিনীতার দিকে এক ঝলক তাকায় ফরহাদ। বহু বছর আগের ওই ইঙ্গিত, এখনকার হিসাবে যা নিতান্ত শিশুতোষ, সেই সময়ের স্মরণে কি শিরশিরানি আনে?
নির্ঝর-ফরহাদ দুজনই খুঁজতে থাকে সাউথ কোরিয়ান ঔপন্যাসিক হ্যান ক্যাং এর দি ভেজিটেরিয়ান । ফরহাদ একা একাই এ তাক ও তাক ঘোরে আর নির্ঝর কাউন্টারে গিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে উপন্যাসটা আছে কি না। সেলসম্যান ডেস্কটপের ডেটাবেস ঘেঁটে জানিয়ে দেয়—নেই। নির্ঝর তখন ফোনে বইটার পিডিএফ ডাউনলোড করে খুঁজতে থাকে সেই অংশটা। খোঁজাখুঁজির মধ্যেই ফরহাদকে গ্রাস করে তার আর বিনীতার এক বালিশে ভর দিয়ে ভেজিটেরিয়ানের লাভ মেকিং সীন পড়ার স্মৃতি। ফরহাদ এরই মধ্যে, মনের ভেতর নিশ্চিত জেনে ফেলে নির্ঝরও একই ঘটনার কথা ভাবছে। খানিকটা সংকোচের বুদবুদ উঠে মিলিয়ে যায় বাসনার উত্তাপে।
নির্ঝর যেন দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায়, ফরহাদ-বিনীতা বিছানায় আধশোয়া হয়ে পড়ছে শরীরময় ফুল এঁকে ফুল ফোটানোর অংশটা। উদ্ভিদের আত্মা, মানুষীর শরীর। নারীটির নগ্ন শরীরে রঙতুলির স্পর্শে প্রগাঢ় ফুল আঁকছে পুরুষটি। তার দেহ থেকে স্ফূরিত চাঞ্চল্য, প্রাণশক্তি ভর করে তুলিতে। লাল-কমলা আধফোটা কুঁড়ি, হলুদ কেশরঅলা পাপড়িমেলা কমলা ফুল, সবুজ পাতা আর ডাঁটি। সূর্যরশ্মির মতো উজ্জ্বল ফুল, শ্বেতশুভ্র নিশিফুল। এই নারী-ফুলকে আকর্ষণ করে কেবল পুরুষ-ফুল। পুরুষটির নগ্ন শরীরও তাই ফুলে ছেয়ে যায়। ততক্ষণে বিনীতা-ফরহাদের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে। ভেজিটেরিয়ানের ফুলগাছরূপী দুই নর-নারী তাদের ওপর আছর করেছে। দুই ফুলের বন্য ভালোবাসাবাসির বর্ণনা পড়তে পড়তে বিনীতা ফরহাদের হাত থেকে বইটা সরিয়ে রেখে দিয়েছিল বেড-সাইড টেবিলে। নির্ঝরকে ডিটেইলে বলেনি বিনীতা। শুধু বলেছিল বইয়ের ওই অংশটা পড়তে পড়তে দুজনের ওই দুই চরিত্রে রোল-প্লে করার গল্প। নির্ঝর বইটা জোগাড় করে পড়তে বসে এরোটিক ফিল্মের ডিরেক্টরের মতো তাদের সেসব দৃশ্যে দীর্ঘক্ষণ অভিনয় করিয়েছে।
বিনীতা তখন আর্কাইভের বইগুলো দেখা শেষে পুরানো বইয়ের তাকে ঘুরছে। কোন আমিদ কোন লাবণীকে শেষের কবিতা উপহার দিয়ে অমিত-লাবণ্যের সাথে কেবল নিজেদের নামের মিলই না, জীবনের নানান সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে লম্বা চিঠি আর টুকরো টুকরো মন্তব্যে ভরিয়ে ফেলেছে সাদা পাতা আর মার্জিন। নির্ঝর-ফরহাদকে দেখতে পেয়ে বিনীতা বলে, ‘আজকে যে পুরান বইগুলো ঘাঁটলাম, তার বেশিরভাগেই অমুককে শুভেচ্ছাসহ তমুকের মাঝে যে চিঠিগুলা লেখা, সেগুলা পড়ে মনে হচ্ছে এসব ফরমায়েশী। প্রফেশনাল কাউকে দিয়ে লেখানো।’
ফরহাদ চোখ কপালে তোলে, ‘তাই নাকি!’
নির্ঝর হেসে বলে, ‘হ্যাঁ, হতেই পারে। বই উপহার দিতে গিয়ে অত রোম্যান্টিক, সাহিত্যিক টাইপ লেখা কে আর আজকাল লিখতে যায়! কিন্তু সাবেকীকে তো তাদের স্পেশালিটি ধরে রাখতে হবে!’
বিনীতা গরবিনীর হাসি হেসে বলে, ‘ওদের যখন এমন আকাল… তোমরা আমাকে যে বইগুলা গিফট করছ, সেগুলা ওদের দিয়ে দেই? ইন্ট্রেস্টিং সব গল্প আছে একেকটা বইয়ের চিরকুটে। ডেট ধরে সিরিয়ালি পড়ে গেলে ধারাবাহিক উপন্যাসের ফীল পাবে।’
নির্ঝর ঠাট্টাচ্ছলে বলে, ‘আর্কাইভ সেকশনে যদি রাখে, তাহলে ভেবে দেখতে পারো। লোকে দেখল, পড়ল, আমরা বিখ্যাত হয়ে গেলাম। পুরাতন বইয়ের সেকশনে দিও না। কে না কে কিনে নিয়ে যায় আমাদের সাধের বইগুলা!’
বিনীতা, মজা করে হলেও, এমন কথা উচ্চারণ করতে পারে! আহত চাউনি ফোটে ফরহাদের চেহারায়। তা লুকানোর চেষ্টা না করে সিরিয়াস গলায় বলে, ‘আর পুরাতন সেকশনে যদি দিয়েই দাও, আমাকে জানাইও। আমি একাই সব কয়টা কিনে ফেলব। পামুকের মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স-এর মতো একটা ব্যক্তিগত মিউজিয়াম খুললাম না হয়।’
বিনীতা ‘তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না’ টাইপ দৃষ্টি দিয়ে ফরহাদের পিঠে একটা চাপড় দেয়।
‘অত হোপলেস রোম্যান্টিকের ভেক ধইরো না মিয়া। ইউ আর ওয়ে পাস্ট দ্যাট ফেইজ।’
|| বিনীতা ||
এক অদ্ভুত ভবিতব্য আমার। ফরহাদের সাথে বিয়েটা টিকল না। এই বিচ্ছেদের কারণ ব্যাখ্যায়ও আমি যাব না। তবে আগেরবারের মতোই বন্ধুর মতো, আমাদের চিরস্থায়ী ভালোবাসাকে স্মরণ করে আমরা আমাদের আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের ইতি টেনেছিলাম। সম্পর্কের ধরন বদল তো রাতারাতি ঘটে না। তাই আমি আর ফরহাদ যোগাযোগ বন্ধ করলাম। যেদিন বুঝব, সম্পর্কের এই নতুন ধরনকে অনেকটাই মেনে নিতে পেরেছি, সেইদিন আমরা আবার যোগাযোগ করব।
আবার সেই পুরানো সর্বগ্রাসী ব্যথা ফিরে এলো। জীবন শেষ করে দিয়ে যন্ত্রণা থেকে মুক্তির শর্টকাট উপায় মাথায় কুটকুট করল আগের মতোই। আগেরবারের অভিজ্ঞতা আমাকে ভরসা দিল, যত তীব্রই হোক, যত দীর্ঘই হোক, এ একদিন শেষ হবে। এইবার আমার সান্ত্বনার সাথী হলো নির্ঝর। নির্ঝরের জন্য শোক আর ফরহাদের জন্য শোকে কিছু পার্থক্য ছিল। নির্ঝরের মতো অত তীব্রভাবে ভালোবাসিনি ফরহাদকে, কিন্তু ফরহাদের সাথে আমি লাইফ শেয়ার করেছি। আমার সবচেয়ে সুন্দরতম চেহারা যদি নির্ঝর দেখে থাকে, ফরহাদ কুৎসিততমটা দেখেছে। নির্ঝরের প্রেমের মতো আগুনের ফুলকি ছিটকানো অত তীব্র ছিল না এই সম্পর্ক, কিন্তু গভীর অতলস্পর্শী প্রাণভোমরার মতো ছিল।
নির্ঝর সংসারী হয়নি। বেশ কয়েকবার প্রেম এসেছে আমার পরে, তার আদ্যোপান্ত আমার জানা। কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি। সংসার পাতার প্রস্তাব এলো ওর তরফ থেকে। না বলতে আমি কোনো সময় নিলাম না। আমি অ্যাদ্দিনে বুঝে গেছি, আমার নির্ঝরকাল আগেই শেষ। ফরহাদকালে হালকা সে বয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু তাকে আবার ফিরিয়ে আনব না। সেই স্ফুলিঙ্গ সেভাবেই থাকুক আমার স্মৃতিতে। থাকুক সে পরমবন্ধুর মতো, চির আপনজন। নির্ঝর কিন্তু আমাকে উচিত শিক্ষা দিতে এই নাজুক সময়ে নিজেকে সরিয়ে নিল না। সব জেনেবুঝেও আমাকে ঠেস দিয়ে থাকতে দিল তার ওপর। নিজেকে দিয়ে ফরহাদকে বোঝে সে। গভীর মায়ায় দেখতে পায়। আমাকে বলল, ‘এইগুলা পোস্টমডার্ন ট্রাজেডি। দেখো আমি কত ভালোবাসি তোমাকে, ফরহাদ কত ভালোবাসে তোমাকে। তুমি আমাদের প্রত্যেককেই কত ভালোবাস। কিন্তু আমরা তবু বেশিদিন জোড়া বাঁইধা থাকতে পারি না।’
নির্ঝর আবার ফিরে এসেছিল বলে, আমার মনে বিশ্বাস জন্মেছিল, ফরহাদও ফিরে আসবে। এ এক চক্রের মতো যেন। আমার বলয় থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেলেও ফিরে আসবে নিশ্চিত। ওরা দুজন যেন দুই কাঁধের দুই ফেরেশতা। আমার আলো-অন্ধকারের বয়ান লিখে চলছে।
আমি পুরোটা শুধু আমি তো না। আমি নির্ঝর, ফরহাদ আর আমার যোগফল।
|| ফরহাদ ||
আমাদের ব্যাকরণহীন সম্পর্ক, আমরা নস্টালজিয়া ধরে হেঁটে বেড়াই। আজকের দিনে একটামাত্র ছবি তুলেছি আমরা, ব্যাম্বুশুট ক্যাফেতে। ফেসবুকে প্রাইভেসি অনলি মি করে রেখে দিয়েছি—‘তিন পাগলে হলো মেলা ঢাকায় এসে’। বছর বছর মেমরিতে আসবে, দেখব।
সে অর্থে আমার এখন বন্ধু নেই বললেই চলে। নামে কতই না বন্ধু, কিন্তু আমার কাছে বন্ধুত্বের যে সংজ্ঞা, তার যে ব্যাপ্তি ও গভীরতা, সে পরীক্ষায় উৎরায় না কেউ। স্কুলের বন্ধু, ভার্সিটির বন্ধুরা স্যুভেনিরের মতো। হারানো সময়ের স্মারক। বিনীতা নির্ঝরের যে অবয়ব দাঁড় করিয়েছিল আমার সামনে, তাতে মনে হতো আমরা খুব ভালো বন্ধু হতে পারতাম। কিছু অভিন্ন রুচি-পছন্দ-বৈশিষ্ট্য আছে তো আমাদের, বিনীতার থেকে আমরা যা যা পেয়েছিলাম।
বহু আগে থেকেই আমরা একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়ে হাজার মাইল দূরে থেকেও। আমার প্রথম রিসার্চ পেপারের ফার্স্ট ড্রাফট নির্ঝর দেখে দিয়েছে। রিসার্চের কাজে নির্ঝরের পুরনো দুর্লভ কিছু বইয়ের দরকার, আমি নানান জায়গার আর্কাইভ ঘেঁটে স্ক্যান করে পাঠিয়েছি। নির্ঝরের ছোট বোনের অ্যাক্সিডেন্টের পর এবি নেগেটিভ ব্লাডের দরকার যখন, ডোনার যোগাড় করে দিয়েছিলাম। নির্ঝরের লিস্ট অনুযায়ী একুশে বইমেলার বই পাঠিয়েছি ফ্লোরিডায়, সে আমাকে পাঠিয়েছে আমার প্রিয় হুইস্কি গ্লেনলিভেটের বোতল, ১৫ বছরের পুরনো। যদিও এই সমস্ত যোগাযোগ সরাসরি ঘটত না। বিনীতার খাতিরে, বিনীতার মাধ্যমে আমরা হাত বাড়াতাম, মেলাতাম।
ভালোবাসায় পরিপূর্ণতার অনুভূতি আমার পোষাল না। পরিপূর্ণতাকে জিইয়ে রাখার বদলে আমার একদিন মনে হলো, প্রেম তো পেয়েছিই। দুনিয়া দেখার যে স্বপ্ন ছিল আমার, এবার গৃহীর জীবন ছেড়ে সেই পথে নেমে পড়ি। গৌতম বুদ্ধ যেমন স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে গৃহত্যাগী হয়েছিল, আমি অতদূর যাইনি। সন্তান অব্দি যাওয়ার সাহস পাইনি। আমি তো জানতাম, বিনীতা ঠিক সামলে নেবে। ও নিজেই নিজেকে সামলায়, নির্ঝর বা আমি উপলক্ষ মাত্র।
এ এক সাইকেলের মতো। আমি যেন নির্ঝর ভাইয়ের পদছাপ ধরে ধরে হাঁটছি। মাঝেমাঝে নির্ঝরকে আমার বড় ভাইও মনে হয়। বিনীতা আমাদের দ্রৌপদী। ভাইয়ে-ভাইয়ে যেমন মিলেমিশে ভালোবেসেছিল পাঞ্চালীকে।
বিদেশযাত্রা, বিচ্ছেদ, হাহাকার, ফিরতে চাওয়া, ফিরতে না পারা, অতীতের হাতছানি—এসবের জন্য আমরা চিরকাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে যাব… তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার / তাই জনম গেল, শান্তি পেলি না রে মন, মন রে আমার…আশীর্বাদ না অভিশাপ জানি না।
কীভাবে পারলাম? হায়, মানুষ কি নিজেকেও পরিত্যাগ করে না?
|| তারা তিনজন ||
উচ্চারণ নিষ্প্রয়োজন; মুখের চাউনি, চোখের চাঞ্চল্য, ঘাড়ের এলানোয় সব স্পষ্ট। তাছাড়া সেই বিকালের শুরু থেকেই তো তাদের ভাবনা ঐকতানে মিলেছে। কিছুই কারও অগোচর না।
ফরহাদ প্রথম মুখ খোলে, ‘গুলশান-বনানীর দিকে যাব নাকি? কোনো একটা বারে বসলাম বা লেটনাইট ক্যাফেতে?’
নির্ঝর নাকচ করে দেয়, ‘বারে কেন? গলাকাটা দাম রাখবে। আমাদের দুইজনের বাসাতেই তো মিনি বার এখন।’
ফরহাদ কাঁঠালবাগানে ভাইয়ের বাসায় উঠেছে। তাই ওখানে যাওয়ার সুযোগ নেই। নির্ঝর এয়ার বিএনবিতে নিকেতনে। সেই বাসার গুণকীর্তন শুরু করে দেয়। খুব ছিমছাম ওয়ান বেডরুম চিলেকোঠা। বাথটাবওয়ালা ওয়াশরুম। মাল্টিফাংশনাল কিচেন। সামনে বিশাল ছাদ। তাতে বাগানবিলাস, হাসনাহেনা, প্যাশনফ্রুট, কমলা, তুলসী সহ নানান জাতের গাছ। পূর্ণিমা তিথি গেছে দুদিন আগে। সামান্য ক্ষয়াটে কিন্তু বিশাল চাঁদ এখনো জাজ্বল্যমান। দারোয়ান খুব প্রফেশনাল। নির্ঝর যখন বর্ণনা দিচ্ছিল, ফরহাদ তখন দেখে ফেলেছে তাদের তিনজনকে। হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে সোফায় গা এলিয়ে। যেটুকু আগল ছিল, সরে যাচ্ছে। হেসে হেলে পড়ছে একজন আরেকজনের ওপর। তাদের ঘিরে ম্যাগনেটিক ফিল্ডের বলয় বিস্তৃত হচ্ছে। সোফায়, বিছানায়, শাওয়ারে, বাথটাবে তিনটি শরীর জোড়া লাগছে, ভেসে যাচ্ছে, একাকার হচ্ছে, এক বিন্দুতে মিলছে। মধ্যরাতে তিনজন বিরান ছাদে, যেন তিন আদিম নর-নারী, কোথাও কোনো জনমনিষ্যি নাই। নির্ঝর ফরহাদের চোখের তারায় তাকিয়ে নিশ্চিত হয়। এ জেনে ফেলাতে কারও তরফে কোনো সংকোচ নেই। যেন তাদের তিনজনের পৃথিবীর যেটুকু নিগূঢ়, তা প্রকাশিত হবে এই রাতে। এই আচার পালনের মধ্য দিয়ে এই ত্রিভুজ পূর্ণতা পাবে। নির্ঝর ননস্টপ বিজ্ঞাপন চালিয়ে যায়, ‘ফ্রেন্ডরা অনেকগুলা বোতল শেষ করছে। এখন আছে ব্লু লেবেল। মীড আছে—হানি ওয়াইন। ভালো রেড ওয়াইনও আছে। আমি একটা ককটেলের রেসিপি বানাইছি। নাম দেওয়া হয় নাই। বানায় খাওয়াবো তোমাদের এক শর্তে। সুন্দর একটা নাম দিতে হবে।’
দুজনের শ্বাসের আঁচ বিনীতার গায়ে শিহরণ তোলে। তার স্পর্শপ্রবণ শরীরে ঢেউ ওঠে, ফুলেফেঁপে ওঠে। পাগলাঘূর্ণি পাক খেতে খেতে খেতে খেতে আচমকা থেমে যায়। দুই প্রাক্তন প্রেরিত অদৃশ্য ইশারারা ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায়। তাদের খানিকটা তো তার মধ্যেও বাস করে, সেই কবেকার ফরহাদ-নির্ঝরেরাই যেন সকল আহ্বানকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। যারা চলে যায়, তারা দর্শক সারিতে বসে যায়। দেখতে পায়। কিন্তু মূল কুশীলবের ভূমিকা পায় না। তাকে টাইম মেশিনে চড়িয়ে পেছনে নিয়ে যাওয়া হলেও কিছুই এদিকসেদিক করবে না সে। বিনীতা এই নিরিবিলি রাস্তায় দুজনের হাতে আলতো চাপ দেয়। তারপর কোমল ও দৃঢ় গলায় বলে, ‘রাত হয়ে গেছে। আমাকে এখন যেতে হবে।’
ফরহাদ-নির্ঝর কিচ্ছু বলতে পারে না। যেন বিনীতা তাদের স্বর কেড়ে নিয়েছে। একটা খালি রিকশা এদিকে আসে। বিনীতা হাতের ইশারায় থামতে বলে উঠে পড়ে।
‘পরে কথা হবে, হ্যাঁ? বাই।’
বিনীতা এরকম হুট করে চলে যাওয়ায় তারা দুজনই হতভম্ব হয়ে থাকে।…শেষ? ধাতস্থ হতে পারে না। কোথায় গেল বিনীতা? কয়েকমাস আগে তারা শুনেছিল একজনের কথা। তার কাছে? আশ্চর্যজনকভাবে, এই লোকটাও খুব শিগগিরই আরেক মহাদেশে উড়াল দেবে। বিনীতা নিজে দেশ ছাড়তে চায় না; কিন্তু সে যাদের জড়িয়ে ধরে, তারা প্রত্যেকেই পরবাসে ঠাঁই গাড়ে। এটুকু বাদে, লোকটা তাদের অচেনাই। কোনোদিন চেনা হবে বা তাদের লীগে ঢুকে পড়বে বলে মনে হয় না। বিনীতা আর হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল না। কিংবা নতুন এক সাইকেল শুরু হয়েছে নতুন চরিত্রদের নিয়ে। যেখানে তাদের আর ঠাঁই দেবে না সে।
দুজনই ঈর্ষার আঁচ টের পায়। নির্ঝরের মনে পড়ে, একদিন ঝগড়া মিটমাট করতে বিনীতার হলের সামনে রোদের মধ্যে পাক্কা তিন ঘন্টা সে বসে ছিল। তা-ও তার মন গলেনি। বেরিয়ে এসে একবার দেখা দেয়নি। একবার রাগ করে কাউকে কিছু না বলে তিনদিনের জন্য উধাও হয়েছিল এই মেয়ে। কোনো হদিস না পেয়ে নির্ঝরের তখন পাগল পাগল দশা। তিনটা নারকীয় দিন-নির্ঘুম রাত কেটেছিল।
ফরহাদের মনে পড়ে, কঠিন জেদী এই মেয়েটা একবার সারামাস একটাবারের জন্য ছুঁতে দেয়নি তাকে। কি নিস্পৃহ, হৃদয়হীন বিচারকের মতো সাইলেন্ট ট্রিটমেন্ট জারি করত সে।
দুজনের সন্দেহ হতে থাকে, এই প্রেমিক—যাকে তারা ভুঁইফোড় ভাবছে, বরাবরই ছিল না তো বিনীতার জীবনে? যার কথা কোনোদিন তারা কেউ-ই জানতে পারেনি। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে তাকে সুরক্ষিত রেখেছে। অবিশ্বস্ততার সন্দেহে তাদের গা চিড়বিড় করতে থাকে। বিনীতার জীবনের কোনো একটা অংশ তাদের অগোচরে ঘটেছে বা ঘটবে, তারা বিন্দুবিসর্গও জানে না বা জানবে না, বাইরের মানুষের এই স্ট্যাটাস তারা বইতে পারবে? অমীমাংসিত লোকটা আর অমীমাংসিত বিনীতার থই তারা আর পাবে না! দুজনের উদভ্রান্ত লাগতে থাকে।
|| তারা দুজন ||
স্ট্রিট লাইটের কোমল হলদেটে আলোর পুরনো আবহে মায়ামায়া স্মৃতিময়তা মিহি বৃষ্টিকণার মতো ঝরছে।
নির্ঝর-ফরহাদ হাঁটতে থাকে। তাদের দুজনার পথ জড়িয়ে-মড়িয়ে ছড়িয়ে গেছে। দুজনকে দুপাশে নিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে বিনীতা আজ সরে পড়েছে। এখন তাদের দুজনার কি আর কোনো সম্বন্ধ থাকতে পারে? সামনে অবারিত—‘আমার আছে কর্ম, আমার আছে বিশ্বলোক’।
খানিকটা মোহভঙ্গতা, খানিকটা হতাশা… যে খেদ-আক্ষেপ থেকে মানুষের মুক্তি নাই সাক্ষাৎ স্বর্গেও। খানিকটা আত্মতৃপ্তি, মুক্তির স্বাদ, এই জীবনই তো চেয়েছিলাম ভেবে ইচ্ছাপূরণের শুকরিয়া। কিন্তু এসবের মাঝে ফেলে আসা জীবন, সেই জীবনের অধীশ্বরী ছিল যে, তার জন্য আফসোস তো থাকবেই, আর এ বেদনার ভাগ তারা নিজেরা ছাড়া কেউ নিতে পারবে না। দুনিয়ায় আর কেউ এই দর্দ বুঝবে না অতখানি দরদ সমেত। সেক্ষেত্রে, একদিন তারা প্রতিযোগী হলেও, আজ অভিন্নহৃদয়। একদিন ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে কিংবা বাথরুমে শাওয়ার ছেড়ে যে গলিত চিৎকার, যে আর্তনাদ তাদের জখমী হৃদয় চিরে বেরিয়েছে, তার সাথে আর কেউ একাত্ম হতে পারবে না।
‘ফরহাদ, আমি তো লন্ডনে আপনার বাসায় ছিলাম এক রাত। আপনি চলেন আজ নিকেতনে আমার ওখানে।’
আপনার লেখা পড়লে সব চরিত্র গুলি দেখি ,আলাদা আলাদা হারিয়ে যাওয়া যায় সব চরিত্র গুলিতে
Al amin
অক্টোবর ০১, ২০২৪ ২২:২০