লাল দ্রাঘিমা || তৃতীয় পর্ব

অ+ অ-

 

লাল দ্রাঘিমা || তৃতীয় পর্ব

পড়ুন ► প্রথম পর্ব  দ্বিতীয় পর্ব

 

গিটার শিক্ষকের কাছে ত্বকী প্রথম একজন ডাচ চিত্রশিল্পীর গল্প শুনেছিল, গল্পটা এমনবেঁচে থাকা অবস্থায় কেউ সেই চিত্রশিল্পীর ছবি বেশি দামে কিনতে চায় না, চিত্রশিল্পী তখন তার স্ত্রীকে বুদ্ধি দিলেন, উনি মারা গেছেনএমন গুজব ছড়িয়ে দিতে। ভদ্রমহিলা তাই করলেন, ওনার ছবির দামও বাড়ল কিন্তু পরে মানুষজন কোনোভাবে বুঝে গেল, চিত্রশিল্পী বেঁচে আছেন। চিত্রশিল্পী তখন আবার বার্তা ছড়িয়ে দিলেন তিনি এসবের কিছুই জানেন না, সব তার স্ত্রীর কাণ্ড। মানুষজন তখন রাগ করে ডাইন স্ত্রীকে পিটিয়ে মেরে ফেলল, কিন্তু চিত্রশিল্পীর ছবির দামের কোনো গড়পতন হয়নি। কথা হচ্ছে, ওনার সেসব ছবি তাহলে মুদ্রাস্ফীতির কবজায় পুরস্কৃত। সোজা ভাষা, মুদ্রাস্ফীতি কমুক বা বাড়ুক, সামান্য একটা চকলেট বার, কিংবা ওয়াশিং মেশিন, ভেন্টিলেটর, ফ্ল্যাট-বাড়িমানে এসব যত জিনিসের দাম বাড়বে, ওনার ছবির দামও বাড়বে।

ত্বকী জিজ্ঞাসা করেছিল, চিত্রশিল্পীটা কে? 

জানি না

নাপিতের কাছ থেকে গল্প শোনার বেলায় তার ভিতরকার জরাজীর্ণ স্মৃতিকুণ্ডলীতে এই উপাখ্যান নিভু নিভু, কিন্তু জারিত। নাপিত গল্প করে যাচ্ছে, বুঝলেন, সে সকাল নয়টার মধ্যে মোরগফাঁস এরিয়ায় চলে আসতো, আশপাশের সব হোটেলের থেকে হিসাব-নিকাশ নিয়ে সোজা এই সেলুনে চলে আসতো। তার আয়েশটা শোনেন, সে এইখানে আসার আগে আগের দিন বাসায় নাপিত ডেকে চুল কাটায় নিতো, পরে সেলুনে এসে সে চুল কালার করাইতো।

সেলুনের ভিতরটা এসির ফুঁতে প্রায়শ শীতল, তবে এক ভদ্রলোক বলে উঠল, গুলি লাগসে জানি কই?

আরেকজন বলল, কাঁধে আর কোমরে। সে বলে গাড়ির সামনের সিটে বসতো না যাতে মাথায় গুলি না লাগে।

এইবার নাপিত ত্বকীর চুল কাঁটা বাদ দিয়ে বলল, বেচারার তো সেই তাকদির হইল না, মাথায় গুলি খেয়ে তো প্রেসিডেন্টরা মরে, সে কী জানি কোন দিকের কোন আহ্বায়ক। ব্যানারে নামের চেয়ে টাইটেলের দৈর্ঘ্য কয়েক গজ, এই জন্যেই এ রকম ফাউ মৃত্যু।

বলে নাপিত ত্বকীকে বলল, দাড়ি সাইজ করবেন?

ত্বকী মাথা নাড়ল, নাপিত ওর কান, ঘাড়, কপাল সেভাবে স্পর্শ করছে, ওতে ত্বকীর স্বাভাবিক খরস্রোতায় মনে হলো, এই নাপিত তো আসলে খুন হওয়া আহ্বায়ককে ঘিন্না করে না। যৌক্তিক কারণেও কি ঘিন্না করা সম্ভব? আচ্ছা, ধরে নেওয়া যায় সে এরিয়ায় একগাদা অবৈধ রেস্টুরেন্ট খুলে এলাকায় পানির ঘাটতি কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দিয়েছেন, লোডশেডিং তো আছেই, আবার তার দলবদলের মানুষজনের ঠ্যালায় বাসিন্দারা মধ্যরাতের পরে যে কড়া গন্ধ পেত, তারা আসলে সেটা গুয়ের গন্ধ ভেবে ভুল করত। তবে যদি পর্যবেক্ষণটা রুক্ষ হয়, তাহলে তো বলতে হয় আহ্বায়ক ভদ্রলোক অর্থনীতির কাঙাল, সে তো প্রচুর জব সেক্টর সৃষ্টি করে এলাকার কাঠামো চাঙা করে দিয়েছিলেন। কারও কারও মতে উনি আবার এলাকার ঐতিহ্য নষ্ট করেছেন, যেমন এলাকায় যে এক সাইটে উনি রেস্টুরেন্ট করলেন, সেই জায়গাটা বলে ঢাকায় প্রথম দাস বিক্রি শুরু হয়েছিল, মজার ব্যাপার রেস্টুরেন্ট বানানো আর সেটার ব্যবসার সময়কালে কোনো প্রতিবাদ কেউ করেনি, উনি খুন হবার পরে ফট করে এটার নিউজ বের হলো, এখন দাবি হচ্ছে ওটা ভেঙে ওখানে একটা মনুমেন্ট করা হোক, কিছু গোষ্ঠী আবার এলাকার মেইন রাস্তা বন্ধ করে ওখানে বিরাট সভা করে প্রতিশ্রুতি দিলেন, মনুমেন্ট হলে এর পাশে ভালো করে পাবলিক টয়লেট করে দেওয়া হবে, যাতে ট্যুরিস্টদের সমস্যা না হয়। ত্বকীর কাছে ব্যাপারটা আত্মহত্যা সাহসিকতার কাজ মূলক যুক্তি মনে হয়েছিল। হ্যাঁ, আত্মহত্যায় সাহস আর বীরত্ব আছে, সমস্যা হলো দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত বুদ্ধিমান আত্মহত্যাকারী এখনো জন্মায়নি। ত্বকী ভেবেছিল, এসব তুলোধুনো সন্নিকটে। হঠাৎ ভাবল নাপিত না, আসলে ওর বাবা কথা বলছে, ফোনে চিৎকার করে বলছেন, জি না, ইসরায়েলের কোনো ধরনের কোনো ফার্মের সাথে আমাদের এবং আমার কোনো সম্পর্ক নেই, এটা আমি কতবার বলব আপনাদের? আমার নামে কী? কিসের অ্যাকাউন্ট, সব আপনাদের বানানো। তো? কাগজপত্র থাকলে আপনারা সেগুলো ফাঁস করেন, পুলিশদের বলুন, আমাকে বারবার ফোন দিচ্ছেন কেন? কার জীবনের মায়া? যে আবার মিথ্যাচার ছড়াচ্ছে তার আবার জীবন কী?... তো মারুক তাকে…’

এরপরে উনি এক চুমুকে পানি শেষ করে বলেন, আপনাদের পত্রিকার মালিককে আমি চিনি। চিনি মানে চিনি আমি তো চিনি তাকে, আমার বসেও তাকে চিনে, সেও আমার বসকে চিনে, আবার সে নিজে আমাকে চিনে। না, এই জন্যই তো বললাম, আমরা চিনি একে অপরকে, তো তাকে নিয়ে লিখেন। আচ্ছা, একটা আর্টিকেল লিখেন ওনাকে নিয়ে খরচ আমি দিয়ে দিব নে আপনাকে, হবে না? কী, মিথ্যা বলছি? সে দেশের কৃষি সেক্টরে কী করেছে সবাই জানে না? আমাকে ছেড়ে আপনারা আগে চাষাদের কাছে যান…’

এরপরে উনি লাঞ্চ করতে বসলেন, তবে তখনো ত্বকীর মনে হচ্ছিল, ওর বাবা ভাতও চুমুক দিয়ে খাচ্ছেন। 

হিটলার কার নাম সব সময় বেশি নিত জানো?

তারা গাড়ির ভেতরে আর গাড়ি শহর ছেড়ে শহরের হবু অংশে চলছে। শহর ছাড়তে বেশি কিছু ত্যাগ করতে হয় না, তবে পাবলিক বাসগুলো ছাড়তে দিবে না, ভানটা এমন করে, তবে ছাড়তে দিবে হয় যাত্রার পথে, নইলে মানুষের বিশ্বাসের পথে। চুল কাটিয়ে আসার পর দ্রুত গোসল করেই ত্বকী মি. মোতালেব আলমের সাথে বের হয়ে গেল। মি. আলমের বিভিন্ন কথাবার্তা ত্বকীর মধ্যে অনেকটা আনাড়ি হয়ে থাকল বহুক্ষণ; কারণ, তার চিন্তা ছিল অবচেতন দ্বারা গ্রেপ্তারকৃত। ওর মস্তিষ্কের প্রতি প্রবাহ এবং ঢেউয়ে তখন চমকাচ্ছিল

I've got a bike, you can ride it if you like
It's got a basket, a bell that rings
And things to make it look good
I'd give it to you if I could, but I borrowed it… 
(Pink Floyd)

কিন্তু তৎক্ষণাৎ কোনো বিলম্ব মর্যাদাহীন দুঃখ মনটাকে গ্রাস করে, সেটা হয়তো শহরটার রাস্তাঘাট দেখে। ত্বকী মোবাইল ওপেন করে দেখে, ফারিহার ম্যাসেজ, আজ আর কথা বলব না, আমি জানাব নে, আমার ভালো লাগছে না কিছু…’

গাড়ি আস্তে আস্তে রাজধানী ফিকা শহরের ভেতর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, রাজধানী প্রসারিত করতে কিছু জেলা আবার রাজধানীর আওতায় এনে ফেলা হবে, কয় দিন সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে ছিল বিরল উচ্ছ্বাস, কিন্তু এখন তারা বুঝে গেছে আসলে কী হচ্ছে। মি. আলম ইতিমধ্যে ওকে ওয়ার্নিং দিয়ে রেখেছেন যে প্রচুর কথা এমনিই শুনতে হবে, তা-ও যেন কান খোলা থাকে, সাথে বাকি যা কিছু লাগে।

মি. আলম বলতে লাগলেন, হিটলার সব ধরনের পাপ করার আগে ওর খোদার নাম নিত। আমি এ জন্য মনে মনে আমার খোদার নাম নিই, যাতে আমি যদি কথা না রাখতে পারি, আমাকে যেন পাপী বলা হয়, মিথ্যুক না তারা জানে আমি কোন বংশের? আমার পূর্বপুরুষরা আদি বংশের ব্যবসায়ী আর তারা ভাবে, আমি ওর সাথে জড়িত। হেহ, আমি চলছি প্র‍্যাকটিক্যালভাবে ফকাই ওই সব শালা আর ওদের ওই সব বাল-ছাল মানসিকতা আসল চেঞ্জ আসছে আমার জন্য, তারা কই ছিল তখন?

এবার মি. আলম ফোন বের করে কল করার মুহূর্তে ত্বকী বহুত মৃতদেহ দেখল, মানে গাছের লাশ; নগ্ন, ভঙ্গুর এবং আধা-বিকশিত। সিটি করপোরেশন নিয়ত করেছে এই সব জায়গায় আবার গাছ লাগাবে, কিন্তু যে ঘিঞ্জি এলাকা; পরে পারে কি না সন্দেহ। মি. আলমের মোবাইল কথাবার্তা ত্বকী যতখানি পারছে গুরুত্ব না দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাও কানে বিলকুল হিমখোঁচায় ছিদ্র, তো আমি কী করব? আমি নিষেধ করি নাই? তারা জানলে জানছে, কর্মীদের সাথে আমাদের একটা অ্যাগ্রিমেন্ট ছিল, কারা ভঙ্গ করছে সেটা বের করেন আর মানহানি মামলা করেন। মানুষ কি ব্যবসা করে না? আমেরিকার যে যে ব্যাংকে আমরা খরচ পাঠাই, সেসবের হেড ইহুদি না?... ওসব নামেমাত্র বাল-ছাল আমাকে বুঝাতে আসবেন না, ধর্ম ভালো জানি বুঝলেন। দেশের নাম ওইটা তো কী হইছে, খরচ মেইন সেটা মানুষকে বুঝান ফাউ-ফাউ আমাকে নৈতিকতা শিখাতে আসবেন না…’

ঢাকা থেকে ৪০ কি.মি. পূর্ব দিকে ত্বকীদের যেতে সময় লাগল সাড়ে তিন ঘণ্টা, ঊহ্য প্রবেশদ্বারে ত্বকী দেখল সেখানে কিছু মানুষ নির্মাণকাজ বন্ধের জন্য মিছিল করছে। 

আসছে  চতুর্থ পর্ব