দ্য গ্রেট গ্যাটসবি || দ্বিতীয় অধ্যায় || এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড
পড়ুন ► দ্য গ্রেট গ্যাটসবি || প্রথম অধ্যায়
দ্য গ্রেট গ্যাটসবি || দ্বিতীয় অধ্যায় || এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড
অনুবাদ || লায়লা ফারজানা
ওয়েস্ট এগ থেকে নিউইয়র্ক—সড়কপথের প্রায় অর্ধেক পেরুলেই, রাস্তাগুলো রেললাইনের সঙ্গে তড়িঘড়ি করে খানিক পর পর যুক্ত; কোয়ার্টার মাইল ধরে পাশাপাশি যাত্রা করে সেখানে সঙ্কুচিত হয়েছে একটি নির্দিষ্ট জনশূন্য এলাকা। এক ‘ছাই-উপত্যকা’—আজব খামার যেখানে ছাই গমের মতো বেড়ে উঠে শৈলশিরা, পাহাড় এবং অদ্ভুত বাগানে পরিণত হয়; যেখানে ছাই ঘর, চিমনি এবং কুন্ডলিত ধোঁয়ার রূপ নিয়ে সীমাহীন প্রচেষ্টার শেষে মানুষের আকৃতি ধারণ করে পরমুহূর্তেই গুঁড়া-বাতাসের অস্পষ্ট চলাফেরায় ভেঙে গুড়িয়ে যায়। মাঝেমাঝে ধূসর গাড়ির লহর অদৃশ্য ট্র্যাকে হামাগুড়ি খেয়ে কড়্-কড়্ শব্দে ভয়ঙ্করভাবে থামে, আর মুহূর্তের মধ্যে এক ঝাঁক ছাই-ধূসর পুরুষ সীসার কোদালে দৃষ্টি থেকে অস্পষ্ট ক্রিয়াকলাপ ঢেকে দেওয়া দুর্ভেদ্য মেঘকে আঘাতে আন্দোলিত করে।
কিন্তু সেই ধূসর ভূমির উপর অবিরামভাবে প্রবাহিত বিষণ্ণ ধূলিকণার মাতন ফুঁড়ে মুহূর্তেই জেগে ওঠে ডাক্তার টি জে একেলবার্গের চোখ। ডাক্তার টি জে একেলবার্গের চোখ—নীল, বিশালাকার—এক গজ উঁচু তার রেটিনা। চোখগুলো কোনো মুখ থেকে নয়, বরং, তাকিয়ে থাকে অস্তিত্বহীন নাকের উপর স্থাপিত এক জোড়া বিশাল হলুদ চশমার ভেতর থেকে। স্পষ্টতই মহৎ চক্ষু বিশেষজ্ঞদের বুনো ঝাঁকের একজন, কুইন্স-বরোতে তার অনুশীলনকে মোটাতাজা করার উদ্দেশ্যে, সেটিকে সেখানে স্থাপন করে, নিজেকে চির-অন্ধত্বে ডুবিয়ে, দূরে চলে গেছে তাকে ভুলে। আর তার সেই চোখ, রোদ-ঝড়-বৃষ্টির বহু বিবর্ণ দিনে, গৌরবময় আবর্জনার বধ্যভূমিতে, ধীরে ধীরে হয়েছে অপসৃত, মৃয়মান।
ছাই-উপত্যকার একপাশ পুতিময় এক ছোট নদী দিয়ে আবদ্ধ, মালবাহী বড় নৌকাগুলো যাতায়াত করার সময়, টানা সেতুটি যখন উপরে উঠে যায়, অপেক্ষমাণ ট্রেনের যাত্রীরা আধ ঘন্টা ধরে সেই অস্বস্তিকর দৃশ্যটি দেখার সুযোগ পায়। প্রতিদিন অন্তত এক মিনিটের সেই বিরতি, আর সে কারণেই প্রথমবারের মত আমি টম ব্যুকাননের উপপত্নীর দেখা পাই।
তার সব পরিচিত মহলেই কেউ একজন আছে বলে জোর-রটনা ছিল। পরিচিতরা বিরক্ত, সে তাকে নিয়ে জনপ্রিয় রেস্তোরাঁয় উপস্থিত হয়, তাকে এক টেবিলে বসিয়ে, অন্যদের সঙ্গে গল্পে মেতে ওঠে। সেই নারী সম্পর্কে আমার কৌতূহল থাকলেও, দেখা করার সদিচ্ছা ছিল না—তবুও দেখা হল। একদিন বিকেলে টমের সঙ্গে ট্রেনে করে নিউইয়র্ক যাচ্ছি, মাঝপথে ছাইয়ের কাছে থামতেই, সে এক পায়ে লাফিয়ে, কনুই ধরে হিচকে আমাকে আক্ষরিক অর্থে গাড়ি থেকে বেরুতে বাধ্য করল।
“আমরা এখানে নামব!” সে জোর দিয়ে বলল, “আমি চাই তুমি আমার প্রেমিকাকে দেখো।”
আমার ধারণা দুপুরের খাবারে সে এতটাই গিলেছিল যে আমার সঙ্গ লাভের তার দৃঢ় সংকল্প সহিংসতার পর্যায়ে পৌঁছেছিল। অবশ্য এটা অনুমান করাও স্বাভাবিক যে রবিবার বিকেলে আমার কিছু করার থাকে না।
রেলপথের উপরে নিচু একটি সাদা-রঙের বেড়া পেরিয়ে আমি তাকে অনুসরণ করি, তারপর ডক্টর একেলবার্গের একাগ্র দৃষ্টিতে অবিরাম তাকিয়ে থাকা রাস্তাটি ধরে একশ গজ পিছনে হাঁটি। সেখানে চোখে পড়ে—বিরান বর্জ্য জমির ধারে হলুদ ইটের এক ছোট্ট বসতি, তারই নিমিত্তে নিবিড় প্রধান সড়ক, চারপাশ শূন্য। এর তিনটি দোকানের একটি ভাড়ার জন্য, একটি ছাই আবৃত রাস্তার শেষে সারা রাত খোলা রেস্তোরাঁ; তৃতীয়টি একটি মেরামতি গ্যারেজ—জর্জ বি উইলসন। গাড়ি ক্রয় বিক্রয় হয়—আমি টমের পেছন পেছন যার অভ্যন্তরে প্রবেশ করি।
অভ্যন্তরটি অপ্রীতিকর, অপ্রগতিশীল এবং খালি; আবছা কোণে কুঁকড়ে থাকা ধুলোয় ঢাকা একটি ফোর্ডের ধ্বংসাবশেষই একমাত্র দৃশ্যমান গাড়ি। যখন আবর্জনায় হাত মুছে মালিক নিজেই দফতরের দরজায় হাজির হল, মনে হল যেন গ্যারেজেটি কেবল একটি পর্দা মাত্র আর মাথার উপরে কোথাও লুকিয়ে আছে দুর্দান্ত রোমান্টিক অ্যাপার্টমেন্টগুলো। লোকটি একজন স্বর্ণকেশী, ভাবলেশহীন মানুষ; রক্তশূন্য, ক্ষীণকায়, চলনসই মাপের সুদর্শন। আমাদের দেখেই তার হালকা নীল চোখে আশার স্যাঁতসেঁতে আলো ছড়িয়ে পড়ল।
“হ্যালো, বুড়ো, উইলসন,” টম উচ্ছ্বসিতভাবে তার কাঁধ চাপড়ে বলে “ব্যবসা কেমন চলছে?”
“কোন অভিযোগ নেই,” উইলসনের অবিশ্বাস্য উত্তরে আমি অবাক। “আপনার ঐ গাড়িটা আমার কাছে বিক্রি করবেন কবে?”
“আগামী সপ্তাহে; আমার লোককে দিয়ে এখন গাড়িটির কাজ করাচ্ছি।”
“সে তো বেশ ধীর গতিতে কাজ করে, তাই না?”
“না, সে করে না,” টম ঠান্ডা গলায় বলে। “আর যদি তোমার এমন মনে হয়, তাহলে আমি গাড়িটি অন্য কোথাও বিক্রি করতে পারি।”
“আমি তা বলিনি,” উইলসন দ্রুত ব্যাখ্যা দেয়, “আমি শুধু বোঝাতে চাইছি—”
তার কণ্ঠ ম্লান হয়ে এলে টম অধৈর্যভাবে গ্যারেজের চারপাশে তাকাতে থাকে। ঠিক তখনি সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শোনা যায় এবং পলকেই এক নারীর পুরু অবয়ব, দফতরের দরজা থেকে আগত আলো রুদ্ধ করে দাঁড়ায়—মধ্য-তিরিশের, সামান্য ভারী, কিন্তু যে জানে বাড়তি মেদকে কিভাবে আবেদনময় করে তোলা যায়। গাঢ় নীলক্রেপ-ডি-চীনের ডোরা কাটা পোশাকের উপরে তার মুখে সৌন্দর্যের কোনো আভাস বা দীপ্তি ছিল না, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে উপলব্ধি করার মত ছিল প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা এক প্রখর জীবনীশক্তি, যেন টগবগ করে তার শরীরের স্নায়ুগুলো ক্রমাগত ধূমায়িত। ধীরে ধীরে, হাসিমুখে, নিজের স্বামীকে অদৃশ্য ভূতের মত অগ্রাহ্য করে, ভেজা চোখে টমের সঙ্গে করমর্দন করে সে। তারপর তার ঠোঁট ভিজিয়ে, পিছনে না ফিরেই নরম কিন্তু রুক্ষ স্বরে স্বামীকে বলে:
“কিছু চেয়ার নিয়ে আসো, কেনো রাখো না, যাতে কেউ বসতে পারে!”
“ওহ, অবশ্যই,” দ্রুত সম্মতি জানিয়ে, অবিলম্বে দেয়ালের সিমেন্টের রঙে মিশে উইলসন তার ছোট্ট দফতরটির দিকে ছুটে যায়। এক দলা সাদা ভস্মিভূত ধূলো তার গাঢ় স্যুট আর ফ্যাকাশে চুলকে ঢেকে দেয়, যেমন “ধুলার-ঢাকা” আশেপাশে সব কিছু—শুধু তার স্ত্রী ছাড়া, সে এখন টমের আরো কাছাকাছি।
“আমি তোমার সঙ্গ চাই,” টম আন্তরিকভাবে ফিসফিস করে বলে।
“তাহলে পরের ট্রেন নাও।”
“ঠিক আছে।”
“আমি নিচ তলার নিউজ-স্ট্যান্ডে তোমার সঙ্গে দেখা করব।”
সে মাথা নেড়ে তার কাছ থেকে সরে যেতেই জর্জ উইলসন ভেতর থেকে দরজা খুলে দুটি চেয়ার নিয়ে বের হয়।
আমরা রাস্তার মাথায়, আড়ালে তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ঘটনাটি “ফোর্থ অব জুলাই” র কয়েকদিন আগের, ছাই মাখা ধূসর, অস্থিসার এক ইতালীয় শিশু রেল-ট্র্যাকের পাশে সারিবদ্ধভাবে টর্পেডো বুনছিল।
“ভয়ংকর জায়গা, তাই না,” ডাক্তার একেলবার্গের সঙ্গে ভ্রুকুটি বিনিময় করে বলে টম,
“আতঙ্কজনক।”
“এসব থেকে দূরে যাওয়া তার জন্য ভালো।”
“তার স্বামী আপত্তি করে না?”
“উইলসন? তার ধারণা সে নিউইয়র্কে তার বোনকে দেখতে যায়। সে এতটাই বোকা যে, নিজে বেঁচে আছে তাও জানে না।”
টম ব্যুকানন, তার প্রেমিকা আর আমি একসঙ্গে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম—অবশ্য একসঙ্গে বলা যাবে না, কারণ মিসেস উইলসন বিচক্ষণতার সঙ্গে অন্য একটি বগিতে বসেছিল। ইস্ট-এগাররা ট্রেন নিতে পারে এই ভেবে টম সচেতনভাবে সেটি স্থগিত করেছিল।
টম যখন নিউইয়র্কের প্ল্যাটফর্মে তাকে উঠতে সাহায্য করছে, লক্ষ্য করলাম সে পোষাক পাল্টে একটি বাদামি মূর্তিওয়ালা মুসলিন পড়েছে, যেটি তার প্রশস্ত নিতম্বটি শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে প্রসারিত। নিউজ-স্ট্যান্ড থেকে সে “টাউন ট্যাটল”-এর এক কপি, একটি সিনেমা ম্যাগাজিন, স্টেশনের ওষুধের দোকান থেকে কিছু কোল্ড ক্রিম আর এক বোতল পারফিউম কিনল। উপরে সমারোহে পূর্ণ প্রতিধ্বনিত রাস্তায় সে চারটি ট্যাক্সি ক্যাব বিদায় করে শেষ পর্যন্ত ধূসর সাজসজ্জার ল্যাভেন্ডার-রঙা একটিকে বেছে নিল, সেটাতে করে আমরা স্টেশনের ভীড় থেকে ঝকঝকে রোদে রওনা হতেই সামনে ঝুঁকে সে জানালার কাঁচে টোকা দেয়।
“আমি ঐ রকম একটি কুকুর চাই,” আন্তরিক কণ্ঠে বলে। “অ্যাপার্টমেন্টের জন্য। কুকুর থাকা ভাল—অ্যাপার্টমেন্টে।”
আমরা গাড়ি পেছোই—জন ডি. রকফেলারের সঙ্গে অস্বাভাবিক সাদৃশ্য বহনকারী এক ধূসর বৃদ্ধের কাছে। তার কাঁধে ঝোলানো ঝুড়িতে, হালে জন্ম নেয়া, অজানা প্রজাতির ডজনখানেক ঢেকে রাখা কুকুরছানা।
“এরা কোন জাতের?” ট্যাক্সির জানালার কাছে আসতেই মিসেস উইলসন তাকে সাগ্রহে জিজ্ঞেস করে।
“সব ধরনের আছে, শ্রীমতি, আপনি কোনটি চান?”
“আমি পুলিশ কুকুর চাই; আমার মনে হয় না আপনার কাছে ঐ জাতের আছে।”
লোকটি সন্দিহানভাবে ঝুড়ির মধ্যে উঁকি দেয়, তার হাত নিমজ্জিত হয় এবং ঘাড়ের পেছন দিয়ে সে একটিকে টেনে তোলে।
“এটা পুলিশ কুকুর নয়,” টম বলে।
“না, এটা পুলিশ কুকুর নয়,” হতাশ কণ্ঠে লোকটি উত্তর দেয়। “এটা বলতে গেলে আসলে একটি এয়ারডেল।” পিঠের বাদামি ন্যাকড়ার ওপর হাত বুলিয়ে বলে সে। “এর কোটটা দেখুন। একটা কোটের মত কোট। এটি এমন একটি কুকুর যে আপনাকে কোনোদিন ঠান্ডার জন্য বিরক্ত করবে না।”
“খুব সুন্দর,” মিসেস উইলসন উৎসাহের সঙ্গে বলে। “দাম কত?”
“এই কুকুর?” সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। “এই কুকুরের দাম দশ ডলার।”
এয়ারডেল—নিঃসন্দেহে এর মধ্যে কোথাও একটি উদ্বিগ্ন এয়ারডেল ছিল, যদিও এর পা ছিল চমকপ্রদ সাদা—হাত বদল করে ছানাটি মিসেস উইলসনের কোলে বসতি স্থাপন করলে সে পরমানন্দে “আবহাওয়া সুরক্ষিত” কোটটি চেপে তাকে আদর করতে শুরু করে।
“এটি কি ছেলে না মেয়ে?” মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে সে।
“এই কুকুরটি? এই কুকুরটি একটা ছেলে।”
“এটি একটি কুক্কুরি, বিচ” টম শক্তভাবে বলে। “এই নাও তোমার টাকা। আর যাও এটা দিয়ে আরও দশটা কুকুর কিনো।”
গাড়ি নিয়ে আমরা চলে আসি ফিফথ অ্যাভিনিউ—যেন চারণ-ভূমি, এতটাই উষ্ণ আর নরম যে রবিবারের সেই গ্রীষ্মের বিকেলে সাদা ভেড়ার একটি বড় পালও যদি কোণ থেকে বেরিয়ে আসত, আমি অবাক হতাম না।
“থামাও,” আমি বলি, “এখান থেকেই বিদায় নিচ্ছি।”
“না, না! তা করো না,” টম তাড়াতাড়ি বলে। “তুমি উপরে না এলে মার্টল আহত হবে যে।—তাই না, মার্টল?”
“আসুন,” সে অনুরোধ করে। “আমার বোন ক্যাথরিনকেও ফোন করছি। সবাই বলে সে মহাসুন্দরী।”
“আচ্ছা, আমি আসতাম, কিন্তু—”
আমরা পার্কের ভেতর দিয়ে ওয়েস্ট হানড্রেডসের দিকে এগোই। ক্যাবটি ১৫৮ তম স্ট্রিটে, অ্যাপার্টমেন্ট হাউসগুলোর দীর্ঘ-সাদা-কেকের এক টুকরোয় এসে থামে। মিসেস উইলসন মহল্লার আশেপাশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের রাজকীয় দৃষ্টিতে, তার কুকুর এবং সদ্য কেনা জিনিসগুলো জড়ো করে অহংকারী ভঙ্গিতে ভিতরে প্রবেশ করে। লিফটে উঠেই ঘোষণা দেয়, “ম্যাককিদের আমি উপরে নিয়ে আসছি। আর অবশ্যই বোনকেও খবর দিচ্ছি।”
উপর তলায় অ্যাপার্টমেন্টটিতে—একটি ছোট বসার ঘর, ছোট ডাইনিং রুম, একটি ছোট বেডরুম এবং একটি বাথরুম। বসার ঘরটি দরজার কাছে হাতে-আঁকা কাপড়ে তৈরি আসবাবপত্রে ঠাসা; ঘরটির আয়তনের তুলনায় যেগুলো এতই বিশাল যে চলাফেরা করতে গিয়ে, প্রতিমুহূর্তে ভার্সাইয়ের বাগানে, মহিলাদের দোল খাওয়ার দৃশ্যে অবিরত হোঁচট খেতে হয়। একমাত্র ছবিটি অতি-বর্ধিত এক আলোকচিত্র—দৃশ্যত একটি মুরগি একটি ঝাপসা পাথরের ওপর বসে। দূর থেকে তাকালে মুরগিটি একটি বনেটের মধ্যে নিজেকে স্থির করে নেয় এবং হৃষ্টপুষ্ট এক বৃদ্ধার মুখমণ্ডল ভেসে উঠে। টেবিলে “টাউন ট্যাটল”-এর বেশ কিছু পুরানো কপি “সাইমন কলড পিটার” এবং ব্রডওয়ের কিছু ছোট স্ক্যান্ডাল ম্যাগাজিনের সঙ্গে একত্রে পড়ে আছে।
মিসেস উইলসন প্রথমেই কুকুরটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। অলস লিফট-বয়টি অনিচ্ছাসত্বেও খড় ভর্তি বাক্স এবং দুধ আনতে গিয়ে নিজের উদ্যোগেই কুকুরের শক্ত-বড় বিস্কুটের একটি টিনও নিয়ে এল—যার একটি সারা বিকাল দুধের বাটিতে উদাসীনভাবে পঁচল। ইতিমধ্যে টম তালাবদ্ধ অফিস ঘর থেকে একটি হুইস্কির বোতল বের করে আনে।
আমার জীবনে আমি মাতাল হয়েছি মাত্র দুবার—দ্বিতীয়বারটি ছিল সেই বিকেলে, যাই ঘটছিল তার উপর একটি অস্পষ্ট আবছা ঘোরের ভর ছিল, যদিও আটটারও পর পর্যন্ত অ্যাপার্টমেন্টটি ছিল প্রফুল্ল রোদে পূর্ণ। টমের কোলে বসে মিসেস উইলসন টেলিফোনে বেশ কয়েকজনকে আমন্ত্রণ জানাল; ঘরে কোন সিগারেট না থাকায় আমি কোনের ওষুধের দোকান থেকে কিনতে যাই। ফিরে এসে দেখি তারা হাওয়া, বুদ্ধি করে আমি বসার ঘরে বসে চুপচাপ “সাইমন কলড পিটার”-এর একটি অধ্যায় পড়া শুরু করি—জানি না পড়ার জন্য কতটা অখাদ্য ছিল; নাকি হুইস্কিই তাকে বিকৃত করেছিল, কারণ কোনভাবেই আমার কাছে অর্থবহ মনে হয়নি।
টম এবং মার্টলের [প্রথম পানীয়টি গলায় পড়তেই; মিসেস উইলসন এবং আমি একে অপরকে প্রথম নামে ডাকতে শুরু করি] ফিরে আসার পর পরই অন্যান্য অতিথিও একে একে অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় পৌঁছতে শুরু করে।
বোন, ক্যাথরিন, ক্ষীণকায়—জাগতিক বস্তুবাদী মেয়ে, শক্ত আঠালো লাল বব চুল, গুঁড়া দুধের মত সাদা গায়ের রঙ, প্রায় ত্রিশ বছর বয়স। তার প্লাক করা ভ্রুর উপরে, আবেদনময় কোণে টেনে আঁকা নতুন ভ্রুর আড়ালে, দৃশ্যমান পুরোনো সারিবদ্ধ ভ্রু-জোড়াকে পুনরুদ্ধারের প্রকৃতির দুরূহ প্রচেষ্টা তার মুখটিকে বিমূর্ত করে তুলেছিল। তার ছুটোছুটির সঙ্গে তার বাহুতে অজস্র মৃৎপাত্রসুলভ ব্রেসলেট অবিরাম ঝিঁঝিঁ পোকার মতো বাজছিল। তার স্বচ্ছন্দ প্রগলভ দেহভঙ্গি এবং আসবাবপত্রের প্রতি কর্তৃত্বপরায়ণ আধিপত্যের নমুনা দেখে মনে হচ্ছিল যেন সে এখানেই থাকে। তবে জিজ্ঞেস করতেই অপ্রস্তুতভাবে হেসে, উচ্চস্বরে আমার প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করে জানাল সে কোনো এক হোটেলে কোনো এক বান্ধবীর সঙ্গে থাকে।
মি. ম্যাককি নিচের ফ্ল্যাটের ফ্যাকাশে মেয়েলি পুরুষ। সবেমাত্র দাড়ি কামিয়েছে, কারণ তার গালের হাড়ের উপর একটি সাদা ফেনার দাগ। অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে সে ঘরের সকলকে অভিবাদন জানাচ্ছিল। আমাকে বলল, “শৈল্পিক খেলায়” সে একজন খিলারি, পরে তথ্য পাই সে একজন আলোকচিত্রী এবং মিসেস উইলসনের মায়ের প্রসারিত বিমূর্ত ছবিটি যা দেয়ালে একটি ইক্টোপ্লাজম ওরফে জীবকোষের বহিরাবরণের মতো ঝুলছে—সেটি তারই সৃষ্টি। তার স্ত্রী ঈষৎ উগ্র, নির্জীব, সুদর্শনা এবং ভয়ঙ্কর—গর্ব করে জানাল তার স্বামী বিয়ের পর থেকে একশত সাতাশ বার তার ছবি তুলেছে।
ইতিমধ্যেই, মিসেস উইলসন পোশাক পরিবর্তন করেছে, এখন সেজেছে একটি ক্রিম-রঙের শিফনে বিস্তীর্ণ বিকালের পোশাকে, যা ক্রমাগত ঘরের চারপাশে ঘোরাঘুরির সঙ্গে সঙ্গে কোলাহল সৃষ্টি করছিল। পোশাকের প্রভাবে তার ব্যক্তিত্বেও এসেছে পরিবর্তন। গ্যারেজের অসাধারণ জীবনীশক্তি এখন রূপান্তরিত হয়েছে চিত্তাকর্ষক ঔদ্ধত্যে। তার হাসি, অঙ্গভঙ্গি, তার দাবি-দাওয়া মুহূর্তে মুহূর্তে হিংস্রভাবে প্রভাবিত হয়ে যতই বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তার চারপাশের ঘরটি যেন ততই ছোট হচ্ছিল, যতক্ষণ না সে ধোঁয়াটে বাতাসের কুণ্ডলিতে একটি কোলাহলপূর্ণ, ক্যাচক্যাচে পিভটে ঘূর্ণমান লাট্টুতে পরিণত হয় ।
“প্রিয় বোন আমার,” সে বোনের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে ঢং করে বলে, “বেশিরভাগ মানুষই তোমার সঙ্গে প্রতারণা করবে, প্রতিবার। তাদের জন্য টাকাই সব। গত সপ্তাহে আমার পা দেখতে এখানে একজন মহিলা এসেছিল এবং যখন সে আমাকে বিলটি ধরিয়ে দিল, মনে হল সে আমার অ্যাপেন্ডিসাইটিস বের করে নিয়েছে।”
“মহিলার নাম কী?” জানতে চাইল মিসেস ম্যাককি।
“শ্রীমতি এবেরহার্ডট। মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে সে পা দেখে বেড়ায়।”
“আপনার পোশাকটি আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে,” মিসেস ম্যাককি মন্তব্য করে, “অসাধারন।”
মিসেস উইলসন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে প্রশংসাটি প্রত্যাখ্যান করে, “অত্যন্ত পুরানো একটি পোশাক,” সে বলে। “আমি মাঝে মাঝে এটিকে গলিয়ে নেই যখন আমি আমাকে দেখতে কেমন লাগবে তা নিয়ে ভাবি না।”
“কিন্তু আপনাকে চমৎকার দেখাচ্ছে, যদি আপনি আন্দাজ করতে পারেন আমি কি বলতে চাইছি,” মিসেস ম্যাককি বলে চলে। “যদি চেস্টার আপনাকে এই ভঙ্গিতে পায় তবে আমি মনে করি সে একটা কিছু করতে পারে।”
আমরা সবাই নিঃশব্দে মিসেস উইলসনের দিকে তাকালাম, সে তার চোখের উপর থেকে চুলের থোকাটি সরিয়ে উজ্জ্বল হাসি দিয়ে আমাদের দিকে ফিরে তাকায়। মি. ম্যাককি একপাশে মাথা রেখে গভীরভাবে তাকে দেখতে থাকে, তারপরে তার মুখের সামনে ধীরে ধীরে তার হাত দুটি আগে পিছে করতে করতে এগিয়ে যায়।
“আলোটা বদলানো উচিত,” কিছুক্ষণ পর সে বলে। “আমি মডেলিংয়ের বৈশিষ্ট্যগুলো বের করে আনতে চাইব। আর পেছনের চুলগুলোকে ধরার চেষ্টা করব।”
“আমার মনে হয় না আলো বদলানোর দরকার আছে,” মিসেস ম্যাককি চিৎকার করে বলে। “আমি মনে করি এটা—”
তার স্বামী বলে “সসস!”
আমরা সবাই আবার বিষয়ের দিকে তাকাই, ওদিকে টম ব্যুকানন সশব্দে হাই তুলে উঠে দাঁড়ায়।
“তোমরা; ম্যাককিরা কিছু পান করো,” সে বলে। “সবাই ঘুমিয়ে পড়ার আগে আরো কিছু বরফ এবং মিনারেল-ওয়াটারের ব্যবস্থা করো, মার্টেল।”
“আমি ছেলেটিকে বরফের কথা বলেছিলাম।”
নিম্নগামী আদেশের পরিবর্তনহীনতায় হতাশায় ভ্রু কুঁচকে ওঠে মার্টলের। “এই লোকগুলো! সবসময় এদের পিছে লেগে থাকতে হয়।”
সে আমার দিকে তাকিয়ে অর্থহীনভাবে হাসে; তারপর কুকুরছানাটির দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মহানন্দে তাকে চুম্বন করে এমনভাবে রান্নাঘরে প্রবেশ করে যেন সেখানে এক ডজন শেফ তার আদেশের অপেক্ষায়।
“আমি লং আইল্যান্ডে কিছু সুন্দর কাজ করেছি,” আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে মি. ম্যাককি বলে।
ভাবলেশহীন দৃষ্টি-শূন্য চোখে তাকায় টম।
“তাদের মধ্যে দুটিকে আমরা নিচে ফ্রেম করেছি।”
“দুটি কী?” টম জানতে চায়।
“দুটি স্টাডি। তাদের একটিকে আমি বলি “মন্টাউক পয়েন্ট—দি গালস”, অন্যটিকে বলি “মন্টাউক পয়েন্ট—দি সি।”
বোন ক্যাথরিন আমার পাশে সোফায় বসা। “আপনিও কি লং আইল্যান্ডে থাকেন?” জিজ্ঞাসা করে।
“আমি ওয়েস্ট এগ-এ থাকি।”
“সত্যি? আমি প্রায় মাসখানেক আগে সেখানে একটি পার্টিতে গিয়েছিলাম। গ্যাটসবি নামে একজনের পার্টিতে। আপনি কি তাকে চিনেন?”
“আমি তার পাশের বাসাতেই থাকি।”
“আচ্ছা, লোকে বলে সে কাইজার উইলহেলমের ভাতিজা বা চাচাতো ভাই। ওখান থেকেই তার সব টাকা আসে।”
“সত্যি?”
সে মাথা নাড়ে।
“আমি তাকে ভয় পাই। তার কাছ থেকে কিছু পেতেও ঘৃণা করব।”
আমার প্রতিবেশী সম্পর্কে এই রকম লোভনীয় তথ্য সংগ্রহে ব্যঘাত করে মিসেস ম্যাককি হঠাৎ ক্যাথরিনের দিকে ইশারা করে: “চেস্টার, আমি মনে করি তুমি ওকে নিয়ে কিছু করতে পারো,” সে উৎসাহে ফেটে পড়ে, কিন্তু মিস্টার ম্যাককি বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে টমের দিকে মনোযোগ দেয়।
“আমি লং আইল্যান্ডে আরও কাজ করতে চাই যদি প্রবেশাধিকার পাই, শুধু চাই তারা যেন আমাকে একটা শুরু দেয়।”
“মার্টলকে বলুন,” মিসেস উইলসন একটি ট্রে নিয়ে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে টম। “সে আপনাকে পরিচয়পত্র দেবে। কি, তুমি দিবে না, মার্টেল?”
“কি করব?” সে চমকে ওঠে।
“তুমি ম্যাককিকে তোমার স্বামীর সঙ্গে পরিচয়ের একটি রেফারেন্স লেটার দেবে, যাতে সে তার সম্পর্কে কিছু স্টাডি করতে পারে।” তার ঠোঁট কিছুক্ষণের জন্য নীরবে নড়ে ওঠে বিড়বিড় করে কিছু একটা আবিষ্কার করতে চায়।
“পেট্রোল পাম্পে জর্জ বি উইলসন,” বা এরকম একটা কিছু।”
ক্যাথরিন আমার দিকে ঝুঁকে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে: “যাদেরকে তারা বিয়ে করেছে, দুজনের কাউকেই তারা সহ্য করতে পারে না।”
“সহ্য করতে পারে না?”
“সহ্য করতে পারে না।” সে মার্টলের দিকে এবং তারপর টমের দিকে তাকায়। “আমি বলি, সহ্য করতে না পারলে ওদের নিয়ে বাঁচা কেন? আমি হলে ডিভোর্স নিতাম তারপর একে অপরকে বিয়ে করতাম।
“সেও কি উইলসনকে পছন্দ করে না?”
অপ্রত্যাশিত উত্তরটা এসেছিল মার্টলের কাছ থেকে, সে প্রশ্নটি শুনে ফেলেছিল এবং তার উত্তরটি ছিল হিংসাত্মক এবং অশ্লীল।
“দেখেছো?” ক্যাথরিন জয়ের সুরে বলে। তারপর আবার কণ্ঠস্বর নিচু করে বলে, “আসলে তার স্ত্রীই তাদের আলাদা করে রেখেছে। সে ক্যাথলিক, বিবাহ-বিচ্ছেদে বিশ্বাস করে না।”
ডেইজি ক্যাথলিক নয়, আমি মিথ্যার বাড়াবাড়িতে অবাক হয়েছিলাম!
“বিয়ে করে তারা,” ক্যাথরিন চালিয়ে গেল, “কিছুদিন পশ্চিমে থাকবে যতদিন না পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়।”
“ইউরোপে যাওয়া আরও বুদ্ধিমানের কাজ হবে।”
“ওহ, আপনি ইউরোপ পছন্দ করেন?” সে অবাক হয়। “আমিতো সবেমাত্র মন্টে কার্লো থেকে ফিরলাম!”
“সত্যি?”
“গত বছরই। আমি একজন মেয়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম।”
“অনেকদিনের জন্য?”
“না, আমরা শুধু মন্টে কার্লো গিয়েছিলাম এবং ফিরে এসেছি। গিয়েছিলাম মার্সেইলেসের পথে। যাত্রার শুরুতে আমাদের বারোশো ডলারেরও বেশি ছিল কিন্তু প্রাইভেট রুমে প্রতারিত হয়ে দুদিনের মধ্যেই সব শেষ! সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে ভয়ঙ্কর সময় পার করেছি, আপনাকে বলতে পারি। ঈশ্বর, আমি যে সেই শহরকে কতটা ঘৃণা করি!”
ভূমধ্যসাগরের নীল মধুর মতো কিছুক্ষণের জন্য জানালায় ফুটে উঠল শেষ বিকেলের আকাশ—মিসেস ম্যাককি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ঘর থেকে ডাকল।
“আমিও প্রায় ভুল করছিলাম,” সে ঘোষণা দিল।
“আমিতো প্রায় এক ছোট ইহুদি কাইকে বিয়েই করে ফেলছিলাম, যে বছরের পর বছর আমার পিছনে ঘুরেছে। সে আমার যোগ্য ছিল না, আমি জানতাম। সবাই আমাকে বলেছিল: “লুসিল, সেই লোকটির অবস্থান তোমার অনেক নিচে!” যদি চেস্টারের সঙ্গে দেখা না হতো, তবে সে নির্ঘাত আমাকে হরণ করত।”
“হ্যাঁ, তবে শোন,” মার্টেল উইলসন মাথা নিচু করে বলে, “অন্তত তুমি তো তাকে বিয়ে করোনি।”
“আমি জানি আমি করিনি।”
“কিন্তু, আমি তাকে বিয়ে করেছি,” অস্পষ্টভাবে বলে মার্টল। “এবং তোমার পরিস্থিতির সঙ্গে আমার পরিস্থিতির এটাই তফাৎ।”
“কেন করেছ মার্টেল?” ক্যাথরিন জিজ্ঞেস করে। “কেউতো তোমাকে জোর করে বিয়ে দেয়নি।”
ব্যাপারটি মার্টেলকে ভাবায়।
“আমি তাকে বিয়ে করেছি কারণ আমি ভেবেছিলাম সে ভদ্রলোক,” সে শেষ পর্যন্ত ভেবে বলে।
“আমি ভেবেছিলাম উঁচু জাত এবং আচার সম্পর্কে সে ভাল জ্ঞান রাখে, কিন্তু আমার জুতা চাটার উপযুক্তও সে ছিল না।”
“তুমি তো তখন তার জন্য পাগল ছিলে,” ক্যাথরিন বলে।
“তার জন্য পাগল!” অবিশ্বাস্যভাবে চেঁচায় মার্টল। “কে বলেছে আমি তার জন্য পাগল ছিলাম? আমি এই লোকটির জন্য যতটা পাগল, তার জন্য তখন তার চেয়ে একটুও বেশি পাগল ছিলাম না।”
হঠাৎ করেই তার ইশারা আমার দিকে। প্রত্যেকেই আমার দিকে অভিযোগের দৃষ্টিতে তাকায়। আমি আমার অভিব্যক্তি দিয়ে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করি যে তার অতীত জীবনে আমার কোন ভূমিকা নেই।
“একমাত্র তখন আমি পাগল ছিলাম যখন আমি তাকে বিয়ে করি। আমি তখনই জেনে যাই আমি ভুল করেছি। সে বিয়ে করার জন্য একজনের কাছ থেকে তার সেরা স্যুট ধার নিয়েছিল, এমনকি আমাকেও সে সম্পর্কে কিছু বলেনি, পরদিন লোকটি সেটি ফেরত নিতে আসে, যখন সে বাইরে ছিল।” কে কে শুনছে তা দেখার জন্য সে চারপাশে তাকিয়ে বলে: “ওহ, এটা তোমার স্যুট?” আমি জিজ্ঞেস করি। “জীবনে প্রথম আমি এ সম্পর্কে শুনলাম।” আমি তাকে স্যুটটি ফিরিয়ে দিয়ে সারা বিকেল শুয়ে শুয়ে কেঁদেছি।”
ক্যাথরিন আমার কাছে আবার ফিরে এল, “সত্যিই তার থেকে তার থেকে দূরে সরে যাওয়া উচিত। “তারা এগারো বছর ধরে গ্যারেজে বাস করছে। তাছাড়া টমই তার প্রথম প্রেমিক।”
দ্বিতীয় দফা—হুইস্কির বোতল—উপস্থিত সকলের এখন এটাই ক্রমাগত চাহিদা, শুধুমাত্র ক্যাথরিন “কিছুতেই ভালো বোধ করছিল না।”
টম দারোয়ানকে কিছু সেলিব্রেটেড স্যান্ডউইচ আনতে পাঠায়, সেগুলোই ছিল তাদের নৈশভোজ। আমি বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, নরম গোধূলিতে পার্কের পূর্ব দিকে হাঁটতে চেয়েছিলাম, কিন্তু যতবারই বেরুবার চেষ্টা করেছি, ততবারই কিছু জংলি বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি, যা আমাকে দড়ি দিয়ে টেনে চেয়ারে নিয়ে বসায়। তবুও জানি, শহরে আমাদের এই জানালাগুলোর হলুদ-রেখা অন্ধকার রাস্তার ভ্রাম্যমান কোনো পথচারীর সঙ্গে মানবীয় গোপনীয়তার অংশ ভাগাভাগি করে নিয়েছে, আমিও ছিলাম ঠিক তারই মত, তাকিয়ে ছিলাম, অবাক হয়েছিলাম—ভিতরে এবং বাইরে, একই সঙ্গে জীবনের অক্ষয় বৈচিত্র্যে বিমোহিত এবং বিতাড়িত হয়ে।
মার্টেল তার চেয়ারটি আমার কাছে টেনে নিয়ে বসল, তার উষ্ণ নিঃশ্বাস হঠাৎ আমার উপর টমের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতের গল্প টেনে ধরল।
“ট্রেনের শেষে পরস্পরের মুখোমুখি দুটি ছোট আসন যা সবসময় খালি থাকত সেখানেই বসেছিলাম দুজন। আমি বোনকে দেখতে এক রাতের জন্য নিউইয়র্ক যাচ্ছিলাম। তার পরনে ছিল একটি ড্রেস-স্যুট আর পেটেন্ট চামড়ার জুতা, আমি চোখ সরাতে পারছিলাম না, কিন্তু যতবার সে আমাকে দেখছিল, ততবারই আমি তার মাথার উপরে বিজ্ঞাপনটি পড়ার ভান করছিলাম। আমরা যখন স্টেশনে নামি তখন সে আমার পাশেই ছিল… তার সাদা শার্ট-ফ্রন্ট আমার বাহুতে চাপা পড়ে ছিল—আমি বলেছিলাম আমি পুলিশ ডাকব, কিন্তু সে জানত আমি মিথ্যা বলছি। আমি এতটাই উত্তেজিত ছিলাম যে, যখন তার ট্যাক্সিতে উঠি, বুঝতেই পারিনি আমি পাতালরেলে উঠছি না। আমি ভাবতে থাকি বারবার —“কেউ চিরকাল বাঁচে না, কেউই চিরকাল বাঁচে না।”
সে মিসেস ম্যাককির দিকে তাকায়; তার কৃত্রিম হাসিতে পুরো ঘরটি ভরে ওঠে।
“প্রিয় আমার,” সে চিৎকার করে বলে, “কাজ শেষ হলেই আমি এই পোশাকটি তোমাকে দিয়ে যাবো। আমি আগামীকাল আরেকটি কিনছি, আমি যা যা চাই তার একটি তালিকা তৈরি করছি। একটি মাসাজ-ওয়েভ, একটি কুকুরের কলার আর সেই সুন্দর ছোট অ্যাশ-ট্রেগুলোর একটি যাতে বসন্ত ছোঁয়া যায়, আর মায়ের কবরের জন্য একটি কালো রেশমি ফিতা-বাঁধা পুষ্পস্তবক, যা সারা গ্রীষ্মের জন্য যথেষ্ট। আমাকে আরো একটি তালিকা তৈরি করতে হবে; যাতে লেখা থাকবে আমার যা যা করা দরকার, যেন ভুলে না যাই।”
তখন নয়টা—প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যখন আমি আবার ঘড়ির দিকে তাকাই, দেখি দশটা বেজে গেছে। মিস্টার ম্যাককি, একজন কর্মক্ষম মানুষের ফটোগ্রাফের মত, কোলে হাত মুঠো করে চেয়ারে ঘুমিয়ে। আমি রুমাল বের করে তার গাল থেকে শুকনো ফেনার দাগের অবশিষ্টাংশ মুছে ফেলি, সারা বিকেল যা আমাকে জ্বালাতন করছে।
ধোঁয়ায় মধ্যে খাবি খেয়ে টেবিলের উপর অন্ধ চোখে বসে, ছোট্ট কুকুরটি মাঝে মাঝে অস্পষ্টভাবে কাঁদছিল।
মানুষগুলো কখনো অদৃশ্য, কখনো আবির্ভূত, কখনো কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করছে, কখনো একে অপরকে হারিয়ে ফেলে, একে অপরকে খুঁজছে, আবার কখনো কয়েক ফুট দূরত্বেই একে অপরকে খুঁজে পাচ্ছে।
মধ্যরাতে টম ব্যুকানন এবং মিসেস উইলসন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, উত্তেজিত স্বরে মিসেস উইলসনের ডেইজির নাম উল্লেখ করার অধিকার বিষয়ক আলোচনা শুরু করে।
“ডেইজি! ডেইজি! ডেইজি!” হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে মিসেস উইলসন। “যখন ইচ্ছা হবে, আমি তখনই ডাকব! ডেইজি! ডেই—”
এক নিপুণ-সংক্ষিপ্ত-ভঙ্গিতে দ্রুত নড়ে উঠেই টম ব্যুকানন খোলা হাতের এক চাপড়ে মিসেস উইলসনের নাক ভেঙে ফেলে।
তারপরে বাথরুমের মেঝেতে রক্তাক্ত তোয়ালে, মহিলাদের আর্ত চিৎকার, ভর্ৎসনা আর বিভ্রান্তি ছাপিয়ে ভাঙা যন্ত্রণার দীর্ঘ হাহাকার। ঘুম থেকে জেগে দরজার দিকে এগিয়ে হতবুদ্ধি হয় মি. ম্যাককি। অর্ধেক পথ গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার সেই দৃশ্যের দিকে তাকায়—সেখানে তাঁর স্ত্রী এবং ক্যাথরিন এখানে সেখানে এইডের আর্টিকেল সমৃদ্ধ আসবাবপত্রের ভিড়ে হোঁচট খেয়ে তিরস্কার করছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে, সোফায় হতাশাগ্রস্ত চিত্রটি রক্তপাতে ভার্সেইয়ের দৃশ্যের ওপর “টাউন ট্যাটল”-এর অনুলিপি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
একটু পরেই; মি. ম্যাককি উল্টো ঘুরে দরজার বাইরে চলে যায়। ঝাড়বাতির উপর থেকে আমিও আমার টুপিটি নিয়ে তাকে অনুসরণ করি।
“কোন একদিন লাঞ্চে এসো, দেখা হবে” লিফটে নামার সময় সে পরামর্শ দেয়।
“কোথায়?”
“যে খা নে খু শি”
“আপনার হাতটি লিভার থেকে দূরে রাখুন,” লিফটবয় ঝটকা মেরে বলে।
“আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি,” মি. ম্যাককি মর্যাদার সঙ্গে বলে, “আমি বুঝতে পারিনি যে আমি এটা স্পর্শ করছিলাম।”
“ঠিক আছে,” আমি সম্মতি জানাই, “সানন্দে।”
আমি এসে তার বিছানার পাশে দাঁড়াই, সে চাদরের ওপর উঠে বসে, পরনে অন্তর্বাস, হাতে একটি দুর্দান্ত পোর্টফোলিও।
“বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট... একাকীত্ব... ওল্ড গ্রোসারি হর্স... ব্রুক’ন ব্রিজ...।”
পেনসিলভানিয়া স্টেশনের ঠান্ডা নিচতলায় শুয়ে, তারপর আমি আধো ঘুমে সকালের “ট্রিবিউন”-এর দিকে তাকিয়ে চারটার ট্রেনের অপেক্ষা করি।
* * *
চোখ রাখুন || আসছে তৃতীয় অধ্যায়
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন