কাউন্টার কালচার ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-

 

কাউন্টার কালচার

চিবুকের অন্ধকারে নতুন ভূমি খুঁড়ে 
পিপাসায় ভূমিষ্ঠ নদীর শোধে দাঁড়িয়ে যাত্রা করবো 
                         অগাধ ধ্বনিময় মায়াবী শতক।
আর স্নেহের শেকড়ে প্রহরের ছাই দিয়ে বাঁধবো 
                                            দীর্ঘতম সড়ক
নাব্যতার নীলে বরণ করবো সঙ্ঘসন্ধ্যা
যৌথ স্বপ্নের উল্কাপাতে ভায়োলিনে বাজবে সুবর্ণ সময়
প্রিয় নম্রতা! এই যে অথৈ সাইবারে ভাসছি দুই বেলা 
মেসেঞ্জারে ঝুলে থাকছি উতল মধ্যরাত 
                                কেউ কি কোথাও জেগে আছে
একটি প্রোফাইল পিক তিরতির করে কাঁপছে আলোতে।

পৃথিবীর কিনারায় দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকিয়ে আছে, 
জীবন এইটুকু নয়, জীবন কোন প্রতিষ্ঠার বাণী নয় যেন
অন্য কোন গ্রহের ধ্মনী থেকে পেড়ে নেবে
স্থাপত্যের গভীরে লাল টিপ থেকে জ্বলে ওঠা সূর্যের সাজ 
মায়ায় বিঁধছে ঋতুমুখ, হাত ভরে ওঠে নির্মাণের খনিজ 
ঘ্রাণ তার রক্তময় স্নায়ুর অগাধ পৃষ্ঠে বসনপ্রান্ত 
                                মানুষের দীর্ঘ সরণি, 
মানুষের বিকিকিনি হল্লা, নীল মেঘ ওপরে রেখে বাঁচে
কারা যেন সারারাত শোর করে চলে, চোখ তুলে আসে
প্রাচীন বেহালার তন্তু নড়ে ওঠা সুরে মুছে অভিষেক।

আমরা এতোটা কাছে শূন্য প্রহরে এতো দুঃখ ভাঙনে
আকাশের দিকে পাতা করতল তবু পাখি দাঁড়াবে কোন 
সুমিত্র প্রত্যুষে!
মুঠোফোনের পর্দা থেকে পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে যায় 
                                         শিকারি জ্যোৎস্না।

 

বড় মাছের কাহিনি

একদিন, নদীর জল দুধে পরিণত হলো। মানুষের আকৃতি ধারণ করলো মেঘ। পিতামহ যখন ছাতা খুললেন, বিশাল পাখিতে পরিণত হলেন। পাখিদের ডানায় মানুষের নাম লেখা, তারা মানুষের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। হাসিতে ঝলমলিয়ে ওঠে চাঁদ, চাঁদ নেমে এসে পুকুরে গোসল করে।

পুকুরের মাছগুলো গোল হয়ে বসে একটি বড় মাছের কাহিনি শোনায়। যখন কাহিনি শোনায়, তাদের মুখ থেকে আরও ছোট ছোট মাছ বেরিয়ে আসে। 

মানুষের বাড়িগুলো আকাশে ভাসতে থাকে। প্রতিটি দরজা একটি অন্য জগতে খুলতে শুরু করে। মাছরাঙার বর্ণিল পুচ্ছ মাঠে রঙ ছিটিয়ে যায়, ডানা গুটিয়ে বসে বসন্ত বিস্তারের কঞ্চিতে। পায়ের নিচে ঘাস বড় হচ্ছে, ঘাসে নলিমাছি হেলিকপ্টারের মতো উড়ছে। মেয়েটি তার পেছনে রংধনু নিয়ে হাঁটছে। তার জুতোর ফিতে খুলে গেলে পথে উজ্জ্বল মাছের নৃত্য দেখতে পায়। এই ভোর যেন তারই গাওয়া কোন গান। দুই চোখের মণিতে ফুটে উঠে ওই রাতপ্রভাতের অঙ্কুরোদগম। পিতামহ তার দাড়িতে বয়ে বেড়াচ্ছেন গত ঋতুর স্মৃতি। অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া পথ এখন কেবল মেয়েটির কাছে দৃশ্যমান।

 

ঝরো জীবনের কালেমা

দূর থেকে বাঁশি শুনতে ভালো লাগে
দূর থেকে কীর্তন
     দূর থেকে মাহফিল
          দূর থেকে পাখি
                দূর থেকে মানুষ
দূর থেকে প্রেম
নদীও কিছুটা দূর সাবলীল
নদীর মুখোমুখি বসলে নিঃশেষ
                    ফুরিয়ে ফেলে আসরের সাধ।

কস্তুরিমুখ মানুষের আঙুলের চম্পায় 
এখন দূরের গান মসৃণ, 
দূরে থেকেই নৈকট্য দেয় তারারা, 
রাস্তায় নেমে চুপচাপ হারানো পথিক
দূরে গেলে সহজ ঝরনা
দূর থেকে দুঃখ হয়ে ঝরে ভোরের আজান
সবকিছুই একসময় হয়ে পড়ে দূরের পাহাড়
শোকার্ত সরসীবসন্তে উড়ে মগ্ন নীল বাকুম
উপমা রূপসী হলে রক্তিমে মেশে 
                     মাঘের মোনাজাত
                         আসলে কতো দূর?

বিষণ্ণ ট্রেন হোগলাবনে তার ছায়া ফেলে 
ছুটে যায় আলো ছেকে নেওয়া জংশনের দিকে
দূর থেকেই তার আরোহী সুন্দর সময়
কাছে এলে সমবায়ী পরিচয় সহসা ম্লান পক্ষী।

 

বিস্কুটের ছিদ্র দিয়ে দেখা দুনিয়া

তবু এ দেহের ঝঞ্ঝা, এ জন্মসাহসের কল্লোল আয়তন
পীত ফুলের রোমে দানা বেঁধে 
মৌনি পরিধি ডিঙ্গিয়ে চিত্রল বনে এসে পড়ি
মাটিতে কোপ দিয়ে দেখি রাতের চূর্ণ অনায়াস
জনদুঃখী কোন অস্তাচল নেমে এসে দেখছে স্থিতি
মাছ ও মসলার ঘ্রাণে পাড়াগুলো উঠেছে জেগে
                            পৃথিবী আবার কালের ছেনিতে
অপরিণত ভূগোল হয়ে ভেসে আছে মোহের মর্গে
বিস্কুট ফ্যাক্টরি থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি ময়দার ঘ্রাণ 
কে কার ব্যথার তাপ, আনন্দের প্রপাগান্ডা?

শহরে ট্রাক ঢুকে পড়ে, তার চাকার ওজন বুকে নিয়ে
ক্রমে চিহ্নের মুদ্রা জেগে ওঠে প্রাণের মুখশ্রীর ভেতর
কত অক্ষরের অর্থ মুখে নিয়েও শ্বাসের নেই নিজস্ব মানুষ 
কত সময় তন্তুর রূপ ধরে তৃপ্ত বসে থাকে পাথরের টান
একটা পাহাড় ঘুমিয়ে থাকে সময়ের মহিমা নিয়ে 
একটা শামুক টেনে নেয় গোটানো গোধূলির মায়া,
মাটিতে কোপ দিয়ে দেখি ছায়া প্রসারিত অপরূপ পলি
শ্রমিক মেয়েরা ফিরছে ঘরে শিশুকে স্তন দেবে বলে
ফ্যাক্টরির চিমনি দিয়ে তখনও উড়ে যায় ঋতুবৃত্তের ধারা।

 

নীল ঋতুর ঊর্ধ্বে

মানুষ কেন মরে যায়, হৃদয়ের ভাঙা টুকরো নিজেই সাজায় 
দেহের প্রাপণীয় মুকুটে তার আদি প্রত্যাশায় কাতর
                                              চোখের বল্লমে কাঁপা 
অরব চাঁদের নিচে অকস্মাৎ টুপ করে ডুবে যায় পাথর,
মানুষ বাঁচে, স্নান করে জ্যোৎস্নালিপ্ত সেই হরিণীর দুধে 
গা মুছে নর্তকীর বাজুর সুগন্ধী রুমাল 
জল পিয়ালির ধবল পেটে অঙ্কুরিত কুসুমে ঘুমিয়ে পড়ে 
                                              ঢেউয়ের কেশর, 
বাঁচে অজানাকে মুঠো করে, মিশে মনীষায়
নিজেকে নস্যাৎ করা আকাঙ্ক্ষার প্রিয় ক্ষতে 
বারবার চঞ্চু ছুঁইয়ে চৌচির করার শখ তার, 
হিম ছিঁড়ে জ্বলে ওঠে কিংবা আরেকটু বেশি
প্রজাতির কোষের চুল্লিতে চায় রূপান্তর।

মানুষ কেন মরে যায়, মন্দিরের ঘণ্টা বেজে স্থির হয়ে আসে 
সেইসব বাড়ির সিঁড়ি, মানুষ হেঁটে দাঁড়িয়েছিল যে দরজায়
মানুষটা বেঁচে নেই, বাড়িটাও ভেঙে ফেলা হয়েছে
যে নখে ঢেউ তুলে শখের মানুষ নামে প্রান্তরে—বিস্ময়ে
মাঘী বিকেলে নেভে, শরতের আরো দূর কোলাহল 
কোথায় গেলো সব জীবের শঙ্কিত মুখে
আজ চিহ্নহারা বাড়ি, মানুষেরও দৃষ্টিপথ উড়ে গেছে
উড়ে গিয়ে বসেছে কোড়াপাখির শ্রান্তির ঠোঁটের নিষ্ঠায়
মানুষ মরে যায়, হরিত পাথরে ঘুমন্ত গোলাপ স্বচ্ছ মেঘে 
                                 চলে যায় রঙিন দেশের দিকে
হায় মানুষ, তোমার সমাজ, সময়ের উদ্ধত কুহেলি
ক্রমাগত কাঁপে হাওয়ার নির্মোক বিচ্ছুরিত বিদ্যুতে অনিবার্য
তবু উৎসব চলে, মসজিদের গম্বুজে চমকায় ইস্পাতের চাঁদ
শঙ্খের খয়েরি স্তবে উদযাপনের শতাব্দী আছে পশ্চাতে পড়ে।