বিপুল বিষাদ ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-

 

|| অকাল বৈধব্যের ঘুণ ||

এ কুঁড়েঘর, তার ক্রন্দনভরা নুনে পোপামাছ রাঁধছি। তোমার প্রিয় রেসিপি। কোন সাগরের ওপারে ঘর করলে একা একা, হোগলার বেড়া, পরপুরুষ হয়ে ওঠে চাঁদ, ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়। জলের তলায় হা করে শুয়ে আছে মাছ। দেখতে পাচ্ছি, আরশিতে মুখ রেখে অকালপাকা চুল কালো করছ। কতখানি তীব্রতায় কেঁপে উঠছে তোমার শরীর এই ভোরবেলা! কতদিন দেখি না ঝোপের ভেতর তোমার জোনাকি জ্বলে ওঠা! তুমি সখা ছায়াকর, জিহ্বায় সাপ নাচিয়ে মজা পাও। আলো চিরে সারারাত বৃষ্টি ঝরার পর আমি বুঝি, এই তল্লাটে আমারও নিজস্ব কোনো বাহু নেই, যেখানে কান্নার দাগ না শুকানো অব্দি মাখামাখি থাকবে প্রেম। 
ঝড়ের প্রাবল্য বুকে শান্ত হয়ে বসে থাকি। দূরের আকাশ কাঁপে। গন্ধমেদুর রন্ধনশালা। মনে হয় নিজেকেই রান্না করে রেখেছি তেলঝালনুনে। সকলের পাতে পাতে বেড়ে দিচ্ছি নিজেরই মাংস।

প্রতিটি সন্ধ্যায় মন খারাপ হবে 
মনে হবে একা একা ভালো লাগছে না
মনে হবে এভাবে বাঁচা যায় না 
মনে হবে কেউ থাকলে একটু গল্প করা যেতো 

তারপর অন্ধকার ঠেলে জানালার দিকে চোখ যাবে
মনে হবে—যদি কেউ কিছু ভাবে! 
দ্রুত জানালা থেকে সরে যাবার আগে
মনে হবে—আগের দিনটা ভালো ছিল
বন্ধুরা বন্ধু ছিল, ঘর ঘর ছিল—প্রেমিকও প্রেমিক ছিল
এসব ভেবে অন্ধকার আরও অন্ধকার হয়ে উঠবে
পাখির পালকের ভাঁজ খুলে রাত এগিয়ে আসতে চাইবে

মনে হবে আর বেঁচে থাকা সম্ভব না
কাউকে দরকার, কিন্তু কাকে দরকার জানা যাবে না
মনে হবে মাথার মধ্যে পেরেক ঠুকি
নিজের গায়ে বোমা মারি

মনে হবে—মরে যাবার আগে আরও একবার সর্বাঙ্গে বাঁচি...

সকাল চুপচাপ—বিকেল মন্থর  
রাতের বাসগুলো প্রবল ছুটে যায়
কোথায় যায় তারা? অলীক মানুষেরা
বাসের পেটে করে কার যে দরগায়!

আকাশে জ্বলে ওঠে মেঘের ঝাড়বাতি 
ফলতঃ ভুল নয় বৃষ্টি ভাবনাও
গুনছি খেসারত লাশের জেয়ারত 
তর্কে ভরে ওঠা বোধের শঙ্কাও

রাত্রি ধোয়া চাঁদ, অধিক নাগরিক 
হাসতে ভুলে যায় তিক্ত হতাশায়
জীবন ফেড়েওঠা মৃত্যু বিষফোঁড়া 
লালন করে যাই—ব্যথা ও বেদনায়

কৃপার শেষ হবে! যেখানে ভালোবাসা 
দাঁড়াবে নীচুস্বরে পাহাড় জঙ্ঘায়
প্রণয় বিক্ষত আলোর তরজমা 
নিভিয়ে মোমবাতি তারারা গান গায়...

 

|| সখা হে ||

একটু শাসনে রেখে তুমি দিতে যদি—সামান্য আদর—
কী এমন হ'তো!
আমি কি বখে যেতাম? জীবনটা খুলে দিতাম জুয়ার আসরে?
চোরা হাওয়া আমাকে টলিয়ে দেয় মাঝে মাঝে 
কী যেন হয়! কাকে সন্দেহ করি?
রূপকথার দৈত্য এসে দু'হাতে খুবলে নেয় চোখ 
একটানে খুলে দেয় বুকের সমস্ত বোতাম
টেনে আনে থকথকে উন্মাদনা 
যেন এই বেঁচে থাকা এক গাঢ়-দুর্ঘটনা 

জন্মান্ধের মতো রাত এলে একটা সহজ মোমবাতি 
তুমি জ্বেলে দিতে পারতে শিয়রে 
নিরাবেগ পাথর তোমার বুকে ঝনঝন বাজে
সেই শব্দে ঘুমাতে পারি না!

এখন অনেক রাত জড়ো হয়ে গেছে।
করে চলছে পাথর-প্রণাম 
এখন অনেক অন্ধকার—দাঁত খুলে রাখে ভয়

অনিদ্রার অট্টহাসি বীজক্ষেত ছড়াল শরীরে 
কুহক নদী, বিপুল তরঙ্গ রে...
এই দুঃখবাদ, শৃঙ্গার শ্রীখোলে
আমি লিখছি তোমাকে—সখা হে!

 

|| আত্ম-প্রণোদনা ||

রক্ত জল হয়ে গড়াবার আগে এই যে পেটেব্যথা—কাউকে বলো না আর। বলো না লিগামেন্টে টান লাগার কথা। মৃত্যুর বুক ছুঁয়ে প্রশ্বাসের অস্তিত্ব হাতে নিয়ে যে তুমি ঘুমিয়ে পড়, তাকে তুমি জীবন বলে মানো। পায়ের পাতা যেভাবে তোমার গোড়ালি আগলে রাখে, তুমিও আগলে রেখো তোমাকে সেভাবে। 

হাত পেতো না। মন পেতো না। কেবল বুক পেতে নাও অসীম ঝঞ্ঝা।

 

|| বিপুল বিষাদ ||

অনেকগুলো শালিক বসেছিল রাস্তায়। তুমি বললে—অনেক শালিকে কী হয়? বললাম—অনেক আনন্দ। আর তখনই আমাদের যুগল আনন্দ পথে পথে পাতা হয়ে গেল। ঠোঁটে নাচছিল ঘাসফড়িং। তুমি আপ্লূত, যেন প্রথম গড়ে তোলা বাড়ি, একটা একটা ইট গাথা হচ্ছে। তারপর ছাদ হবে, রং হবে, আলো হবে, হবে সোনার সংসার। সন্তান থাকবে। অথবা না-ও থাকতে পারে। ঘরে-উঠানে অলীক শিশুদের ছায়া ঝিরঝির করবে। গাছের নামে হবে না-থাকা সন্তানের নাম। 
আমরা জানি, এই শব্দময় পৃথিবীতে শালিকেরা বসে না বেশিক্ষণ। উড়ে যাবে দূরে, দল ছেড়ে দলের সমীপে। আনন্দও ফুরিয়ে যাবে। উচাটন হবে ঘরহীন ঘরমুখো মন। আমাদের যৌথনামে যেভাবে বেড়ে ওঠে দূরত্ব, জিঘাংসা যেভাবে গড়ে বালির আবাদ, ঠিক সেইভাবে আমরা ভূমিষ্ট হবো মানুষের ভুল তরিকায়।

তোমাকে মেঘের কথা বলি, বৃষ্টিভাষা—চাঁদগান
নদীর গলার স্বরে রাতভোর শরীর স্লোগান 
তোমাকে বলেছি—পাখি কত কথা রেখে গেছে চোখে!
দুপুর ছাড়িয়ে দূরে, কলিজার আগুন মৌচাকে 
ঢেলে দিল যে, ত্রিভঙ্গ কৃষ্ণ সে তো নয়! জোনাকির 
ডাকঘরে জমা নেই কোনো চিঠি এই অভাবীর 

তোমাকে বলেছি—প্রেম কতভাবে চলে আসে ঘরে!
কাজল চোখের পাতা কেঁপে ওঠে ধুলার বাসরে 
তারপর পথ বেঁকে যায়! ঝরে বৃন্তচ্যুত ফল
কেন্দ্রবিন্দু ছেড়ে কথা নির্নিমেষ জাগায় গরল

অভিভাজ্য সূর্যতলে আমাদের স্মৃতিজীর্ণ রুহ
সকল স্বীকার করে বেঁচে থাকে, যেন মহীরুহ 
যদি দেখা হয়, ফের, অস্তগত দিনে—কখনোও
দেখবে জ্বলছি একা, পাশে এসে তুমিও জ্বলিয়ো

 

|| যেভাবে বেঁচে থাকা নিজের হয়ে ওঠে ||

যাদের প্রেমিক আছে 
তারা জানে—সব ঠিকঠাক হয় না কখনো 
সব দিন কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি হয় না
সব দিন ঝগড়া হয় না
কিছু দিন যায় ফাঁকা আর শূন্যতায়

মন কেমন করা ক্ষণে 
মরে যাবার সহজ পদ্ধতিগুলো ভেবে
যদি মৃত্যুও সহজ না হয়ে ওঠে 
যখন মনে হয়—একটু সে ডাক দিক!
সেসব সময়গুলোতে 
পরস্পরকে মনে না পড়লেও
কিছুই করার থাকে না!

কোনও কোনও সন্ধ্যার বিষমাখা মুখ
ধোঁয়াটে নক্ষত্রে ভেসে ওঠা প্রথম চুম্বন 
ক্ষয়িষ্ণু পাঁজরের নিবিড় আলিঙ্গন
মনে পড়ে—
বয়সের অহমিকা ভুলে বলা হয় না—
যদি ভালোবাসো, একটু টান দাও! 

সব দিন ভাঙতে ইচ্ছে করে না
এমনকি গড়তেও না
আধভাঙা প্রেমে থাকা ও না-থাকার ভেতর 
প্রেমিক জানে না আমি আছি
আমিও জানি না আছে, সে-ও

শুধু জানি
কোনও কোনও দিন কিছুই না হয়েওঠা ভয়ের
সকল মাধুর্য হারিয়ে ফুরিয়ে যাওয়ার আগে হৃদয় নীরব হয়ে ওঠে।