চোষ্য চর্ব্য [পঞ্চদশ পর্ব]
পড়ুন ► চোষ্য চর্ব্য [চতুর্দশ পর্ব]
চোষ্য চর্ব্য [পঞ্চদশ পর্ব]
নাশিতা বাসা থেকে বের হল। ভাওয়াল চেয়ারম্যান সন্ধ্যায় ‘গুলশান এলিট ক্লাবে’ মিটিং ডেকেছেন। ফিঙ্গেবাড়ি যেতে চান তিনি। যাবার আগে কিছু বিষয় আলোচনা করবেন।
গুলশান দুই নম্বর গোল চত্বর থেকে কামাল এভিনিউ দিয়ে যেতে হবে। পশ্চিম দিকে একটু এগিয়ে গেলে বনানী লেকের কাছে এই ক্লাব। সাড়ে চার বিঘা জমির ওপর ব্যাপক আয়োজন। ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা জবরজং গুদাম মনে হয় বটে বাইরে থেকে।
নাশিতা কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, ‘এই ক্লাবের ক্যাফেতে আটাশ রকম আইসক্রিম আছে। তেষট্টি রকম স্ন্যাকস আছে আর ষোল রকম চা-কফি।’
‘ওহ! এরা এত গরিব তা ত জানতাম না!’ শিমুলের আমোদিত কণ্ঠ।
মিটিংটা তরুণ মেধাবীদের নিয়ে। তরুণদের সঙ্গে চেয়ারম্যান সাধারণত ফাইভ স্টারে বসেন। তাতে তারা বিশেষ আমোদিত হয়। আজ ফাইভ স্টারের বদলে এই ক্লাব। এখানে তারা আরো বেশি আমোদিত হবে বলে চেয়ারম্যানের ধারণা।
নাশিতা ছাড়া অন্য জুনিয়ররা আজই এখানে প্রথম। তারা ফিঙ্গেবাড়ির পরিস্থিতি কিভাবে দেখছে সেসব বুঝতে চান চেয়ারম্যান। প্রবীণদের ভাবনা তিনি আগেই জানেন। তবু তাদের সঙ্গে সকালে অফিসে বসেছিলেন।
ক্লাব চত্বরে পা দিয়েই কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন চেয়ারম্যান।
চৌত্রিশ বছর আগে গুলশানের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি ব্যাপক চেষ্টা-তদবির করে একটা প্লট ম্যানেজ করে এই ক্লাব গড়ে তোলেন। গুলশান-বনানী-বারিধারার স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য। এখন বিভিন্ন খাতের উচ্চপর্যায়ের নেতারাও সদস্য হতে পারে। হবার জন্য উদগ্রীব তারা অনেকে।
তরুণ চেয়ারম্যান ছিলেন প্রথম দিকের সদস্য। আগে নিয়মিত আসতেন। এখন আসেন মাঝে মাঝে। যদিও এর স্লোগান আগের মতই আছে: বাড়ির বাইরে আরেকটা বাড়ি।
সবার জন্য আছে গ্রন্থাগার পুল, জিম, সেলুন ও লনড্রি। আছে জ্যাকুজি ও ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থা। বিলিয়ার্ড অ্যান্ড স্নুকার, কোলেজিয়াম, টেনিস কমপ্লেক্স, স্কোয়াশ কোর্ট, ইত্যাদি।
রয়েছে কাঠের ডান্স ফ্লোরসহ সুদৃশ্য সাজে সাজানো দুটি বড় হল। সদস্যদের অতিথিদের জন্য আছে অতিথিশালা। অতিথিরা আসে বহু দেশ থেকে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ গোটা দশেক দেশের ত্রিশটা অ্যাফিলিয়েট ক্লাব থেকে। এসব ক্লাবের বেশির ভাগই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের। অ্যাফিলিয়েট ক্লাবের সদস্যরা পাঁচতারা হোটেলের অর্ধেকের কম খরচে প্রায় পাঁচ তারার মত খাওয়া-থাকার সুবিধা ভোগ করে।
পানশালায় আছে বড় রকম সংগ্রহ আর তিন-চারটা রেস্তোরাঁয় যেমন চাই তেমনি খাবার।
চেয়ারম্যান তরুণ মেধাবীদের নিয়ে গেলেন দাম্ভিক মেজাজের ভিন্টেজ রেস্টুরেন্টে। এটা তরুণদের মনে বিরাটত্বের বোধ জাগাতে পারে বলে মনে করেন চেয়ারম্যান। ফুরফুরে মেজাজের কামিনি রেস্তোরাঁ বা অ্যাম্বার আর্ট অ্যান্ড জুস বার বা ফুলবাগানের সামনে ক্যাফে আছে রিল্যাক্সের জন্য। ওসব জায়গায় চেয়ারম্যান সস্ত্রীক বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে বসেন।
নাশিতা একটা ভারি বাদামি চেয়ারে মুখ ভার করে বসল। সামনে সাদা কাপড়ে ঢাকা লম্বা-চওড়া টেবিলে চতুর্ভুজ আকারের থালাবাটি, ছুরি-চামচ আর বড় বড় কাচের গবলেট। আছে পানির বোতল, ভাঁজ করা ত্রিভুজ আকার টিস্যু পেপার। কিন্তু নাশিতা এই মিটিংয়ের কোনো তাল পাচ্ছে না। চেয়ারম্যান আসলে কী বুঝতে চান? এতগুলো ছোকরা-পোলাপান ডেকে আনার মানে কী? তাদের মধ্যে একটা মেয়েও আছে দেখা যাচ্ছে যে স্রেফ একটা গবেট। চেয়ারম্যানকে সে হোটেল ব্যবসায় নামাতে চায়। যে ব্যবসাগুলো আছে সেগুলোই ঠিকমত চালাতে পারছে না—। নাশিতা গভীর দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে রাখল।
চেয়ারম্যান বললেন, ‘ফিঙ্গেবাড়িতে চার-পাঁচ বছর ধরে উত্তেজনা বাড়ছে। তিন-চার দিন ধরে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। ওই এলাকার ছোট পোশাক ব্যবসায়ীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছে।’
সবাইকে তাদের পর্যবেক্ষণসহ করণীয় বাতলাতে বললেন চেয়ারম্যান। পোশাকের তুলনায় অন্যান্য খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত কিনা তাও জানতে চান তিনি।
একজন বলল, ‘ফিঙ্গেবাড়ির চাঁদাবাজরা প্যাঁচ দিয়ে ব্যবসায়ীদের চাপে ফেলার চেষ্টা করছে। আর পুলিশও খুব আলসেমি করছে। আগামী কাল পুলিশমন্ত্রী সেখানে যাচ্ছেন যে—। সমাধান হয়ে যাবে আশা করা যায়।’
কয়েকটা উদাহরণ টেনে সে এর ব্যাখ্যা দিল।
ব্যবসা বাড়ানো প্রসঙ্গে বলল, আপাতত পোশাক খাতই সেরা। সস্তা শ্রমিক, কর ছাড়সহ নানা বিষয়ে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা দিল।
‘পোশাক খাতে সারা দুনিয়ায় প্রথম দুই-চারটা দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এসে যাচ্ছে! বাংলাদেশকে আমরা এক নম্বরে দেখতে চাই!’
‘ভাওয়াল কী করবে যা এখনও শুরু করেনি?’
‘আমাদের পোশাক কারখানার জন্য আমাদের যতটুকু কাপড় দরকার হয় তার দুই-তৃতীয়ংশ আমরা অন্যদের টেক্সটাইল মিল থেকে কিনে আনি। পুরোটা কেন আমরা উৎপাদন করছি না? আমাদের টেক্সটাইল মিলের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যে মূলধন দরকার তা আমরা খুব সহজেই পুঁজিবাজার থেকে তুলতে পারি। বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সবচেয়ে বেশি কম্পানি টেক্সটাইল।’
‘টেক্সটাইলঅলারা ত বছরের পর বছর লোকসান খেয়ে চলেছে। শেয়ারহোল্ডারদের অনেক বছর পরপর ভিক্কের মত একটু লভ্যাংশ দেয়। অনেকে ত যুগ যুগ ধরে দেয় না।’
‘এই টেক্সটাইলঅলারা নিজেদের পোশাক কারখানায় কম দামে কাপড় বেচে দেয় বলে আমার মনে হয়েছে। আরো নানা কায়দায় ব্যয় দেখিয়ে টাকা তুলে নেয় আর লোকসান দেখায়। তাছাড়া অনেকের কারখানা আছে নামমাত্র। তারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিল পুঁজিবাজার থেকে। সেই টাকা তারা বিদেশে পাচার করেছে। অন্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে। তবে হাতেগোনা দুই-একটা সৎও আছে। তারা অনেক লাভ করছে। শেয়ারহোল্ডারদের বুঝিয়ে দিচ্ছে।’
দুই পরিচারক ট্রেতে সাজিয়ে কাচের গ্লাসে আপেল জুস, আনার জুস, ইত্যাদি নিয়ে আসল। আর দুইজন আনল কয়েক পদের খাবার-দাবার। জনা দশেক তরুণ মেধাবী দইয়ের মত সসে পপকর্ন চিকেন ডুবিয়ে নিয়ে কুড়মুড় করে লেকচার শুরু করল। কোনো কোনো লেকচার নিয়ে মাঝে মাঝে আলোচনা।
প্রথম দিকে তারা বাংলিশ বলছিল। পরে সবাই ব্রিটিশ স্বরভঙ্গিতে সম্পূর্ণ ইংলিশ শুরু করলে চেয়ারম্যান বেশ বিরক্ত হলেন। ব্রিটিশ স্বরভঙ্গিতে অপরিচিত শব্দ তিনি প্রায়ই ধরতে পারেন না।
নাকের ওপর দিয়ে তাকালেন চেয়ারম্যান। ইচ্ছে করছে এখনই শক্ত করে ধমকে দিতে, ‘এখন থেকে ইংরেজি বলা নিষেধ!’
চেয়ারম্যান দমে গেলেন। মেধাবীদের খুঁজে আনা মোটেও সহজ কাজ না। এই মেধাবীরা ভাওয়ালের আগেও বড় বড় প্রতিষ্ঠানে ছিল। চেয়ারম্যান তাদের দিয়ে নতুন যুগ শুরু করতে চান। তা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে।
তাদের লেকচার শুনতে শুনতে নাশিতার ঘুম এসে গেল। এসব লেকচার তার কাজের মনে হচ্ছে না। ঘুম ঠেকাতে সে বাম্বু পিক দিয়ে এক টুকরো বাইট-সাইজ চিকেন তুলে নেয়। কিন্তু অতিরিক্ত খাবারে তার রীতিমত অ্যালার্জি আছে। খানিক চিন্তা করে সে ইংরেজি অক্ষরে ‘আরইএনজিও’ লিখে নেটে সার্চ করে। আরইএনজিও হল জাপানিজ ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন। তারপর ‘লেবার আনরেস্ট ইন জাপান’ ‘জার্মান…’ ‘ট্রেড ইউনিয়ন ইন…’ ইত্যাদি সার্চ করতে লাগল। এসব তার আগেও ভাল করে পড়া আছে বটে।
চেয়ারম্যান নাশিতার দিকে তাকালেন। ‘আপনি জুনিয়র দলেও আছেন সিনিয়র দলেও আছেন,’ মৃদু হেসে বললেন চেয়ারম্যান।
নাশিতা এতক্ষণ ছোকরাগুলাকে শায়েস্তা করার উপায় খুঁজছিল। চেয়ারম্যানের কথায় তাজা হয়ে উঠল।
‘আমরা কেন সব সময় শ্রমিক অসন্তোষ মোকাবিল করি? এর কারণ সম্পর্কে কেউ কিছু বলেননি। কেউ যদি এ বিষয়ে একটু কিছু বলেন!’
সবারই পর্যবেক্ষণ আছে বলে তারা মনে করে।
তারা বলল ‘শ্রমিকদের মধ্যে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা নেই বললেই চলে’ ‘একটু কিছু হতে-না-হতে হাত-পা গুটিয়ে নেয়’ ‘যে কারখানা থেকে রুটিরুজি হয় সেখানে ভাঙচুর দেখে বিস্মিত হতে হয়’ ‘শ্রম সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি’ ইত্যাদি।
‘ত এ অবস্থায় আমাদের এখন কী করতে হবে? প্রথম পদক্ষেপটা কী হবে? সাফাউল যদি একটু বলেন!’
নাশিতা ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠল। ব্যবসা পরিকল্পনা বিভাগের ছোকরাটা এখনই ধরা খাবে ভেবে তার মনে সুখ হয়।
ছোকরাটা বলল, ‘এটা ত বিরাট কাজ। সরকারি কাজ। একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এত বড় পরিসরে কাজ করতে পারে না।’
‘তাহলে আমাদের ব্যবসা কিভাবে নিরাপদ হবে? কিভাবে নির্বিঘ্ন হবে?’
‘রাজনীতি ঠিক না হলে—। আমরা পুলিশকে চাপ দিতে পারি। আমাদের হাতে মিডিয়া আছে। মিডিয়াকে আমরা কাজে লাগাতে পারি।’
কিন্তু অন্যদের ওপর নির্ভর করে ব্যবসা দাঁড়াতে পারে না। আবার রাজনীতি ঠিক নেই বলে সারাজীবন নাস্তানাবুদ হতেও রাজি না চেয়ারম্যান। তিনি মেধাবীদের কথায় বেশ হতাশ হলেন। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না।
নাশিতা বলল, ‘এ অবস্থায় ট্রেড ইউনিয়ন কি কিছু করতে পারে?’
সবাই হাই হাই করে ওঠে। নাশিতার মাথামুণ্ডু নিয়েও অনেকে হাসি লুকিয়ে রাখে। ট্রেড ইউনিয়নের অনুমতি দিলে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে যাবে, বলে তারা।
‘তাহলে আমরা কি চিরকাল শ্রম বিক্রি করব নাকি? ক্রীতদাসদের মত শ্রমিক দিয়েই কি আমাদের চিরকাল চলতে হবে?’
সবাই চুপ। শুধু চেয়ারম্যান কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে বসেন। নাশিতার বুকের ভেতর দুরুদুরু করে ওঠে। সে জানে প্রথম জীবনে চেয়ারম্যান আদম পাচার করতেন। পরে পোশাক কারখানা দেন। একাত্তরের এক দশক পরে যখন ঢাকায়-চাটগাঁয় রপ্তানিমুখী এসব কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করে। চেয়ারম্যান প্রথম কারখানাটা দেন এই গুলশানেই। সে যুগে ঢাকা শহরজুড়ে কারখানা গড়ে ওঠে। ভুখা-নাঙ্গার দেশে তখন শ্রমের দাম নামমাত্র আর পোশাক তৈরির বিল ইউরোপ-আমেরিকার মান বিচারে। মোট বিলের ত্রিশ শতাংশের কম খরচ হয়েছে বেশির ভাগ চালানে। এমনকি বিশ শতাংশের কমে কাজ শেষ করার নজির রয়েছে। সবার বেতন ও কাপড়চোপড় কেনার খরচসহ।
এক দশক পোশাক ব্যবসার পর অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ শুরু করেন চেয়ারম্যান। সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে সবকিছু থমকে আছে। আদম পাচারের গন্ধটা পুরোপুরি কাটছে না আবার ব্যবসাটা ভালমত বাড়ছে না। চেয়ারম্যান বুঝতে পারছেন তিনি বুদ্ধির সীমায় আটকা পড়েছেন। তাই নবীন-প্রবীণ অনেক মেধাবীকে নিয়োগ দিচ্ছেন। কিন্তু তারা ছকে বাঁধা দাপ্তরিক কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায়। নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আছে এমন কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন চেয়ারম্যান।
নাশিতা কিঞ্চিৎ চিন্তা করে আরো সাহসী হয়ে উঠল, ‘শ্রমিকদের যদি দরকষাকষি করার ক্ষমতা থাকে—আমরা সবাই বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটরা কেন তা মোকাবিলা করতে পারব না? আমাদের সংকট কোথায়?’
সবাই চুপ।
নাশিতা বলল, ‘ট্রেড ইউনিয়নের সুবিধা হচ্ছে—শ্রমিকদের শাসন করার জন্য, পরিচালনার জন্য শ্রমিকনেতারাই বেটার। তাতে আমাদের মাথ্যব্যথা কমে যাবার কথা।’
‘সরকারি পাটকল-চিনিকলের মত বিশৃঙ্খল হয়ে যায় যদি?’
‘সরকারের কথা কেন বলছেন? মূর্খ সরকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মূর্খ আমলাদের বসায়। যাদের ব্যবসায়িক কাণ্ডজ্ঞান বলতে কিছু নেই। আপনি টাটা ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের কথা কেন বলছেন না যাকে বলা হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল হারমোনির জন্য রোল মডেল? কেন বলা হয়?’
সবাই কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে থাকল। তারপর শুধু ব্যবসা পরিকল্পনা বিভাগের ছোকরাটা মি-মি করে বলল, ‘কোথায় ইন্দিরা গান্দি আর কোথায় কলার কান্দি! আমাদের বাস্তবতার কথা আমাদের মনে রাখা দরকার না?’
‘টাটার ইউনিয়ন কি আকাশ থেকে পড়েছে? ভারত-বাংলাদেশের মানুষ মোটামুটি একই। এক সময়ের জাপানিজদের সঙ্গে তার অনেক মিল রয়েছে। এখনও আছে বৈকি। সেই বিবেচনায় আমরা যেকোনো বাস্তবতা তৈরির ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছি বলে আমার মনে হয়।’
সবাই চুপ।
নাশিতা যুক্তি দেখায়, ‘রাজনীতির চাঁদাবাজদের শায়েস্তা করার জন্যও ট্রেড ইউনিয়ন কাজে লাগবে। আমি যদ্দূর জানতে পেরেছি, চাঁদার অংকে টান পড়লে রাজনীতির লোকজন শ্রমিকদের উস্কে দেয়।’
‘রাজনীতির নেতাদের সাথে ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের বন্ধুত্ব হয়ে যাবে।’
‘বন্ধুত্ব এখনই আছে। ট্রেড ইউনিয়ন হলে বরং শত্রুতা তৈরি হবে। তাছাড়া আমরা শ্রমিকনেতাদের মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকব না। এই নেতারা আমাদের নির্দেশনায় কাজ করে খুশি হবে। নির্দেশনা সেভাবেই হতে হবে। এটা স্লেভ যুগ না তা মনে রাখতে হবে। সময় বদলেছে। রাজনীতির লোকদের আমরা যে পরিমাণ চাঁদা দিই তার চাইতে অনেক কম খরচ হবে ট্রেড ইউনিয়নের পেছনে। এই প্রক্রিয়ায় শ্রমিকরা একটা বিরাট বাহিনীর মত শক্তি হয়ে দাঁড়াবে। তাদের আমরা নানাভাবে কাজে লাগাতে পারব। তাতে করে এলাকার নষ্ট রাজনীতি আর দুষ্টু লোকেরাও সুষ্ঠু হয়ে উঠবে সেই আশা করাই যায়। শ্রমিকদের রাস্তায় নামা দেখে আমাদের লজ্জা পাওয়া উচিত।’
‘ব্যাপারটা বেশি জটিল হয়ে যাবে না?’
‘জটিলতা মানে কী?’
সবাই চুপ।
জটিলতা বলতে কিছু আছে বলে নাশিতা মনে করে না। মিটিংয়ে আসা অন্য সবাইও তা জানে বটে।
নাশিতা বলল, ‘দরকার হলে ট্রেড ইউনিয়ন তদারকের জন্য করপোরেট অফিসে আলাদা শাখা থাকবে। এই শাখা প্রত্যেক স্টাফকে ভাওয়ালের অবধারিত অঙ্গ করে তুলবে। সবাই যেন ভাওয়ালকে আপন মনে করে সেজন্য কাজ করবে। কাজের পরিবেশ ভাল রাখার জন্য এটা আবশ্যক মনে হচ্ছে। এখন কোথাও সমস্যা হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বাতাসের মত কাজ করে। আমার মনে হচ্ছে কয়েক বছর আগে এই মাধ্যমটা আসার পর থেকে কারখানা এলাকায় আন্দোলন ভাল করে দানা বাঁধতে পারছে।’
চেয়ারম্যান বেশ পুলকিত হলেন নাশিতার পর্যবেক্ষণে।
অন্যরা কিছু বলল না। ট্রেড ইউনিয়নে তাদের আস্থা নেই। আবার এখন চেয়ারম্যানের সামনে নেতিবাচক কিছু বলা যাবে না। সহজ কোনো পথও তারা দেখতে পাচ্ছে না। তাদের বরং নাশিতার ওপর রাগ হয়। তাকে তাদের আগের চাইতে বেশি বিপজ্জনক মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রধান পারফরমেন্স অ্যানালিস্ট হিসেবে নাশিতা এসব পরামর্শ তাদের কাছে চাইতে পারে।
তাহলে ভাল কিছু বলতে না পারলে আপাতত চুপ থাকাই ভাল। এবং টার্টার সস দিয়ে মাছের বড়া খাওয়া যেতে পারে। ডিমের কুসুম, জলপাই, লেবুর রস, ঝাল, লবণ ইত্যাদি দিয়ে বানানো সাদাটে ক্রিমি সস আর ব্লক করে কাটা কড মাছে ঘি স্প্রে করে পাউরুটির গুঁড়োয় ডুবিয়ে নিয়ে বেক করা বড়া। বাম্বু পিক দিয়ে খুঁচিয়ে ধরে তুলতে হবে যাতে হাতে না মাখে।
তবে নাশিতা তাদের চুপ থাকতে দিল না, ‘আমি আমার শ্রমিকদের সবচাইতে বেশি বেতন দিতে চাই। আমার কম্পাউন্ডে টুঁ শব্দটি শুনতে চাই না। কী উপায়? যেভাবেই হোক এটা আমি চাই। কেউ কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছেন?’
সবাই চট করে বলল, সম্ভব।
চেয়ারম্যান অবাক হলেন। সবাই আত্মবিশ্বাসী হল কিভাবে? তাহলে এতক্ষণ তারা শ্রমিক অসন্তোষ দূর করার পথ দেখতে পাচ্ছিল না কেন? প্রশ্নটা করি করি করেও করলেন না চেয়ারম্যান। আধুনিক ব্যবসাশাস্ত্র সম্পর্কে তার ভাল ধারণা নেই।
ব্যাপারটা আসলে এই, এতক্ষণ তারা অন্য অনেকের মধ্যে থেকে সবার মত গড়ে চিন্তা করছিল। ‘সবচেয়ে বেশি বেতন’ প্রসঙ্গে সবাইকে ছাড়িয়ে দাঁড়ানোর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব-সূত্র মনে পড়ল।
চেয়ারম্যান এই মিটিংটা তিন দিন পরপর চালিয়ে নিতে বললেন। তিনি নিজে ইদানীং আর তেমন কোনো সিদ্ধান্ত দেন না। শুধু একটু পরামর্শ দেন। তারপর সিইও পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেন।
পরিচারকরা চার-পাঁচ রকম আইসক্রিম নিয়ে আসল। ক্লাসিক ভ্যানিলা। বেলিসিমো মোচা। বাটার স্কচ ক্যারামেল। ইত্যাদি।
খেতে খেতে আরো বিভিন্ন বিষয় আলোচনা হয়।
চেয়ারম্যান কালো কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, ‘আমি আমার সময়ে অনেক করেছি। এখন আপনাদের সময়। পারলে টিকবেন। না পারলে শেষ!’
কী শেষ তা আর ব্যাখ্যা করলেন না চেয়ারম্যান। যার যেমন ইচ্ছা বুঝুক।
সবাইকে বিদায় করে চেয়ারম্যান লাউঞ্জের দিকে গেলেন। ফিঙ্গেবাড়ি নিয়ে অন্য ব্যবসায়ীরা কে কী ভাবছে জানা দরকার।
চেয়ারম্যানকে দেখে জুনিয়র বন্ধুরা যেন বিশেষ আমোদিত হয়। সবারই বিভিন্ন রকম ব্যবসা রয়েছে। তাছাড়া ফিঙ্গেবাড়ি, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরে রয়েছে তাদের পোশাক কারখানা।
একজন বলল, ‘ওহো! মোগল যে!’
আরেকজন বলল, ‘উয়াউ! আপনাকে অনেক দিন দেখি না, মোগল!’
চেয়ারম্যান খুব খুশি হলেন। মোগল শুনতে ভাল লাগে।
অন্যদেরও নানা রকম উপাধি রয়েছে। শিল্পপতি, ব্যারোন, ফাইন্যান্সার, ইত্যাদি।
চেয়ারম্যান বললেন, ‘তোমরা শালারা খুব বজ্জাত আছো। সামনে বলো মোগল আর পেছনে বলো ফ্যাট ক্যাট!’
বন্ধুরা হোহো হাহা করল।
ফাইন্যান্সার বলল, ‘আপনি যে গোয়েন্দা এজেন্সিতে বিনিয়োগ করেছেন তা আপনার মুখেই প্রথম শুনলাম, মোগল! এখন থেকে সাবধান হয়ে যাব।’
চেয়ারম্যান ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত সাড়ে বারটা।
সবাই কিছুক্ষণের মধ্যে উঠে পড়ল।
‘মোগল! চলেন, হাঁটি।’
‘তা ভাল বলেছ। অনেক দিন রাতের ঢাকায় হাঁটি না।’
বন্ধুদের বাড়ি গুলশান-বনানী-বারিধারা। তিনজন থাকে নিজেদের দোতালা বাড়িতে। অন্য চারজনের রয়েছে বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি। তাদের দুইজন ঋণ নিয়ে করেছে সেই বাড়ি। আরেকজন গেছে আবাসন কম্পানিতে অংশীদারিতে।
বনানী-বারিধারার তিন বন্ধু গাড়িতে করে চলে গেল। গুলশানের বন্ধুরা হাঁটতে হাঁটতে দুই নম্বর গোল চত্বর। তাদের পেছন পেছন তাদের গাড়ি আর দলে দলে নিরাপত্তাকর্মীরা।
আশপাশে প্রায় সব ভবনের বাতি নিভে গেছে। রাস্তায় সুনশান নীরবতা। কিছুক্ষণ পরপর দুএকটা ব্যক্তিগত গাড়ি যাচ্ছে।
ফাইন্যান্সার বলল, ‘আধুনিক শহরের হাল দেখেছেন, মোগল? সন্ধে লাগতে না লাগতে মনে হচ্ছে যেন সবাই প্রাচীন যুগে ফিরে গেছে।’
‘ঠিক বলেছ। মহাখালীর বাস টার্মিনালটাকে শাহাবুদ্দিন পার্কে এনে বসানো উচিত। ওখানে নয় একর জায়গায় ভাল জমজমাট হবে।’
‘ওওহ! আমি ভেবেছিলাম আপনি এখানে লাস ভেগাস বানাতে বলবেন। আর আমরা হৈচৈ করে নেমে পড়ব।’
লাস ভেগাস আমেরিকার এক প্রাণবন্ত শহর। সব ধরনের আমোদ-আয়োজন নিয়ে পৃথিবীর স্বর্গ যেন। সেই স্বর্গে চাইলে নরকের হতাশাও ভোগ করা যায়। অনেকে তা করেও বটে। ডিস্কো ক্লাবের জন্য বিশিষ্ট। চব্বিশ ঘণ্টা জেগে থাকে প্রতি দুই হাজার খদ্দেরের জন্য একটি করে পানশালা। প্রতি চার হাজারের জন্য আছে একটি ক্যাসিনো। আর হোটেল রেস্তোরাঁ ত আছেই। ধনী পর্যটকদের আকর্ষণের তালিকায় রয়েছে ওপরের দিকে। তাদের জন্য বিদ্যুতের আলো আর রঙের ঝলকে সব সময় প্রস্তুত থাকে সব ধরনের আরাম-ভোগের জিনিস।
চেয়ারম্যান মুখ ভার করলেন। গুলশানকে তিনি শান্ত শান্তির নীড় বানাতে চান। সেজন্য কাজ করছেন তারা অনেকে। কাজটা কঠিনতম মনে হচ্ছে। এখনও অনেক রাস্তার পাশ দিয়ে ধুলো-ময়লা জমে থাকে। বর্জ্য ফেলে রাখে কেউ কেউ। মাথার ওপর নেটের তার, টিভির তার জঞ্জাল হয়ে আছে কিছু রাস্তায়। বাড়ির সীমানা প্রাচিল ঘেঁষে মুক্ত নর্দমা আছে দুচার জায়গায়। গা ঘিন ঘিন করা ফেরিঅলারা চায়ের কেটলি হাতে ঘুরে বেড়ায় কোথাও কোথাও। রিকশা ত আছেই।
‘রাস্তার পরিচ্ছন্নতা’ এখানে এখনও দামি পণ্য হয়ে উঠতে পারেনি। বিক্রয়কর্মীদেরও বিশেষ আগ্রহ নেই। থাকলে এতদিন বিক্রি হয়ে যেত। যেমন বিক্রি হতে শুরু করেছে থাকার ঘর আর বসার ঘরের আলাদা নকশা। শিশুদের ঘর এক রকম হলে তরুণদের জন্য অন্য রকম। ইত্যাদি।
বিক্রয়কর্মী ভাল প্রশিক্ষক।
ফাইন্যান্সার বলল, ‘আপাতত আমরা চাঁদা দিয়ে শাহাবুদ্দিন পার্কটা সংস্কার করতে পারি, মোগল!’
‘এত দিনে কী মনে করে?’
চেয়ারম্যান অনেক দিন ধরে শাহাবুদ্দিন পার্কটা সংস্কারের কথা বলে আসছেন। গুলশান দুই নম্বর গোল চত্বরের কাছেই এই পার্ক। যার একপাশে গুলশান মডেল উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। আরেক পাশে গুলশান লেডিজ কমিউনিটি ক্লাব। দেড় হাজারের বেশি গাছপালায় ঢাকা পার্কে আছে বড় একটা পুকুর। পানির দিকে তাকালে ঘেন্না লাগে। পুকুরের চারপাশ দিয়ে আর পার্কের যেখানে-সেখানে আবর্জনার ছড়াছড়ি।
পার্কটা সংস্কার না করায় গরিব গুলশানবাসীর মনে বিশেষ ক্ষোভ আছে। গরিব মানে যারা চাকরিবাকরি করে। ছোটখাটো কেনাবেচা টাইপের কারবার করে। গণপার্কগুলো যাদের বিনোদনের প্রধান জায়গা।
চেয়ারম্যান অনেক দিন বললেও ফাইন্যান্সার সাড়া দেয়নি। তবে কিছু বন্ধু সক্রিয় হয়েছে। তাদের চেষ্টায়-তদবিরে সরকার এগিয়ে এসেছে। পনের-ষোল কোটি টাকার কাজ। পার্ক সংস্কারের রূপকল্প তৈরি হয়ে গেছে। থাকছে পুকুরের চারপাশে পানির ওপর ফুটপাত। গাছের ছায়ায় সবার জন্য হাঁটার রাস্তা। শিশুদের সাইকেল চালানোর রাস্তা। ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল, ওয়াচ টাওয়ার, খাবার পানি, বসার নানা রকম ব্যবস্থা, ইত্যাদি মিলিয়ে ভাল পাবলিক পার্ক হতে যাচ্ছে।
চেয়ারম্যান বললেন, ‘কেন্দ্রীয় পার্ক, ইয়ুথ ক্লাব পার্ক মিলে প্রায় পাঁচ একরের একটা জায়গা রয়েছে। ওটা দখল হয়ে যাচ্ছিল। উদ্ধার করা গেছে। ওখানে এখন ভাল কিছু করতে হবে। সরকারই করবে। কিন্তু করাতে হবে আমাদের। কেউ সেধে এসে করে দেবে না।’
‘গুলশান লেক আর বনানী লেক নিয়েও একটা ধাক্কা দেওয়া দরকার। তাছাড়া কড়াইল বস্তি—।’
‘এসবেরও প্রকল্প তৈরি হয়ে গেছে! রিভিউ চলছে। প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। থাকবে উড়াল সড়ক, ওভার পাস, গোটা দশেক এলিগ্যান্ট সেতু, আলোকসজ্জা, লেকপারে হাঁটার রাস্তা, পার্ক, অ্যাম্ফিথিয়েটার, ইত্যাদি।’ চেয়ারম্যানের মুখে অহংকারের হাসি ফুটল। যদিও তিনি নিজে এসবের সঙ্গে সরাসরি থাকেন না। থাকে তার বন্ধুরা। তবে চেয়ারম্যান খোঁজ রাখেন নিয়মিত এবং পেছনে সক্রিয় থাকেন দরকার অনুযায়ী।
ফাইন্যান্সার বলল, ‘আপনি আসলেই মোগল, মোগল!’
সম্প্রতি গুলশানে কমিউনিটি বোধ জোরদার হচ্ছে। প্রায় বায়ান্ন বছর আগে আবাসিক এলাকাটা গড়ে উঠলেও নবাগত বাসিন্দাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ কম ছিল। পরের প্রজন্ম যাদের জন্ম এখানে তাদের মধ্যে বাড়ছে। তাদের সঙ্গে প্রবীণরাও যোগ দিচ্ছে। সম্প্রতি তারা অনেকগুলো সোসাইটি-ক্লাব-সংগঠন করেছে। কয়েকটা আবার তহবিল গঠন করে প্লট-বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছে।
কয়েকটা দলে চেয়ারম্যানও আছেন। তিনি তাদের না বলতে চাননি। একদিন তিনি ক্ষোভ ঝেড়েছিলেন যে, ‘সব শালা বিদেশ চলে যেতে চায়!’
তখন এই ফাইন্যান্সার তার মুখের ওপর বলে দিল, ‘আপনার দেশে চুদা যাবে না। ড্রিংক করা যাবে না। এমনকি নাচাও যাবে না। একটু হাঁটার জায়গা পর্যন্ত নেই। বিস্ময়কর। আর রাজনীতির লোকজনকে সব সময় দেখি প্রগতি প্রগতি করে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। কিন্তু আমি ত দেখছি সব আরো কুয়োর ব্যাঙ হয়ে যাচ্ছে! আধুনিক ছেলেমেয়েরা এখানে কেন থাকবে?’
চেয়ারম্যানের এই বন্ধুরা বছরের নয়-দশ মাস ইউরোপ-আমেরিকায় থাকে। অনেকেরই ইউরোপ-আমেরিকায় নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। তাদের বেশির ভাগ বন্ধুবান্ধব আর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন সেসব দেশেই বাস করে।
চেয়ারম্যান বললেন, ‘এখন সব রাস্তায় সকাল-বিকাল পানি ছিটাতে হবে। সেজন্য বাড়িঅলাদের নিয়ে মিটিং করা দরকার। কাজটা মোটেই কঠিন না। সব বাড়িতে দারোয়ান আছে। প্রত্যেক বাড়ি থেকে কয়েকটা করে শাওয়ার রাস্তায় সেট করে দিলেই হয়। এই খরচ নামমাত্র। তোমরা একটু গরজ দিলে হয়ে যায়।’
‘হবে না! মাদারচোত বাঙ্গালকে আপনি তা বোঝাতে পারবেন না।’
‘তোমাদের নিয়ে এই এক বিপদ। তোমরা মনে কর যে হবে না। সবাই যদি মনে করতে হবে তাহলে অনেক কিছু সহজ হয়ে যেত।’
‘একটা দৃশ্য মনে পড়ল। গ্রামের কাঁচা টয়লেট দেখেছেন, মোগল? গুয়ে পোকা কেমন থগবগ থগবগ করে? হা হা হা। একটা আরেকটার পাছা কামড়ে ধরে ঝুলে থাকে। আর এক জায়গায় এসে দলা পাকায়। হা হা হা।’
চেয়ারম্যান গম্ভীর হলেন। তিনি জানেন ফাইন্যান্সার সাংঘাতিক লোক। এখন কিসের মধ্যে কী বলবে কে জানে।
ফাইন্যান্সার গোল চত্বরে দাঁড়িয়ে পশ্চিমে কামাল এভিনিউ বরাবর তাকাল। তারপর একইভাবে পুবে মাদানি এভিনিউ বরাবার।
দুই এভিনিউ দুইটা লেক পাড়ি দিয়েছে।
ফাইন্যান্সার বলল, ‘এসব লেকের জলে কতগুলো সোয়ারেজ পাইপের মুখ এসে পড়েছে, কেউ জানেন? আর সেসব কোত্থেকে এসেছে? টয়লেট-বাথরুম থেকে। এসব টয়লেট বাথরুম পাইপ—সবই প্রথম শ্রেণির, ঠিক? এবং সেগুলো ঝকমকে। আর আমি খোঁজ নিয়ে দেখলাম—এসব টয়লেট-বাথরুমে যেসব পাছাগুলো বসে না—উয়াউ! সেগুলো আরো চকচকে। সবই বিদেশি সাবানে ঝকঝকে তকতকে।’
চেয়ারম্যান বাদে সবাই থেকে থেকে উচ্চস্বরে হাহা হোহো করতে লাগল আর ফাইন্যান্সার বলতে লাগল। চেয়ারম্যান কিছু বলবেন কিনা ভাবতে লাগলেন।
ফাইন্যান্সার বলল, ‘এবার কাজের কথায় আসি, মোগল! আমি গুলশান এভিনিউ আর কামাল এভিনিউতে গোটা চারেক ডিস্কো ক্লাব করতে চাই।’
‘মোটে যায় না ত্যানা প্যাঁচায়, হুম? একটাই হয় না—!’
‘আগে শোনেন, বাল, কী বলি। আপনি ত বহিরাগতদের চলাচল এসব এভিনিউতে সীমাবদ্ধ রাখতে চান, তাই না? আর ভেতর থেকে সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, পাবলিক সেন্টার সরাতে চান।’
সবাই কান খাড়া করে রাখল ফাইন্যান্সারের দিকে।
ফাইন্যান্সার বলল, ‘আপনি যদি ডিস্কো ক্লাবে আমার সাথে থাকেন অথবা শুধু সহযোগিতা করেন, তাহলে আমি ভেতর থেকে সব পাবলিক সেন্টার সরিয়ে দেব। ঝাড়ু দিয়ে হোক আর হাওয়া দিয়ে হোক।’
‘তখন তারা কই যাবে?’
‘তারা পারলে এভিনিউতে এসে ঠাঁই নেবে। না পারলে গুলশান থেকে দূর হয়ে যাবে।’
চেয়ারম্যান গুলশানের ভেতরটা এমন নিরাপদ করতে চান যাতে বাচ্চারা সময়-অসময় নির্ভয়ে ঘর থেকে বের হতে পারে। একা যেন চলতে পারে। স্কুলগুলো তিনি আবাসিক এলাকায় এমনভাবে প্রতিস্থাপন করতে চান যাতে শিশুরা হেঁটে, দৌড়ে, সাইকেলে যেতে পারে। বহিরাগতরা ভেতরে না গেলে তা সম্ভব বলে মনে করেন চেয়ারম্যান। এসব নিয়ে তিনি ফাইন্যান্সারের সঙ্গে বেশ কয়েকদিন আলাপ করেছেন। ফাইন্যান্সার চাইলে সেদিকে আগানো সম্ভব বলে চেয়ারম্যান মনে করেন।
ফাইন্যান্সারের প্রধান ব্যবসা পোশাক রপ্তানি আর যন্তরপাতি আমদানি। দেশে যেমন তার প্রভাব আছে তেমনি দেশি-বিদেশি নানাজনের সঙ্গে রয়েছে সুসম্পর্ক। গুলশানেই তার জন্ম। ব্যবসায়ী পরিবারে। চেয়ারম্যানের দ্বিগুণ সম্পত্তির মালিক ফাইন্যান্সার।
► আসছে সপ্তদশ পর্ব
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন