দ্য গ্রেট গ্যাটসবি || চতুর্থ অধ্যায় || এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড
রোববার সকালে গ্রামের সৈকত জুড়ে যখন গির্জার ঘণ্টাধ্বনি বাজছিল, পৃথিবী আর তার উপপত্নী ফিরে এসে গ্যাটসবির বাগানে মিটমিট করে হাসছিল।
“সে একটা চোরাকারবারি,” তারই ককটেল আর সাজানো ফুলবাগিচায় বিচরণ করতে করতে বলছিল যুবতী মেয়েরা। “সে ভন হিন্ডেনবার্গের ভাতিজা আর সেই শয়তানের সেকেন্ড কাজিন; এই তথ্যটি জেনে গিয়েছিল বলে সে একজনকে খুনও করেছে। রোজেটা একটু কাছে নিয়ে আসো তো সোনা, ওই ক্রিস্টালের গ্লাসে ঢেলে দাও শেষ ফোঁটা।”
একবার একটি টাইম-টেবিলের খালি জায়গায়, আমি সেই গ্রীষ্মে যারা যারা গ্যাটসবির বাড়িতে এসেছিল তাদের নাম লিখে রেখেছিলাম। শিরোনাম: “কার্যকর সময় ৫ জুলাই, ১৯২২”, এখন সেটি পুরোনো, ভাঁজে ভাঁজে ভাঙা; তবু ধূসর নামগুলো এখনও পড়া যায়, যে নামগুলো আমার সরলীকরণের বাইরেও তার সম্পর্কে কিছু না জেনেই যারা তার আতিথেয়তা গ্রহণ করে তাকে নিগূঢ় শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিল, তাদের সম্পর্কে একটি ভাল ধারণা দিতেও সক্ষম।
সেবার ইস্ট এগ থেকে এসেছিল, চেস্টার বেকার্স এবং লিচেস আর বুনসেন নামে একজন, যাকে আমি ইয়েল থেকেই চিনতাম এবং ডাক্তার ওয়েবস্টার সিভেটে যে গত গ্রীষ্মে মেইনে ডুবে মরেছে। এসেছিল হর্নবিমস, উইলিভলতেয়ার্স এবং ব্ল্যাকবাক নামে বলতে গেলে পুরো এক গোষ্ঠী, যারা সবসময় এক কোণে জড়ো হয়ে থাকত এবং কেউ কাছে আসলেই ছাগলের মতো তাদের নাক উল্টে দিত। আরো ছিল ইসমাইস এবং ক্রিস্টি (বরং হুবার্ট আউরবাখ এবং মিস্টার ক্রিস্টির স্ত্রী); এডগার বিভার যার চুল তারা বলত যে শীতের কেনো এক বিকেলে কোনো কারণ ছাড়াই তুলো-সাদা হয়ে গিয়েছিল।
আমার মনে আছে, ইস্ট এগ থেকে এসেছিল ক্লারেন্স এন্ডাইভ—মাত্র একবার, এসেছিল সাদা নিকারবকারে, এও মনে আছে যে বাগানে ইটি নামের এক ভিখিরির সঙ্গে তার ঝগড়া হয়েছিল। দ্বীপের অনেক দূর থেকে এসেছিল চেডলস, ও.আর.পি. শ্রেডারস এবং জর্জিয়ার স্টোনওয়াল জ্যাকসন আব্রামস, ফিশগার্ডস এবং রিপলি স্নেলস। স্নেল সংশোধনাগারে যাওয়ার তিন দিন আগে সেখানে এসেছিল আর এতটাই মাতাল হয়ে নুড়ি বিছানো ড্রাইভে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল যে মিসেস ইউলিসিস সোয়েটের অটোমোবাইলটি তার ডান হাতের উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল। এসেছিল ড্যান্সিও এবং এস.বি. হোয়াইটবেট, যার বয়স তখন ষাটেরও বেশি এবং মরিস এ. ফ্লিঙ্ক, হ্যামারহেডস আর তামাক আমদানিকারক বেলুগা এবং বেলুগার মেয়েরা।
ওয়েস্ট এগ থেকে এসেছিল পোলস, মুলরেডিস, সিসিল রোবাক, সিসিল শোয়েন, গুলিক—যে ছিল রাষ্ট্রীয় সিনেটর, নিউটন অর্কিড যিনি ফিল্মস পার এক্সিলেন্স-এর পরিচালক, একহাস্ট, ক্লাইড কোহেন, ডন এস শোয়ার্টজ (পুত্র) এবং আর্থার ম্যাককার্টি—যারা সবাই কোনো না কোনোভাবে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত। বং ক্যাটলিপস, বেমবার্গস, জি. আর্ল মুলডুন—সেই মুলডুনের ভাই, যে পরে তার স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। প্রমোটার দা ফন্টানো সেখানে এসেছিল, এড লেগ্রোস, জেমস বি. (“রট-গুট”) ফেরেট, ডি জংস এবং আর্নেস্ট লিলি—তারা এসেছিল মূলত জুয়া খেলতে আর ফেরেটের বাগানে চক্কর কাটার তাৎপর্য ছিল এই যে, সে সম্পূর্ণ বরবাদ এবং অ্যাসোসিয়েটেড ট্র্যাকশনকে পরের দিন লাভজনকভাবে ওঠানামা করতে হবে।
ক্লিপস্প্রিংগার নামে একজনের ঘন ঘন যাতায়াত এবং দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থানের কারণে তাকে “জায়গীর” পদবী দেয়া হয়েছিল—আমার সন্দেহ, আদৌ তার নিজের কোন বাড়ি ছিল কিনা। নাট্যজনদের মধ্যে ছিল গাস ওয়াইজ, হোরেস ও’ডোনাভান, লেস্টার মেয়ার, জর্জ ডাকউইড এবং ফ্রান্সিস বুল। এছাড়াও নিউইয়র্ক থেকে এসেছিল ক্রোমস, ব্যাকহিসনস, ডেনিকারস, রাসেল বেটি, করিগ্যানস, কেলেহার্স, দেওয়ারস, স্কুলিস, এস ডব্লিউ বেলচার, স্মারকস এবং তরুণ কুইনস যারা এখন বিবাহ-বিচ্ছেদ করেছে আর হেনরি এল পালমেটো যে টাইমস স্কয়ারে সাব-ওয়ে ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
বেনি ম্যাকক্লেনাহান সবসময় চারজন মেয়ে নিয়ে আসত। প্রতিবারই ভিন্ন চারজন, কিন্তু দেখতে এতটাই অভিন্ন যে অনিবার্যভাবে মনে হতো তারা আগেও সেখানে এসেছিল। আমি তাদের নাম ভুলে গেছি—মনে হয় জ্যাকলিন, নইলে কনসুয়েলা বা গ্লোরিয়া বা জুডি বা জুন, তাদের নামের শেষগুলো ছিল হয় ফুল কিম্বা মাসের সুরেলা নাম অথবা কঠোর আমেরিকান পুঁজিবাদীদের নামে, চাপাচাপি করলে হয়ত স্বীকারও করত যে তারা তাদের কাজিন।
এদের পাশাপাশি আমি মনে করতে পারি ফস্টিনা ও ব্রায়েন অন্তত একবার সেখানে এসেছিল এবং বেডেকার মেয়েরা, তরুণ ব্রুয়ার যুদ্ধে যার নাকে গুলি লেগেছিল, মিস্টার অ্যালব্রুকস বার্গার এবং তার বাগদত্তা মিস হাগ, আরদিতা ফিটজ-পিটার্স, মি. পি. জুয়েট, আমেরিকান সৈন্যদলের একসময়কার প্রধান, মিস ক্লডিয়া হিপ এবং তার সঙ্গী যে তার গাড়ি-চালক হিসেবে পরিচিত, এবং কোনো এক রাজপুত্র যাকে আমরা ডিউক বলে ডাকতাম, তার নাম তখন জানা থাকলেও এখন ভুলে গেছি।
উল্লেখিত সকলেই সেই গ্রীষ্মে গ্যাটসবির বাড়িতে এসেছিল।
* * *
জুলাইয়ের শেষের দিকে, একদিন সকাল নয়টায় গ্যাটসবির চমৎকার গাড়িটি তার বিশেষ উল্লেখযোগ্য তিন-স্বরের-ভেঁপুর সুরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমার বাড়ির দরজার পাথুরে ড্রাইভে এসে থামে। প্রকৃত অর্থে সেদিনই প্রথম সে আমাকে ডেকেছিল, যদিও তার আগেই আমি তার বাসায় দুটো পার্টিতে গিয়েছি, তার সঙ্গে হাইড্রো-প্লেনেও বসেছি, এবং তারই জরুরি আমন্ত্রণে তার সমুদ্র সৈকতের ঘন ঘন ব্যবহারও করেছি।
“শুভ সকাল, পুরনো খেলার সাথী। আজ তুমি আমার সঙ্গে লাঞ্চ করছ আর ভাবছি আজ আবারও আমরা একসঙ্গে উড়ব।”
পাণ্ডিত্যপূর্ণ বুদ্ধিদীপ্ত দেহভঙ্গিতে গাড়ির ড্যাশবোর্ডে সে তার নিজের ভারসাম্য বজায় রাখছিল, যা ভীষণ অদ্ভুতভাবে আমেরিকান—যার উৎপত্তি, আমার ধারণা, যৌবনে উত্তোলন কাজের অনুপস্থিতি বা অনমনীয় অনড় বসে থাকা এমনকি আরও বেশি, আমাদের ভয়াতুর, বিক্ষিপ্ত খেলার আকৃতিহীন আভিজাত্য থেকে। তার এই গুণটি তার শিষ্টাচারের বৈশিষ্ট্য থেকে ক্রমাগত অস্থিরতায় রূপ নিচ্ছিল। এক মুহূর্তের জন্যও সে স্থির ছিল না; কখনও বা পা নাচাচ্ছিল কিম্বা অধৈর্যভাবে হাত খুলছিল আর বন্ধ করছিল।
তবুও তার গাড়ির প্রতি আমার প্রশংসনীয় দৃষ্টি তার নজর এড়ালো না।
“খুব সুন্দর, তাই না, পুরানো খেলার সাথী?” আমাকে আরও ভাল করে দেখাবার জন্য সে লাফিয়ে উঠল। “তুমি আগে এটি দেখনি?”
আমি দেখেছি। সবাই দেখেছে। এটি একটি উজ্জ্বল ক্রিম রঙের নিকেল; বিজয়ী হ্যাটবক্স, সাপার-বাক্স এবং টুল-বক্সে সমৃদ্ধ, বিশাল দৈর্ঘ্যে এখানে-সেখানে স্ফীত এবং এক ডজন সূর্যরশ্মি প্রতিফলনকারী উইন্ডশীল্ডের গোলক-ধাঁধায় আরোহিত। পিছনে বহু-স্তর বিশিষ্ট কাঁচ এবং সবুজ চামড়ার প্রায় এক ধরনের সংরক্ষণাগারে বসেই যেন আমরা শহরের উদ্দেশে যাত্রা রওয়ানা হলাম। ইতিমধ্যেই তার সঙ্গে গত মাসে আমি প্রায় আধ-ডজন বার কথা বলেছি এবং হতাশার সঙ্গে আবিষ্কার করেছি তার বলার মতো কিছু নেই। তার সম্পর্কে আমার প্রাথমিক ধারণা হয়েছিল, সে ধীরে ধীরে ম্লান হওয়া এক অনির্ধারিত পরিণতির মানুষ, যে কেবল একটি বিস্তৃত রাস্তার পাশে একটি বিশাল বাড়ির মালিক।
শুরু হল ক্লান্তিকর সেই উত্তেজক যাত্রা। আমরা তখনও ওয়েস্ট এগে পৌঁছাইনি, গ্যাটসবি তার মার্জিত বাক্যালাপ অসমাপ্ত রেখে তার ক্যারামেল স্যুটের হাঁটুতে নিজেকে এলোপাতারি চড় মারতে শুরু করল।
“এদিকে তাকাও, পুরানো খেলার সাথী,” উৎসাহের সঙ্গে বলল সে। “সব মিলিয়ে, আমার সম্পর্কে তোমার অভিমত কী?”
খানিকটা হতভম্ব হয়েই, প্রশ্নের যোগ্য উত্তরগুলোর সরলীকরণ এড়াতে শুরু করলাম।
“যাই হোক, আমি তোমাকে আমার জীবন সম্পর্কে জানাতে চাই,” সে বাধা দেয়। “আমি চাই না তুমি সেই সব গল্প শুনে আমার সম্পর্কে ভুল ধারণা কর।”
অবাক হলাম আবারও, তার মানে হলগুলোতে তাকে নিয়ে রসাল আলাপ আর উদ্ভট অভিযোগ সম্পর্কে সে সচেতন।
“আমি তোমাকে ঈশ্বরের সত্য বলব।” তার ডান হাত হঠাৎ করেই ঐশ্বরিক বিধানকে পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়।” আমি মধ্য-পশ্চিমের ধনী ঘরের সন্তান—পরিবারের সবাই মৃত। আমেরিকায় বেড়ে উঠলেও অক্সফোর্ডে পড়েছি কারণ আমার পূর্বপুরুষরা বহু বছর ধরে অক্সফোর্ডে পড়ে আসছে। সেটাই আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য।”
কথাগুলো শেষ করে সে আমার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকায়—এবং আমি অনুভব করি জর্ডান বেকার কেন আন্দাজ করেছিল সে মিথ্যা বলেছে। “অক্সফোর্ডে পড়েছি” শব্দগুলো সে যেন তাড়াহুড়ো করে গিলে ফেলেছিল কিম্বা শব্দগুলোই হয়ত তার দমের টুটি চেপে ধরেছিল, অথবা শব্দগুলো যেন তাকে আগেও কোনো না কোনোভাবে উত্যক্ত করেছে। এই সন্দেহের সঙ্গেই তার পুরো বিবৃতিটি আমার কাছে খান খান হয়ে যায় এবং সর্বোপরি আমি ভাবতে থাকি তার মধ্যে আরো কোন খারাপ গুণ আছে কি না।
“মধ্য-পশ্চিমের কোন অংশের তুমি?” খুব সাধারণভাবেই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি।
“সানফ্রান্সিসকো।”
“আচ্ছা।”
“পরিবারের সবাই মারা গেছে, প্রতিফল আমি বিপুল অর্থ-প্রতিপত্তির সম্মুখীন হয়েছি।”
তার কণ্ঠস্বরে এক অন্তর্নিহিত গাম্ভীর্য ছিল যেন তার বংশের আকস্মিক বিলুপ্তির স্মৃতি এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল হয়তো সে আমার সঙ্গে মজা কিম্বা পরীক্ষা করছে, কিন্তু তার দিকে তাকাতেই আমি আমার ভুল বুঝতে পারি।
“এরপর আমি ইউরোপের সমস্ত দেশের রাজধানীতে—রাজার মতো জীবন যাপন করেছি—প্যারিস, ভেনিস, রোম—রত্ন সংগ্রহ করেছি, বিশেষ করে রুবি, বড় বড় খেলা আর শিকার করেছি, এমন কী ছবিও এঁকেছি—শুধুমাত্র নিজের জন্য, ভুলে থাকতে চেষ্টা করেছি আমার দুর্ভাগ্যজনক অতীত।”
এই পর্যায়ে অনেক চেষ্টার পর আমি আমার দুর্বিনীত সন্দিগ্ধ হাসিকে সংযত করলাম। তার বক্তব্যগুলো এতটাই শব্দসর্বস্ব সুতোয় বাঁধা ছিল যে, “বোইস ডি বোলোন”-এ বাঘকে ধাওয়া করা শরীরের প্রতি ফুটো দিয়ে কাঠের গুড়া ঝরানো “পাগড়ি-ওয়ালা চরিত্র” ছাড়া সেগুলো আর কোনও চিত্রই জাগিয়ে তুলতে পারেনি।
“তারপর শুরু হল যুদ্ধ, পুরনো খেলার সাথী। এক দুর্দান্ত স্বস্তি, মৃত্যুর চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি আমি অথচ আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় কতই না মন্ত্রমুগ্ধ একটা জীবন কাটাচ্ছি! আমি “ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট” হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি যুদ্ধ যখন শুরু হয়। আর্গোন ফরেস্টে দুটি মেশিনগানের ডিট্যাচমেন্টকে এতদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম যে আমাদের উভয় পাশে মাত্র আধমাইল ব্যবধান ছিল, যেখানে পদাতিক বাহিনী অগ্রসর হতে পারেনি। আমরা সেখানে দু’দিন, দু’রাত ছিলাম, ষোলটি লুইস বন্দুকসহ একশত ত্রিশ জন, অবশেষে পদাতিক বাহিনী উঠে এলে তারা মৃতের স্তূপে তিনটি জার্মান বিভাগের চিহ্ন খুঁজে পায়। আমাকে মেজর পদে উন্নিত করা হয়েছিল আর মিত্রপক্ষের প্রতিটি সরকার আমাকে অলঙ্কৃত করেছিল—এমনকি মন্টিনিগ্রো, অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের নীচে ছোট্ট মন্টিনিগ্রো!”
ছোট মন্টিনিগ্রো! সে তার স্মিত হাসিতে শব্দগুলোকে এক গভীর উচ্চতায় তুলে মাথা নাড়ে—যেন তার হাসি মন্টেনিগ্রোর সমস্যাগ্রস্ত ইতিহাসের প্রতি সমবেদনা এবং মন্টিনিগ্রোর জনগণের সাহসী সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতির প্রকাশ। যেন সে শৃঙ্খলিত জাতীয় পরিস্থিতির সম্পূর্ণ মর্ম উপলব্ধি করতে পেরেছে যা মন্টিনিগ্রোর উষ্ণ ছোট্ট হৃদয় থেকে শ্রদ্ধার নিবেদন। আমার অবিশ্বাস তখন মুগ্ধতায় নিমজ্জিত; ডজনখানেক পত্রিকার মধ্যে দ্রুত স্কিমিং করার মতো। পকেট হাতরে ফিতেয় ঝুলানো একটি ধাতব গোলক সে আমার হাতের তালুতে ছুড়ে দেয়।
“এটা মন্টিনিগ্রো থেকে পাওয়া।”
আমার বিস্ময় তখন তুঙ্গে, জিনিসটি নিখাঁদ খাঁটি, “অর্ডারি দে দানিলো”, বৃত্তাকারে কিংবদন্তি দৌড়াচ্ছে, “মন্টিনিগ্রো’, নিকোলাস রেক্স।
“ওপিঠে ঘুরাও।”
মেজর জে গ্যাটসবি, আমি পড়লাম, তাঁর অসাধারণ বীরত্বের জন্য।
“আরো একটা জিনিস আমি সবসময় সঙ্গে রাখি। আমার অক্সফোর্ড-দিনের স্মারক, একটি স্যুভেনির। ট্রিনিটি কোয়াডে নেওয়া—আমার বাম দিকের লোকটি এখন ডরকাস্টারের আর্ল।”
তোরণ-শোভিত সরণিতে ব্লেজার পরা আধ ডজন যুবকের একটি ছবি, যার মধ্যে দৃশ্যমান অনেকগুলো গম্বুজ। সেখানে গ্যাটসবি, এক পরিণত যুবক—হাতে ক্রিকেট ব্যাট।
মুহূর্তেই আমার কাছে সব সত্যি হয়ে গেল। আমি গ্র্যান্ড ক্যানেলের উপর তার প্রাসাদে বাঘের চামড়ার ঝলক দেখলাম; লাল রঙের আলোকিত গভীরতায় তাকে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে রুবির-সিন্দুক খুলতে দেখলাম, তার ভাঙা হৃদয়ের হাহাকার শুনলাম।
“বড় আশা করে তোমার কাছে আজ আমি এক অনুরোধ নিয়ে এসেছি,” সন্তোষের সঙ্গে স্মৃতি-চিহ্নগুলোকে পকেটে রাখতে রাখতে বলল সে, “তাই মনে করি আমার সম্পর্কে তোমার জানা থাকা উচিত। আমি চাই না, তুমি ভাবো আমি অস্বিত্বহীন কেউ। তুমি নিজেই দেখেছ, আমি সাধারণত অপরিচিতদের মধ্যেই বিচরণ করি, কারণ আমি আমার দুঃখজনক অতীতকে ভুলতে এখানে ওখানে বিভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াই।”
সে সংকোচের সঙ্গে বলল, “তুমি আজ বিকেলেই এ সম্পর্কে জানতে পারবে।”
“দুপুরের খাবারে?”
“না, আজ বিকেলে। আমি শুনেছি তুমি মিস বেকারকে নিয়ে চায়ে বেরুচ্ছ।”
“আপনি কি মিস বেকারের প্রেমে পড়েছেন?”
“না, পুরানো খেলার সাথী, আমি তার প্রেমে পড়িনি। কিন্তু মিস বেকার এই বিষয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছে।”
“ব্যাপারটা” কী সে সম্পর্কে আমার ক্ষীণতম ধারণাও ছিল না, তবে আমি যতটা না আগ্রহী ছিলাম, বিরক্ত হয়েছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি। জর্ডানকে আমি জে গ্যাটসবি নিয়ে আলোচনা করার জন্য চায়ের আমন্ত্রণ জানাইনি। আমি নিশ্চিত ছিলাম অনুরোধটি ভীষণ অদ্ভুত কিছু হবে এবং সে মুহূর্তে আমার চরম আফসোস হচ্ছিল—কোন দুঃখে আমি কখনও তার সেই অত্যধিক জনবহুল লনে পা ফেলেছিলাম!
সে বিষয়ে আর একটি কথাও বলেনি সে। শহরের কাছাকাছি তার শিষ্ঠাচার আরো বৃদ্ধি পায়। আমরা পোর্ট রুজভেল্ট পার হই, সেখানে লাল বেল্টের সমুদ্রগামী জাহাজের আভাস, যাদের সঙ্গে গতি মিলিয়ে খোঁয়া বাঁধানো বস্তির সারিবদ্ধ অন্ধকার আর সেলুনগুলোর নির্জনতা মিলে গিয়েছিল গিল্টি করা “নাইনটিন হান্ড্রেড”-এর বিবর্ণ রেখায়। আমাদের দুপাশে উন্মুক্ত ছাইয়ের উপত্যকা, যেতে যেতে আমি মিসেস উইলসনকে তার অফুরন্ত জীবনীশক্তি নিয়ে গ্যারেজ পাম্পে এক ঝলক হাঁপাতেও দেখলাম।
ডানার মতো ছড়িয়ে থাকা ফেন্ডারে আমরা অর্ধেক অ্যাস্টোরিয়ায় আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলাম—কেবলমাত্র অর্ধেক, কারণ আমরা যখন উঁচু স্তম্ভের মধ্যে পাক খাচ্ছি, শুনতে পেলাম মোটর সাইকেলের পরিচিত শব্দ “জগ-জগ-স্প্যাট!”, একজন উন্মত্ত পুলিশ রাস্তার পাশে তাতে বসে আছেন।
“সব ঠিক আছে, পুরানো খেলার সাথী” বলল গ্যাটসবি।
আমরা গতি কমালাম। মানিব্যাগ থেকে একটা সাদা কার্ড বের করে লোকটার চোখের সামনে তুলে ধরল সে।
“ঠিক আছে,” পুলিশ সম্মতি জানাল, ক্যাপ দুলিয়ে। “পরের বার আর ভুল হবে না, মিস্টার গ্যাটসবি। মাফ করবেন!”
“ওটা কী ছিল?” জানতে চাইলাম আমি, “অক্সফোর্ডের ছবি?”
“আমি কমিশনারকে একবার একটা উপকার করেছিলাম, সেই থেকে তিনি প্রতি বছর আমাকে একটি করে ক্রিসমাস কার্ড পাঠান।”
বিশাল সেতুর উপর, চলন্ত গাড়ির মসৃন ত্বকে, গার্ডারে আছরে পড়া সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে অবিরাম চিকচিক করে, নদীর ওপারে চিনি-পিণ্ডের সাদা স্তূপে জেগে ওঠা ঘ্রাণহীন-অর্থের ইচ্ছায় নির্মিত শহর। কুইন্স-বোরো-ব্রিজ থেকে দেখা এই শহরটি প্রতিবারই প্রথম দেখা নতুন শহরের মত বিশ্বের সমস্ত রহস্য আর সৌন্দর্যের প্রথম বন্য প্রতিশ্রুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
ফুলের স্তবক ঢাকা শবযানে এক মৃত ব্যক্তি আমাদের পাশ দিয়ে চলে যায়, পিছে পিছে পর্দা-টানা আরো দুটি গাড়ি এবং আরও কিছু বন্ধুর প্রফুল্ল গাড়ির লহর। বন্ধুরা করুণ চোখে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপীয় উপরের-ছোট-ঠোঁট নিয়ে আমাদের দিকে তাকায়, আমিও খুশি হই গ্যাটসবির দুর্দান্ত গাড়িটি তাদের বিষন্ন ছুটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল বলে। ব্ল্যাকওয়েলস দ্বীপ পার হতেই সাদা-চালক-চালিত একটি লিমুজিন আমাদের পাশ দিয়ে চলে যায়, সেখানে বসে দুই-কড়ির তিন কেতাদুরস্ত নিগ্রো, আর একটি মেয়ে। উদ্ধত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাদের চোখের কুসুম আমাদের দিকে গড়িয়ে পড়তেই আমি জোরে হেসে উঠি।
“যে কোনো কিছুই ঘটে যেতে পারে এখন; আমরা যেহেতু সেতুর উপর পিছলে গেছি,” ভাবলাম আমি; “একেবারে যে কোনো কিছুই...”
এমনকি গ্যাটসবিও, কোনো বিশেষ বিস্ময় ছাড়াই।
* * *
দুপুরের গর্জন। ফর্টিসেকেন্ড স্ট্রিটে, ভালো পাখাওয়ালা এক সেলারে গ্যাটসবির সঙ্গে দুপুরের খাবারে আমার দেখা। বাইরের রাস্তার মিটমিটে উজ্জ্বলতায় চোখ বুলাতে বুলাতে অস্পষ্টভাবে আমার চোখ পড়ে যায় তার দিকে, অভ্যর্থনা কক্ষে একজনের সঙ্গে কথা বলছে।
“জনাব ক্যারাওয়ে, ইনি আমার বন্ধু মিস্টার উলফশিয়াম।”
ছোট, চ্যাপ্টা নাকওয়ালা এক ইহুদি লোক তার বড় মাথা আর সূক্ষ্ম দুটি চুল—যা তার নাকের উভয় ছিদ্রে অবাধ বিলাসতায় বেড়ে উঠেছিল—দুলিয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করল। কিছুক্ষণ পর আধো অন্ধকারে আমি তার ছোট্ট চোখগুলোও আবিষ্কার করি।
“—সুতরাং আমি তার দিকে একবার তাকালাম—” বলল মি. উলফশিয়াম, আন্তরিকভাবে আমার দিকে হাত নাড়িয়ে,
“— এবং আপনি কি মনে করেন? আমি কি করেছি?”
“কি?” আমি বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম।
কিন্তু স্পষ্টতই প্রশ্নটি আমার উদ্দেশ্য ছিল না, কারণ আমার হাত ছেড়ে সে গ্যাটসবিকে তার অভিব্যক্তিপূর্ণ নাক দিয়ে আড়াল করল।
“আমি ক্যাটসপফের হাতে টাকা তুলে দিয়েছি এবং বলেছি,” “ঠিক আছে, ক্যাটসপফ, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার মুখ বন্ধ না করে ততক্ষণ তাকে একটি পয়সাও দেবে না।” “সে তখনই, সেখানেই তা বন্ধ করে দেয়।”
গ্যাটসবি আমাদের দুজনের হাত ধরে রেস্তোরাঁর দিকে এগোতেই মি. উলফশিয়াম নতুন কিছু একটা বলতে গিয়েও গিলে ফেলে এক নিদ্রাগত বিমূর্ততায় স্তব্ধ হয়ে যায়।
“হাইবলস?” হেড ওয়েটার জিজ্ঞেস করে।
“চমৎকার রেস্তোরাঁ,” ছাদের প্রেসবিটেরিয়ান জলপরীদের দিকে তাকিয়ে বলে মিস্টার উলফশিয়াম। “কিন্তু রাস্তার ওপারেই আমি আরও বেশি পছন্দ করি!”
“হ্যাঁ, হাইবলস,” সম্মতি জানায় গ্যাটসবি, তারপর মি. উলফশিয়ামকে বলে: “ওখানে খুব গরম”।
“হ্যাঁ—গরম এবং ছোট,” বলে মি. উলফশিয়াম, “কিন্তু স্মৃতিকাতর।”
“ওটা কোন জায়গা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“পুরোনো মেট্রোপোল।”
“পুরোনো মেট্রোপোল,” মিস্টার উলফশিয়াম বিষণ্নতায় উদ্বেলিত হয়ে বলে। “সেই মুখগুলো দিয়ে ভরা যারা আজ মৃত, চলে গেছে চিরতরে। চিরতরে চলে যাওয়া বন্ধু দিয়ে পরিপূর্ণ। তবু এতদিন বেঁচে থাকার পরেও, যে রাতে তারা সেখানে রোজি রোজেনথালকে গুলি করে মেরেছিল, আমি আজও ভুলতে পারিনি। টেবিলে আমরা ছয়জন ছিলাম আর রোজি; সারা সন্ধ্যা প্রচুর খাওয়া-দাওয়া আর পান করেছিলাম আমরা। যখন প্রায় ভোর, ওয়েটার মজা করে তার কাছে এসে বলল বাইরে কেউ তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। “ঠিক আছে,” রোজি উঠতে শুরু করলে আমি তাকে তার চেয়ারে টেনে নামিয়ে দেই।
“জারজগুলোকে এখানে আসতে বল রোজি, যদি তোমাকে চায়, কিন্তু তুমি যাবে না, তাই এটুকু উপকার করো, এই দিক দিয়ে ঘরের বাইরে চলে যাও।” তখন ভোর চারটা, ব্লাইন্ডগুলো তুলে দিলে হয়ত দিনের আলোও দেখতে পেতাম।”
“সে কি গিয়েছিল?” আমি সরলতার সঙ্গে জিজ্ঞেস করি।
“অবশ্যই,”—বিরক্তিতে মি. উলফশিমের নাক আমার দিকে ঝাঁঝিয়ে ওঠে—“সে দরজার দিকে ঘুরে বলল, “ওয়েটারকে আমার কফি নিতে দিও না!” বলেই সে ফুটপাথে বেরিয়ে যায় আর তারা তার ভরা পেটে তিনবার গুলি করে গাড়ি চালিয়ে চলে যায়।”
“তাদের মধ্যে চারজনকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করা হয়েছিল,” আমি মনে করে বলি।
“বেকারসহ পাঁচজন।” তার নাসারন্ধ্র এবার আবার আমার দিকে আগ্রহী হয়ে উঠল। “আমি বুঝতে পারছি আপনি একটি ব্যবসায়িক গনেগশন খুঁজছেন।”
দুটি মন্তব্যের সহাবস্থান ছিল বিস্ময়কর।
গ্যাটসবি আমার হয়ে উত্তর দেয়: “ওহ, না,” চিৎকার করে জানায়, “ইনি সেই লোক না!”
“না?” মিস্টার উলফশিয়ামকে হতাশ মনে হলো।
“সে শুধুই আমার বন্ধু। আমি আপনাকে বলেছিলাম যে আমরা এ বিষয়ে অন্য কোনো সময় কথা বলব।”
“আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি,” মি. উলফশিয়াম বলে ওঠে, “আমি ভুল মানুষ ভেবে কথা বলে ফেলেছি।”
জিভে জল আসা একটি রসাল হ্যাশ এসে পৌঁছায়, এবং মি. উলফশিয়াম পুরানো সেই মেট্রোপোলের ততোধিক আবেগপূর্ণ পরিবেশ ভুলে হিংস্র আবেগে ঐতিহাবাহী সুস্বাদু খাবারটি গলধকরণ করতে শুরু করেন। এর মধ্যেই, তার চোখ, খুব ধীরে চক্রাকারে ঘরের চারপাশ প্রদক্ষিণ করে—সরাসরি পিছনের লোকদের পরিদর্শন করে একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করে। আমার ধারণা, আমি উপস্থিত না থাকলে, সে হয়ত আমাদের টেবিলের নীচেও উঁকি দিত।
“আমার দিকে তাকাও, পুরানো খেলার সাথী,” আমার দিকে ঝুঁকে গ্যাটসবি বলে, “আমি ভয়ে আছি আমি বোধহয় আজ সকালে গাড়িতে তোমাকে একটু বেশিই রাগিয়ে ফেলেছি।”
আবারো সেই ভুবন ভুলানো হাসি, কিন্তু এবার আমি রুখে দাঁড়াই।
“আমি রহস্য পছন্দ করি না,” বললাম। “এবং বুঝতে পারছি না কেন তুমি খোলাখুলি বলছ না তুমি কী চাও। কেন এইসব মিস বেকারের মাধ্যমেই আসতে হলো?”
“ওহ, গোপনীয় কিছু নয়,” সে আমাকে আশ্বস্ত করে। “মিস বেকার একজন দুর্দান্ত ক্রীড়াবিদ, তুমি জান, সে এমন কিছু করবে না যা ঠিক নয়।”
হঠাৎ সে তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, লাফিয়ে উঠে আমাকে মি. উলফশিয়ামের সঙ্গে টেবিলে একা রেখে রুম থেকে দ্রুত বেড়িয়ে যায়।
“এখন সে টেলিফোন করবে,” চোখ ঘুরিয়ে তাকে অনুসরণ করে মিস্টার উলফশিয়াম বলে। “একজন ভালো মানুষ, তাই না? সুদর্শন, নিখুঁত একজন ভদ্রলোক।”
“হ্যাঁ।”
“অক্সফোর্ড ব্যক্তিত্ব।”
“তাই!”
“তিনি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড কলেজ ফেরত। আপনি অক্সফোর্ড কলেজের নাম শুনেছেন?”
“জ্বী, আমি শুনেছি।”
“বিশ্বের অন্যতম সেরা কলেজ।”
“আপনি কি গ্যাটসবিকে অনেক দিন ধরে চেনেন?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“বেশ কয়েক বছর,” তৃপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয় সে। “যুদ্ধের পরপর তার সঙ্গে আমার পরিচয়ের আনন্দ লাভের সুযোগ হয়। মাত্র এক ঘণ্টা আলোচনার পরই আমি অনুভব করি, আমি একজন উঁচু জাতের লোকের সন্ধান পেয়েছি। আমি মনে মনে ভেবেছি: “সে এমন একজন মানুষ যাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যায়, মা-বোনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে মন চায়।”
সেখানে সে একটু থামে। “আমি দেখছি আপনি আমার কাফের বোতামের দিকে তাকিয়ে আছেন।”
আমি আদতে সেদিকে মোটেও তাকাইনি, কিন্তু তখন তাকাই। বিখ্যাত আইভরি দিয়ে অদ্ভুতভাবে তৈরি।
“মানুষের দাঁতের এক উৎকৃষ্ট নমুনা,” সে আমাকে জানায়।
“আচ্ছা!” আমি নেড়ে-চেড়ে বলি। “আসলেই খুব আকর্ষণীয় একটা জিনিস।”
“হ্যাঁ।” সে তার জামার নিচে আস্তিন গুটিয়ে নেয়। “হ্যাঁ, গ্যাটসবি মহিলাদের ব্যাপারে খুবই সতর্ক। সে কখনই তার বন্ধুর স্ত্রীর দিকে নজর দেয়ার মত নয়।”
এই সহজাত আদিরসাত্মক বিষয়ের নায়ক টেবিলে ফিরে এলে মিস্টার উলফশিয়াম এক ঝটকায় কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ায়।
“আমি মধ্যাহ্নভোজ উপভোগ করেছি,” সে বলে, “এবং আমাকে স্বাগত জানানোর উচ্ছাসটুকু বেঁচে থাকতেই আপনারা, দুই যুবক থেকে পালাতে চাই।”
“তাড়াহুড়ো করবেন না, মেয়ার,” নির্লিপ্তভাবে বলে গ্যাটসবি। মি. উলফশিয়াম এক প্রকার আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তোলে।
“আপনি খুবই অমায়িক কিন্তু আমি অন্য প্রজন্মের লোক,” তার গম্ভীর ঘোষণা। “আপনারা এখানে আড্ডা দিন, এবং আপনাদের খেলাধুলা নিয়ে আলোচনা করুন এবং আপনাদের মেয়ে বান্ধবী আর আপনাদের—” সে তার হাতের তরঙ্গে একটি কাল্পনিক বিশেষ্য সরবরাহ করার চেষ্টা করে—“আমার বয়স পঞ্চাশ, আমার নিজের স্বার্থে “নিজেকে আমি আর আপনাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাই না।”
হাত মিলিয়ে বিদায় নেওয়ার সময় তার করুণ নাক আবার কেঁপে ওঠে আর আমি মনে করতে চেষ্টা করি আমি তাকে আহত করার মত কিছু বলেছি কিনা।
“তিনি মাঝে মাঝেই খুব আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন” গ্যাটসবি ব্যাখ্যা করে। “আজকে তার আবেগপ্রবণ দিনগুলোর একটি। তিনি নিউইয়র্কের বেশ একটি চমকপ্রদ চরিত্র—ব্রডওয়ের বাসিন্দা।”
“আসলে কে সে—একজন অভিনেতা?”
“না।”
“দন্ত্য-চিকিৎসক?”
“মেয়ার উলফশিয়াম? না, সে একজন জুয়াড়ি।”
গ্যাটসবি ইতস্তত করে বলে, তারপর শান্তভাবে যুক্ত করে: “তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি ওয়ার্লড-সিরিজকে সাজিয়েছিলেন, ১৯১৯ সালে।”
“ফিক্সড দ্য ওয়ার্ল্ডস সিরিজ?” আমি আবার বলি।
ভাবনাটা আমাকে স্তব্ধ করে দেয়। অবশ্যই আমার মনে আছে যে ওয়ার্ল্ডস সিরিজটি ১৯১৯ সালে স্থির করা হয়েছিল তবে আমি যদি সত্যিই ভাবতাম তবে ভাবতাম এটি কেবল একটি নিছক ঘটনা, কিছু অনিবার্য শৃঙ্খলের সমাপ্তি। আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে একজন মানুষ কখনো পঞ্চাশ কোটি মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলতে পারে—নিরাপত্তা সিন্দুক উড়িয়ে দেয়া চোরের একাগ্রচিত্ত নিয়ে।
“সে এটা কিভাবে করল?” আমি এক মিনিট চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলাম।
“সে শুধু সুযোগ নিয়েছে।”
“সে জেলে গেলনা কেন?”
“তারা তাকে ধরতে পারেনি, পুরানো খেলার সাথী। সে বিচক্ষণ মানুষ।”
আমি চেক পরিশোধের জন্য জোর করেছিলাম। ওয়েটার বাড়তি টাকা ফেরত নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ভিড়ের মধ্যে টম ব্যুকাননকে দেখতে পাই।
“এক মিনিটের জন্য আমার সঙ্গে আসো,” আমি বললাম। “আমি একজনকে হ্যালো বলব।”
আমাদের দেখে টম লাফিয়ে উঠে ছয় কদম এগিয়ে এল।
“কোথায় ছিলে এতদিন?” সাগ্রহে জিজ্ঞেস করে সে। “ডেইজি তো রেগে আগুন, তুমি একবারও কল করনি।”
“ইনি মিস্টার গ্যাটসবি, মিস্টার ব্যুকানন।”
তারা সংক্ষিপ্ত করমর্দন করার সময় আমি গ্যাটসবির মুখে এক চাপা, অপরিচিত বিব্রত চেহারা লক্ষ্য করি।
“যাই হোক, কেমন আছো?” টম জানতে চাইল।
“তুমি এতদূরে খেতে এলে কী মনে করে?”
“আমি মিস্টার গ্যাটসবির সঙ্গে লাঞ্চ করছি।”
আমি মিস্টার গ্যাটসবির দিকে ফিরি, কিন্তু সে আর সেখানে ছিল না।
* * *
“উনিশ-সতের সালের অক্টোবর মাসের কোন একদিন—
(সেদিন বিকেলে, প্লাজা হোটেলের চা-বাগানে, একটা সোজা চেয়ারে, খুব সোজা হয়ে বসে জর্ডান বেকার বলে)—
আমি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় হাঁটছিলাম, অর্ধেক ফুটপাত আর অর্ধেক লনে। আমি লনেই বেশি খুশি ছিলাম; কারণ ইংল্যান্ডের জুতা পড়েছি, যার রাবারের নোব নরম মাটিকে স্পর্শ করছিল। আমার নতুন প্লেড স্কার্টটি মাঝে মাঝে বাতাসে একটু একটু উড়ছিল এবং যখনই এমনটি ঘটছিল, সমস্ত বাড়ির সামনের লাল, সাদা এবং নীল ব্যানারগুলো টানটানভাবে প্রসারিত হয়ে অসম্মতিসূচক ভঙ্গিতে বলে উঠছিল টাট-টাট-টাট-টাট।
ব্যানার আর লনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল ডেইজি ফেয়ের বাড়ির ব্যানার এবং লন। সে তখন সবেমাত্র আঠারো, আমার থেকে বছর দুয়েক বড় এবং লুইসভিলের সব তরুণীদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয়। সে একটি সাদা পোশাক পরেছিল, আর তার ছিল একটি সাদা ছোট্ট রোডস্টার, সারাদিন ধরে তার বাড়িতে টেলিফোন বেজেই চলেছিল, আর ক্যাম্প টেলরের সব উত্তেজিত তরুণ অফিসাররা সেই রাতে তাকে একচেটিয়াভাবে পাওয়ার বিশেষ দাবি জানিয়েছিল, “যাই হোক, শুধুমাত্র এক ঘন্টার জন্য!”
সেদিন সকালে যখন আমি তার বাড়ির উল্টো দিকে, তার সাদা রোডস্টারটি তখন রাস্তার কার্বের পাশে; সে একজন লেফটেন্যান্টের সঙ্গে বসেছিল, যাকে আমি আগে কখনও দেখিনি। তারা পরস্পরের সঙ্গে এতই মগ্ন ছিল যে আমি পাঁচ ফুট দূরত্বে না আসা পর্যন্ত তারা আমাকে দেখতেই পায়নি।
“হ্যালো জর্ডান,” সে অপ্রত্যাশিতভাবে ডাকল আমাকে।
“দয়া করে এখানে একটু এসো”
আমি খুশি হয়েছিলাম যে সে আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল, কারণ আমার থেকে বয়সে বড় সব মেয়েদের মধ্যে আমি তাকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতাম। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আমি রেড ক্রসে ব্যান্ডেজ তৈরি করি কিনা।
আমি করতাম।
আচ্ছা, তাহলে কি আমি গিয়ে তাদের বলতে পারব কি না যে, সেদিন সে আসতে পারবে না?
কথা বলার সময় অফিসারটি ডেইজিকে দেখছিল, যেমনভাবে প্রতিটি মেয়ে চায় তাকে কেউ দেখুক।
আমার কাছে ব্যাপারটি ভীষণ রোমান্টিক মনে হয়েছিল, সেদিন থেকে আজোবধি আমি ঘটনাটি মনে রেখেছি। তার নাম ছিল জে গ্যাটসবি এবং তারপর চার বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে, আমি তাকে আর চোখে দেখিনি—এমনকি লং আইল্যান্ডে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরও বুঝতে পারিনি, সে একই লোক।
তখন উনিশ-সতের। পরের বছর নাগাদ আমি নিজেও কয়েকটি বোয়াউ পেয়ে যাই, টুর্নামেন্টে খেলতে শুরু করি, তাই সচরাচর ডেইজির সঙ্গে আর দেখা হতো না। সে আমার চেয়ে বয়সে অপেক্ষাকৃত বড় এবং তার সমবয়সীদের সঙ্গেই ঘুরত—মানে যদি সে আদৌ কারো সঙ্গে ঘুরত। তার সম্পর্কে এক বন্য গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল—কীভাবে তার মা তাকে ধরে ফেলে; সে এক শীতের রাতে ব্যাগ গুছিয়ে নিউইয়র্কে এক বিদেশগামী সৈনিককে বিদায় জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ফলস্বরূপ তাকে কঠোরভাবে আটকে রাখা হয়, এবং কয়েক সপ্তাহের জন্য সে তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দেয়। তারপরে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অপারগ শহরের কয়েকটি খরম-পায়ের, অদূরদর্শী যুবক ছাড়া সে আর কোন সৈনিকের সঙ্গে জড়ায়নি।
পরের শরতেই সে আবার আনন্দোচ্ছল, বরাবরের মতোই প্রফুল্ল। সাময়িক বিরতির পরে তার নতুন আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এবং সম্ভবত ফেব্রুয়ারিতে সে নিউ অরলেন্সের এক ব্যক্তির সঙ্গে বাগদান করে। জুন মাসে সে শিকাগোর টম ব্যুকাননকে লুইসভিলের চেয়ে অনেক বেশি আড়ম্বর পরিস্থিতিতে বিয়ে করে। টম চারটি প্রাইভেট কারে একশত লোক নিয়ে এসেছিল এবং সিলবাচ হোটেলের পুরো একটি ফ্লোর ভাড়া করেছিল, বিয়ের আগের দিন সে ডেইজিকে তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলার মূল্যের একটি মুক্তোর মালা উপঢৌকন দেয়।
আমি ব্রাইডস-মেইড ছিলাম। বৈবাহিক-নৈশভোজের আধঘণ্টা আগে আমি তার ঘরে গিয়ে দেখি সে তার বিছানায় ফুলের পোশাকে, জুনের রাতের মতো সুন্দর; অথচ বানরের মতো মাতাল। তার এক হাতে সাটারনের বোতল আর অন্য হাতে একটি চিঠি।
“ধন্যবাদ জানাও আমাকে,” সে বিড়বিড় করে বলছিল। “এর আগে কখনও পান করিনি তবে ওহ, আমি কীভাবে উপভোগ করি!”
“কি ব্যাপার, ডেইজি?” আমি ভয় পেয়েছিলাম, আমি আপনাকে বলতে পারি; এমন অবস্থায় কোনো মেয়েকে আমি আগে কখনো দেখিনি।
“এই, এগুলো সব আবর্জনা।” সে তার বিছানায় পাশে রাখা ময়লার ঝুড়ি হাতড়ে মুক্তোর মালাটি বের করে।
“এগুলো নীচে নিয়ে যাও এবং এগুলো যারই হোক না কেন” তাকে ফিরিয়ে দাও।
“ডেইজি মত বদলে ফেলেছে” বলে দাও তাদের।
সবাইকে জানিয়ে দাও “ডেইজি মত বদলে ফেলেছে!”
সে কাঁদতে থাকে—কাঁদতে কাঁদতে কাঁদতেই থাকে। ছুটে গিয়ে আমি তার মায়ের দাসিকে খুঁজে বের করি এবং দরজা বন্ধ করে তাকে ঠান্ডা-স্নান করাই। সে চিঠিটা কিছুতেই ছাড়বে না। সেটিকে সে তার সঙ্গে বাথটাবে পর্যন্ত নিয়ে যায় এবং ভেজা বলের মত করে তার হাতে চেপে ধরে রাখে, তারপর একসময় যখন সেটি তুষারের মতো ঝরতে শুরু করে সে আমাকে বলে সাবানের থালায় রেখে দিতে।
তারপর চুপ। আমরা তাকে অ্যামোনিয়ার স্পিরিট দেই, কপালে বরফ দেই, আবার তাকে তার পোশাকে ফিরিয়ে আনি এবং আধঘন্টা পরে আমরা যখন ঘর থেকে বের হই তখন তার গলায় সেই মুক্তোর মালা এবং নাটকীয়তার সেখানেই অবসান। পরদিন বিকেল পাঁচটায় সে যথারীতি টম ব্যুকাননকে বিয়ে করে—এবং কোন কাঁপুনি ছাড়াই দক্ষিণ সমুদ্রে তিনমাসব্যাপী ভ্রমণে যাত্রা শুরু করে।
তারা ফিরে আসার পর সান্তা বারবারায় আমার সঙ্গে তাদের দেখা হয়; মনে হয়েছিল এমন স্বামী-পাগল মেয়ে আমি আগে কখনো দেখিনি। এক মিনিটের জন্যও যদি টম ঘর থেকে বেরিয়ে যেত সে অস্বস্তিতে চারপাশে তাকিয়ে বলত “টম কোথায়?” এবং তাকে দরজায় ফিরে আসতে না দেখা পর্যন্ত চুড়ান্ত বিমূর্ত অভিব্যক্তি ধারণ করে থাকত। বালির উপর বসে, সে তার কোলে টমের মাথা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তার চোখের উপর আঙুল বুলিয়ে, অপার আনন্দে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। তাদের একসঙ্গে দেখাও ছিল স্পর্শকাতর এক বিষয়—যা নীরব, মুগ্ধতায় হাসতে বাধ্য করত।
তারপর আগস্ট। আমি সান্তা বারবারা ছাড়ার এক সপ্তাহ পর টম একরাতে ভেনচুরা রোডে একটি ওয়াগনের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দিলে তার গাড়ির সামনের চাকা খুলে যায়। যে মেয়েটি তার সঙ্গে ছিল সেও কাগজপত্রে চলে আসে, কারণ তার হাত ভেঙে গিয়েছিল—সে ছিল সান্তা বারবারা হোটেলের চেম্বার মেইডদের একজন।
পরের এপ্রিলে ডেইজির ছোট্ট মেয়েটি পৃথিবীতে আসে এবং তারা এক বছরের জন্য ফ্রান্সে চলে যায়। আমার সঙ্গে তাদের কোন এক বসন্তে কানে দেখা হয় এবং এরপরে ডিউভিলে। তারপর বসতি স্থাপন করতে তারা শিকাগোতে ফিরে আসে। শিকাগোতে ডেইজি জনপ্রিয় ছিল, আপনি জানেন। তারা দ্রুত ভিড়ের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, যারা সবাই তরুণ এবং ধনী এবং বন্য, কিন্তু সে ছিল একেবারে নিখুঁত হিসেবে সুপরিচিত, সম্ভবত এই কারণে যে সে মদ পান করত না। হার্ড-ড্রিংকিং লোকেদের মধ্যে মদ্যপান না করা একজনের বড় সুবিধা হল বেসামাল জিহ্বাকে ধরে রাখা যায়, উপরন্তু, নিজের সামান্য অনিয়মকে সময় দিতে পারে, যেখানে অন্য সবাই এতটাই অন্ধ থাকে যে তারা দেখতেও পায় না বা আমল দেয় না। সম্ভবত ডেইজি কখনই প্রেম খোঁজেনি—কিন্তু তবুও তার কণ্ঠে একটা কিছু আছে...
যাই হোক, প্রায় ছয় সপ্তাহ আগে, বহু বছর পর সে প্রথমবারের মতো আবার গ্যাটসবি নামটি শুনতে পায়। এটা ছিল যখন আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করি— আপনি কি মনে করতে পারছেন?—আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি ওয়েস্ট এগ-এর গ্যাটসবিকে চিনেন কিনা। আপনি বাড়ি চলে যাওয়ার পরই সে আমার ঘরে এসে আমাকে জাগিয়ে জানতে চায়, “কী গ্যাটসবি?” যখন আমি তাকে বর্ণনা করি—আমি ছিলাম অর্ধ-ঘুমে—সে অদ্ভুত কণ্ঠে বলেছিল,—সে অবশ্যই সেই ব্যক্তি,—যাকে সে চিনত। এর আগ মুহূর্ত পর্যন্তও আমি এই গ্যাটসবিকে তার সেই সাদা গাড়ির অফিসারের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারিনি।”
জর্ডান বেকার যখন এই সব বলে থামল তখন আমরা আধ-ঘণ্টার জন্য প্লাজা ছেড়ে ভিক্টোরিয়া হয়ে সেন্ট্রাল পার্কে গাড়ি চালাচ্ছি। ওয়েস্ট ফিফটিসের চলচ্চিত্র তারকাদের লম্বা অ্যাপার্টমেন্ট গুলোর পিছনে অস্তমিত সূর্য আর মেয়েদের স্পষ্ট কণ্ঠস্বর, ইতিমধ্যে ঘাসের উপর ঝিঝি পোকার মতো জড়ো হয়ে, উষ্ণ গোধূলিতে গেয়ে উঠছিল:
“আমি আরবের শেখ,
তোমার ভালোবাসা আমার।
রাতে যখন তুমি ঘুমাবে,
তোমার তাঁবুতে আমি হামাগুড়ি দেব—”
“অদ্ভুত কাকতালীয় ব্যাপার,” আমি বললাম।
“না, মোটেও কাকতালীয় না।”
“কেন না?”
“কারণ গ্যাটসবি তার সেই বাড়িটি এজন্য কিনেছিল যে, যেন তার ডেইজি উপসাগরের মোহনার ঠিক ওপারে থাকে।”
তারপর সেগুলো কেবল আর সেই নক্ষত্রপুন্জ ছিল না; সেই জুনের রাতে যাদের সে পেতে চেয়েছিল। তার জাঁকজমকপূর্ণ উদ্দেশ্যহীন গর্ভ থেকে হঠাৎ প্রসূত হয়ে সে আমার কাছে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল।
“সে জানতে চায়—” জর্ডান বলে—আপনি যদি কোনো বিকেলে ডেইজিকে আপনার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান এবং তাকেও আসতে বলেন।”
এতটুকু চাওয়ার এই বিনয় আমাকে নাড়া দিয়েছিল। সে পাঁচ বছর অপেক্ষা করে একটি প্রাসাদ কিনেছে যেখানে সে প্রতিদিনকার পতঙ্গদের নক্ষত্রের আলো বিতরণ করেছে যাতে সে (ডেইজি) কোনও এক বিকেলে সেই অপরিচিত ব্যক্তির বাগানে “পদধূলি দিতে পারে”।
“এই সামান্য চাওয়াটুকুর জন্য আমার এত কিছু জানার কি দরকার ছিল?”
“সে ভয় পায়। সে এতদিন অপেক্ষা করেছে। ভেবেছে আপনি যদি বিরক্ত হন। আপনি তো দেখেছেন সবকিছুর ব্যাপারেই সে কতটা অনমনীয়।”
ব্যাপারটি আমাকে ভাবিয়ে তোলে।
“সে আপনাকেই কেন সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে বলল না?”
“সে তাকে তার বাড়ি দেখাতে চায়,” সে ব্যাখ্যা করে। “এবং আপনার বাসা ঠিক তার পাশেই।”
“ওহ!”
“আমার ধারণা সে প্রায় অর্ধেক ধরেই নিয়েছিল যে তার পার্টিগুলোতে কোনো না কোনো এক রাতে ঘুরতে ঘুরতে সে (ডেইজি) চলে আসবে” জর্ডান বলে যায়, “কিন্তু সে আসেনি। তারপর সে লোকদের কথার ছলে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেছিল যে তারা তাকে চেনে কিনা, এবং আমিই প্রথম যাকে সে খুঁজে পায় যে তাকে চিনি। সেই রাতেই সে তার নাচে আমাকে আমন্ত্রণ জানায়, এবং সে যেভাবে এর উপর কাজ করেছিল দেখলে বুঝতে পারতেন। অবশ্য, আমি অবিলম্বে নিউ ইয়র্কে মধ্যাহ্নভোজের পরামর্শ দিয়েছিলাম—ভেবেছিলাম সে হয়ত আনন্দে আত্মহারা হবে:
“আমি সঠিক পথের বাইরে কিছু করতে চাই না!” সে জানিয়েছিল। “আমি তাকে পাশের বাড়িতে দেখতে চাই।”
যখন আমি তাকে জানাই আপনি টমের বিশেষ বন্ধু, সে পুরো ব্যাপারটি বাদই দিতে চেয়েছিল। সে টম সম্পর্কে খুব বেশি জানে না, যদিও বলেছে, “শুধু এক ঝলক ডেইজির নাম দেখার সুযোগের অপেক্ষায় সে বছরের পর বছর শিকাগোর খবরের কাগজ পড়ে।”
অন্ধকার হয়ে এসেছিল, আমরা একটি ছোট সেতুর নীচে ডুব দিতেই আমি জর্ডানের সোনালী কাঁধে আমার হাত রাখি, তাকে কাছে টেনে নিয়ে ডিনারের আমন্ত্রণ জানাই। ক্ষণিকের জন্য আমি ডেইজি বা গ্যাটসবি, কারো কথাই আর ভাবছিলাম না, ভাবছিলাম এক পরিচ্ছন্ন, কঠোর, নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তির কথা, যে সর্বজনীন সংশয়ের সম্মুখীন এবং যে এই মূহূর্তে আমার হাতের বৃত্তে প্রাণবন্ত আর নিরঙ্কুশভাবে বন্দী। এক ধরনের মাথা ঘামানো উত্তেজনার সঙ্গে আমার কানে একটি বাক্য ধ্বনিত হতে শুরু করে:
“শুধুই শিকার, আর শিকারী, আর ব্যস্ততা আর ক্লান্তি।”
“আর তাছাড়া ডেইজির জীবনেও তো কিছু থাকা উচিত,” জর্ডান বিড়বিড় করে বলে।
“সেও কি গ্যাটসবিকে দেখতে চায়?”
“সেটা তার জানার কথা না। গ্যাটসবি তাকে জানাতে চায় না। তাকে শুধু চায়ের আমন্ত্রণ জানানোর কথা।”
আমরা অন্ধকার গাছের বাঁধা পেরুই, তারপর ফিফটি স্ট্রিটের শরীর; কমনীয় বিলাসী নরম আলোর একটি ব্লক নেমে এসে পার্কটি আলোকিত করে।
গ্যাটসবি আর টম ব্যুকাননের মতো আমার এমন কেউ ছিল না, যার অশরীরী মুখ অন্ধকার কার্নিস আর অন্ধ করা জ্বলন্ত বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে ভেসে উঠবে, বাহুর বেষ্টনে তাই আমি আমার পাশের মেয়েটিকেই শক্ত করে আঁকড়ে ধরি। তার সাদা, দাম্ভিক মুখ হেসে ওঠে, আমি তাকে আরো কাছে টেনে নেই। এবার একদম আমার মুখের কাছে।
* * *
পড়ুন || ►প্রথম অধ্যায় || ►দ্বিতীয় অধ্যায় || ►তৃতীয় অধ্যায়
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন