অন দ্য বর্ডার
[ নোট: গল্পে ব্যবহৃত কবিতা ও উদ্বৃতিগুলো কবি সাবদার সিদ্দিকীর।]
তিরিশ বছর আগে এক নো ম্যানস ল্যান্ডে আমি মারা যাই। দিল্লি থেকে ফিরছিলাম ঢাকার পথে। ঢাকাই আমার দেশ, কলকাতা নয়। আমি তখনই গুরুতর অসুস্থ। আমার এই মার্কিন কাপড়ের জামা আর চটের কোট পরা সুরত দেখলেও ঢাকা আমাকে কবি হিসেবে চিনতে পারবে। আর কলকাতা আমাকে চিনবে মিউজিয়ামের সামনে বসা ভিক্ষুক হিসেবে, আদৌ একজন ভিক্ষুককে যদি আলাদা করে কেউ চিনতে পারে। ছোট বোনটা কলকাতায় আছে। শবনম। ভোরের শিশির। দেখতে খুব ইচ্ছা হয়। কিন্তু কোথায় খুঁজবো!
বনগাঁ রেল জংশনে নেমেছিলাম। বনগাঁ চিনেন তো? বনগাঁ কিন্তু আর বনগ্রাম নাই। বড় শহর। দীনবন্ধু মিত্র, বিভূতিভূষণ, শংকর, বিনয় মজুমদারের শৈশবের শহর। আর শক্তি আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখলেন, এত কবি কেন? তখন দেশ পত্রিকায় কবিতা সম্মেলনে মফস্বল থেকে আসা কবিদের নিয়ে সেই শক্তির লেখাতেই অপমান করে বলা একজন ‘মহিলা কবি’ই ব্যঙ্গ করে লিখলেন—‘এসেছে বনগাঁ থেকে কয়েকজন কবিতা পড়তে’। দেশ পত্রিকা তো ক্যারিকেচার আঁকায় এক্সপার্ট। খুব মজা নিলো আঁকা আর লেখা মিলিয়ে যুগলবন্দি সাজিয়ে। আমি শক্তির প্রবন্ধ নিয়ে পরে কথা বলবো। মনে করিয়ে দিয়েন। ওই মফস্বল থেকেই কবিরা উঠে আসে।
এবারে আমাকে পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে যশোরের বেনাপোলে ঢুকতে হবে। একটু ঝামেলা করলেও আমাকে ঢুকতে দেয়। নরমালি ঢুকতে পারি না। আপনারাই তো বলেন, আমি নাকি অ্যাবনরমাল। আমার পাসপোর্ট নাই তো, তাই ঝামেলা করে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে যেখানে পৌঁছলাম, জায়গাটা পেট্রাপোল নাকি বেনাপোল সেটা ইয়াদ নাই। আপনারা লিখেছেন এক নামহীন গ্রামে সাবদার সিদ্দিকীর মৃত্যু হয়। এটাই হয়তো লেখা ছিল, ললাটে কিংবা হাতে। ইবনে বতুতা বলেছিলেন পৃথিবীর সব কাহিনিই নিয়তিবদ্ধ।
গোলাপি এখন ট্রেনে দেখেছেন তো আপনারা? পরিচালক আমজাদ ভাই বলেছিলেন নতুন গল্প বলে কিছু নাই। দুনিয়ায় ৩৬ রকমের গল্পের প্লট আছে। তার যে কোনো একটার মধ্যেই তোমার কাহিনী ফিট করে যাবে। আমি আমজাদ ভাইকে একটা কথা বলার জন্যেই তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম। আমি তো আবার মৃত মানুষ ছাড়া আর কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারি না। আমজাদ ভাইকে বলে এসেছিলাম, ভাই আমার গল্পটা কিন্তু ৩৭ নম্বর প্লটের।
নামহীন সেই গ্রামে পৌঁছেছিলাম সেবারে দিল্লি থেকে ঢাকা ফেরার পথে। ঢাকায় আমার কে আছে? কেউ না। ঢাকা কলকাতা দিল্লি আগ্রা নেপাল সবই আমার।
যেখানে পা রাখি
ভিন গ্রহে কিংবা ভিন গাঁয়ে দেখি
পায়ের নিচে টুকরো দুই জমি
হয়ে যায় আপন মাতৃভূমি
বলেছি তো যে, ‘আমার কোনো পাসপোর্ট নাই। এক সময় দেখতে চাইতো। তখন বলতাম, ইউ আর গার্ডিং দ্য লাইন্স ড্রউন বাই মেন, বাট হোয়াট এবাউট দ্য লাইন্স ড্রউন বাই দ্য পোয়েটস? সীমান্ত প্রহরীগণ, কবির আবার বর্ডার কিসের? ওরা জিজ্ঞেস করতো, আপনি যে কবি তার বিশ্বাস কি? চোরাচালানি নন তা কে জানে? আমি ঝোলা থেকে ডাডাবাদি কবিতা বের করে পড়ে শোনাতাম।’
তারপরে তো এক সময় আপনারা বললেন যে সাবদার পাগল হয়ে গেছে। পরে আর পাগলের কাছ থেকে বা ফকিরের কাছ থেকে কোন বোকাপাঁঠা বিডিয়ার বিএসেফ পাসপোর্ট চায়! ততদিনে চন্দন নগরের কনভেন্টে শেখা খাস ইংরেজিও আধো আধো বোল। কলকাতায় তবু তো ছোট একটা বোন ছিলো৷ বলেছি? ফেরার সময় শরীর খুব খারাপ ছিল। খাবারের কষ্টও করেছি। ওষুধপত্র কি জিনিস, হে মানুষ, আমি জানার সুযোগ পাইনি। জীবনের গ্যারান্টি নাই জেনেও—শবনম, তোর কাছে যাওয়ার কথা না ভেবে ঢাকায় আসতে চাচ্ছিলাম। বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমিও না। তবু ঢাকা আমার ঢাকা! রিটন মিয়া এখন কই আছে কে জানে!
কলকাতা ১৯৫০ সালে আমাকে জন্ম দিয়েছিল, মানে গোলাম সাবদার সিদ্দিকীকে। আর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা আমাকে আরেকটা জন্ম দিলো—সে আমার নাম থেকে গোলাম কেটে দিল। শুধু সাবদার সিদ্দিকী। এই দেশ তো আমিও স্বাধীন করেছি। আট নম্বর সেক্টরে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী স্যারের আন্ডারে যুদ্ধ করেছি! কবিতা লিখেছি। স্বাধীনতার কবিতা পত্রিকা করবো বলে আবার ক্যাম্পে রাইফেল জমা দিয়ে কলকাতার প্রেস পাড়ায় গেছি—
‘পরিণত হাত যখন হাতিয়ারে/ সময়ের ধার তখন কে রে ধারে/ এ ধারে ও ধারে/ ঘুমায়ে পড়েছে কে রে? / রেখে মাথা ঘাস বাংকারে/ তর্জনী রেখে ট্রিগারে?’
স্বাধীন বাংলাদেশ আমার নামের গোলামের জিঞ্জির খসিয়ে দিলো। গোলাম সাবদার সিদ্দিকী এখন অনলি সাবদার সিদ্দিকী। হাওড়া ব্রিজের রেলিং-এ সেই জিঞ্জির এখন লোহার ব্রেসিয়ার। লিখেছিলাম—
হাওড়া ব্রীজ যেন লোহার ব্রেসিয়ার তোমার
কলকাতা, যন্ত্রের সমান বয়সী তুমি
কলকাতা , তোমার ইতিহাস
বাইবেলের পিছনে গাদা বন্দুক
বাংলা গদ্যের সমান বয়সী
আমার কিশোর কলকাতা
সন্ন্যাসীর লিঙ্গের মতো নিস্পৃহ তুমি আজ
বুঝলেন তো, বাইবেলের পিছনে গাদা বন্দুক লুকিয়ে রেখে ওরা এই উপমহাদেশ দখল করে ফেললো। এসব কবিতা কলকাতায় বসেই লেখা। আগে আর পরে। কলকাতা ছাড়লাম ১৪/১৫ বছর বয়সে। পরে আসা যাওয়া ছিল। আপনারা শুনতে চাইলে পরে আরো বলা যাবে।
১৯৯৪ সালে যেদিন আবার ১৯৬৪ সালের মতো বর্ডার ক্রস করছিলাম, তখন জুতাজোড়া ছিঁড়ে গেছে, আর বয়ে নিতে পারছিলো না আমাকে। ফেলে দিলাম এক খালের পানিতে। আফসান একজোড়া জুতো দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু ওর পা দুইটা বড় বড়। আমার ছোট পা। আফসানের বাসায় গিয়ে কত জ্বালাতন করেছি। ওর আম্মা কিন্তু যত্ন করতো ঠিকই, ভাত খেতে দিতো।
চৌষট্টি সালে এপারে-ওপারে দাঙ্গা হয়েছিল। ওরা বললো, গো ব্যাক টু পাকিস্তান! আমাদেরকে কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হবে। বাবা আমাদেরকে নিয়ে শিয়ালদহ থেকে বনগাঁ দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে এলেন। এটাই সেই শের শাহের গ্রান্ড ট্রাংক রোড—সোনারগাঁ টু পাকিস্তান! এটাই আবার একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসে এলেন গিনসবার্গের সেপ্টেম্বর অন জেশোর রোড হবে!
Millions of souls nineteen seventy-one
homeless on Jessore road under grey sun
...
Millions of babies in pain
Millions of mothers in rain
Millions of brothers in woe
Millions of children nowhere to go
তো, আমরা গেলাম সাতক্ষীরা। বাবার বন্ধু ছিলেন কে একজন উকিল সাহেব। বাবা আবার আইনের ব্যবসা গুছিয়ে নিতে শুরু করলেন। আমরাও স্কুলে ভর্তি হলাম। কলকাতায় ক্লাস নাইনে উঠে ফরাসি ভাষা শিখতে আরম্ভ করেছিলাম। এখন সাতক্ষীরার সুন্দরবনের আশেপাশে প্রকৃতির ভাষা শিখি। স্বাধীন বাংলাদেশ হবার পরে আবার ছফা ভাইয়ের বদান্যতায় জার্মান ভাষা শিখলাম।
মাথার ওপর ঝাঁঝালো রোদ। চোখে রক্তজবা দেখছি। আকাশ থেকে, বড় বড় গাছ থেকে, সীমান্তের কাঁটাতারের বেষ্টনী থেকে ঝপ ঝপ করে মৃত্যুর মতো মোহন রক্তজবা ঝরছে। হঠাৎ চোখে দুলে ওঠে সব। ভার্টাইগো। সেন্টু ভাইয়ের কবিতার মতো একটা রক্তজবা মনে হলো আমার পিঠের মধ্যে ঢুকে একটা তপ্ত ক্ষত করে গেলো। রক্তজবাটা আমার হার্টের মধ্যে ঢুকে গেল। না মিথ্যা বলবো না, আমি কোনো শত্রু বা মিত্রের উদ্যত সঙ্গীন দেখি নাই। আমার কোনো শত্রু বা মিত্র থাকলে তো!
The wind whips up the waves so loud,
the ghost moon sails among the clouds
Turns the rifles into silver on the border
(Al Stewart, On the Border)
আপনাদেরকে সেন্টু ভাই বললাম ঠিকই। কিন্তু কোনোদিন তাঁর কাছে যাবার বা তাঁকে সেন্টু ভাই বলে ডাকার চান্স তো পাইনি। জাহিদ ভাই, আসাদ ভাই, নির্মল দাদাদের মুখে শুনতে শুনতে সেন্টু ভাই-ই বলি। উনি এলিট মানুষ। বড় কবি। আমি ভবঘুরে, পাগল ছাগল, কিন্তু কবি বলে মানতে হবে তোমাদের। হ্যাঁ। সেন্টু ভাই হলেন আবুল জাফর ওবায়দুল্লাহ। অনেক বড় নাম। ওই নোম্যান্স ল্যান্ডে ওনার পুর্বপুরুষের পিঠের রক্তজবা আমার পিঠে ঢুকে গেল। কিন্তু আমি তো ক্রীতদাস না। আমি বাংলাদেশের সব চাইতে স্বাধীন কবি। হাসছেন? শুনে রাখুন, আমিই বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব। এভাবে বলতে শুরু করেছি কবে, বলেন তো? মানুষ কখন এই পরিচয় দেয়! মানুষের মাথা যখন বিগড়ে যায়, তখন নিজেকে রাজা বাদশাহ বলেই মনে করে। সব এলিট-ফেলিট আমার পেসাবের ধারায় ভেসে গেছে! এই কথাটা সেন্টু ভাইকে বলে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনি মার্জিত, রুচিবান মানুষ; তবে মাওলা ভাইয়ের মতো রাবীন্দ্রিক কিনা জানি না। তাঁকে এসব কথা বলা যায় না সেই বিবেচনা আমার আছে।
শেষ স্বাধীন নবাব হবার পরে তখন আমি আরমানিটোলা গির্জার কাছে কবরস্থানে থাকি। কাদার মধ্যে জুতা আটকে গেলে পুলিশ আমার জুতা দেখে ফেলবে। তখন ঠিকই নবাব হিসেবে ধরা খেয়ে যাব। টায়ার- কাটা জুতা। মানুষজন চারটা ডাল ভাত খেতে দেয়। কখনো শেফালি ওর ঘরে ডেকে নিয়ে যায়। খেতে দেয়, তেল পানি দিয়ে চুল আঁচড়ে দেয়। তোষকে ঘুমাই। ওর মানুষ চলে এলে আবার একটা ছোট বোতল নিয়ে কবরস্থানে যাই। এখানে মশা আছে। মোরগ মার্কা কয়েল নাই। টিএসসির টেবিল টেনিসের বোর্ডে ঘুমাতে আরাম ছিল। মশা কম। এখন তো আর আগের পোলাপান নাই। সবাই ঢিল মারে। দৌড়ানি দেয়। সারাজীবনই দাবড়ানি খেয়েছি। তখন তো সবাই আমাকে কবি বলেই জানতো। পার্টিও তো একটা করতাম। মধুর ক্যান্টিন থেকে মারতে মারতে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে নিয়ে আসে নাই আমাকে? আপনারা দেখেছেন। বাঁচাতে আসেন নাই। আরমানিটোলা কবরস্থানে কেউ আমাকে মারতে আসে না। ফকির মানে। আর জানো নাকি, আজিমপুর কবরস্থান তখন খলিলুল্লাহর দখলে। জিজ্ঞেস করলাম, খিদা তো আমারও লাগে। আমি ভাত খাই। তুমি মরা মানুষের কলিজা মাংস কেন খাও? বললো, খেতে ভালো লাগে। ওই মাংস না খাইলে পাগল অইয়া যাইমু। বললাম, ভাই খলিল, আমাকে না বলে দুই এক টুকরো নরমাংস ডাল ভাতের সাথে মিশিয়ে খাইয়ে দাও, যদি আমি পাগল থেকে সুস্থ মানুষ হতে পারি! না হলে, পেটটা তো ভরলো। ব্যাটা হাসে। হারামজাদা তুই তো পাগলই। নইলে তোকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যায়? আমাকে নিলো না কেন? আমি হয়তো পাগল পরিচয়েরও অযোগ্য। আহা, হাসপাতালে তো তিন বেলা ডায়েট আছে। নার্স এসে চুল আঁচড়ে দেয় রে?
...একজন কবি কোন রাষ্ট্র নন।
নির্দিষ্ট, সুনির্দিষ্ট কোন ভূখন্ড নেই একজন কবির
সৌর সংসারেও নয়
পৌর সংসারেও নয়।
একজন কবি, কম্পাসহীন কলম্বাস।
যে রকম ধর্মের নিজস্ব নির্দিষ্ট কোন ভূখণ্ড নেই
সে রকম ধর্মের, কবিতার নেই, কবির নেই
সৌর সংসারেও নেই
পৌর সংসারেও নেই।
কবি ও কবিতার নিজস্ব ভূখণ্ড নেই
একজন কবি তাই চতুর্থ বিশ্বের নিঃসঙ্গ নাগরিক।
খলিলুল্লাহ সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরে এলো। আবারো আজিমপুর কবরস্থানেই ঢুকলো। কিরে? আবারো কলিজা মাংস খাবি! বললো, না কবি ভাই, মানুষের সমাজে তো আশ্রয় মিলে না। আমি নাকি পিশাচ হইয়া গেছি। মানুষ আমারে মারে। তাই সমাজ থেকে দূরে থাকি। গোরস্থান ছাড়া আর কই যামু?
|| ২ ||
Late last night the rain was knocking on my window
I moved across the darkened room and in the lamp glow
I thought I saw down in the street the spirit of the century
Telling us that we're all standing on the border
(Al Stewart, On the Border)
ঢাকার উপর তারপরেও আমার অনেক দাবি আছে। আমার আসলে একটা ঘর ছিল। সবুজ ঘর। টিএসসি আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোনায়। এখান থেকেও আর্মেনি গির্জার ঘন্টা শুনতে পেতাম। ঢং ঢং ঢং! এখানে আমার সবুজ ঘর। ঘাস আর মাটি দিয়ে ঘেরা। এখন সেটা মেট্রোরেলের পিলারের নিচে চলে গেছে। মরে যাবার পর আবারও ঘর ছাড়া। আমি কোথায় থাকি রে—বটগাছের পাতা নাইরে! আমজাদ ভাইয়ের নয়নমনি সিনেমায় ববিতাকে জ্বিনে ধরলো। গাছে উঠে এই গান গায়। হেসো না। আমি এখন কোথায় থাকব?
আমি কিন্তু মোমবাতির ভাষায় কবিতা লিখি নাই। ওই যে তুমি মোমবাতি জ্বালিয়ে অন দা বর্ডার গান শুনতে শুনতে আমার কথা চিন্তা করলা। আর আমি সামনে এসে হাজির হলাম প্রদীপের জ্বিনের মতো। আমি তো কবেই মরে ভূত! কেন চলে এলাম? ঘাড় মটকাতে? না ভয় পেও না ভয় পেও না, তোমায় আমি মারবো না। তোমাকে তো সেই ছোট থেকেই চিনি। আজাদে এক সময় অল্প কিছুদিন ছিলাম। বাসাবোতে সম্পাদক মুজীবুর রহমান খাঁ সাহেবের বাসায় গেছি একদিন। দেখি তুমি ওনার নাতির সাথে ফুটবল খেলছ। খাঁ সাহেব মুখে মুখে জীবনকথা বলবেন। তোমাকে বললেন, মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে আসছ। এখন তো ছুটি। আমার কাজটা করে দাও। রোজ দুই তিন ঘন্টা কথা বলবো। তুমি রাজি হও নাই। ভুল করছো। না, সেজন্যে ঘাড় মটকানোর প্রশ্ন উঠে না। তুমি আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে একটা গল্প লিখছিলা। আমি নাকি একটা মূর্তিমান আপদ ছিলাম! ভুল তো মানুষ করতেই পারে, লেখকেরা ভুল করে বেশি। কিন্তু সমস্যা হলো, একবার ছাপা হয়ে গেলে—সেটা হয়ে যায় অমোচনীয়। এসেছি তোমাকে ভুল ধরিয়ে দিতে। না, থাকতে আসি নাই। কই জায়গা দিবা? বৌ বকবে না! আমার আরমানিটোলাই ভালো। প্রতিবেশী ইংলিশ ভুত পাওয়া যায়। কথা বলে আরাম। ঝগড়া ফ্যাসাদ নাই। দাবড়ানি নাই। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে থাকব না। বিদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেট্রো স্টেশান!
প্রত্যেকেই দুরত্ব চায়
একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষ
অন্ততঃ একমানুষ দুরত্ব চায়
তবু জেনে রাখা ভালো। ঢাকা যখন সিটি করপোরেশন ঘোষিত হলো, সেটা নিয়ে কে প্রথম কবিতা লিখেছিলো—খুঁজে দেখো।
শোনো আর একটা ভালো কথা বলি। গুরুজনের উপদেশ বলতে পারো। মোমবাতির ভাষায় কবিতা লিখো না। সরে আসো। বরং সুকান্তের ভাষায়—কঠিন গদ্যকে আজ হানো। হাসান আমার বন্ধু ছিল, গুণদা তো আমার বন্ধু ছিলই। ষোলোই ডিসেম্বরে ট্রাক চালিয়ে বনগাঁ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসছি না ওনাকে। হাসান ওয়াজ এ গুড সোউল। কিন্তু মোমবাতির ভাষায় এক্সপার্ট। মরে যাবে তো, তাই দপ করে জ্বলে উঠলো। ওইটা আগুন না। গুণদা? উনি লিখছেন টর্চের আলো দিয়ে। আগুন ছিল শুধু সাবদারে; মশাল ছিল শুধু সাবদারের। সত্যি কথা। এখন নিজেই নিজের ঢোল বাজাতে হচ্ছে আর কি। আর কেউ আগুনের দেখা পায় নাই। কবিরা আশি সালের দিকে সালে একবার আমাকে মাতাল অবস্থায় নদীতীরে বালুর ঢিবির মধ্যে পুঁতে দিয়েছিলো। গিয়েছিলাম কবিতা সম্মেলনে। আমি তখন পুরা ফিটফাট। চোখে সানগ্লাস, রং চটা জিনসের প্যান্ট, বঙ্গের লেদারের জ্যাকেট পরা ডলি সায়ন্তনীর হে যুবক! নেশা করলেই আর ঠিক থাকতে পারতাম না। উল্টাপাল্টা বলতাম। আমার কথা কেউ পছন্দ করতো না। কি বললে—কি বলতাম আমি? আমি বলেছি, গৌতমবুদ্ধ কয়েক কোটি লোককে গৃহহারা করেছেন এটা সুমহান সত্য। বলেছি, মিসেস ইসাবেলা পেরন একজন মহিলা ফ্যাসিস্ট। বলেছি, গোলাপ মূলত চরিত্রহীন ফুল। গোলাপের শ্রেণী চরিত্র বিশ্লেষণ করা যাক। বলেছি, শান্তির পিকাসো পারাবত এযাবৎ কোন ডিম্ব প্রসব করেননি, একথা জেনে দুঃখ পাওয়া ভাল। বলেছি, জাতিসংঘের বদলে একটি কম্পিউটার যথেষ্ট। কবিরাও আমার মর্ম বুঝে নাই। এইটাই কষ্ট। না না, গুণ আর হাসান না। ওরা ভালো মানুষ। ওরাও আমার উন্মূল-উদ্বাস্তু যৌবন সঙ্গী।
কি যেন বলছিলাম—আগুন কোথায় পাবে?
ম্যাচবাক্সহীন শহরের ক্রুদ্ধ যুবক
দড়ির আগুনে জ্বেলে নেয় সর্বশেষ সিগারেট।
শোনো, চুরানব্বই সালে মারা গেছি। অনেক বছর তোমাদের দৃশ্যপটে ছিলাম না। মারা যাবার আগ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সবই কিন্তু আমি কোনো না কোনোভাবে জেনে গেছি—তোমাদের দেশীয় আর এশীয় কবিতা উৎসব, নব্বই এর গণ অভ্যুত্থান—ফল অব এরশাদ রেজিম, কবিতা আন্দোলন, ভড়ংবাজি—সব দেখেছি। আরেকদিন বলবো। রুদ্রের সাথে কথা হয়। ত্রিদিবের সাথে মাঝে মধ্যে দেখা হয়। আর শোনো, আমার ওই কবিতাটা খুঁজে বের করবে। নো ম্যান’স ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমি কবিতা পড়ছি, আর আমার সেই অদ্ভুত কবিতা শুনছে দুই দেশের বর্ডার গার্ডরা—আর তারিফ করছে। কবিতাটা আমি হারিয়ে ফেলেছি। খুঁজে পেলে আরেকবার একটা মোম জ্বালিও।
অসীম ভালোবাসায় ভালোলাগায় বুকের মধ্যে একজন প্রিয়জন হারানোর বেদনার অনুভুতি নিয়ে শেষ করলাম।লেখক কে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ।
পলাশ
ডিসেম্বর ০৬, ২০২৪ ২৩:১৭