কুহকের ফাঁদ

অ+ অ-

 

মিজান দৌড়াচ্ছিল, অনবরত। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে। তার নার্ভাসনেস তাকে ঠিকভাবে দৌড়াতে দিচ্ছিল না। মাঝে মাঝে নিজের মধ্যে দৃঢ়তা ও ভারসাম্য না রাখতে পেরে সে হোঁচট খেয়ে খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। ফুটপাতগুলোতে তখনও লোকজনের অবিরাম কোলাহল। সে কোলাহলকে পাশ কাটিয়ে কোনো একটি গলির ভিতর আত্মগোপন করার চেষ্টায় ছিল। চেষ্টা করছিল, তার পথের সামনে যা কিছু পড়বে তাকে ভেঙে-ছিঁড়ে-দলিত করে এগিয়ে যাবার।

 

বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে, সন্ধ্যায় হ্যাপি নিউ ইয়ারের পার্টিতে সে ও তার ঘনিষ্ট কয়জন বন্ধু মিলে পানির বোতলের ভিতর হুইস্কি নিয়ে বের হয়েছিল। মেয়ে বন্ধুদের কাছে ছিল বিয়ারের ক্যান। পুরো বিষয়টাই ছিল খুব মজার। বেশ কিছুদিন পরিকল্পনা করে করে এসব জোগাড় করেছিল ওরা। পরষ্পরকে সারপ্রাইজ দেবার আরও অনেক আইডিয়া ওদের মাথার ভিতর গিজগিজ করছিল তখনও। ওরা তখন ঘুনাক্ষরেও ধারণা করতে পারেনি যে এমন একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেতে পারে, একটু পরেই।

রাস্তায় তখন অনবরত বাজির শব্দ। চমৎকার সব ফানুস উড়ছে। সিনথিয়ার বাড়ির ছাদে সাজানো হয়েছিল নিউ ইয়ার পার্টি, বরাবরের মতো। কয়েকবছর আগে ও লেভেল পরীক্ষা শেষ করার পর থেকেই এ বাড়িতে ওরা নিউ ইয়ার পার্টি করে নিয়মিত, বন্ধুরা মিলেমিশে। আসলে পরিবারের সবার কাছে নিজেদেরকে বড় করে তুলবার উত্তেজনাটাও ছিল এই নিউ ইয়ার পার্টির আয়োজনের ভিতর। যেন, পরিবারের লোকজনদের বুঝিয়ে দিতে চাওয়া যে, তারা সত্যিই এখন আর ছোট নয়। তারা এখন পার্টিতে হুইস্কি-বিয়ার এসব ড্রিংকসও চালাতে পারে। সিনথিয়ার চাচাতো আর খালাতো ভাইবোনেরাও এই পার্টিতেই হাজির হয়েছিল সিনথিয়ার আমন্ত্রণে। ওদের ক্লাসের আটজন বন্ধু আর সিনথিয়ার কোচিং ক্লাসের চারজন বান্ধবী মিলে বারো জনের একটি গ্রুপ। সঙ্গে ওর সমবয়সি ভাইবোন মিলে প্রায় আঠারো জন। প্রতিবছরই এদের পরষ্পরের দেখা হয়ে যায় কারো বার্থডে পার্টিতে, বা ঈদে, বা কোনো কোচিং সেন্টারে! এরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বিশেষ পরিচিত। তাছাড়া, এ বছর ওদের ভিতরে চারজন দেশের বাইরে পড়তে যাবে তাই, এবারের আয়োজন ছিল ভিন্নতর। এরা সবাই গ্রাজুয়েশান কমপ্লিট করেছে। মিজান সামনের মাসেই স্কলারশিপ নিয়ে হংকং চলে যাবে। আদনান আর লিমা যাবে ইউ,এস,এতে। তাই এবারের হ্যাপি নিউ ইয়ারটা ছিল একটু বেশি আনন্দের!

এতসব আনন্দের উৎসের ভিতরে যে খুব সামান্য বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি চরমে উঠতে পারে, তারপর তা থেকে কথা বাড়তে বাড়তে তা ব্যক্তিগত আক্রোশের মধ্যে দিয়ে রক্তপাত পর্যন্ত গড়াতে পারে, তা ছিল চিন্তার অতীত! ইকরাম ক্রমাগতই খোঁচাচ্ছিল আদনানকে। খোঁচাটা ছিল তার গার্লফ্রেন্ড ঋতুকে নিয়ে। কথায় কথায় কেবলি কথা বাড়ছিল। ঋতু আর সহ্য করতে না পেরে যখনই উঠে যাচ্ছিল তখনই শেষ পর্যায়ে এসে তা হয়ে গেল চরমযখন আদনান ছাদের কোনায় পড়ে থাকা ইট দিয়ে রক্তাক্ত করল ইকরামকে। বরাবরের মতই কে, কবে, কাকে দেখে ক্রাশ খেয়েছিল, প্রথম কবে হঠাৎ করে অ্যাডাল্ট ফিল্ম দেখে ফেলেছিল, তার প্রতিক্রিয়ায় কী ঘটেছিল, এসবই ছিল আড্ডার বিষয়বস্তু। তারপর কিছুক্ষণ চাকুরী সংক্রান্ত কিছু কথা, যদিও সামান্য টিউশনির অভিজ্ঞতা ছাড়া কাজের জীবন সর্ম্পকে তাদের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তারপর তা গড়াতে লাগল ব্যক্তিগত রিলেশানশিপের দিকে। জোর তর্কে কেবলই হারিয়ে যেতে লাগল ন্যায়- অন্যায়ের বোধ, আর তা ক্রমেই পরিণত হতে লাগল তর্ক থেকে উচ্চস্বরে গালাগালি ও রক্তারক্তিতে। উত্তেজনাটা থামাবার জন্য আশেপাশে বয়ষ্ক কেউ ছিল না।

 

সিনথিয়াদের বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথমে কিছুক্ষণ ক্রমাগত দৌড়ের পর, মিজান নিজেকে আবিষ্কার করে আসাদ অ্যাভেনিউতে। মনিপুরিপাড়ার দুই নাম্বার গেট দিয়ে দৌড়ে বের হয়ে, অসংখ্য ফুটতে থাকা বাজির শব্দের ভিতর, যেন সেগুলো প্রচণ্ডভাবে ফুটছে মাথার ভিতরেও। ঝাঁ-ঝাঁ করা মাথাটা নিয়ে কিছুক্ষণ দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে দৌড়ানোর পর, সে এবার ধীর গতিতে হাঁটতে থাকে। ধীর লয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবে, ঝামেলাটা কতদূর গড়াতে পারে! একসপ্তাহ পর সে দেশের বাইরে যাবে। টিকিট বুকিং ও যাবতীয় গোছগাছ প্রায় শেষ। কিন্তু ঠিক শেষ মুহূর্তেই এটা কী ঘটে গেল! ইকরামের যদি গূঢ়তর কিছু হয়! নিশ্চয়ই এতক্ষণে অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। ইকরামকে নিশ্চয়ই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। ইকরাম কী বেঁচে আছে! যেভাবে রক্তাক্ত হয়েছে, বেঁচে থাকলেও তার নাক, কান, চোখ বা মাথায় বড় রকমের ক্ষতি হয়ে যাবে! ইকরামের বাবা অনেক ধনী ও প্রভাবশালী। উনি নিশ্চয়ই সবার নামেই কেইস করে দেবে! মিজানের নামেও কী! কে জানে!

তার কী উচিত হয়েছিল কাউকে কিছু না বলে এভাবে পালিয়ে আসা! অবশ্য লিফটটি ব্যস্ত থাকায় সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়েই নেমেছিল, আর গেটের দারোয়ান তখনও বিষয়টা ভালভাবে টের পায়নি। তাই তাকে দেখেই বদ্ধ গেটটা খুলে দিয়েছিল! এভাবে না এসেও বা সে কী করতে পারতো! একটা অপরাধবোধ যেন বুকের ভিতর খচখচ করছে!  ত্রমাগত দৌড়ের পর এখন হাঁটার গতিতে ঝুঁকে সে ভাবছে, এখন সে যাবে কোথায়! অন্তত আজকের রাত! আব্বু-আম্মুকে এখন ঘুম থেকে জাগিয়ে এসব বলতে গেলে তুলকালাম বাধবে। আর এই ঘটনা না জানি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! ভাগ্যিস সে সঙ্গে সঙ্গেই উঠে এসেছিল! ঠিকসময় মতো ফোনটাকেও সুইস অফ করে ভালই করেছে। আগে তো তার নিজের নিরাপত্তাটা নিশ্চিত করতে হবে! আব্বু-আম্মু এসব জানলে নিশ্চিত হার্টঅ্যাটাক করবে। আচ্ছা, ইকরাম কী সত্যিই মারা যাবে! আদনান যে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে ইট দিয়ে আঘাত করবে এটা তো কারো কল্পনাতেই আসে না! ও কী করে এমন মাথা গরম করতে পারল!  কী হতে যে কী হয়!

আদনানের ক্রুদ্ধ চেহারা আর ইকরামের মাথা ফেটে রক্ত পড়ার দৃশ্যটা আরেকবার নিজের মনের মধ্যে মিলিয়ে নিয়ে সে আরও দ্রুত হাঁটতে থাকে। যদিও সে জানে না, সে কোথায় যাবে! আসাদ অ্যাভেনিউ থেকে এগিয়ে যেতে যেতে  অনেকক্ষণ পর আচমকা সে নিজেকে দেখতে পায় মোহাম্মদপুর আদাবর থেকে মনসুরাবাদ পেরিয়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমির দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে গলির খোঁজ করতে করতে কখন যে আচমকা সে এই পথে এসে গেছেহঠাৎ সে নিজেকে অনুভব করে খানিকটা। কিন্তু সেখানে পাহারারত কিছু পুলিশ থাকায়, সে একটু কেঁপে ওঠে, কিন্তু চলা থামায় না। পুলিশের সামনে দিয়েই প্রচণ্ড শীতরাত্রির ভিতর সমস্ত কুয়াশাকে তছনছ করতে করতে দ্রুতগতিতে মিজান এগিয়ে যেতে থাকে রায়েরবাজার কবরস্থানের দিকে। যদিও শীতের রাত, তবু কবরস্থানও কিছুটা আলোকউজ্জ্বল। সম্ভবত থার্টিফাষ্ট নাইটের কারণে। কবরস্থানেও ভয়ের কিছু নাই। অন্তত আজকের রাতটা নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেয়া যাবে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবে না। আর জিজ্ঞেস করলেও বা কী! সে দৃঢ় স্বরে বলবে, কবর জিয়ারত করবে নতুন বছরে। রাতের রহস্যঘেরা আলো-অন্ধকারে কবরের দিকে সে হেঁটে যেতে থাকে দৃঢ় পায়ে, যেন সে একটু আগে ঘটে যাওয়া কোনো মুহূর্তকেই চেনে না।

 

অন্ধকার, কুয়াশা আর হলুদ আলোতে কবরের ঘন সবুজঘাসগুলো নিস্তব্ধতা বুকে নিয়ে যেন আহ্বান জানাচ্ছে অন্য কোনো একক পৃথিবীকে। এখানে কবরের ধার বেয়ে ঘন জঙ্গল। পরিবেশটা যেন তার স্নায়ুর আর চেতনার গভীরতর অতল পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল। কবন্ধ সময়ের ভার বুকে নিয়ে মিজান কবরের জায়গাতেও আরও অধিক অন্ধকার খোঁজে। তার মনে হয় কবরের উপরের সবুজ গালিচাগুলোও যেন ভেসে যাচ্ছে রক্ত স্রোতে। তার পুরো সময়টাই যেন পরিণেত হতে যাচ্ছে, ভ্রান্তিতে আর বিভ্রমে! সে দম আটকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ চারপাশটাতে নজর বুলিয়ে নিজের বুকে হাত রেখে নিজের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসকে বুঝে নিতে চায়।

হঠাৎ কবরের জঙ্গলের ভিতরে একটি অর্ধেক খোঁড়া শূন্য গর্তের দিকে সে তাকিয়ে থাকে এক মনে। ঘন অন্ধকারে তার খুব ভয় লাগতে থাকে। তবু সে বুকে সাহস রেখে সেদিকে দেখতে দেখতে দ্রুতই এগিয়ে যায়, সেইস্থানে কিছু একটা নড়েচড়ে ওঠার আভাস পেয়ে। একটা অজানা ভয় নিয়েও সে ঝুঁকে বসে দেখে, একটা কিম্ভুতকিমাকার মানুষ সঙ্গে কয়েকটি কুকুর নিয়ে বসে আছে সেই গর্তের ভিতর!

এই! এই! আপনি কে! এখানে কী করেন! মিজানের মনের ভিতর সীমাহীন ভয়। তবু সে যেন নিজের ভয় তাড়াতেই জোরে জোরে চ্যাঁচাতে থাকে।

ঘেউ! ঘেউ! [ লোকটি চুপ! কুকুরগুলোই তাকে সামনে-পিছনে ঘিরে উত্তর দিতে থাকে।]

এই যে! কথা বলেন না কেন! বোবা নাকি!

মৌন স্থবিরতার ভিতর থেকে লোকটির মুখ বিড়বিড় করে কী যেন বলে!

এই জোরে বল! শুনতে পাচ্ছি না! উঠে আয় উপরে!

আবার ঘেউ ঘেউ! প্রায় পাঁচ থেকে ছয়টি কুকুর সমস্বরে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে।

কয়েকটি কুকুরের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে লোকটি যেন অতি কষ্টে উঠে আসে গর্ত থেকে! আর বলে

এইডা আমার এলাকা। তুই কেডা! এত রাইতে!

মিজান মুখে কিছু না বলে, পকেট থেকে দুটি সিগারেট বের করে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে চায়।

সিগারেটটা দেখে লোকটিও আশ্বস্ত হয়! সঙ্গে থাকা  কুকুরগুলোও বুঝে যায় এই নতুন বন্ধুত্বের প্রস্তাবনা। তাই ঘেউ ঘেউ বন্ধ করে জ্বলজ্বলে চোখজোড়া দিয়ে নিরীক্ষণ করতে থাকে পুরো পরিস্থিতিকে।

অল্প আলোতেও লোকটির শরীরের গঠনের বিকৃতি চোখে পড়ে। তার ঠোঁট জোড়া কাটা। মধ্যবয়সী, কাঁচা-পাকা চুলের লোকটি সম্ভবত জন্মাবার সময়ই ঠোঁট কাটার ত্রুটি নিয়ে জন্মেছে। দুই পায়ের গঠনেও ভারসাম্যহীনতা।

বাড়ি কই?

ছিল একসময়, কুমিল্লায়। এহন নাই! [ঠোঁট কাটা বলে, তার কথাগুলো কেবলি জড়িয়ে যাচ্ছে।]

বাপ-মা?

কেউ নাই! একবার টর্নেডো হইছিল, হেই তুফানডা হইছিল আমগো বাড়ির উপর দিয়া। টিন দিয়া দুইভাগে কাইট্যালাইছে। এক টিনের তলায় মা-বাপ দুইডাই মইর‌্যা গেছিল। একটু থেমে কুকুরদের ঘেউ ঘেউ বন্ধ করার জন্য ওদের কয়েকটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আবার সে বলতে থাকে

এক বাড়িতে পালক ছিলাম। এট্টু বাড়তি হওনের পর হেই বাড়ির আম্মাও মইরা গেল। তারপর থেইকাই রাস্তায় বাড়ি, রাস্তায়ই ঘর! কবরখানার খাটিয়ার ভিত্রে ঘুমাই। আর যত কুত্তা আছে, হেগো লগে চলি। কামাই করি মাঝে-মধ্যে। চইল্যা যায় ভালই।

কামাইয়ের রাস্তা কী?

একসময় বাসে ট্রেনে জিনিসপত্র বেচতাম। একবার অ্যাকসিডেন্ট কইরা পাডা গেলো গা। ট্রেনের ছাদে উঠছিলাম আরি-পইরা গেছি গা। এহন ল্যংড়াইয়া হাডি। মাঝে মইদ্যে পুরানা কাম করার সখ জাইগ্যা ওডে। তহন কমলাপুর রেল ইষ্টিশনে যাই। শরীরে কুলায় না। তবু চেষ্টা করি। ওইহানে কিছু কাম কাইজ পাওন যায়।

মিজানের ভাল লাগছিল না এইসব কথাবার্তা। কিন্তু একটা কিছু করেতো আজকের রাতটা পার করতে হবে! তাই সে লোকটির সঙ্গে নতুন নতুন কথা চালিয়ে যেতে থাকে। লোকটির কথায় সে থেমে থেমে বিস্মিত ও কৌতুহলীও হয়!  সে আবার লোকটিকে প্রশ্ন করে

তো চলে কেমনে? এই টাকায়!

চইল্যা যায়! যেইনে রাইত হেইনে কাইত।

এভাবে কবরখানায় থাকতে ভয় লাগে না আপনার!

ভয়-ডর বলতে দুইন্যায় কিছু নাই। আমার পালক বাপে যেদিন আমারে রাস্তায় নিয়া ছাইরা দিল, আমিতো তহন নাবালক। দশ-বারো বছরের। কিছু না বুইজ্যাই বাসে উইঠ্যা গেলাম। বাসের থেইক্যা নাইম্যা শুইয়া থাকলাম ফুটপাতে! কুত্তা কয়ডার লগে। বেয়ানে উইঠ্যা দেহি, খিদায় জান যায়! কুত্তাগুলা বুঝলো আমার খিদা লাগছে, টানতে টানতে লইয়া গেলো হোটেলের সামনে। আগের দিনের বাসি খানা ছিল, পেট ভইরা খাইয়ালাইলাম। মাইনষে আমারে খাইতে দেয় না, দেয় কুত্তারে। তয় কুত্তার লগে ভাগাভাগি কইরা খাই। হেরা মাইনষের তুন ভালা। 

কী বলেন! সত্যি!

বেবাক হাছা কতা! একশ দশটা কুত্তা আছে, লগে থাহে! এই ঢাহা শহরের মধ্যেই! হেরা আমারে দেখলেই চিন্যা ফালায়। কেউ কেউ হোটেলের বারান্দা থেইক্যা বিরানির প্যাকেট  কামড়াইয়া লইয়া আইয়ে! 

এসব কী শুনছে মিজান! নিজের কানকেই যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না! জীবন এমনও হয়! কী ভয়াবহ! আবার এত সহজ! ভালবাসাময়! এরকম চ্যালেঞ্জিং সময় তার জীবনে আর কখনও আসেনি! সে একবার বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকায়, আরেকবার নিজের দিকে! কী প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছে! অথচ, সে ঘামছে দরদর করে। লোকটির দিকে তাকিয়ে সে যেন অজস্র প্রশ্নকে তৈরি করছে মাথার ভিতর! আবার লোকটির মধ্যেই যেন সে খুঁজে পাচ্ছে সব প্রশ্নের উত্তর! 

লোকটির কথায়, অজস্র আর্ত-জিজ্ঞাসা নিয়ে নিজের দিকে ফিরে তাকালো মিজান। একটি ক্ষত-লাঞ্ছিত জীবন নিয়েও এই অন্ধকারের বুকে লোকটি এক বুক বিশ্বাস নিয়ে তার প্রিয় কুকুরদের ছুঁয়ে আছে। কিছুই নেই, তবুও আছে সব! আছে কী এক বুক ভালবাসা!

অথচ তার এতদিনের জীবনে একটি দিনও আসেনি এমনভাবে স্পন্দিত হয়ে! এতদিন ধরে সে শুধু অনুভব করেছে এক অন্য জীবনযা পাইয়ে দেয়াআভিজাত্য, স্ট্যাটাস, আর এক আয়েশি জীবন। এর বাইরে কোনো জীবনের কথা তার সিলেবাসে নাই! তার চোখের সামনে ভেসে উঠল তাদের দুটো পাজেরো গাড়ী, বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট আর তার নরম গদির বিছানা। আশ্চর্য! এই জীবনে সে কোনদিন জানতেও চায়নি, তার চারপাশের লোকদের জীবন-ধারণের উপায়গুলো কেমন!  যে জীবনের সংকেতগুলো এত তীব্র, এতটাই আলাদা, যার কোনো সহজ ব্যাখ্যা নেই। সে লোকটির দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।

 

একটু সময় পরে, লোকটি ফিরে যাচ্ছে তার নির্ধারিত গর্তটির দিকে, যেখানে চটের বস্তা দিয়ে তার ঘুমাবার আয়োজন, প্রিয় কুকুর কয়টির গা ঘেঁষে। রাত গভীর হচ্ছে আর স্তব্ধতা বাড়ছে চারদিকে। কুয়াশার ভিতর দিয়ে জোৎস্নাটুকু এসে পড়েছে, ভাঙা ইটের গা ঘেঁষে, লোকটির পায়ের কাছে। আপাতত লোকটির গন্তব্য ওই গর্তটাই।

মিজান যেন এতক্ষণের ঘোরের মধ্যে হঠাৎ থমকে যেয়ে থপ করে মাটির উপর বসে পড়ে। সে যেন হঠাৎ করে অজানার দিকে যাবার সাহসকে খোঁজে! নিজেকেই প্রশ্ন করে!  জীবনের শেষে এসে তারও কী গন্তব্য ওই গর্তটাই নয়! নিজেকেই প্রশ্ন করে সে! মৃত্যুর স্টেশনে কোনো কোলাহল নেই, কেবলি অখণ্ড স্তব্ধতা। এতক্ষণের উৎকণ্ঠা আর ভীতসন্ত্রস্ত দৌড়াদৌড়ির সকল অবসান।

এক অলৌকিক আত্মপরিচয়ের ভিতর দিয়ে মিজান যেন পরিণত হল অন্য এক মানুষে। কিছুক্ষণ যেন ঝিমিয়ে পড়ে গভীর অন্ধকারে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে, ভোর হতে আর কত বাকী!