আকলিমার স্বপ্ন জটিলতা

অ+ অ-

 

আকলিমার চোখে গভীর অন্ধকারের ছায়া যেন স্থায়ীভাবে আঁকা হয়ে গেছে। প্রতিরাতে ঘুমাতে যাবার আগে মনে হয় যেন ওর সারা শরীর একটি অদৃশ্য চাপের মধ্যে রয়েছে। ও বিছানার ওপর লুটিয়ে পড়ে, কিন্তু ঘুম আসতে আসতে ভোর হয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ ভাবনাগুলো সারাক্ষণ মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। নিজের  জীবন জটিলতায় নিজের ওপর ঘৃণা হয় ওর।  

এক রাতে আকলিমা যখন ঘুমিয়ে পড়ে, স্বপ্ন দেখে একটি লম্বা, অন্ধকার, এবং নিষ্প্রাণ টানেলের মধ্যে ও হাঁটছে। প্রতিটি পদক্ষেপে টানেলটি আরও সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং চাপ বাড়তে থাকে। ও চিৎকার করে উঠতে চায়, কিন্তু গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হয় না। এসময় ও ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে। সৌভাগ্যবশত, ফরিদ হোসেনের পুত্রবধু সায়ন্তী ওকে ধরে ফেলে। সায়ন্তী দেখে আকলিমার হাত-পা ঠান্ডায় ঘেমে গেছে। ওর দুই চোখে প্রচণ্ড অস্থিরতা দেখতে পায়।

আকলিমা সকালে ঘুম থেকে উঠে কিছুই মনে করতে পারে না। সায়ন্তী জানায়, ও রাতে ঘুমের মধ্যে হাঁটছিল আর বিড়বিড় করে কিছু বলছিল। আকলিমা মনে করার চেষ্টা করে, ওর স্বপ্ন এবং রাতে হাঁটার ঘটনা কোনভাবে সম্পর্কিত কিনা। অস্থিরতা ও উদ্বেগ নিয়ে দিনের কাজগুলো করে ও। যদিও এটা নতুন নয়, আগেও হয়েছে।

বেশিরভাগ দিন সকালে উঠে আলোর দিকে তাকাতে পারে না আকলিমা। জানালা দিয়ে সূর্যের আলো প্রবাহিত হলেও, ওর মনে হয় সবকিছু তীব্রভাবে অন্ধকার। প্রতিদিন সকালে বিছানায় শুয়ে থেকে একরকম অস্বস্তি বোধ করে। যেন ওর শরীরটি প্রাত্যহিক কাজের জন্য প্রস্তুত নয়। নিজেকে যেন  নিজেরই অচেনা মনে হয়। এখন শুরু হয়েছে নতুন এক সমস্যা। ফরিদ হোসেন সাহেবের কাছে যাবার আগে আকলিমার বুকের ভেতর এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। ওর শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়ে যায়। হাতের তালু ঘামতে থাকে। ও বারবার হাত ধোয়া শুরু করে। ওর চিন্তা যেন একটি অদৃশ্য ফাঁদে আটকে থাকে।

বিপত্নীক প্রায় সাতাত্তর বছর বয়সী ফরিদ হোসেন প্রতিবছর মাস দুয়েকের জন্য আমেরিকা আসেন। ওনার তিন ছেলের প্রত্যেকেই আমেরিকায় সেটলড। লংআইল্যান্ডের নিউ হাইড পার্কে  ছোট ছেলে জাভেদের বিশাল বাড়ি । তিন ছেলের মধ্যে ডাক্তার ছোট ছেলের আয় সবচেয়ে বেশি। পুত্রবধু সায়ন্তীও ডাক্তারী পেশায় জড়িত। পেশাগত ব্যস্ততার জন্য সন্তানাদি নিতে পারেনি এখনও ওরা।

আগের বছরগুলোর মতো ফরিদ হোসেনের এবারের বেড়ানো সুখকর হল না। স্ট্রোক করে ডান দিক প্যারালাইজড হয়ে গেল। হাসপাতাল থেকে রিহ্যাবে পাঠানো হল ওনাকে। সেখানে চলাফেরার জন্য একহাতে ক্রাচ দিতে চাইলে ফরিদ হোসেন হুইল চেয়ার চাইলেন। মাস খানেক পরে ছোট ছেলের বাসায় ফিরলেন হুইলচেয়ারে।

ছোট ছেলে জাভেদ আর ওর স্ত্রী ব্যস্ত থাকায় কাগজপত্র বিহীন মধ্যবয়সী আকলিমাকে বাসায় রেখেছে অনেকটা হাউজকিপারের মতো। রান্না, লন্ড্রি, বাড়ি পরিস্কার থেকে শুরু করে সবকিছু করে আকলিমা। সায়ন্তীর মায়ের সূ্ত্রে পাওয়া বলে বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন নেই। পুরো বাড়ি ওর ওপরে ছেড়ে দিয়ে কাজে চলে যায় ওরা। আকলিমার কাজের সঙ্গে বাড়তি হিসেবে যোগ হল ফরিদ হোসেনকে দেখাশুনা করা। বাড়তি দায়িত্বের জন্য বেতন বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিল সায়ন্তী।

আকলিমার মনে হতে লাগলো এই বাড়তি অর্থ না পেলেও হতো। তার আগেই ও ভালো ছিল। ফরিদ হোসেনের হুইল চেয়ার ঠেলতে হয় ওকে। বাড়ির ভেতরে কাজটা উনি নিজেও করতে পারেন একহাতে। ইচ্ছে করেই যেন আকলিমাকে ব্যস্ত রাখেন। প্রতিদিন ওনাকে বাড়ির পিছনে সুইমিং পুলে নিয়ে আসতে হয়। ওখানে বসে প্রকৃতি দেখেন। আকলিমার জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ালো লোকটাকে গোসলে সাহায্য করা। তাছাড়া তাকে দাড়ি কাটতেও সাহায্য করতে হয়। তখন স্বাভাবিকভাবে কাছে আসতে হয়। আকলিমা নিশ্চিত না ফরিদ হোসেন তখন ইচ্ছে করেই ওর শরীর স্পর্শ করে কিনা!

প্রথমদিকে ওর মনে হতো সবকিছু দুর্ঘটনাক্রমে ঘটছে। কিন্তু দিন দিন ও বুঝতে পারে ইচ্ছে করেই এমন করেন তিনি। আকলিমা বুঝতে পারে না কি করবে? সায়ন্তী ম্যাডামকে বলে দেবার কথা ভাবে। তারপর কি হবে সেটাও চিন্তা করে। বাবাকে তো ওরা ফেলতে পারবে না। মাঝখান থেকে ওর চাকরিটা চলে যাবে। চাকরিটা ওর খুব দরকার। স্বামী মারা যাবার পরে তিন ছেলেমেয়ে বাফেলোর ভাড়া বাসায় মায়ের কাছে রেখে এসেছে। এখানে যে বেতন পায় তার প্রায় পুরোটা সেখানে পাঠায়। মার আয় খুব সীমিত। কাগজপত্র নেই বলে মেডিকেয়ার বা সোশ্যাল সিকিউরিটিও পায় না। এখানে আকলিমার তেমন কোন খরচ নেই। এই বাড়িতে থাকা ও খাওয়া ফ্রি।

ক্রমে লোকটা আকলিমার বুকে হাত দিতে লাগলো। আকলিমার জঘন্য অনুভূতি হয়। একজন বৃদ্ধ, চলৎশক্তিহীন লোক কিভাবে এতোটা নোংরা হতে পারে ওর মাথায় আসে না। ওর প্রতিটি মুহূর্ত কাটে গা ঘিনঘিনে অনুভূতি নিয়ে। রাতে ঘুমালেও সেই অনুভব থেকে নিস্তার মেলে না।

প্রতিদিন সকালে নাস্তা খাওয়ার পরে বুড়োর ছেলে আর ছেলের বউ কাজে চলে যায়। তারপর লোকটাকে আকলিমা বাড়ির পিছনে নিয়ে আসে। এখানে গাছপালায় ঘেরা সুইমিং পুল। দুপুরের আগ পর্যন্ত এখানে সময় কাটায় লোকটা।

আকলিমা আপা তোমার লাইফে কি কোন প্রবলেম হয়েছে? আমেরিকায় জন্ম হলেও সায়ন্তী ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারে।

নাস্তার টেবিল গোছাচ্ছিল আকলিমা। ও ভেবেছিল জাভেদ ও সায়ন্তী বেরিয়ে গেছে। যে কারণে সায়ন্তীর হঠাৎ উপস্থিতিতে আকলিমা ঘাবড়ে যায়। ও কিভাবে কী বলবে ভেবে পায় না।

সায়ন্তীর মোবাইলে জাভেদের কল আসলে ও তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যায়। আসলে ও বলতে এসেছিল, আজ বাড়িতে জাভেদের বড় ভাইয়ের পরিবার আসবে। বিশেষ রান্না-বান্না করতে হবে আকলিমাকে। মেহমান আসার খবর পেয়ে আনন্দিত হয় আকলিমা। যদি বড় ছেলে এসে তার বাবাকে কিছুদিনের জন্য নিয়ে যায় তবে আকলিমার মতো আনন্দিত আর কেউ হবে না। কিন্তু ওর মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয় না। তারা অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা-খাওয়া দাওয়া করে, তারপর সবাই চলে যায়। কেউ একজন থেকে গেলেও হতো।

আকলিমার একবার বুড়াকে সুইমিং পুলের পানিতে ডুবিয়ে মারতে ইচ্ছা হয়। ও জানে বাড়ির অন্যান্য জায়গায় ক্যামেরা লাগানো থাকলেও সুইমিংপুলের পিছনে ওই জায়গায় কোন ক্যামেরা নেই। বাড়ির চারপাশে গাছপালা থাকায় আশেপাশের বাড়িরও কারো চোখে পড়বে না। ও যদি লোকটার হুইল চেয়ার ধরে এক ধাক্কা দেয় কেউ কিছু বলার নেই। তারপর ও সবাইকে বলবে, রান্নাঘরের কাজে ছিল, পরে এসে দেখে এমন অবস্থা। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।

ফরিদ হোসেনের নোংরামি যত বাড়ছিল আকলিমার এই অনুভূতি তীব্র হতে লাগলো। রাতে ঘুমের মধ্যেও ও এই স্বপ্ন দেখে। ওর মধ্যে একটা ভাঙচুর চলছে দিনরাত। মনের মধ্যে ঝোড়ো হাওয়ার তোলপাড়। একবার ভাবে ছেলে আর ছেলের বউকে জানিয়ে দেয় সব। আবার মাথা নেড়ে সেই ভাবনা বাতিল করে। ওকে ওরা তক্ষুণি কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবে। এতো ভালো বেতনে লোক পেতে ওদের কোন সমস্যা হবে না। তাছাড়া ও একা একা বেশ স্বাধীনতাও ভোগ করে।

একদিন পড়ন্ত দুপুরে নিজের ঘরে এসব ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল আকলিমা। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ওর কেমন গা শিউরানো অনুভূতি হয়। সারা শরীর ঘামে ভেজা। ও বুঝতে পারে না কী হয়েছে? সাধারণত এই সময়ে ফরিদ হোসেনকে দুপুরের খাবার খাওয়ানোর পরে নিজের রুমে দিয়ে আসে আকলিমা। উনি সেখানে বিশ্রাম নেন। আজ ওর মনে হতে লাগলো কী একটা ভুল করে ফেলেছে ও। প্রতিদিনের মতো লোকটাকে রুমে দিয়ে আসেনি। তারমানে সে সুইমিং পুলের ধারে হুইল চেয়ারে রয়ে গেছে। হয়ত তাকে ডেকেছিল, হয়ত ডাকেনি। কিছুই শুনতে পায়নি আকলিমা স্লাইডিং ডোর বন্ধ থাকায়। বিছানা থেকে ধড়মড় করে উঠে পড়িমরি ছোটে আকলিমা। ঘরের ভেতর থেকে সুইমিং পুলের পাশে হুইল চেয়ার দেখতে পায় না ও। কাছে যেতে সুইমিং পুলের পানিতে বৃদ্ধকে উপুড় হয়ে ভাসতে দেখে। কাছে না গিয়েও আকলিমা তার তৃতীয় সেন্সে বুঝতে পারে লোকটা মারা গেছে। পাশে হুইল চেয়ারটাও পানিতে ডুবে আছে।

আকলিমা ধপাস করে পুলের পাশে বসে পড়ে। ওর মাথা কাজ করে না। ও বুঝতে পারে না কী করবে? হুইল চেয়ারের ব্রেক লক করতে কি ভুলে গিয়েছিল? মনে পড়ে না। হয়তো উনি নিজে চালাতে গিয়ে ভারসাম্য রাখতে না পেরে পুলে পড়ে গেছে? প্রকৃতির বিচার এভাবে হয়েছে!

অবচেতন মনে আকলিমার মনে হতে থাকে, ও নিজেই ফরিদ হোসেনকে ফেলে দেয়নি তো? এই দুপুরে ওর কেন এমন কালঘুম পেল? ঘুমের মধ্যে যেভাবে হাঁটে ও, সেভাবে হাঁটতে হাঁটতে এসে লোকটাকে ধাক্কা দিয়েছে ও? ও কি তাহলে খুনি? খুনি নাকি খুনি না? ঠিক কী হয়েছে ওর মাথায় আসে না। সব চিন্তা জট পাকিয়ে যায়। যদি ও করে থাকে তাহলে তো হুইল চেয়ারে ওর হাতের ছাপ থাকবে। পুলিশ এসে ওকে হাতকড়া পরাবে। কিন্তু ওকে তো সব সময়ই হুইল চেয়ার ঠেলতে হয়। সে কারণে ওর হাতের ছাপ থাকা তো খুব স্বাভাবিক।

নাইন ওয়ান ওয়ানে কল করার আগে আকলিমা ফোন করে সায়ন্তীকে। আশ্চর্য ব্যাপার, এতো বড় একটা দুঃসংবাদ শুনে সায়ন্তীর কণ্ঠে বিস্ময় বা বেদনা কোনটাই কাজ করে না।